মোগল যুগে স্ত্রীশিক্ষা

উইকিসংকলন থেকে
মোগল যুগে স্ত্রীশিক্ষা অন্য সংস্করণ দেখুন

মোগল যুগে স্ত্রীশিক্ষা

শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

মোগল যুগে স্ত্রীশিক্ষা

শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রণীত

স্যর যদুনাথ সরকার এম-এ, ডি. লিট্
লিখিত ভূমিকা সম্বলিত।

গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স
কলিকাতা



প্রকাশক
শ্রীহরিদাস চট্টোপাধ্যায়
২০৩৷১৷১ কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট,

কলিকাতা

মূল্য॥৹

মুদ্রাকর
শ্রীপ্রবোধ নান
শনিরঞ্জন প্রেস
২৫৷২ মোহনবাগান রো,

কলিকাতা

লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিত্রশিল্পী অকৃত্রিম বন্ধুবর শ্রীযুত যতীন্দ্রকুমার সেন করকমলেষু


দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপন

 ১৩২৬ সালের আষাঢ় মাসে ‘মোগল যুগে স্ত্রীশিক্ষা’ সর্ব্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। কয়েক বৎসরের মধ্যেই এই সংস্করণটি নিঃশেষিত হয়। তাহার পর পুস্তিকাখানি পুনর্মুদ্রণের জন্য বহু তাগিদ আসিয়াছে, এই কারণে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করিতে সাহসী হইলাম। এবার পুস্তকের স্থানে স্থানে পরিবর্ত্তন ও পরিবর্দ্ধন প্রয়োজন হইয়াছে।

১২০৷২ আপার সার্কুলার রোড
কলিকাতা, চৈত্র ১৩৪২

শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়


ভূমিকা

ভূমিকা
স্যর যদুনাথ সরকার, এম-এ, ডি. লিট্‌

 ‘মুঘল যুগে স্ত্রীশিক্ষা’ সম্বন্ধে ব্রজেন্দ্রবাবুর রচনা আমি আগাগোড়া দেখিয়া দিয়াছি। গ্রন্থখানি ছোট হইলেও অতি মনোরম, শিক্ষাপ্রদ, এবং ঐতিহাসিক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি এ সম্বন্ধে নানাস্থানে-ছড়ান ছোট ছোট তথ্য একত্র করিয়া, তাহা হইতে যতটুকু অনুমান যুক্তিসঙ্গত ও স্বাভাবিক, ততটুকু মাত্র লইয়া এই সব উপকরণের পুটপাক করিয়া, একটি ধারাবাহিক কাহিনী রচনা করিয়াছেন। প্রত্যেক চরিত্রই স্পষ্ট এবং বিশেষত্বে চিহ্নিত। উপকরণের অভাবে স্থানে স্থানে ফাঁক রাখিতে হইয়াছে,—জীবনী কখন কখন অসম্পূর্ণ রহিয়া গিয়াছে। অবিমিশ্র কল্পনার সাহায্য লইয়া বা অলঙ্কারের প্রাচুর্য্যে এই সব চরিত্র-চিত্র দীর্ঘতর, পূর্ণতর, এবং অধিকতর মন-আকর্ষণকর করা যাইতে পারিত। ব্রজেন্দ্রবাবুর প্রধান গৌরব এই যে, তিনি এই লোভ সংবরণ করিয়াছেন,—ইতিহাসকে নবেলে পরিণত করেন নাই। যাহা সত্য তাহাই দিয়াছেন, যাহা কাল্পনিক বা অসত্য প্রবাদমাত্র তাহা নির্ম্মমভাবে ত্যাগ করিয়াছেন; ঐতিহাসিকের কর্ত্তব্য করিয়াছেন,—লাভ-লোকসানের দিকে তাকান নাই।

 কিন্তু ফল ভালই হইয়াছে। অক্লান্ত পরিশ্রমে নানা স্থান হইতে যে-সব ঐতিহাসিক সত্য এখানে একাধারে সমাবেশ করা হইয়াছে, তাহা স্বভাবতঃই অতি মনোরম, এবং আর কোন ইংরাজী বা বাঙ্গালা গ্রন্থে তাহাদিগকে একত্র দেখিতে পাওয়া যায় না। কাজেই এই ছোট পুস্তিকাখানি খাঁটি জ্ঞানবৃদ্ধির উপাদান হইয়া রহিবে।

 গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়টি যেমন মনোরম, তেমনই শিক্ষাপ্রদ। সমাজের অর্দ্ধ অঙ্গ, সাম্রাজ্যের যাঁহারা অনেক সময় প্রকৃত প্রস্তাবে ‘রাজার উপর রাজা’ ছিলেন, সেই সব মহিলা পর্দ্দার ভিতর কি খাঁচার পাখীর মত বাস করিতেন? তাঁহারা কি অজ্ঞান-তিমিরে মগ্ন থাকিয়া শুধু পুরুষের বিলাসের উপাদান হইয়া জীবন কাটাইতেন? না, শিল্প ও কলা, কাব্য ও সঙ্গীত দ্বারা নিজ নিজ জীবন আলোকিত—উন্নত, শিব ও সুন্দর করিতেন?

 এ প্রশ্নের উত্তর সমসাময়িক দলিলের সাহায্যে যে গ্রন্থে দেওয়া হইয়াছে, তাহা ভারতীয় পাঠকের হৃদয় অধিকার করিবেই।

 সে সময় অবরোধের মধ্যেও যথেষ্ট ফাঁকা স্থান, মুক্ত বাতাস ও স্বাধীনতা ছিল। জনসংখ্যা তত বেশী ছিল না, রেল ছিল না। উপবন, বাগান, শিকারের জন্য রক্ষিত জঙ্গল, ভ্রমণের জন্য কাশ্মীরের শত শত ঝরণা, উপত্যকা, চেনার-বাগ্ প্রচুর ছিল। রাজপ্রাসাদের মধ্যে আঙ্গুরী-বাগ্, ছোট হইলেও, বাহিরে যমুনার সৈকত অথবা খোলা মাঠ ছিল; আর ছিল,—রাজধানীর উপকণ্ঠে প্রশস্ত উদ্যান—তাহার মধ্যে জলাশয় ও ফোয়ারা, চারি দিকে অলঙ্ঘ্য দেওয়াল; আর মধ্যে মধ্যে হাতীর উপর পর্দ্দা-ঘেরা হাওদা (আম্বারী) চড়িয়া দূরে ভ্রমণ বা কাশ্মীর-যাত্রা। সুতরাং ইহারা ঠিক অসুর্য্যম্পশ্যা ছিলেন না,—বাহ্যপ্রকৃতির সহিত মুখোমুখী আলাপ হইত।

 আবার ইরাণ হইতে আগত শিক্ষয়িত্রী, তুরাণের ফেরীওয়ালী, অথবা আরবের স্ত্রী-হাজী প্রায়ই দেশ-বিদেশের হাওয়া হারেমের মধ্যে আনিয়া দিত। প্রবীণা বিধবা রাজ-পুরললনাগণও তীর্থযাত্রা করিতেন। এইরূপে জ্ঞানের আদান-প্রদানের পথ খোলা ছিল। পালকীটা সব সময়ে ঘাটাটোপ্ দিয়া ঢাকা থাকিত না।

 অর্থ, বিশ্রাম ও শিক্ষার ফলে কলার চর্চ্চা হারেমে বেশ অগ্রসর হইত, কিন্তু তাহার সাক্ষ্য বর্ত্তমান নাই। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন ধরিল, দেশময় অশান্তি ও বিপ্লব, তখন হইতে ভারতীয় সম্ভ্রান্ত মুসলমান-পুরনারীগণ যথার্থই খাঁচার পাখী হইলেন।

মোগল যুগে স্ত্রীশিক্ষা

 মোগল আমলে ভারতবর্ষে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন ছিল না,—ঘোর অজ্ঞান-তিমিরাচ্ছন্ন হইয়া মোগল-মহিলাগণ জীবন যাপন করিতেন, পূর্ব্বভাষ ইতিহাস এ মত সমর্থন করে না। সাহিত্যে সঙ্গীতে, শিল্পকলায় কাব্যে যাঁহাদের প্রগাঢ় অনুরাগ জগদ্বিখ্যাত, এবং যাহার নিদর্শন কালের করাল প্রভাব উপেক্ষা করিয়া এখনও বিদ্যমান, সুষমার মোহন-মন্ত্রে যাঁহারা ভোগৈশ্বর্য্যবিলাসের উপাসনা করিতেন, সেই সৌন্দর্য্য-বিভোর জাতি যে জীবন-সঙ্গিনীগণের হৃদয়-মনের উৎকর্ষ-বিধানে উদাসীন ছিলেন, এ কথা প্রত্যয় করা কুসংস্কার। অবশ্য যে উদার শিক্ষা গৃহকোণে আরব্ধ হইয়া বিশ্বসমাজ-সংসর্গে বহুদর্শিতা ও ভূমাজ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয়, কঠোর অবরোধরুদ্ধা মোগল মহিলাগণের তাহা সুদূরপরাহত ছিল; কিন্তু যে শিক্ষা এবং চর্চ্চায় কণ্টকাকীর্ণ ক্ষেত্র মনোরম উদ্যানে পরিণত—খনির মণি রাজরাজেশ্বরের শিরোভূষণ হয়, মোগলের অসূর্য্যম্পশ্য অন্তঃপুরে তাহার অভাব ছিল না,—অতীত-সাক্ষী ইতিহাস ইহার অবিরোধী প্রমাণ।

 সত্য বটে সাধারণ গৃহস্থ-বালিকা ও রমণীগণের শিক্ষাবিধান সম্বন্ধে ইতিহাসে কোন কথা লিপিবদ্ধ নাই, এবং বিদ্যাচর্চ্চাও যে ইহাদের মধ্যে অধিক দূর অগ্রসর হইত, তাহাও সম্ভব বলিয়া মনে হয় না; কেন-না একটা নির্দ্দিষ্ট বয়স (বোধ হয় আট বৎসর) অতিক্রান্ত হইলে মুসলমান-বালিকাগণের বিদ্যালয়-গমন নিষিদ্ধ ছিল এবং অর্থের অস্বচ্ছলতাহেতু অনেক গৃহস্থ অন্তঃপুরে শিক্ষাবিধান করিতেও সমর্থ হইতেন না; সুতরাং শৈশবে প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে গমন করিয়া যৎকিঞ্চিৎ শিক্ষালাভেই অধিকাংশ গৃহস্থ-ললনাকে সন্তুষ্ট থাকিতে হইত। কিন্তু সম্ভ্রান্ত ও সম্রাট্-বংশীয়াগণের এ সম্বন্ধে অধিকতর সুযোগ ছিল। পঞ্চম বর্ষে উপনীত হইলে শাহ্‌জাদীগণকে লিখিতে ও পড়িতে শেখান হইত; কিন্তু সাধারণ গৃহস্থ-কন্যার ন্যায় তাঁহারা প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে যাইতেন না; হারেমের মধ্যে ‘আতুন্’ বা গৃহশিক্ষয়িত্রীর নিকট শিক্ষালাভ করিতেন এবং তাহাও স্বল্পকালের নিমিত্ত নহে। সতের-আঠার বৎসরের পূর্ব্বে শাহ্‌জাদীগণের বিবাহ হইত না; তৎকালাবধি বিদ্যাচর্চ্চাই তাঁহাদিগের বিশেষ অবলম্বন ছিল। কেহ কেহ পরিণয়ান্তে পরিণত বয়সাবধি বিদ্যালোচনায় রত থাকিতেন, কাহারও বা অনূঢ় জীবন একান্তে জ্ঞানানুশীলনে অতিবাহিত হইত।

 মোগল যুগে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে আমরা সর্ব্বাগ্রে বাদশাহ্‌গণের অন্তঃপুরের সন্ধান লইতে চাই; কেন-না সেখানেই অবরোধ-প্রথা আপনার প্রভাব পূর্ণমাত্রায় বিস্তার করিবার অবকাশ পাইয়াছিল। অসার আমোদ-প্রমোদ ও বিলাসে বিভোর হইয়া মোগল শুদ্ধান্ত-বাসিনীবৃন্দ অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে তাঁহাদের অশিক্ষিত জীবন যাপন করিতেন, ইহাই সাধারণের ধারণা। কিন্তু ইতিহাসে আমরা যে-সকল মোগল-মহিলার পরিচয় পাই, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেরই বিদ্যাবত্তা ও জ্ঞানের উৎকর্ষ সত্যসত্যই আমাদিগকে বিস্ময়বিমুগ্ধ করে। তাঁহাদের সুশিক্ষার পরিচয়—তাঁহাদের স্বরচিত গ্রন্থে ও কাব্যে—তাঁহাদের ভাবের নির্ম্মলতায়, সুনিয়ন্ত্রিত চিন্তাধারায়, কলাকুশলতায় এবং বিশুদ্ধ রুচিতে বিশেষভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি হইতে আরম্ভ করিয়া, আমরা সংক্ষেপে এই তথ্যের আলোচনা করিব।

 যে-সকল পুণ্যশীলা, দানরতা, জ্ঞানগরিমাশালিনী মহিয়সী মহিলার নাম মোগল-ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত বাবর ও হুমায়ূনের
রাজত্বকাল
থাকিবার যোগ্য, বেগম গুল্‌বদন্ তাঁহাদের অন্যতমা। তিনি ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের স্থাপয়িতা অক্লান্তকর্ম্মী, অধ্যবসায়-শীল সম্রাট্ বাবরের কন্যা, উত্থান-পতনের বিচিত্র লীলানায়ক হুমায়ূনের বৈমাত্রেয় ভগিনী, এবং মোগলকুলচন্দ্র ‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা’ আখ্যার যোগ্যতম অধিকারী বাদশাহ্, আকবরের পিতৃষ্বসা। গুল্‌বদনের সুদীর্ঘ জীবন ভূয়োদর্শনের আদর্শ; তিনি যথাক্রমে বাবর, হুমায়ূন ও আকবর—মোগল-বংশের এই তিন জন কৃতী পুরুষের অভ্যুদয়, ভাগ্যবিপর্য্যয় এবং প্রতিষ্ঠা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়া মানব-জীবন সম্বন্ধে অপরিসীম অভিজ্ঞতা-সঞ্চয়ের সুযোগ পাইয়াছিলেন। এই অনন্যসুলভ অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁহার স্বাভাবিক ধর্ম্মানুরাগ, কর্ত্তব্যনিষ্ঠা ও স্নেহ-মমতার অপূর্ব্ব মিশ্রণ তাঁহার জীবনকে এক অভাবনীয় বৈশিষ্ট্য দান করিয়াছে। অন্যান্য মহিলার ন্যায় গুলবদনও সুখে-দুঃখে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়াছেন। তাঁহার সুদীর্ঘ জীবনে কখন তিনি রাজকার্য্যে কোন প্রকারে হস্তক্ষেপ করেন নাই সত্য, কিন্তু তথাপি তাঁহার জীবন ব্যর্থ নহে। তিনি যে ‘হুমাযুন্-নামা’ রচনা করিয়াছিলেন, সেই বহুমূল্য গ্রন্থই তাঁহার জীবনের অপূর্ব্ব গৌরবময়ী কীর্ত্তি। কেবল এই একটিমাত্র কার্য্য করিয়াই তিনি মরজগতে চিরস্মরণীয় হইয়া গিয়াছেন, এই কারণেই তিনি ইতিহাসবেত্তাগণের কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার অর্ঘ্য লাভের অধিকারিণী; আর এই জন্যই তাঁহাকে মোগল বিদুষীদিগের অন্যতমা বলিয়া অসঙ্কোচে নির্দ্দেশ করিতে পারা যায়।

 কয়েক বৎসর পূর্ব্ব পর্য্যন্ত যে-সমস্ত ইংরেজ ঐতিহাসিক মোগল রাজত্বের ইতিহাস লিখিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের কোন গ্রন্থেই গুল্‌বদনের ‘হুমায়ুন্-নামা’র উল্লেখ নাই। ‘আইন্-ই-আক্‌বরী’তেও ব্লক্‌মান্ সাহেব এই পুস্তক সম্বন্ধে নীরব, মোগল ইতিহাসের এই অমূল্য উপাদান অবগত থাকিলে গুল্‌বদন্‌কে তিনি এক স্থলে ভ্রমক্রমে ‘আক্‌বরের বেগম’ বলিয়া অনুমান করিতেন না![১]

 ব্রিটিশ মিউজিয়মে রক্ষিত, ‘হুমায়ুন্-নামা’র পুঁথিখানি ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে কর্ণেল জর্জ্জ উইলিয়ম্‌ হ্যামিল্‌টনের বিধবার নিকট হইতে ক্রয় করা হইয়াছিল। এই মহামূল্য গ্রন্থখানির ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করিয়া বিদুষী বেভারিজ-পত্নী আমাদের ধন্যবাদার্হ হইয়াছেন।

 গুল্‌বদন্‌ লিখিয়াছেন, “সম্রাট্ আক্‌বর আদেশ প্রচার করেন, বাবর ও হুমায়ূনের বিষয় যাহা জান, লিপিবদ্ধ কর।” এই রাজ-অনুজ্ঞায় গুল্‌বদন্‌ ‘হুমায়ুন্-নামা’ রচনা করিয়াছিলেন। ‘আক্‌বর-নামা’ রচনার পূর্ব্বে ঐ গ্রন্থের উপাদান-সংগ্রহ সম্বন্ধে আকবর কর্ত্তৃক যে আদেশ-প্রচারের[২] কথা আবুল্-ফজল্ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, এবং যে আদেশের ফলে হুমায়ুনের পানপাত্রবাহক জৌহর ও আক্‌বরের ‘বকাওল্‌বেগী’ (রন্ধনশালার পরিদর্শক) বায়াজীদ্ বীয়াতের স্মৃতিকথা লিখিত হইয়াছে, খুব সম্ভব গুল্‌বদনের উল্লিখিত আদেশ-প্রচারের কথা তাহারই পুনরুক্তি মাত্র। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, ‘হুমাযুন্-নামা’ ন্যূনাধিক ১৫৮৭ খ্রীষ্টাব্দে (৯৯৫ হিজরা) লিখিত হয়। আবুল্-ফজল্ ‘হুমায়ুন-নামা’ সম্বন্ধে নির্ব্বাক, তবে তিনি যে ‘আকবর-নামা’ রচনাকালে বেগমের পুস্তকের সাহায্য লইয়াছিলেন, সে-সম্বন্ধে প্রমাণ দেওয়া যাইতে পারে।[৩]

 হুমায়ুন্-নামার প্রথমাংশে বাবরের কথা। ইহার অধিকাংশই বাবরের আত্মজীবনচরিত-অবলম্বনে লিখিত; কারণ পিতার মৃত্যুকালে গুলবদনের বয়ঃক্রম মাত্র ৮ বৎসর; সুতরাং তাঁহার নিকট হইতে বাবরের রাজত্বকালের চাক্ষুষ বিবরণ জানিবার আশা করা যায় না। দুঃখের বিষয়, ব্রিটিশ মিউজিয়মের এই পুঁথিখানি অসম্পূর্ণ—শেষের কয়েক পৃষ্ঠা হারাইয়া গিয়াছে, হুমায়ুনের দ্বিতীয় বার ভারত-বিজয়ের পূর্ব্বাবধি ইতিহাস এই খণ্ডিত পুস্তকের শেষ সীমা। হুমায়ুন-নামা রচনা করিয়া গুল্‌বদন্‌ ইতিহাসের প্রভূত উপকারসাধন করিয়াছেন। ইহা প্রকাশিত না হইলে বোধ হয় বাবরের পুত্রকন্যা, আত্মীয়স্বজনবর্গ ও তৎকালীন অন্যান্য কয়েকটি পরিবারের সঠিক বৃত্তান্ত আমাদের অজ্ঞাত থাকিত।

 হুমায়ুন-নামাই গুল্‌বদনের একমাত্র কীর্ত্তি নহে; তৎকালপ্রচলিত রীতি অনুসারে বহু ফার্সী কবিতার রচয়িত্রী বলিয়াও তিনি জনসমাজে সুপ্রতিষ্ঠিতা। মীর্ মহ্‌দী শীরাজী ‘তাজ্‌কিবতুল্ খওয়াতীনে’ তাঁহার কোন কবিতার এই দুইটি চরণ উদ্ধৃত করিয়াছেন:—

“হর্ পর কে উ বা-আশিক্-ই-খুঁদ ইযার নীস্ত।
তূ ইয়াকীন্ মীদান্ কে হেচ্, অজ্ উমর্ বর্-খুরদার্ নীস্ত।”

—নিজ প্রেমিকের প্রতি বিমুখ প্রত্যেক পরী! নিশ্চয় জানিও যে, কেহই জীবন-রূপ ফল পূর্ণরূপে আস্বাদন করে না। অর্থাৎ জীবন নশ্বর, তাহার মধ্যেই যতটুকু পার সুখ ভোগ করিয়া লও।

 গুল্‌বদনের অধ্যয়ন-স্পৃহা অসামান্য ছিল। এই বিদুষী রমণী একটি পুস্তকাগার প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তজ্জন্য তিনি নানা স্থান হইতে বহু পুস্তক সংগ্রহ করিয়াছিলেন।

 বাবর ও হুমায়ুনের পরবর্ত্তী রাজত্বকালে রাজঅন্তঃপুরবাসিনীগণকে নিয়মিত শিক্ষাদানের সুবন্দোবস্ত প্রথম আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। আকবর-প্রতিষ্ঠিত ফতেপুর সীকরীর রাজভবনে আকবরের
রাজত্বকাল
কয়েকটি কক্ষ শাহজাদীগণের পাঠাগাররূপে নির্দিষ্ট ছিল।[৪]

 পূর্ব্ববর্ত্তী সম্রাট্‌দ্বয়ের রাজআন্তঃপুর-আকাশে গুল্‌বদন্‌ ব্যতীত অন্য কোন জ্যোতিষ্কের উদয় হইয়াছিল কিনা ইতিহাস তাহার উল্লেখ করে না; কিন্তু আকবরের রাজত্বকালে একাধারে যুগলনক্ষত্র আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। তন্মধ্যে সর্ব্বপ্রথম

 সলীমা সুলতান্ বেগম—সম্রাট্ আকবরের হারেমে সর্ব্বাপেক্ষা সুচতুরা, বুদ্ধিমতী এবং বাক্‌পটুতায় অদ্বিতীয়া বলিয়া ইঁহার খ্যাতি ছিল; ইনি বাবরের দৌহিত্রী, হুমায়ূনের বৈমাত্রেয় ভগিনীর কন্যা, এবং অজিতশৌর্য্য মোগল সেনাপতি বয়রাম্ খাঁর গৌরব-তিলক—রাজপ্রসাদ-নিদর্শনস্বরূপিনী আদরিণী পত্নী। অমিতবীর্য্য আফগান-সূর্য্য শের শাহ্ কর্ত্তৃক সিংহাসনচ্যুত হইয়া হুমায়ূন্ যখন ফকিরী-গ্রহণের কল্পনা করিতেছিলেন, তখন বীরবর বয়রামের উত্তেজনাতেই তিনি পারস্য-সম্রাটের নিকট গমন করিয়া সহায়তা প্রার্থনা করেন। মগধের এক জন নগণ্য ভূম্যধিকারীর পুত্র সম্রাট্-বংশধরকে রাজ্যচ্যুত করিয়াছে শুনিয়া, পারস্য-সম্রাট্ রাজ-অতিথিকে সাহায্যদানে সম্মানিত করিলেন। পারস্য-বাহিনী-সহায়ে এবং বয়রামের অলৌকিক বীর্য্যবলে হুমায়ুনের হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধৃত হয়। চিরহতভাগ্য সম্রাট্ দুর্দ্দিনের বন্ধুকে বিস্মৃত হন নাই, তিনি প্রতিশ্রুত ছিলেন, ভারত-বিজয় হইলেই ভাগিনেয়ী সলীমার সহিত বিবাহ দিয়া বয়রামকে রাজ-আত্মীয়রূপে গৌরবান্বিত করিবেন। সম্রাট্ আকবর পিতৃপ্রতিশ্রুতি পালন করিলেন। কিন্তু বয়রামের ভাগ্যে এই দুর্ল্লভ নারীরত্ন দীর্ঘকাল ভোগ হইল না,—বিবাহের তিন বৎসর পরে জনৈক গুপ্তঘাতক তাঁহাকে নিহত করে। বয়রামের কণ্ঠচ্যুত রত্নহার সম্রাট্ আকবর স্বয়ং সাদরে হৃদয়ে তুলিয়া লইলেন।

 অনপত্যা সলীমা তাঁহার হৃদয়ের চিরসঞ্চিত স্নেহরাশি কুমার সলীমের (জহাঙ্গীরের) উপরেই বর্ষণ করিয়াছিলেন। সপত্নী-সন্তান হইলেও তিনি সলীম্‌কে গর্ভজ-পুত্রের ন্যায় লালনপালন করিতেন। দুর্ব্বুদ্ধিবশতঃ সলীম্ যখন পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, সেই সময় পুত্রের দুর্ম্মতি অপনোদনের জন্য সলীমা স্বয়ং এলাহাবাদে তাঁহার নিকট উপস্থিত হন এবং নানারূপে বুঝাইয়া কুমারকে পিতৃসন্নিধানে লইয়া আসেন। তীক্ষ্নবুদ্ধিশালিনী এই বিদুষী মহিলার মধ্যস্থতা ব্যতীত এই বিদ্রোহানল যে কিরূপে নির্ব্বাণপ্রাপ্ত হইত, তাহা কে বলিতে পারে?

 বিদুষী সলীমার অধ্যয়ন-স্পৃহা যেমন বলবতী, তাঁহার অধীত পুস্তকের সংখ্যা ও বৈচিত্র্য তেমনই বিশাল। বদায়ুনী বলেন (Lowe, ii, 389, 186) সলীমা ‘বত্রিশ সিংহাসন’ পুস্তক অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। বদায়ুনী স্বয়ং গদ্য ও পদ্যে পারস্য-ভাষায় এই পুস্তক অনুবাদ করিয়া নামকরণ করিয়াছিলেন ‘খিবদ্-আফ্‌জা’। কবিতা-রচনাতেও সলীমার বিপুল প্রতিভা ছিল। ‘মখ্ ফী’ (গুপ্ত ব্যক্তি) এই ছদ্মনাম দিয়া তিনি বহু ফার্সী কবিতা রচনা করিয়াছিলেন। সলীমার নিম্নলিখিত বয়েৎটি তৎকালে বিশেষ প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছিল বলিয়া খাফি খাঁর গ্রন্থে উদ্ধৃত আছে:—

“কাকুলৎ রা মন্ জে মস্তী রিষ্ তা-ই-জান্ গোফ্‌তা আম্।
মস্ত্‌ বুদম্‌জীঁ সবর্ হর্ফ-ই পরেশান্ গোফ্‌তা আম্।”[৫]

 —মোহবশে তোমার চাঁচর কেশকে ‘জীবন-সূত্র’ বলিয়াছি, ইহা উন্মত্ত প্রলাপ।

 খাফি খাঁর গ্রন্থে ধর্ম্মপ্রাণা সলীমা ‘খাদিজা-উজ্-জমানী’ অর্থাৎ ‘বর্ত্তমান যুগের খাদিজা’ (মুহম্মদের প্রথম স্ত্রী) বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। সম্রাট্ জহাঙ্গীর স্বীয় আত্মকথা ‘তুজুক্-ই-জহাঙ্গীরী’তে সলীমার প্রকৃতিদত্ত গুণরাশি, মানসিক উৎকর্ষ এবং সর্ব্বোপরি তাঁহার সুশিক্ষার বিশেষভাবে প্রশংসা করিয়াছেন।[৬]

 সলীমার ন্যায় সমুজ্জ্বল প্রতিভাশালিনী না হইলেও সম্রাট্ আকবরের হারেমের দ্বিতীয় নক্ষত্র মাহম্ আনগা। ইনি সম্রাট্ আকবরের প্রধান ধাত্রী। মোগল যুগে যে-সমস্ত মহিলা শিক্ষা-বিস্তারকল্পে স্ব-স্ব নাম সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে মাহম্ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইনি এক জন সুশিক্ষিতা রমণী এবং শিক্ষার প্রসারকল্পে দিল্লীতে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এই বিদ্যালয় ‘মাহম্ আনগার মাদ্রাসা’ নামে পরিচিত ছিল। এক্ষণে ইহা ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে।[৭]

 বিদ্যাবুদ্ধি, প্রতিভা এবং অপরূপ রূপলাবণ্যপ্রভায় যে জহাঙ্গীরের
রাজত্বকাল
সীমন্তিনী মোগল রাজত্বের মধ্যাহ্ন-যুগ আলোকিত করিয়াছিলেন, তাঁহার নাম জগজ্জ্যোতিঃ নূরজহান্ — চতুর্থ মোগল-সম্রাট্ জহাঙ্গীরের জীবনস্বপ্ন। মানব-জীবনে সময়ে-সময়ে কি অভাবনীয় পরিবর্ত্তনই না সাধিত হয়! অতি হীন অবস্থা হইতে ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য্যের অত্যুচ্চ শিখরে অধিরূঢ় হইবার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল নহে; কিন্তু দৈন্যের প্রকটমূর্ত্তি মরুভবন হইতে ভারতের শ্রেষ্ঠ সিংহাসন অতি দীর্ঘ পদক্ষেপ! আমরা যাঁঁহার প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াছি, তিনি মরুভূমির সন্তান—মরুর মতই চিরপিপাসাতুরা; ইঁহার উচ্চ আকাঙ্ক্ষার সীমা ছিল না। নূরজহানের প্রকৃত নাম— মিহ্‌র-উন্নিসা। জহাঙ্গীর যখন কুমার সলীম্‌, সেই সময় তিনি কিশোরী মিহ্‌রের মোহে মুগ্ধ হইয়াছিলেন। সম্রাট্ আক্‌বর সে রূপমোহ ছিন্ন করিবার জন্য শের আফ্‌কনের সহিত বিবাহ দিয়া মিহ্‌রকে যুবরাজের দৃষ্টিপথ হইতে অপসারিত করিলেন। কিন্তু চতুর-চূড়ামণি, ভারতের অদ্বিতীয় কূটনীতিজ্ঞ সম্রাট্ও এই কুহকিনী কিশোরীর দুশ্ছেদ্য মোহপাশ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন নাই। সলীমের কিশোর-স্বপ্ন ছুটিল না। ভুবনবিজয়ী ‘জহাঙ্গীর’ নাম লইয়া সলীম পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করিলেন; কিন্তু নিজহৃদয় জয় করিতে পারিলেন না। মিহ্‌র—মিহ্‌র—এখনও সেই মিহ্‌র। নন্দনের কুসুমে তাঁহার হারেম পরিপূর্ণ, কিন্তু সেখানে পারিজাত নাই। বৃথা দিল্লীর সিংহাসন, বৃথা মোগল সাম্রাজ্যের অতুল ঐশ্বর্য্য, বৃথা তাঁহার জীবনধারণ,—মরু-দুহিতা মিহ্‌র বিহনে সব মরুময়। এই দুর্ল্লভ রমণী-মণি লাভ করিবার জন্য সম্রাট্ শের আফ্‌কন্‌কে হত্যা করাইলেন। মিহ্‌র তাঁহার হারেমে আসিলেন। মুগ্ধনেত্র সম্রাট দেখিলেন, যে কিশোরকলিকা এক দিন তাঁহার করচ্যুত হইয়াছিল, আজি তাহা প্রস্ফুট কুসুম—বিদ্যা-বুদ্ধি-প্রতিভার সৌরভে গৌরবময়ী। আজ সম্রাটের মনে হইল, তাঁহার ভুবনবিজয়ী জহাঙ্গীর নাম সার্থক হইয়াছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সম্রাট্‌কে সম্পূর্ণ করায়ত্ত না করিয়া মিহ্‌র আত্মসমর্পণ করিলেন না। ক্রমে সম্রাট্‌, সিংহাসন, সাম্রাজ্য—একে একে সকলই মিহ্‌রের করগত হইল। জহাঙ্গীর আদরে তাঁহার নামকরণ করিলেন—নূরজহান্

 ঐতিহাসিকগণ মুক্তকণ্ঠে বলিয়াছেন, জহাঙ্গীরের রাজত্বের শেষভাগকে নূরজহানের রাজত্বকাল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সম্রাট্ নিজেই বলিতেন, ‘নূরজহান্‌কে আমি তীক্ষ্নবুদ্ধিশালিনী ও রাজ্যভার-গ্রহণের উপযুক্ত বিবেচনা করিয়া তাঁহার উপর শাসনকার্য্যের সমস্ত ভার অর্পণ করিয়াছি। আমি মাত্র একটু মদ্য ও কিঞ্চিং মাংস পাইলেই সন্তুষ্ট।’ প্রকৃতপক্ষে রাজ্যের যাবতীয় কার্য্যই নূরজহান্ কর্ত্তৃক পরিচালিত হইত—জহাঙ্গীর নামেমাত্র সম্রাট্ ছিলেন। প্রজাবর্গ নূরজহান্‌কে অত্যন্ত সম্মানের চক্ষেই দেখিত। তিনি দীনহীনের জননী ছিলেন। তাঁহার অনুগ্রহভিখারী হইলে কাহাকেও রিক্তহস্তে ফিরিতে হইত না। তিনি বহু অনাথ বালিকাকে অর্থসাহায্য করিতেন, এমন কি নিজ ব্যয়ে পাঁচ শত বালিকার বিবাহ দিয়াছিলেন।

 এই বিদুষী ললনা যেমন সুন্দরী ছিলেন, তাঁহার সৌন্দর্য্যবোধ, উদ্ভাবনী-শক্তি এবং ললিত শিল্পকলাজ্ঞানও তেমনই অনন্যসাধারণ ছিল। শুনা যায়, ‘অতর্-ই-জহাঙ্গীরী’ নামক গোলাপ-সার তাঁহারই আবিষ্কার।[৮] পেশোয়াজের দুদামী, ওড়নার পাঁচতোলিয়া, বাদ্‌লা, কিনারী, নূরমহলী এবং ফরস্-ই-চন্দনী (চন্দন-কাষ্ঠের বর্ণবিশিষ্ট কার্পেট) তাঁহারই কারু-কল্পনার ফল।[৯]

 অভিনব আদর্শের বিচিত্র স্বর্ণালঙ্কার ও নারী-পরিচ্ছদ প্রচলন করিয়া নূরজহান্ তাঁহার বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়া গিয়াছেন। আপাদ-লম্বিত নিচোল ব্যবহার তাঁহারই প্রবর্ত্তন। লক্ষ্নৌ শহরের সম্ভ্রান্ত ললনাকুল তখনকার দিনে তাঁহারই অনুকরণে নিচোল ব্যবহার করিতেন! নূতন ধরণের এক প্রকার আঙ্গিয়াও তাঁহারই নামে সাধারণে পরিচিত হইয়াছিল। ওড়নার ব্যবহারে তিনিই পথপ্রদর্শিকা।[১০]

 এই আশ্চর্য্য গুণময়ী ললনার রন্ধন-নৈপুণ্যের কথা তখন চারি দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। সম্রাটের তৃপ্তিসাধনের জন্য তিনি নিত্য নব নব মুখরোচক আহার্য্য দ্রব্য প্রস্তুত করিতেন। বাস্তবিক তাঁহার ন্যায় পাচিকা তখন বিরল ছিল। ভোজনাধার (দস্তরখান্) সজ্জিত করিবার অভিনব প্রণালী ও উপায় উদ্ভাবন, এবং ভোজ্যদ্রব্যগুলি কুসুমাকারে বিন্যস্ত করিয়া এই সুন্দরী রমণী সৌন্দর্য্যানুরাগের প্রকৃষ্ট পরিচয় প্রদান করিতেন।[১১]

 নূরজহানের সৌন্দর্য্যানুভূতি ও কলানুরাগের পরিচয় তাঁহার নির্ম্মিত উদ্যান, অত্যুচ্চ প্রাসাদ ও হর্ম্ম্যে আরও স্ফুটতর। জহাঙ্গীর লিখিয়াছেন, ‘তৎকালে এমন নগর বা শহর ছিল না, যেখানে নূরজহানের কীর্ত্তিবাজি সগর্ব্বে মস্তকোত্তলন করে নাই।’ মহিষী নূরজহান্ নয়নাভিরাম ‘নূরসরাই’[১২] প্রস্তুত করাইয়া মুসাফীরদিগের চিরকৃতজ্ঞতা অর্জ্জন করিয়াছিলেন। কাশ্মীরে ঝিলাম নদীতীরে অবস্থিত ছায়াশীতল চেনার-বৃক্ষসমন্বিত ‘নূর-আফ্‌শান’[১৩] উদ্যান তাঁহারই ব্যয়ে নির্ম্মিত।

 সঙ্গীতের প্রতি নূরজহানের যথেষ্ট অনুরাগ ছিল, এবং এই ললিত-কলার সাধনায় তিনি সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার সুধাস্রাবী গীতি শ্রোতাকে শোকদুঃখময় জগতের কথা ভুলাইয়া দিত।

 কেবল নারীসুলভ কোমল কারুকার্য্যে নয়, এই লোকললামভূতা ললনার মৃণাল ভুজদ্বয় সময়-সময় যে পৌরুষের পরিচয় প্রদান করিত, তাহাতে চমৎকৃত হইতে হয়। মৃগয়া-ব্যাপারে ইঁহার অদ্ভুত পটুত্ব মনে অকপট বিস্ময়ের উদ্রেক করে। দ্বাদশ রাজ্যাঙ্কে জহাঙ্গীর এক দিন নূরজহান্‌কে লইয়া শিকারে বহির্গত হ’ন। ভূত্যেরা চারিটি ব্যাঘ্রকে বেষ্টনী-মধ্যগত করিলে, নূরজহান্ স্বহস্তে তাহাদিগকে নিহত করিবার জন্য সম্রাটের অনুমতি লইয়া, হস্তিপৃষ্ঠে হাওদার ভিতর হইতে অব্যর্থ লক্ষ্যে দুইটি ব্যাঘ্রকে দুইটি গুলিতে, এবং অবশিষ্ট দুইটিকে, দুইটি কবিয়া চারিটি গুলিতে বধ করেন। ‘তুজুকে’ সম্রাট্ স্পষ্টই লিখিয়াছেন, তিনি ইতঃপূর্ব্বে এরূপ অব্যর্থ লক্ষ্যে ব্যাঘ্র-শিকার দেখেন নাই। জহাঙ্গীর খুশী হইয়া নূরজহানকে এক লক্ষ টাকা মূল্যের এক জোড়া হীরার পুঁছি (bracelet) ও হাজার আশ্‌রফি উপহার দেন। এই ব্যাঘ্র-শিকার উপলক্ষে সম্রাটের এক জন সভাসদ্ নিম্নলিখিত কবিতাটি রচনা করিয়াছিলেন:—

“নূরজহান্ গর্‌চে বা সুরৎ জন্ অস্ত্‌।
দর্ সফ্-ই-মর্দান্ জন্-ই-শের-আফ্‌কন্‌ অস্ত।”

 নূরজহান্ যদিও আকৃতিতে স্ত্রীলোক, কিন্তু বীরপুরুষের দলে তিনি ব্যাঘ্রহন্ত্রী নারী। দ্বিতীয়ার্থে শের আফ্‌কনের স্ত্রী।

 আর্বী ও ফার্সী সাহিত্যে এই বিদুষী মহিলা বিশেষরূপে ব্যুৎপন্ন ছিলেন।[১৪] ‘মখ্ ফী’ ছদ্মনাম লইয়া পারস্য ভাষায় তিনি বহু কবিতা রচনা করেন। বীল্ বলেন, যে-সমস্ত গুণের জন্য নূরজহান্ সম্রাটের হৃদয়ে একাধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন, উপস্থিত-মত কবিতা-রচনা তাহার অন্যতম।[১৫] লাহোরে তাঁহার সমাধিগাত্রে খোদিত নিম্নলিখিত কবিতাটি তাঁহারই রচনা বলিয়া জনসাধারণের ধারণা:—

“বর্ মজারে মা গরীবাঁ না চিরাঘে না গুলে
না পরে পর্‌ওয়ানা সূজদ্ না সদায়ে বুলবুলে।”

— দীন আমি, পতঙ্গের পক্ষ দহিবারে
জ্বেল না আলোক মম সমাধি-আগারে।
আকর্ষিতে বুল্‌বুল্ আকুল সঙ্গীত—
ক’রো না কুসুমদামে কবর ভূষিত।

 যে রূপবহ্নি নির্ব্বোধ মানব-পতঙ্গের মর্ম্মদাহের কারণ, প্রেমিক আকুল কণ্ঠে যে পুষ্পিত যৌবনের স্তুতিগান করে, সেই মর-সৌন্দর্য্যের পরিণাম ভাবিয়া নূরজহান্ সমাধি’পরে অক্ষয় অক্ষরে তাঁহার মর্ম্মবাণী চিরাঙ্কিত করিয়া গিয়াছেন। জীবনের সায়াহ্নে বিধবা নূরজহান বুঝিয়াছিলেন, রূপ-যৌবন ক্ষণিকের স্বপন, ঐশ্বর্য্য মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছুই চিরস্থায়ী নহে।[১৬]

 জগজ্জ্যোতিঃ নূরজহান্ নির্ব্বাপিত হইবার পূর্ব্বেই ভারত-সম্রাটের হারেমে আর দুইটি অমল-স্নিগ্ধকিরণ নক্ষত্রের উদয় হইয়াছিল,—মুম্‌তাজ্-মহল্ ও জহান্-আরা।

 যে লাবণ্যময়ী ললনার স্মৃতিমন্দির-ছবি বক্ষে ধারণ করিয়া নীলসলিলা যমুনা ললিত-লহরী-লীলায় নশ্বর প্রেমের জয়গান শাহ্‌জহানের
রাজত্বকাল
করিতেছেন, তাজ্‌মহলের সেই অধিষ্ঠাত্রী দেবী ইতিহাসে প্রেমিক সম্রাট্ শাহ্‌জহানের প্রিয়দয়িতা মুম্‌তাজ্-মহল্ নামে খ্যাত। পতিপরায়ণা মুম্‌তাজের অপূর্ব্ব প্রেমকাহিনী, অপত্যস্নেহ, আশ্রিত-বাৎসল্য ও উদার বদান্যতার কথা ইতিহাস আজিও গৌরবে কীর্ত্তন করিতেছে। বিদুষী মুম্‌তাজ্ পারস্য ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। তিনি বহু ফার্সী কবিতা রচনা করিয়া গিয়াছেন।

 জহান্-আরা—সম্রাট্ শাহ্‌জহানের জ্যেষ্ঠা কন্যা; মুম্‌তাজ্-মহল ইঁহার জননী। আলোকসামান্য রূপরাশির জন্য তাঁহার নামকরণ হইয়াছিল—‘জহান্-আরা’ বা জগতের অলঙ্কার।

 শৈশবের শিক্ষা এবং সহবৎ জহান্‌-আরার ভবিষ্যৎ জীবন-গঠনের বিশেষ সহায় হইয়াছিল। মুম্‌তাজ-মহল কন্যার উপযুক্ত শিক্ষাবিধানের জন্য সিত্তী-উন্নিসা নামে এক উচ্চশিক্ষিতা সদ্বংশজাতা পুণ্যবতী মহিলাকে নিযুক্ত করেন। সিত্তী-উন্নিসার একাগ্র চেষ্টায় শাহ্‌জহান্‌-নন্দিনী অল্পকালের মধ্যেই কোরাণ পাঠ করিতে অভ্যস্ত হইলেন। ফার্সী ভাষায় জহান্‌-আরার হস্তাক্ষর অতীব সুন্দর।

 ধর্ম্মজ্ঞান এবং মানসিক মাধুর্য্যবিকাশে দেশ-কাল-পাত্রের যেরূপ শুভসংযোগ ও কল্যাণকর প্রভাব প্রয়োজন, অভ্যাসকুশলা রাজবালার পক্ষে তাহার কিছুরই অভাব হয় নাই; কেন-না লোকাতীত রূপ গুণ, সৌজন্য, মোহিনী বাক্‌পটুতা ও রাজনৈতিক প্রতিভার দুর্ল্লভ সমাবেশে যাঁহার অলৌকিক জীবন অপূর্ব্ব প্রভায় সমুজ্জ্বল, সেই লোকললামভূতা নূরজহান্ তখনও অমল রশ্মিপাত করিতেছিলেন। এই মহিয়সী মহিষীর মহান্ আদর্শে মোগলের অন্তঃপুর যে-ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়াছিল, তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রী মুম্‌তাজ্ তাহা অণুমাত্র ক্ষুণ্ণ করেন নাই। এইরূপ আদর্শ-মাতা এবং মাতার পিতৃষ্বসার অজস্র যত্নসেচনে ও অনুপম পারিবারিক আবেষ্টনে রাজ-অন্তঃপুরলতা জহান্‌-আরা বর্দ্ধিত হইয়াছিলেন। শাহ্‌জহান্-সুতা জীবনে বিবাহ করেন নাই; আমরণ কুমারী-ব্রত অবলম্বন করিয়াছিলেন।

 মোগল বিদুষীদিগের মধ্যে জহান্-আরার স্থান অতি উচ্চে। ধর্ম্মতত্ত্ব-আলোচনাই তাঁহার সর্ব্বাপেক্ষা প্রিয় ছিল,—বিশেষতঃ সুফী-সম্প্রদায়ের ধর্ম্মমতের আলোচনা। কোরাণে তাঁহার প্রকৃষ্ট অধিকার ছিল; এই ধর্ম্মগ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত প্রাসঙ্গিক রচনাবলী তাঁহার রচিত প্রবন্ধাদিতে প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়। জহান্-আরা অনেকগুলি ধর্ম্মগ্রন্থ[১৭] রচনা করিয়াছিলেন; তন্মধ্যে ১৬৩৯-৪০ খ্রীষ্টাব্দে (১০৪৯ হিঃ) রচিত ‘মুনিস্-উল্-আর্‌ওয়া’ নামে একখানি গ্রন্থ এখন পাওয়া যায়। ইহাতে আজমীরের সুবিখ্যাত সাধু মুঈন-উদ্দীন্ চিশ্‌তী ও তাঁহার কয়েক জন শিষ্যের জীবন-কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে।

 ‘মুনিস্-উল্-আর্ ওয়া’ জহান্-আরার মৌলিক রচনা নহে; ইহা প্রধানতঃ ‘আখ্ বার্-উল্-আখিয়ার্’ ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ হইতে সঙ্কলিত। এই চিত্তগ্রাহী গ্রন্থ হইতে তাঁহার তীক্ষ্ন বিচারশক্তি, মার্জ্জিত রুচি এবং মনীষার পরিচয় পাওয়া যায়। ইহাতে গভীর ধর্ম্মভাব ও উন্নত-চিন্তার বহুল নিদর্শন পরিদৃষ্ট হয়। ইহার লিখন-ভঙ্গী প্রাঞ্জল অথচ গাম্ভীর্য্যপূর্ণ। সমসাময়িক ফার্সী-লেখকগণের চিরাভ্যস্ত দোষ—অনাবশ্যক উপমা ও অলঙ্কারে এই গ্রন্থ ভারাক্রান্ত নহে।

 উদারহৃদয়া জহান্-আরা দানশীলা মহিলা ছিলেন। তিনি ধর্ম্মমন্দির ও রাষ্ট্রীয় হিতকল্পে বহু সুরম্য অট্টালিকা নির্ম্মাণকার্য্যে অকাতরে অর্থব্যয় করিয়া গিয়াছেন। সুন্দর প্রাসাদ নির্ম্মাণে শাহ্‌জহানের যে ঐকান্তিক অনুরাগ ও সৌন্দর্য্য-রুচির পরিচয় পাওয়া যায়, তাঁহার সন্তানগণের মধ্যে জহান্‌-আরা বহুল পরিমাণে তাহার অধিকারিণী হইয়াছিলেন। আগ্রার সুন্দর সুপ্রসিদ্ধ জামা মস্‌জিদ তাঁহারই ব্যয়ে ১৬৪৭ খ্রীষ্টাব্দে নির্ম্মিত হয়। দিল্লীতে নূতন রাজধানী স্থাপিত হইবার পর, জহান্‌-আরা সমাগত পদস্থ ব্যক্তিগণের অবস্থানের জন্য এক অতি মনোরম সরাই-এর প্রতিষ্ঠা এবং তাহার পরিচালনের সুব্যবস্থা করেন। বর্ত্তমান দিল্লী-ইন্‌ষ্টিটিউট ও তাহার চতুষ্পার্শ্বস্থ ভূমিখণ্ডের উপর এই সরাই প্রতিষ্ঠিত ছিল।

 দিল্লী, আগ্রা, আম্বালা ও কাশ্মীরে জহান্‌-আরা বহু নয়নাভিরাম উদ্যান প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। কাশ্মীরস্থ উদ্যানটি এক্ষণে ‘আচ্‌বল্’ নামে খ্যাত; দিল্লী চাঁদনী চক্-সন্নিহিত উদ্যানটি ‘বেগম বাগ’ নামে অভিহিত ছিল, এক্ষণে কুইন্স গার্ডেন্স আখ্যাপ্রাপ্ত হইয়াছে। এই উদ্যানদ্বয়ে শ্বেতমর্ম্মর-নির্ম্মিত মূর্ত্তি, প্রমোদভবন, জলপ্রণালী ও উৎস-সকল অতীব মনোরম এবং নেত্রতৃপ্তিকর।

 সুবর্ণখচিত, বহুবর্ণে চিত্রিত, আগ্রাদুর্গস্থ মর্ম্মর-নির্ম্মিত জগদ্বিখ্যাত খাসমহলের দক্ষিণ প্রকোষ্ঠে জহান্-আরার অপূর্ব্ব কক্ষরাজি দেখিলে তাঁহার সৌন্দর্য্যবোধের ভূয়সী প্রশংসা না করিয়া থাকা যায় না। আগ্রা-দুর্গের অন্দরমহলে দেওয়ান্-ই-খাসের পশ্চাতে যে-সকল কক্ষ আছে, তাহার দেওয়ালের তাক্‌গুলিতে জহান্-আরার গ্রন্থরাজি সজ্জিত থাকিত,—এই প্রবাদ অদ্যাবধি চলিয়া আসিতেছে।

 জগতের ইতিহাসে জহান্-আরা পিতৃভক্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে পরিকীর্ত্তিত। ভাগ্যচক্রের পবিবর্ত্তনে সম্রাট্ শাহ্‌জহান্ যখন পুত্র আওরংজীব্ কর্ত্তৃক আগ্রা-দুর্গে বন্দী, তখন জহান্-আরা আর রাজাধিরাজ-কন্যা নহেন;—তিনি মর্ম্মপীড়িত পিতার একাধারে সান্ত্বনাদায়িনী মাতা ও সেবাপরায়ণা দুহিতা। সর্ব্বভোগত্যাগিনী, চিরকৌমার্য্যব্রতধারিণী জহান্-আরা এই সময় সকল সুখে জলাঞ্জলি দিয়া, বন্দী পিতার আমরণ সেবা করিয়া, ত্যাগের যে চরম দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন, তাহাতে মনে হয়, তিনি গ্রীসরাজ-দুহিতা, পিতৃসেবিকা এণ্টিগনীর সহিত একাসন পাইবার সম্পূর্ণ যোগ্য। বিখ্যাত ফরাসী কবি লেকঁৎ দ্যলিলে তাঁহার বিষয়ে ‘হিন্দু এণ্টিগনী’ নামক এক প্রশংসাপূর্ণ কবিতা লিখিয়া গিয়াছেন।

 পুরাতন দিল্লীর পথে শেখ নিজাম্-উদ্দীন্ আউলিয়ার যে বিশাল সমাধি ভবন আছে, তাহার ভিতরে প্রাচীরবেষ্টিত এক স্বল্পায়তন স্থানে জহান্-আরা সমাহিতা। তিনি জীবদ্দশায় স্বয়ং এই সমাধি নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন। এই সমাধিভূমিতে শ্যাম-তৃণাস্তরণতলে নিরভিমানিনী জহান্‌-আরা অনন্ত-নিদ্রায় শায়িতা। কবরশীর্ষে শ্বেত মর্ম্মর-প্রস্তরে যে কবিতাটি খোদিত আছে, তাহা তাঁহার মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বে রচিত:—

“হু—আল্ হাই—আল্ কিউম্
বঘাএর্ সব্‌জা ন পোশদ্ কসে মজার্-ই-মবা
কে কব্‌রপোষ্-ই-ঘরিবান্ হামীঁ গিয়া বস্ অস্ত্।
আল্-ফকীরা আল্-ফানীয়া জহান্-আরা
মুরীদ্-ই-খ্বাজ্ গান্ ই-চিশ্‌ত বিন্‌ত্-ই-শাহ্‌জহান্
বাদ্‌শাহ্ ঘাজী আনারুল্লা বুর্হানুহু সনে ১০৯২।”

—তিনিই জীবন্ত—আত্মসত্ত্ব। (কোরাণ তৃতীয় অধ্যায়) আমার সমাধি তৃণ ভিন্ন কোন [বহুমূল্য] আবরণে আবৃত করিও না। দীন-আত্মাদিগের পক্ষে এই তৃণই যথেষ্ট সমাধি-আবরণ। শাহ্‌জহান্‌-দুহিতা, চিশ্‌তী সাধুদিগের শিষ্যা, বিনশ্বর ফকীরা জহান্‌-আরা, ১০৯২ হিজরা।[১৮]

 যে গৃহস্থ কুলমহিলা উন্নত-আদর্শে, সুনিপুণ শিক্ষায়, শ্রান্তিহীন যত্নে বালিকা জহান্‌-আরার কলিকাহদয় প্রস্ফুটিত করিয়াছিলেন, সেই অশেষ গুণবতী সিত্তী-উন্নিসার সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমরা এইখানে প্রদান করিব।

 পারস্য দেশ হইতে যে-সকল কর্ম্মবীর ও দানশীলা রমণী আসিয়া কর্ম্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে আপনাদের নাম চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছেন, সিত্তী-উন্নিসা তাঁহাদের মধ্যে অন্যতমা। তিনি পারস্যের অন্তর্গত মাজেন্দ্রানের জনৈক সম্ভ্রান্ত অধিবাসীর কন্যা। যেপরিবারে তাঁহার জন্ম, তাহা বিদ্বান্ ও চিকিৎসা শাস্ত্রবিদের বংশ বলিয়া বিখ্যাত ছিল। সিত্তীর ভ্রাতা তালিবা-ই-আমুলী জহাঙ্গীরের দরবারের রাজকবি; শব্দ-সম্পদে সে যুগে তাহার সমকক্ষ কেহ ছিল না। সিত্তীর স্বামী নসীবা বিখ্যাত চিকিৎসক রুক্‌নাই কাশীর ভ্রাতা। ভারতে স্বামীর মৃত্যু হইলে সিত্তী-উন্নিসা সম্রাজ্ঞী মুম্‌তাজ্-মহলের অধীনে কর্ম্ম গ্রহণ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই এই সদাচার-রতা বিধবার নির্ম্মল চরিত্র, কর্ম্মনৈপুণ্য, মিষ্টভাষিতা প্রভৃতি গুণরাশির পরিচয় পাইয়া মুম্‌তাজ্ বুঝিলেন সংসারে এরূপ প্রত্যয়পাত্রী বিরল; তিনি সিত্তীকে স্বীয় মোহর-রক্ষার ভার দিয়া সম্মানিত করিলেন। সিত্তী উন্নিসা অতি সুন্দরভাবে কুরাণ পাঠ করিতে পারিতেন। এই ধর্ম্মগ্রন্থের ভাষ্য প্রভৃতি আনুসঙ্গিক সাহিত্যেও তাঁহার অধিকার ছিল। পারস্য গদ্য ও পদ্য উভয় সাহিত্যে তিনি বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন, এমন কি চিকিৎসাশাস্ত্রও তাঁহার অধিতব্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সর্ব্বতোমুখী জ্ঞান-গরিমার জন্য তিনি বাদশাহ্‌জাদী জহান্-আরার শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত হ’ন।[১৯]

 শাহ্‌জহানের পর ষষ্ঠ মোগল-সম্রাট্ আওরংজীবের রাজ্যকালে আমরা তিন জন বিদুষী বাদশাহ্‌জাদীর পরিচয় পাই:— আওরংজীবের
রাজত্বকাল
জহান্-জেব্ বানু—সম্রাট্ শাহ্-জহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শুকোর কন্যা; ডাকনাম জানী বেগম। জানী জহান্‌-আরার বিশেষ প্রিয়পাত্রী ছিলেন। আওরংজীবের তৃতীয় পুত্র মুহম্মদ আজমের সহিত এই অনিন্দ্যসুন্দর পারিজাত-পুষ্প পরিণয়-প্রীতি-বন্ধনে গ্রথিত হন (১৬৬৯ জানুয়ারি)। জহান্-আরাই কন্যা সম্প্রদান করেন। অতুলনীয়া পিতৃষ্বসার শিক্ষা-দীক্ষায় আদর্শে গঠিত জানী কেবলমাত্র বিদ্যাবত্তায় গরীয়সী ছিলেন না;—রণস্থলে ইঁহার সাহস-শৌর্য্য ইতিহাস-পাঠককে চমৎকৃত করে। ১৬৮৪ খ্রীষ্টাব্দে (১০৯৫ হিজ্‌রা) কুমার আজম্ যখন বিজাপুর অবরোধ করিবার প্রয়াস করেন, সে-সময় তাঁহার দুর্দশাপন্ন সৈন্যগণ খাদ্যের অভাবে হতাশমগ্ন,—এক প্রাণীও অস্ত্র ধরিয়া দণ্ডায়মান হইতে অনিচ্ছুক, সেই সময় জানী যদি হস্তিপৃষ্ঠে আরূঢ় হইয়া তীরধনু-করে সমরবাসরে অগ্রসর না হইতেন, তাহা হইলে কুমারের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হইত (K. K., ii, 317), কিন্তু এই বীর্য্যবতী মহিলার আত্মত্যাগ-মহিমায়, উৎসাহে-উত্তেজনায় বীরহৃদয় মাতিয়া উঠিল —কুমারের হৃদিভগ্ন-সৈন্য বিজয়-হুঙ্কারে বিজাপুর অবরোধে ছুটিল!

 আওরংজীবের জ্যেষ্ঠা কন্যা জেব্-উন্নিসা এক জন উচ্চশিক্ষিতা মহিলা। হাফিজা মরিয়ম্ নামে জনৈক বিদুষী মহিলার উপর জেবের শৈশব-শিক্ষার ভার অর্পিত হয়। অত্যল্প বয়স হইতেই তাঁহার জ্ঞানার্জ্জন-স্পৃহা অতীব বলবতী ছিল। তৎকালীন প্রথানুসারে তিনি কোরাণ কণ্ঠস্থ করেন; এক দিন পিতার নিকট সমস্ত কোরাণখানির আমূল আবৃত্তি করিয়া, নিজ পারদর্শিতার পরীক্ষা দিয়া, সকলকে বিস্ময়াবিষ্ট করিয়াছিলেন। বালিকা-কন্যার অনন্যসাধারণ স্মরণশক্তি-দর্শনে মুগ্ধ হইয়া, আওরংজীব তাঁহাকে ৩০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা পারিতোষিক প্রদান করেন। বলা বাহুল্য, জেব্-উন্নিসা এই শিক্ষার সুফল সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করিতে কিছুমাত্র আলস্য করেন নাই। আর্বী ও ফার্সী উভয় ভাষাতেই তিনি লেখনী পরিচালনা করিতে পারিতেন। আরবীয় ধর্ম্মতত্ত্বে তাঁহার ব্যুৎপত্তি ছিল। অনেক সময় জেব্-উন্নিসার সহিত সম্রাটের ধর্ম্মশাস্ত্রের আলোচনা হইত।

 ভারতেশ্বরের আদরিণী কন্যা হইয়াও, বিলাসব্যসনে আমরণ নিমগ্ন থাকা অপেক্ষা জ্ঞানানুশীলন ও সাহিত্যচর্চ্চাকেই জেব্-উন্নিসা তাঁহার পুণ্যময় জীবনের ব্রতরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। পুস্তকাগারে সংগৃহীত ধর্ম্ম ও সাহিত্য সম্বন্ধীয় বহু গ্রন্থ তাঁহার জ্ঞানার্জ্জন-স্পৃহা ও পবিত্র জীবন-যাপনের সাক্ষ্য প্রদান করে। তিনি নিজেও যেমন সাহিত্যানুরাগিনী, সাহিত্যিকগণের সাহিত্যানুরাগেরও তেমনই উৎসাহদাত্রী। বহু দুঃস্থ গুণী লেখক তাঁহার নিকট সাহায্য পাইয়া সাহিত্য-সেবার সুযোগ লাভ করিতেন। সাহিত্যের উন্নতিকল্পে জেব্ অনেক সুপণ্ডিত মৌলবীকে যোগ্য বেতনে নূতন পুস্তক প্রণয়ন, অথবা তাঁহার নিজের ব্যবহারার্থ দুষ্প্রাপ্য হস্তলিখিত পুঁথির নকল-কার্য্যের জন্য নিযুক্ত করিয়াছিলেন। যে-সকল লেখক তাঁহার যত্ন ও চেষ্টায় যশস্বী হন, তন্মধ্যে মুল্লা সফী-উদ্দীন্ অর্দ্দবেলীর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যচর্চ্চার সুবিধার জন্য, সফী-উদ্দীন্ জেব্-উন্নিসার অর্থে আরামে কাশ্মীর বাস করিতেন। তিনি ‘জেব-উৎ-তফাসির’ নাম দিয়া কোরাণের আর্বী মহাভাষ্য ফার্সীতে অনুবাদ করেন। সফী-উদ্দীন্ গ্রন্থখানি জেব্-উন্নিসার নামে প্রচার করিয়াছিলেন। এইরূপ আরও কয়েকখানি গ্রন্থ জেবের নামে প্রচলিত; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজে ঐ সকল গ্রন্থ রচনা করেন নাই। লেখকগণ কৃতজ্ঞতা-প্রকাশের জন্য তাঁহার নাম ঐ সকল গ্রন্থে নিবদ্ধ করিয়াছিলেন।

 সম্রাট্ আওরংজীব কবিতার পক্ষপাতী ছিলেন না। কবিদিগকে তিনি মিথ্যাবাদী চাটুকার, এবং তাহাদের রচনাকে জলবুদ্বুদের মত ব্যর্থ বলিয়া ঘৃণা প্রকাশ করিতেন। কোন কবিই তাঁহার দরবারে রাজ-অনুগ্রহ লাভ করিতে পারেন নাই। কিন্তু করুণারূপিণী জেবের করুণা হইতে যে তাঁহারা বঞ্চিত হ’ন নাই, তাহা বলা বাহুল্য। কন্যার করুণার ফল্গুধারা, আওরংজীবের আমলের সাহিত্যকে এইরূপে সঞ্জীবিত রাখিয়াছিল।

 ‘দেওয়ান্-ই-মখ্‌ফী’তে তাঁহার রচিত অনেক কবিতা স্থান পাইয়াছে সত্য, কিন্তু সে কোন মখ্‌ফী? তৎকালে যে-সকল কবি গুপ্তভাবে কবিতা রচনা ও প্রচার করিতেন, ফার্সীতে তাঁহাদের ছদ্মনাম ‘মখ্‌ফী’। ফার্সী ভাষায় মখ্‌ফী এক নহে— বহু। বাদশাহ্‌জাদীর হৃদয়ের নির্ম্মল ভাবধারা কোন্ মখ্‌ফীর আধারে প্রবাহিত হইয়াছিল, তাহা আজ কে নির্ণয় করিবে?[২০]

 প্রকৃতি জেব-উন্নিসাকে সৌন্দর্য্যের ললামভূতা করিয়া সৃষ্টি করিয়াছিলেন। বাহিরের রূপ ও অন্তরের পাণ্ডিত্য তাঁহার কবিপ্রতিভাদীপ্ত শুভ্র ললাটে যে গৌরবের মুকুট পরাইয়া দিয়াছিল, তাহা রাজকিরীট অপেক্ষাও সমুজ্জ্বল। মোগলের নিভৃত অন্তঃপুরে দুর্ভেদ্য যবনিকার অন্তরালে থাকিয়াও জেব্ ঘন পত্রান্তরালে বিকশিত, সুরভি-সৌন্দর্য্য-মণ্ডিত গোলাপ পুষ্পের ন্যায় আপনাকে ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে লুক্কায়িত রাখিতে পারেন নাই— দেশ-দেশান্তরে তাঁহার যশ-সৌরভ পরিব্যাপ্ত হইয়াছিল।

 জেব্-উন্নিসা ভ্রাতা মুহম্মদ্ আক্‌বরকে নিরতিশয় স্নেহচক্ষে দেখিতেন। এই জ্যেষ্ঠা ভগিনীর প্রতি আক্‌বরেরও অগাধ বিশ্বাস, অপরিসীম শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিল। আক্‌বর একখানি পত্রে জেব্-উন্নিসাকে লিখিয়াছিলেন, “যাহা তোমার, তাহাই আমার, এবং যাহা আমার, তাহাতে সর্ব্বময়ে তোমার অধিকার রহিয়াছে।’ পত্রের অন্যত্র আছে, ‘দৌলৎ ও সাগরমলের জামাতৃগণকে কার্য্যে নিয়োগ বা কর্ম্মচ্যুত করা, তোমার ইচ্ছাধীন। তোমারই আদেশে আমি তাহাদিগকে কর্ম্মচ্যুত করিয়াছি। সমস্ত বিষয়েই তোমার আদেশ আমি কোরাণ ও প্রেরিত-পুরুষের ‘হদীসে’র ন্যায় পবিত্র মনে করিয়া অবশ্যকর্ত্তব্যবোধে প্রতিপালন করি।” ভগিনীর কিরূপ স্নেহ ও আন্তরিকতার জন্য আক্‌বর তাঁহাকে এত শ্রদ্ধা, এত নির্ভর করিতেন, তাহা সহজেই অনুমেয়। এই অকৃত্রিম ভ্রাতৃস্নেহই জেব্-উন্নিসার কালস্বরূপ হইয়াছিল।

 আক্‌বর পিতার বিরোধী হইলেন; কিন্তু রাজসৈন্যের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। আজমীরের নিকট তাঁহার যে শিবির সন্নিবেশ হইয়াছিল, তাহা পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিলেন। বিদ্রোহের অব্যবহিত পূর্ব্বে ভ্রাতা আক্‌বরকে জেব্-উন্নিসা যে-সকল গুপ্ত চিঠিপত্র লিখিয়াছিলেন, রাজসৈন্য শিবির অধিকার করিলে (১৬ই জানুয়ারি, ১৬৮১) তৎসমুদয় সম্রাটের করতলগত হয়। অপরাধী পুত্র তাঁহার হস্তচ্যুত, সুতরাং বিদ্রোহীর সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অপরাধে আওরংজীবের সমস্ত ক্রোধ পতিত হইল জেব্-উন্নিসার উপর। জেবের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও বার্ষিক চারি লক্ষ টাকা বৃত্তি বন্ধ হইল—দিল্লীর সন্নিকটে সলীম্‌গড়-দুর্গে সম্রাট্-নন্দিনী আমরণ বন্দী হইলেন (১৬৬১-১৭০২)।

 তাহার পর সুদীর্ঘ দ্বাবিংশতি বর্ষ স্নেহময়ী কুসুম-কোমলা জেব্-উন্নিসাকে বন্দিনীর কঠোর জীবন যাপন করিতে হয়। কারা-প্রাচীরের আবেষ্টনের মধ্যে নিঃসঙ্গ বন্দীদশায় তখন তাঁহার কবিচিত্তে বেদনাভরা কত ভাবের উদয় হইত, কত বিষাদ-গীতি মুকুলিত হইয়া ঝরিয়া পড়িত, তাহার ইয়ত্তা কে করিবে? মনে হয়, ঐ সময়েই তিনি খেদ করিয়া গায়িয়াছিলেন:—

কঠিন নিগড়ে বদ্ধ, যত দিন চরণযুগল,
বন্ধু সবে বৈরী তোর, আর পর আত্মীয়-সকল।
সুনাম রাখিতে তুই করিবি কি সব হবে মিছে
অপমান করিবারে বন্ধু যে গো ফেরে পিছে পিছে।
এ বিষাদ-কারা হ’তে মুক্তি তরে বৃথা চেষ্টা তোর,
ওরে মখ্‌ফী, রাজচক্র নিদারুণ বিরূপ কঠোর;
জেনে রাখ্ বন্দী তুই, শেষ দিন না আসিলে আর,
নাই নাই, আশা নাই, খুলিবে না লৌহ-কারাগার।

 লৌহদ্বার আর সত্য-সত্যই ইহলোকে মুক্ত হয় নাই — হইয়াছিল এক দিন, যেদিন মৃত্যুর ভবভয়হারী মহাবল আনন্দময় বাহু জেব্-উন্নিসাকে শান্তিপ্রদ মুক্তিরাজ্যে লইয়া যাইবার জন্য প্রসারিত হয় (২৬ মে, ১৭০২)। প্রকৃতি এখন অস্বাভাবিক প্রতিরোধের সম্পূর্ণ শোধ লইলেন। যে বাদ্‌শাহ্ এত দিন রাজনীতির কুটিল-চক্রে অপত্য-স্নেহ ভুলিয়াছিলেন, তিনিও শোকাবেগ ধারণ করিতে পারেন নাই। প্রিয়কন্যার মৃত্যু-সংবাদ-শ্রবণে বৃদ্ধ আওরংজীবের পাষাণ চক্ষু ফাটিয়াও অশ্রুধারা বহিয়াছিল।[২১]

 বদর্-উন্নিসা—সম্রাট্ আওরংজীবের তৃতীয়া কন্যা, সমগ্র কোরাণখানি ইঁহার কণ্ঠস্থ ছিল, কিন্তু জ্যেষ্ঠা ভগিনী জেব্-উন্নিসার ন্যায় বদর্-উন্নিসা উচ্চশিক্ষিতা ছিলেন না।

 মোগল সাম্রাজ্যের ভগ্নদশায় শৌর্য্যবীর্য্য গৌরব সব বিলুপ্ত প্রথম বাহাদুর
শাহ্ র রাজত্বকাল
হইয়াছিল, কিন্তু হারেমে বিদুষী-মহিলার অভাব হয় নাই। প্রথম বাহাদুর শাহ্‌র পত্নী—নূর্-উন্নিসা মোগলের কালরাত্রি উদয় হইবার পূর্ব্বে গোধূলি-অন্ধকারে সন্ধাতারার ন্যায় কিরণ বর্ষণ করিয়াছিলেন। তিনি মীর্জা সঞ্জব নজম্ সানীর কন্যা। খাফি খাঁ লিখিয়াছেন (ii, 33o) নূর্-উন্নিসা সুন্দর হিন্দী কবিতা রচনা করিতে পারিতেন।
শেষ কথা

 মোগলের কথা ছাড়িয়া দিলেও, তাঁহদের পূর্ব্ববর্ত্তী মুসলমান যুগেও যে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন ছিল, ইতিহাস তাহার সুস্পষ্ট আভাস প্রদান করে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতিবৃত্ত-পটে দুই জন বিদুষী রমণীর আলেখ্য অতি উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত।

 সুলতান্‌ আল্‌তামাশের অযোগ্য পুত্রগণের ব্যসন-স্রোতে যখন দিল্লীর সিংহাসন ভাসমান, সেই সময় ধূল্যবলুণ্ঠিত রাজদণ্ড এই বহু রাজগুণসম্পন্না বীর্য্যবতী রাজকন্যার করে ন্যস্ত রাজ্ঞী রাজিয়া হইয়াছিল। বিদুষী রাজিয়ার কোরাণে বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল;—তিনি এই ধর্ম্মগ্রন্থ বিশুদ্ধ উচ্চারণের সহিত পাঠ করিতে পারিতেন।[২২] আওরংজীব-দুহিতা জেব্-উন্নিসার ন্যায় ইনিও সাহিত্য ও সাহিত্যিকগণের উৎসাহদাত্রী ছিলেন।[২৩] কি প্রজাপালনে, কি রণাঙ্গনে সৈন্য-পরিচালনে, এই ন্যায়পরায়ণা বীরাঙ্গনার তুল্যপারদর্শিতা ছিল। এই প্রজাপ্রিয় বিচক্ষণ সুল্‌তানা সম্বন্ধে এক জন ঐতিহাসিক লিখিয়াছেন, “রাজিয়ার একমাত্র অপরাধ যে তিনি স্ত্রীলোক! যাঁহারা তন্নতন্ন করিয়াও তাঁহার চরিত্র আলোচনা করিবেন, তাঁহারাও তাঁহার দোষের সন্ধান পাইবেন না।” (Ferishta, i. 217-18.)

 মাহ্ মালিক্—আলা-উদ্দীন জহান্‌সোজের দৌহিত্রী; ডাকনাম—জলাল্-উদ্-দুনিয়াও-উদ্দীন্। বিদুষী বলিয়া ইঁহার খ্যাতি ছিল।

মাহ মালিক‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’-প্রণেতা মিন্‌হাজ্ এক প্রকার তাঁহারই যত্ন ও অনুগ্রহে লালিত ও বর্দ্ধিত হইয়াছিলেন। মিন্‌হাজ্ তাঁহার গ্রন্থে বেগমের উচ্চপ্রশংসা করিয়া লিখিয়াছেন, মাহ্ মালিকের হস্তাক্ষর রাজঅঙ্গশোভী মুক্তার ন্যায় শ্রীসম্পন্ন ছিল।[২৪]

 পঞ্চদশ শতাব্দীর ইতিহাসেও স্ত্রীশিক্ষার নিদর্শন বিদ্যমান। ফিরিশ্‌তা লিখিয়াছেন, মালবাধিপতি সুলতান্ ঘিয়াস্-উদ্দীনের হারেমে পঞ্চদশ সহস্র মহিলা ছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে বহু শিক্ষয়িত্রী, প্রার্থনা-পাঠকারিণী প্রভৃতিরও অসদ্ভাব ছিল না।[২৫]

 মানবের বর্ত্তমান সভ্যতা ও উন্নতির তুলনায় যে যুগকে আমরা অজ্ঞানাচ্ছন্ন অন্ধযুগ বলিয়া নির্দ্দেশ করি, কুসংস্কারবর্জ্জিত ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ইতিহাসের সে গভীর তামসী নিশায় সময়-সময় যে উজ্জ্বল শিখার কিরণপাত হয়, তাহা অতীব বিস্ময়কর ও চিত্তগ্রাহী। অবশ্য, এই অভিনব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের দিনে, এখনকার মত জ্ঞানের বৈচিত্র্য ও শিক্ষার প্রসার তখন ছিল না। সত্য বটে, অনেক স্থলে দেখা যায় যে ফার্সী পদ্য, কোরাণ-অভ্যাস এবং শেখ সাদী শীরাজীর ‘গুলিস্তান্’ ও ‘বোস্তান্’ অধ্যয়ন করাই মহিলাগণের বিদ্যশিক্ষার চরমসীমা ছিল; তথাপি অসঙ্গোচে বলা যাইতে পারে, যে-শিক্ষা রমণীর সর্ব্বাঙ্গীন পূর্ণতাপ্রাপ্তির উপায়—যাহা তাঁহার চরিত্রের রমণীয় মাধুর্য্য বিকাশ করে, স্বভাবজাত কুপ্রবৃত্তিসকল নির্মূল করিয়া তাঁহাকে উন্নতির পথে—জ্ঞানের পথে—কর্ম্মের পথে—সত্য ও ধ্রুবের পথে লইয়া যায়, তাহারও ঐকান্তিক অভাব ছিল না। বিশেষতঃ যে-শিক্ষার চরম উন্নতি-নিদর্শন সুকুমার কলাবিদ্যার চর্চায়, ললিত-শিল্পের অনুশীলনে ও মার্জিত রুচির বিকাশে,—মোগল সম্রাট্‌গণের হারেমে তাহাও বিরল নহে,—জহাঙ্গীর-মহিষী নূর্‌জাহান তাহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্থল।

 মানুষী লিখিয়াছেন, ‘বাদ্‌শাহী হারেমে শাহ্‌জাদী ও অন্যান্য মোগল-পুরবাসিনীবৃন্দকে সঙ্গীত শিক্ষা দিবার জন্য বৃত্তিভোগিনী শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত থাকিতেন।’ তাঁহারা রাজবংশের সহিত সম্পর্কিত ছিলেন না; কেবল গুণের পুরষ্কার-স্বরূপ বাদশাহ্‌বৃন্দ তাঁহাদিগকে শিক্ষাকার্য্যে নিযুক্ত করিতেন। মানুষী আরও লিখিয়াছেন, ‘মোগল-সম্রাট্‌গনের নিকট যে-সকল হস্তলিখিত দৈনন্দিন সংবাদলিপি (‘ওয়াকিয়া’) আসিত, তাহা পাঠ করিবার ভার মহলের বেতনভোগিনী মহিলাদের উপর ন্যস্ত ছিল; রাত্রি নয় ঘটিকার সময় তাঁহারা সম্রাট্‌কে সংবাদ লিপি পাঠ করিয়া শুনাইতেন।’[২৬]

 মানুষীর এই সকল উক্তি হইতে স্পষ্টই অনুমিত হয় যে রাজ- প্রসাদ-অভিলাষী সাধারণ ও মধ্যবিত্ত, এমন কি নির্ধন- পরিবারেও স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন ছিল। সম্ভ্রান্ত-বংশের ত কথাই নাই; পূর্ব্ব-বর্ণিত সিত্তী-উন্নিসা ও মাহম্‌ আনগার জীবন-কাহিনী তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আর একটী কথা,—সভ্যতা, শিক্ষা, উন্নতি প্রভৃতি সদ্‌গুণরাজি সমাজের উচ্চস্তর হইতে নিম্নস্তরে সঞ্চারিত হয়,—ইহা চিরন্তন ধারা। যে সমস্ত আচার-ব্যবহার ধনী ও সম্ভ্রান্তব্যক্তিগণের গৃহে অনুসৃত হইয়া থাকে, সাধারণতঃ আমরা দেখিতে পাই, মধ্যবিত্ত ও দুঃস্থ ব্যক্তিরা তাহা অনুকরণ করিয়া থাকেন। মানব মনের এই দুর্দ্দমনীয় বাসনা চিরকাল সমভাবে কার্য্য করিয়া আসিতেছে।

 নির্ধন বা মধ্যবিত্তগণের জীবন-বৃত্তান্ত ইতিহাস আলোকিত করে না; কিন্তু সে সময়ের সামাজিক অবস্থা, রীতি-নীতি প্রভৃতি যুক্তির আলোকে পর্যালোচনা করিলে স্বতই মনে হয়, , বিশেষতঃ মোগল আমলে, যে সাধারণতঃ স্ত্রীশিক্ষার কতকটা প্রচলন ছিল, এ অনুমান অসঙ্গত নহে।

 স্ত্রীশিক্ষা জাতীয় উন্নতির অঙ্গীভূত। যেদিন হইতে শৌর্য্য-বীর্য্যসম্পন্ন মোগল জাতির অধঃপতন সুচনা হইয়াছে, সেদিন হইতে তাঁহাদের কুললক্ষ্মীগণও অন্তর্হিত হইয়াছেন। কিন্তু ইতিবৃত্তের বিশাল দৃশ্যপটে তাঁহাদিগের যে ছায়াছবি চিত্রিত রহিয়াছে, আমরা এই ক্ষুদ্রপটে তাহার অবয়ব-রেখামাত্র অঙ্কিত করিলাম। পরুষহৃদয় পুরুষ অসি বা মসীময়ী লেখনীতে আপনার কীর্ত্তিকাহিনী লিখিয়া যায়; কিন্তু ভাবময়ী নারী মানবের হৃদয়ক্ষেত্রে গভীরতর রেখায় আপনার অব্যক্ত প্রভাব অঙ্কিত করে। যে-হস্ত শিশুর দোলায় দোল দেয়, সেই করই যে ধরাশাসন করে, পৃথিবীর সকল বীর জাতির ইতিহাসে এ নিগূঢ় সত্য পুনঃ পুনঃ আত্মপ্রকাশ করিয়াছে;—

‘The hand that rocks the cradle
Rules the world!’

  1. Ain-i-Akbari, i. 48.
  2. Akbarnama, i. pp. 29, 30, 33
  3. Humayunnama, p.78n. দ্রষ্টব্য
  4. প্রাসাদের ঠিক কোন্ অংশে এই বালিকা-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত ছিল, স্মিথ্ সাহেবের Architecture at Fathpur Sikri (Pt. i. p. 8) গ্রন্থে প্রদত্ত নক্‌শা হইতে তাহা জানা যায়।
  5. Khafi Khan, i. 276; see also Masir-ul-Umara, VoI. I. Eng. Trans., p. 371.
  6. সলীমার বিস্তৃত জীবন-কাহিনী:—‘Salima Sultan’—H Beveridge, J. A. S. B., 1906; Humayunnama —Mrs Beveridge's notes, see Appendix.
  7. এই মাদ্রাসার প্রতিকৃতি Hearn’s Seven Cities of Delhi পুস্তকে দ্রষ্টব্য।
  8. অন্যান্য গ্রন্থে প্রকাশ, ইহা নূরজহান্‌-জননীর আবিষ্কার।—Tusuk-i-Jahangiri, i. pp. 270-271; Gladwin's Reign of Jahangir, p. 24.
  9. দুদামী—ওজনে দুই দাম (তামার ৪০ দামের মূল্য এক টাকা), পাঁচতোলিয়া—ওজনে পাঁচ তোলা। See Blochmann, i. 510.
     পেশোয়াজ= Gown; বাদলা= Brocade; কিনারী= Lace, নিচোল= skrit; আঙ্গিয়া= Bodice, নুরমহলী—এই প্যাটার্ণের কাপড়ে প্রস্তুত বরকনের কিংখাবের সাজপোষাক ২৫৲ টাকায় পাওয়া যাইত।
  10. See Khafi Khan, 1. 269.
     “The Begum herself introduced several improvements in ladies’ dress. The full-flowing skirt, afterwards travestied in the Court of Lucknow, the bodice which bore her name, and the pretty scarf at one time in fashion were her inventions.” — ‘Influence of Women in Islam’, Justice Ameer Ali, The 19th Century, 1899, p. 769.
  11. “This accomplished lady also devoted some attention to the development of culinary art and the decoration of the dinner-table, or to speak more correctly, the dastarkhan. The fashion of dressing dishes in the shape of flowers, which afterwards so astonished and amused the Persian Nadir Shah, is said to have been originated by her.” Ibid, pp. 769-70.
  12. Cunninghain, Arch. Reports, XIV, p. 62,
  13. Abdul Hamid's Padishahnamah, I. B. p. 27.
  14. ‘The Influence of Women in Islam’—Ameer Ali, The 19th Century, 1899, p. 767.
  15. Beale . Oriental Biographical Dictionary, p. 3O4.
    “Besides being thoroughly versed in Persian and Arabic literature she was highly musical and possessed the talent of improvising—an art which was dying out among Moslem ladies.” The 19th Century, 1899, p. 767.
  16. নূরজহানের বিস্তৃত জীবন-কাহিনী আমার ‘দিল্লীশ্বরী’ পুস্তকে দ্রষ্টব্য।
  17. আনন্দরাম মুখ্‌লিস্ ‘চমনিস্তান’ গ্রন্থে (পৃ. ২৫) জহান্-আরার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, জহান্-আরা দুই-একখানি ধর্ম্মতত্ত্ব-বিষয়ক পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন।
  18. জহান্‌-আরার বিস্তৃত জীবনী আমার ‘জহান্‌-আরা’ পুস্তকে দ্রষ্টব্য।
  19. সিত্তী-উন্নীসার জীবন-কাহিনী: — ‘The Companion of an Empress’ in Historical Essays by Jadunath Sarkar, pp. 151-156.
  20. খান সাহিব্ আবদুল্ মুক্‌তাদীর ‘দিউয়ান্-ই-মখ্‌ফী’র বিস্তৃত সমালোচনা ও পরীক্ষা করিয়াছেন। See Bankipur Oriental Public Library Catalogue, Persian Poetry, iii. pp. 25o-51.
  21. জেব-উন্নিসার বিস্তৃত জীবন-কাহিনী আমার ‘মোগল বিদুষী’ পুস্তকে দ্রষ্টব্য।
  22. Ferishta, i. 217.
  23. Tabaqat-i-Nasiri, p. 637.
  24. Ibid., Raverty, i. 392
  25. ‘He [Gheias-ood-Deen] accordingly established within his seraglio all the separate offices of a Court, and had at one time fifteen thousand women within his palace. Among these were School-mistresses, musicians, dancers, embroiderers, 'women to read prayers, and persons of all professions and trades.’ (Ferishta, iv. 236.)
  26. The matrons have generally three four, or five hundred rupees a month as pay, according to the dignity of the post they occupy ... ... ... In addition to these matrons there are the female superintendents of music and their women players, these have about the same pay more or less, besides the presents they receive from the princes and princesses ... ... ... Among them are some who teach reading and writing to the princesses, and usually what they dictate to them are amorous verses. Or the ladies obtain relaxation in reading books called ‘GULISTAN’ and ‘BOSTAN’ ... ... ... and other books treating of love, very much the same as our romances..........”(Storia de Moger, ii. pp. 330-331.)

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।