ম্যালেরিয়া/সবিরাম বিষম জ্বর

উইকিসংকলন থেকে

সবিরাম বিষম জ্বর (INTERMITTENT FEVER ইণ্টারমিটেণ্ট্ ফিবার)।

 সবিরাম বিষম জ্বরে কম্প দাহ ও খর্ম্ম পর্য্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়। ম্যালেরিয়া গ্রস্ত প্রদেশ সমূহে সচরাচর এই জ্বরই দেখিতে পাওয়া যায়। উপযুক্ত চিকিৎসা দ্বারা এই পীড়া প্রসমিত না হইলে ক্ষণবিরাম (remittent fever) জ্বরে পরিণত হইতে পারে। এমন দেখা হইয়াছে যে পালা জ্বর বলিয়া অবহেলা করিয়া টোট‍্কা বা মুষ্টীযোগ দ্বারা পীড়া আরোগ্য হইবে, প্রত্যাশা করত নিশ্চিন্ত থাকিলে অনেক সময়ে ঐ জ্বর সল্পবিরাম জ্বরে পরিবর্ত্তিত হইয়া জীবন বিনষ্ট করিয়াছে। অতএব অস্মদ্দেশীয় ভূত পূর্ব নৈদানিক বাক্যের উপর নির্ভর করিয়া কেবল মাত্র উপবাস অবলম্বন করিয়া থাকা উচিত নয়। এই পীড়ার প্রথম হইতে চিকিৎসাবলম্বন করা বিধেয়।

 সবিরাম জ্বর কখন কখন অকস্মাৎ প্রকাশিত হয়। কম্প আরম্ভ হইবার পূর্ব্বে পীড়ার কোন লক্ষণ অনুভব করিতে পারা যার না। কখন বা ক্ষুধাভাব, কোষ্টবদ্ধ, মস্তিষ্কের ভার, অপরাহ্ণে চক্ষুর জ্বালা ও ধমনীর অত্যল্প বেগ দ্রুততা, দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রমের কার্য্যে অনিচ্ছা প্রভৃতি লক্ষণ সকল পূর্ব্ববর্ত্তী হইয়া এক দিন জ্বর স্পষ্টাকারে প্রকাশিত হয়। এই জ্বরের তিনটি অবস্থা কম্প, দাহ এবং ঘর্ম্ম। ঘর্ম্মান্তে জ্বর সম্পূর্ণ ত্যাগ ও শরীর সুস্থ হয়। সবিরাম জ্বর প্রতিদিন, এক দিন অন্তর অথবা দুই দিবস অন্তর প্রকাশিত হইয়া থাকে।

 চিকিৎসা—কুইনাইন্ সবিরাম জ্বরের একটি অদ্বিতীয় মহৌষধ বলিয়া প্রতিপত্তিলাভ করিয়াছে। সপর্য্যায় জ্বরে ইহার ন্যায় যে আর দ্বিতীয় জ্বর নাই তাহা বলিলে অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে সাধারণ জন জমাজে ইহা তাদৃশ আদরণীয় নহে। এমন কি অনেকে বলেন যে কুইনাইনের পদার্পনে আমাদের দেশের সর্ব্বনাশ হইতেছে। পুনঃ পুনঃ জ্বরে পতিত হওয়া কুইনাইন্ সেবনের অলঙ্ঘনীয় ধর্ম্ম। এরূপ সংস্কার কাহার মনে এত বদ্ধমূল হইয়াছে যে বিনা কুইনাইন সেবনেযদি মরিতে হয় তাহাও ভাল। যাঁহারা সবিরাম, স্বল্পবিরাম জ্বরের নিদানতত্ত্ব অবগত নহেন তাঁহারা যে কুইনাইনের অখ্যাতি ঘোষণা করিবেন তাহার আর সন্দেহ কি। অধুনা অস্মদ্দেশীয় প্রায় সকল ব্যক্তিই জ্বরের এক প্রকার চিকিৎসক হইয়াছেন। জ্বর মগ্ন হইলে কুইনাইন্ সেবন করিলে জ্বর আরোগ্য হয় ইহা সকলে বুঝিয়াছেন, সুতরাং কালাকাল, বয়স, ঋতু, জ্বরের স্বভাব, উপসর্গের সদ্ভাব বা অসদ্ভাব প্রভৃতি বিবেচনা বিমূঢ় হইয়া অনেকে কুইনাইন্ ব্যবহার করিয়া থাকেন। এইরূপ স্থলে কুইনাইন্ যে বিষফল প্রসব করিবে তাহার আর আশ্চর্য্য কি।

 সবিরাম জ্বর তিন প্রকার। একাহিক যাহা প্রত্যহ হইয়া ছাড়িয়া যায়; দ্ব্যহিক, যাহা এক দিবস অন্তর এবং এ্যহিক যাহা দুই দিবস অন্তর প্রকাশিত হয়। জ্বরত্যাগে যদি কুইনাইন্ সেবনে প্রতিনিবৃত্ত হওয়া যায়, তাহা হইলে একাহিক জ্বর সপ্তাহের পর, দ্ব্যহিক জ্বর দ্বি সপ্তাহের পর, এবং ত্র্যহিক জ্বর ত্রি সপ্তাহে রপর পুনরাগত হইতে পারে। ইহা দ্বারা বোধ হইতেছে যে কুইনাইন্ দ্বারা কেবল মাত্র জ্বর অপসারিত করিয়া উহা কিয়দ্দিবস পর্য্যন্ত সেবনে বিরত থাকিলে জ্বর দেহ হইতে সম্পূর্ণ রূপে উম্মলিত হয় না, প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থিতি করে। অতএব জ্বর ত্যাগের পর অন্ততঃ তিন সপ্তাহ কাল অল্প মাত্রায় কুইনাইন্ ব্যবহার করা জ্বরের নৈদানিক বিধি সঙ্গত।

 কুইনাইন্ ব্যবহার সম্বন্ধে কতকগুলি সাধারণ নিয়মের প্রতি দৃষ্টি রাখা উচিত। কুপিত রস বা অন্ত্রমধ্যে মলবদ্ধ থাকিলে কুইনাইন্ সেবনে বিশেষ কোন উপকার প্রাপ্ত হওয়া যায় না। এজন্য অগ্রে বিরেচক, ঘর্ম্মকারক ও মূত্রকারক বা আবশ্যক মত বমনকারক ঔষধি দ্বারা মল, কুপিত রস অপসারিত করিয়া জ্বরমুগ্নে উপযুক্ত মাত্রায় কুইনাইন্ সেবন করিতে দিবে।

 পাকাশয়ের উগ্রতা থাকিলে কুইনাইন্ সেবন মাত্র উদর হইতে বমন হইয়া যায়। এ অবস্থায় হাইপোডারমিক পিচকারির দ্বারা ত্বকের নিম্নে কুইনাইন্ প্রক্ষেপ করিলে বিশেষ উপকার দর্শে। কখন কখন অহিফেনের সহিত বটিকা প্রস্তুত করিয়া উহা সেবন করাইলে বমন হইয়া যায় না। গুহ্যদ্বার দিয়া অন্ত্রমধ্যে প্রক্ষেপ করিলেও অভীষ্ট সিদ্ধ হয়।

 মস্তিষ্কে রক্তাবরোধ, ম্যালেরিয়া হইতে উৎপাদিত ভিন্ন অন্য কারণ বশতঃ শীররোগ, অন্ত্রের প্রদাহ, তরুণ অতিসার ইত্যাদি থাকিলে কুইনাইন্ প্রয়োেগ নিষিদ্ধ। যদি এমন বুঝিতে পারা যায় যে শিরশূল পর্য্যায়ক্রমে উপস্থিত হয় এবং ম্যালেরিয়াই তাহার কারণ, তাহা হইলে কুইনাইন‍্ই উহার প্রকৃত ঔষধি। এ ভিন্ন মস্তিষ্কের কোন যান্ত্রিক পীড়া জনিত অথবা কেবল মাত্র মস্তিষ্কের রক্তাবরোধ বশতঃ মস্তকের ভার ও যন্ত্রণা বিদ্যমান থাকিলে কুইনাইন্ কখনই ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ তদ্দ্বারা মস্তিষ্কের যন্ত্রণা ও রক্তাবরোধ বৃদ্ধি হয়।

 যকৃতের প্রদাহ ও রক্তাবরোধ সত্বে কুইনাইন্ ব্যবহারে অপকার দর্শে এজন্য অগ্রে এই দুইটী উপসর্গ অপসারিত করিতে হইবে। বমনকারক, বিরেচক এবং ব্রিষ্টার ও পিত্ত নিঃসারক ঔষধি প্রভৃতির দ্বারা প্রদাহ ও রক্তাবরোধ প্রতিকার করিয়া পরে কুইনাইন্ প্রয়োেগ করিতে হইবে।

 কুইনাইন্ দ্রাবণাবস্থায় অর্থাৎ সলফিউরিক বা নাইট্রমিউরিয়াটিক্ বা হাইড্রক্লরিক্ অম্লে গলাইয়া জল বা গোলাপের ফণ্টের সহিত প্রয়োগ করিলে আশুফল লাভ হয়। দ্রাবণাবস্থায় ঔষধি সকল যেমন সহজে পাকাশয় হইতে আচোষিত হয়, কঠিনাবস্থায় তেমন হয় না। অহিফেন, হিরাকস, সেঁকো, ষ্ট্রীক্নিয়া প্রভৃতির সহযোগে ইহা ব্যবহৃত হইলে ইহার ক্রিয়া বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তজ্জন্য যে সকল সময়েই ইহাদিগকে কুইনাইনের সহযোগে দিতে হইবে এমত নহে। প্রত্যেক রোগীর অবস্থানুসারে বিবেচনা পূর্ব্বক ব্যবহার করিতে হইবেক। উদরাময় থাকিলে আরসেনিক (সেঁকো) কদাচ ব্যবহার। করা উচিত নহে। এমন অবস্থায় অহিফেন বা ট্যানিক্ এসিডের সহযোগে প্রযুক্ত হইলে উভয় পীড়ার পক্ষে উপকার দর্শে। রক্তাল্পতা (এনিমিয়া) অথবা প্লীহা, সংযুক্ত সবিরাম জ্বরে লৌহ ঘটিত ঔষধির সহিত কুইনাইন্ প্রয়োগ করিলে মহোপকার প্রাপ্ত হওয়া যায়। যদি অন্ত্রের দৌর্ব্বল্য বশতঃ উদরাময় সংঘটিত হয় এবং সবিরাম জ্বর তাহার সহচর হয়, ফেরিসাইট্রাট্ অফ কুইনি, কুইনাইন্ এবং ষ্ট্রীক‍্নিয়া একত্রে বটীকা প্রস্তুত করিয়া ব্যবহার করিলে বিশেষ অভিষ্ট সিদ্ধ হয়।

 শূন্যোদরে দ্রবণাবস্থায় কুইনাইন্ প্রয়োগ করিলে অনতি বিলম্বেই ইহার কার্য্যের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। এজন্য সবিরাম জ্বরে কুইনাইন্ ব্যবহার করিতে হইলে উদর শূন্য সময়েই উহা প্রয়োগ করিবে।

 সবিরাম জ্বরে কুইনাইন্ ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিয়া যত ক্ষণ না কর্ণে শব্দ ও মস্তিষ্ক অল্প ভার বোধ হয়, ততক্ষণ তাহা সেবন করাইতে বিরত হইবে না। কিন্তু এই লক্ষণ প্রকাশ হইলেই কুইনাইন্ প্রয়োগে নিবৃত্ত হইবে। এইরূপ অবস্থায় যদি জ্বর নিবৃত্ত না হয় তাহা হইলে কুইনাইন্ দ্বারা যে কোন উপকার দর্শিবে এমন বোধ হয় না।

 বালকদিগের জন্য এমফস্ কুইনাইন ব্যবস্থা করা উচিত। এমফ্স কুইনাইন, লালাতে দ্রবীভূত হয় না এ জন্য ইহার তিক্ত আস্বাদ উপলব্ধ হয় না। কিন্তু গ্যাস্ট্রিক যুসে অর্থাৎ পাচক রসে ইহা সহজেই দ্রবীভূত হয়, এজন্য বালক এবং যাহারা তিক্ত কষায় রস সহ করিতে পারে না, তাহাদের জন্য ঐ কুইনাইন, বিশেষ উপযোগী। বলপূর্বক শিশুদিগকে যাহা সেবন করান হয় তাহা তাহারা বমন করিয়া ফেলে।

 সবিরাম জ্বরে কোন্ সময়ে কত পরিমাণে কুইনাইন্ ব্যবহার করিলে বিশেষ উপকার প্রাপ্ত হওয়া যায়, তৎসম্বন্ধে অনেক মতভেদ আছে। যে প্রণালী অবলম্বন করিয়া অধিকতর ফল প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে এক্ষণে নিম্নে তাহাই লিখিত হইতেছে।

 বদ্ধ মল ও কুপিত রস দেহ হইতে অপসারিত করিয়া দিয়া জ্বরের সম্পূর্ণ মগ্নাবস্থায় এক মাত্রায় ১০ গ্রেন্ কুইনাইন, ডাইলিউট, সলফিউরিক অম্লে দ্রবীভূত করিরা, প্রয়োগ করিবে। তদৃপরে ২ ঘণ্টান্তর ২ গ্রেন মাত্রায় চারি কিম্বা পাঁচ বার সেবন কবিতে দিবে। যদি কুইনাইন দ্বারা উপকার দর্শে তাহা হইলে জ্বর প্রত্যগত হইবে না, যদি হয় তবে তাহা সামান্য মাত্র হইবে এবং অল্প ক্ষণ থাকিয়া ছাড়িয়া যাইবে। দ্বিতীয় বারের মগ্নাবস্থায় তিন গ্রেন মাত্রায় চারি বার প্রয়োগ করিলে আর জ্বর হইবে না। এরূপে জ্বর নিবারিত হইলে কুইনাইন্ ব্যবহারে নিবৃত্ত হইবে না। নিম্ন মত প্রণালীতে অন্ততঃ ২ সপ্তাহ প্রয়োগ করিতে হইবে।

কুইনাইন্ সাল্‌ফ ৫ গ্রেন্
এসীড্ নাইট্রীক্ ডিল্ ২০ মিনিম্
টিংচর সিন্‌কোনা কোং ১॥ ড্রাম্
ডিকক্‌সন্ সিনকোনা ৩ আউন্স

 অর্দ্ধ ছটাক দিবসে তিনবার সেবন করাইবে। যদি প্লীহার উপসর্গ থাকে তবে—

হীরাকশ ৩ গ্রেন্
এসিড্ সল্‌ফ ডাং ৩০ মিনিম্
কুইনাইন্‌ সল্‌ফ ৫ গ্রেন্
টিংচর কলম্ব ১॥ আউন্স
টিংচর অরেন সিয়াই ১০ মিনিম্
লাইকর ষ্ট্রিক্‌নিয়া ৫ মিনিম্
জল ৩ অউন্স

যত দিবস প্লীহার পীড়া সম্পূর্ণ আরোগ্য না হয় উক্ত মিক্‌শ্চর পূর্ব্বোক্ত নিয়মে ব্যবহৃত হইতে পারে।

 কখন ২ কুইনাইন্ দ্বারা সবিরাম জ্বরে উপকার প্রাপ্ত হওয়া যায় না। এমত স্থলে নিম্ন লিখিত দেশীয় বনজ সহযোগে আরসেনিক ও ষ্ট্রীক্‌নিয়া প্রয়োগ করিলে কৃতকার্য্য হওয়া যায়। যথা

লাইকর আরসেনিক ১০ মিনিম্
লাইকর ষ্ট্রীক্‌নিয়া ২॥৹ মিনিম্
কম্পাউণ্ড্ ডিকক্মন্ আফ নিম[১] ২ আউন্স

 এক ছটাক দিবসে দুইবার সেবন করাইবে;

 দাতব্য চিকিৎসালয়ে সচরাচর জ্বর নিবারণ জন্য অতিশয় ব্যবহৃত হয়। কুইনাইন্ কিম্বা সলফেট অফ বেবারিণের ন্যায় ইহা ফলোপধায়ক নহে। জ্বরের স্থিতিকালে ও বিরামে সকল সময়েই প্রযোজ্য। ইহার দ্বারা আশু ফল প্রাপ্ত হওয়া যায় না। এবং ইহার কার্য্যও সকল সময়ে নিশ্চিত নহে। আরসেনিক ও ইপিক্যাকুয়ানা সম্বন্ধেও এইরূপ বলা যাইতে পারে। জ্বর নিবারণ জন্য আরসেনিক অধিক মাত্রায় ব্যবহার করিতে হয় এবং তজ্জনিত অতিরিক্ত ভেদ হইতে পারে। এজন্য উদরাময় কিম্বা উদরের কোন প্রকার উগ্রতা বর্ত্তমান থাকিলে ইহার প্রয়োগ নিষিদ্ধ। ইপিক্যাকুয়ানার কার্য্যের কিছুমাত্র নিশ্চয়তা নাই। এবং প্লীহা প্রভৃতি পীড়া থাকিলে ইহার দ্বারা কোন প্রকার উপকার প্রাপ্ত হওয়া যায় না। সবিরাম জ্বরের সহিত যকৃতের রক্তাবরোধ থাকিলে কখন কখন ইপিক্যাকুয়ানা দ্বারা কৃতকার্য্য হওয়া যায়। ইপিক্যাকুয়ানা ব্যবহার করিতে হইলে অর্দ্ধ মিনিম্ মাত্রায় দুই ঘণ্টা অন্তর প্রয়োগ করিতে হইবে। কেহ কেহ ষ্ট্রীক‍্নিয়াকে জ্বরঘ্ন বলিয়া পরিচয় দেন, কিন্তু বাস্তবিক উহাকে জ্বরঘ্ন বলিয়া বোধ হয় না। স্নায়বিক দুর্ব্বলতা বা অবসাদ বশতঃ দৈহিক বা যান্ত্রিক কার্য্য বিকার উপস্থিত হইলে ষ্ট্রীকনিয়া ঐ দুর্ব্বলতা অপসারিত করিয়া কতক পরিমাণে প্রকৃতিস্থ করিতে পারে; আর যদি স্নায়বিক অবসাদ জ্বরের নিদান হয় (কেহ কেহ বলেন সমবেদক স্নায়ুমণ্ডলীর অবসাদই জ্বরের কারণ) তাহা হইলে ইহার দ্বারা বিশেষ উপকার দর্শিবার সম্ভাবনা। আমি ষ্ট্রীকনিয়াকে জ্বরঘ্ন বলিয়া বিশ্বাস করি না।

 এস্থলে দেশীয় ঔষধি সম্বন্ধে কিছু বলা আবশ্যক। কুইনাইনের জ্বরঘ্ন গুণ দৃষ্টে দেশীয় ঔষধির জ্বরঘ্নতা সম্বন্ধে আমরা এরূপ অন্ধ হইয়াছি যে তাহাদের নাম গন্ধ ও করি না। এমন কি অনেক বিজ্ঞ চিকিৎসক হয়ত উহাদিগকে কখন স্পর্শও করেন নাই। দেশীয় ঔষধির প্রতি আমাদের কেন যে এত অনাদর তাহা বুঝিতে পারি না। বোধ হয় অজ্ঞতাই ইহার প্রধান কারণ। বিদেশীয় বিদ্যা ও সভ্যতার ছায়া আমাদের অস্থি মজ্জা পর্যন্ত এরূপ অধিকার করিয়া ফেলিয়াছে যে যাহা বিদেশীয় নহে তাহা আমাদের উপেক্ষনীয়। আবার ডাক্তার হইয়া বঙ্গজ ঔষধ ব্যবস্থা করিলে রোগী কিম্বা তাঁহার আত্মীয়েরা মনে করেন যে এ ডাক্তারটীর ইংরাজি চিকিৎসা ফুরাইয়া গিয়াছে, ইহার দ্বারা আর কিছু হয় না। সুতরাং সভ্যতার ও উপার্জ্জনের অনুরোধে দেশীয় ঔষধ পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হন। কিন্তু দেশীয় পীড়ার পক্ষে দেশীয় ঔষধি কতদূর উপযোগী ও ব্যায় সুলভ তাহা আমরা বিবেচনা করি না। যখন দেখিতে পাই যে বৃদ্ধ অতিবৃদ্ধপ্রপিতামহীর সময়ের বিজ্ঞ কবিরাজেরা ঔষধির যে সমস্ত সমষ্ঠি ও ব্যবস্থা লিখিয়াছেন রোগ নির্ব্বিশেষে তাহা এ পর্যন্ত প্রচলিত থাকিয়া কত কৃচ্ছ্রসাধ্য ও উৎকট পীড়া আরোগ্য করিতেছে; যদি এপর্য্যন্ত আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্র দিন দিন উন্নতি লাভ করিয়া আসিত তাহা হইলে এত দিন কত নূতন ঔষধি আবিষ্কার হইত এবং আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্র কত মঙ্গল প্রদ হইত। স্বার্থ পর বিদেশীয় অধিপতি হইতে কখন্ কোন্ জাতি মঙ্গল লাভ করিয়াছে? দেশীয় বিজ্ঞান শাস্ত্রাদি কোন্ বিদেশীয় রাজার নিকট সমাদর প্রাপ্ত হইয়াছে? দেশীয় শাস্ত্রাদি নষ্টোদ্ধার করিয়া যাহা মঙ্গলদায়ক তাহা সমাদরে পরিগ্রহণ ও অসারাংশ পরিত্যাগ করা আমাদের কর্ত্তব্য। অনেকেই জানেন যে উদরাময় ও আমাশয়ের কাবিরাজিক চিকিৎসা যে রূপ উৎকৃষ্ট এমন আর কোন চিকিৎসাই নহে। এই দুই পীড়ার জন্য আমাদের কখনই বিদেশীয় ঔষবির সাহার্য্য গ্রহণ করিবার আবশ্যক নাই। করুনাময় পরমেশ্বর আমাদের দেশের সকল প্রকার ব্যাধির জন্য ভারত কানন ও খনিতে যে, সকল প্রকার আবশ্যকীয় ঔষধির সৃষ্টি করিয়া রাখেন নাই তাহাই বা কে বলিতে পারে। আমরা যদি শারীরস্থানিক, শারীর বিধান ও রসায়ন শাস্ত্র বিশেষ রূপ পরিজ্ঞাত হইয়া ভারত কানন ও গর্ভে প্রবেশ করিয়া ঔষধির জন্য গবেষণা করি, কতই অমূল্য ঔষধ নিধি প্রাপ্ত হইতে পারি।

 আমাদের দাতব্য চিকিৎসালয়ে যে সমস্ত দেশীয় জ্বর ঔষধি সর্ব্বদা ব্যবহৃত হয় তাহাদের বিষয় নিয়ে লিখিত হইতেছে।

 ১। নিম-নিমের ছালের ভিতরকার শ্বেতবর্ণস্তর জ্বরঘ্ন এবং বহিরত্বক সঙ্কোচক। এই শ্বেতবর্ণ স্তর হইতে ডিকক‍্সন্ ও টিংচর প্রস্তুত হয়। নিমের ডিকক‍্সন্ সিন‍্কোনা ডিকক‍্সনের অপেক্ষা অধিকতর বল কারক এবং জ্বরঘ্ন এজন্য সিন‍্কোনার পরিবর্ত্তে নিম ব্যবহারে অধিকতর ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। নিমের ছাল হইতে এক প্রকার এক‍্ষ্ট্রাক‍্ট প্রস্ত‌ুত করিতে পারাযায় তাহার জ্বরঘ্ন শক্তি ডিকক‍্সন্, অপেক্ষাও অধিক। কম‍্পাউণ্ড ডিকক‍্সন্ অফ নিম —যে প্রকারে ইহা প্রস্তুত করিতে হয় তাহা পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে। লাইকার আরসেনিকের সহযোগে ইহা তিন চারি দিন সেবন করিলে যে প্রকার সবিরাম জ্বর হউকনাকেন প্রায় সর্ব্বদা নিশ্চয় আরোগ্য হয়। এই এক‍্ষ্ট্রাক‍্ট প্রতি দিন প্রস্তুত করিতে হইবে। এক দিনের অধিক রাখিলে পচিয়া যায়।

 ২। গুলঞ্চ—ইহার প্রয়োগ রূপ টিংচার, ইনফিউজন, এক‍্ষ্ট্রাক‍্ট এবং পালা জরঘ্ন ভিন্ন ইহার পিত্ত নিঃসারক ও অলটারেটিব গুণ আছে। মৃদু সবিরাম জ্বরে ইহার পালো অথবা এক‍্ষ্ট্রাক‍্টট হিরে কসের সহিত প্রয়োগ করিলে বিশেষ উপকার দর্শে এই রূপে বটিকা প্রস্তুত করিয়া কিছু দীর্ঘকাল সেবন করিলে প্লীহা এবং যকৃতের রক্তাবরোধ ও বিবৃদ্ধতা আরোগ্য হয়।

 ৩। নাটা করঞ্চ—ইহার বিচির শাঁস বলকারক এবং জ্বরঘ্ন মরিচের গুঁড়ার সহিত ইহা ব্যবহৃত হইলে ইহার জ্বরঘ্ন শক্তি বৃদ্ধি পায়। মাত্রা ১৫ হইতে ২০ গ্রেন্।

 ৪। ক্ষেত পাপড়া—ইহার ফ্লুইড এক্সট্রাক্ট ৪।৫ দিবস সেবনে সামান্য সবিরাম জ্বর আরোগ্য হয়। কিন্তু নিম, গুলঞ্চ, চিরেতা প্রভৃতির সহযোগে ইহা ব্যবহৃত হইলে বিশেষ ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। ইহার ডিকক্সন্ সিন‍্কোনা ডিকক্সনের পরিবর্ত্তে ব্যবহার করা যাইতে পারে।

 ৫| আতিষ—ভারতবর্ষের দক্ষিণ প্রদেশে, চুর, সালমা, এবং কেদারনাথ পর্ব্বতে আতিষ যথেষ্ট উৎপন্ন হয়। ইহার মূল গুঁড়া করিয়া ব্যবহৃত হয়। শতমূলি কখন কখন আতিষ বলিয়া বাজারে বিক্রীত হয়। আতিষ অত্যন্ততিক্ত এবং শ্বেতসার পূর্ণ। ২০ হইতে ৩০ গ্রেন্ মাত্রায় প্রতিদিন তিন কিম্বা চারিঘণ্টা অন্তর সেবন করিলে সবিরাম জ্বর আরোগ্য হয়। জ্বর কালীন কিম্বা জ্বর মগ্নে উভয় সময়েই ইহা প্রয়োগ করা যাইতে পারে। ৫ হইতে ১০ গ্রেন্ মাত্রায় ইহা বলকারক। কোন বলহানিকর পীড়ার আরোগ্যাবস্থায় ইহা ব্যবহার করিলে রোগীর শীঘ্র বলাধান হয়। সবিরাম জ্বরে কুইনাইনের পরিবর্ত্তে আমরা ইহাকে সচরাচর ব্যবহার করিয়া থাকি।

 ৬। রসত (বারবেরিষ লাইসিয়ম)—ঐ বৃক্ষের ছাল হইতে টিংচার, ইনফিউসন অর্থাৎ ফণ্ট এবং সার অর্থাৎ একষ্ট্রাক‍্ট প্রস্তুত হয়। ইহা ঘর্ম্মকারক, বলকারক, এবং জ্বরঘ্ন। সবিরাম এবং সল্প বিরাম জ্বরে ও জ্বর আরোগ্যের পর দুর্ব্বলাবস্থায় ইহা বিশেষ ফলোপধায়ী। প্রবল সল্প বিরাম জ্বরে ইহার টিংচর ১ হইতে ৪ ড্রাম মাত্রায় ৪ ঘণ্টা অন্তর প্রয়োগ করিলে জ্বরের কোপ শীঘ্রই হ্রাসিত হয়। ইহা হইতে এক প্রকার সার প্রস্তুত হয় তাহা রসত নামে আখ্যাত।

 বারবেরিষ এসিয়্যাটিকা—ডাক্তার ষ্টীভেন এই ঔষধি দ্বারা যে প্রকারে সবিরাম এবং অন্যান্য প্রকার সপর্য্যায় জ্বর চিকিৎসা করিতেন তাহা নিম্নে প্রদর্শিত হইতেছে। প্রথমতঃ তিনি বিরেচক দ্বারা অন্ত্র পরিস্কার করিয়া জ্বরের কম্পাবস্থার প্রারম্ভেই ৪ হইতে ৬ ড্রাম্ টিংচর বারবেরিষ এক মাত্রায় রোগীকে সেবন করাইতেন এবং কম্বল দ্বারা তাহাকে উত্তম রূপে আবৃত করিয়া রাখিতেন। ইহাতে রোগীর পিপাসা, দাহ, এবং অত্যন্ত যন্ত্রণা উপস্থিত ও সুশীতল বায়ু সেবনের জন্য বলবতী স্পৃহা হয়। এই স্পৃহা চরিতার্থ করিতে দিলে চিকিৎসার পক্ষে ব্যাঘাত জন্মে এবং চিকিৎসক অভিলষিত ফললাভে কৃত কার্য্য হইতে পারেন না। প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে শরীর অত্যন্ত উত্তপ্ত হইয়া উঠে এবং ত্বক্ হইতে স্বেদ বিন্দু ক্রমশঃ নিঃসৃত হইয়া সমস্ত কলেবর ঘর্ম্মে আর্দ্র হইয়া যায়। ঘর্ম্মদ্বারা ক্রমে শরীর স্নিগ্ধ ও সমস্ত প্রকার গ্লানি শূন্য হয়। কিন্তু রোগী কখন ২ অত্যন্ত দুর্ব্বল হইয়া পড়ে। এই সময়ে রোগীকে সাগু কিম্বা এরারুট ভক্ষণ করিতে দিয়া বিশ্রাম করিতে বলিলে প্রায় সচরাচর সুগভির নিদ্রা উপস্থিত হয় এবং নিদ্রাভঙ্গে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থতা লাভ করে, আর জ্বর প্রত্যাগত হয় না। ইহার পর কোন প্রকার মৃদু বিরেচকের সহিত চিরেতার ফণ্ট সেবন করিতে দিলে প্রায় সকল রোগীই আরোগ্য লাভ করে। ডাক্তার ষ্টীভেন বলেন ওয়ারবার্গর্শ্ ড্রপ্স বোধ হয় বারবেরিষ হইতে প্রস্তুত হয় কারণ ঐ ঔষধির কার্য্যের সহিত টিংচর বারবেরিষের কার্য্যের সম্পূর্ণ সৌসাদৃশ্য আছে।

 নারকটিন্—ইহার পর্য্যায় নিবারক শক্তি ডাক্তার ওসগনেসী সাধারণকে বিদিত করেন। ইংলণ্ডে ডাঃ ব্রুট‍্স্ দ্বারা সবিরাম জ্বরে ইহা পরীক্ষিত হইয়াছিল কিন্তু তদ্বারা বিশেষ কোন ফল না পাওয়ায় ইহার ব্যবহার তথায় রহিত হইয়াছে। ডাক্তার ওসগনেশা বলেন যে উপযুক্ত প্রণালী মতে প্রস্তুত না হইলে ইহা পর্য্যায় জ্বর নিবারণে সমর্থ হয় না। বেঙ্গল ফারমেকোপিয়াতে নারকটিন্ প্রস্তুত করিবার যে প্রণালী তিনি প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা অবলম্বন করিলে নিশ্চয়ই ইহা সবিরাম জ্বরের একটী মহৌষধ। ১৮৫৮ খৃঃঅব্দে ডাক্তার জে ব্যালফোর রোহিলখন্দ, রেঙ্গন এবং দিল্লী জ্বর নিবারণ করিবার জন্য প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করিয়া ইহার ফলোপধায়ীতার বিষয়ে বিশেষ সুখ্যাতি করিয়াছেন। তিনি অধিক মাত্রায় ইহা ব্যবহার করিতেন। জ্বরের ঘর্ম্মাবস্থায় এক মাত্রায় ২০ গ্রেন্ প্রয়োগ করিতেন এবং জ্বর আসিবার পূর্ব্বে ঐ পরিমাণে আর একমাত্রা সেবন করিতে দিতেন। দ্ব্যহিক জ্বরের বিরামাবস্থায় তিনি তিন মাত্রা প্রয়োগ করিতেন। শেষের সেবনীয় মাত্রা এরূপে দেওয়া হইত যে ইহা জ্বরের পুনরাগমনের দুই কিম্বা তিন ঘণ্টা পূর্ব্বে পড়িত। ডাক্তার ব্যালফোর বলেন অধিক মাত্রায় কুইনাইন্ সেবন করিলে শরীর যে প্রকার গ্লাণিযুক্ত হয় নারকটিন্ তদ্রুপ মাত্রায় সেবন করিলে তাহা হয় না। কিন্তু কখন কখন এক প্রকার অবসাদ, আবল্য এবং দৈহিক অশাড়তা উপস্থিত হইতে দেখা যায়। ইহা ক্ষণিক এবং অনতি বিলম্বেই অপসারিত হয়। অধিক মাত্রায় সেবন করিলে কখন কখন বমন হয়।

 সম্প্রতি ডাক্তার এগারডেন ইহার জ্বরঘ্ন শক্তির বিশিষ্ট প্রমাণ দর্শাইয়াছেন। ১৮৫৯।৬০ খৃঃঅব্দে গাজিপুরে যে ভীষণ সংক্রামক জ্বর উপস্থিত হয় তাহাতে তিনি ৬৮৪চী রোগীকে নার‍্কটিন প্রয়োগ করেন কিন্তু কেবল ১৯৪ টী রোগীর বিশেষ বিবরণ রাখিয়াছিলেন। ইহার দ্বারা তিনি এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে যদিও নার‍্কটিন কুইনাইনের তুল্য জ্বরঘ্ন নহে কিন্তু কুইনাইন্ ভিন্ন ইহার ন্যায় জ্বরঘ্ন আর নাই। কুইনাইন্ ব্যতীত এত শীঘ্র, নিশ্চিৎ এবং অল্প মাত্রায় জ্বর আরোগ্য করিতে কোন ঔষধি দেখিতে পাওয়া যায় না। ইহা সেবনে শরীরে গ্লানি কদাচিৎ উপস্থিত হয়। উল্লিখিত ৬৮৪টী রোগীর মধ্যে কেবল নয়টীর মৃত্যু হইয়াছিল উক্ত ১৯৪টি। রোগীর মধ্যে শতকরা ৩.৬ স্থলে নার‍্কটিন্ দ্বারা কৃতকার্য্য হওয়া যায় নাই। জ্বর নিবারণ করিবার জন্য গড়ে ২২.৭ গ্রেণ এবং আরোগ্য কালীন গড়ে ১৬.৩ গ্রেণ এবং সমষ্ঠিতে ৩৯ গ্রেণ অর্থাৎ প্রায় দুই স্ক্রুপল লাগিয়াছিল। সচরাচর ১॥ গ্রেণ হইতে ৩ গ্রেণ পর্যন্ত মাত্রায় প্রয়োগ করা হইয়াছিল। কদাচিৎ ৬ গ্রেণ মাত্রায় প্রয়োগ করা হইয়াছিল কিন্তু অধিক মাত্রায় প্রয়োগ করিলে বমন হয়। নার‍্কটিন্ ব্যবহার করিবার পূর্ব্বে বিরেচক দ্বারা অন্ত্রস্থ মল অপসারিত করা আবশ্যক।

 প্লীহার রক্তাবরোধ—পূর্ব্বে বলা হইয়াছে যে সবিরাম জ্বরের কম্পাবস্থায় ত্বকের এবং বাহ্য বিধান সকলের রক্ত প্লীহাতে সঞ্চিত হয় এবং দাহ কালীন ঐ রক্ত আবার স্বস্থানে প্রত্যাগত হয়। এইরূপ নিয়ত হইতে থাকিলে প্লীহার স্থিতি স্থাপকতা ক্রমশঃ বিনষ্ট হইতে থাকে এবং প্লীহাতে রক্ত অবরুদ্ধ হয়। এজন্য প্লীহার রক্তাবরোধ চিকিৎসা করিতে হইলে অগ্রেই জ্বর দমন করিতে হইবে। জ্বর কিছু দিন না হইতে পাইলে রক্তাবরোধ বিদুরিত এবং প্লীহা স্বাভাবিক কলেবর প্রাপ্ত হইয়া থাকে। যদি রক্তাবরোধ বশতঃ প্লীহার আয়তন অধিক বৃদ্ধি না হইয়া থাকে তাহা হইলে—

কুইনিন সল্‌ফ ৫ গ্রেণ
এসিড নাইট্রিক ডাং ২০ বিন্দু
টিংচরসিন্‌কোনা কোং ১॥ ড্রাম
লাইকর্ ষ্ট্রীক্‌নিয়া ৪ মিনিম্
ডিকক্‌সন্ সিন্‌কোনা ৩ আউন্স

একত্রিত করিয়া অর্দ্ধ ছটাক পরিমাণ, দিবসে তিনবার করিয়া কিছু দীর্ঘ কাল সেবন করিলে বিশেষ ফল দর্শে। এই ঔষধি সেবনে প্লীহার রক্তাবরোধ সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়। এমন দেখা হইয়াছে যে সলফেট্ অফ্ আয়রণ্ অর্থাৎ হিরাকশ, কুইনাইন, কলম্বা প্রভৃতি যেখানে কিছুই করিতে পারে নাই, ইহা তথায় বিশেষ সুখ্যাতিলাভ করিয়াছে।

 কিন্তু সচরাচর লৌহঘটিত ঔষধ ব্যবহারে আশাতীত ফলপ্রাপ্ত হওয়া যায়। এ জন্য লৌহই এই ব্যাধির একটী প্রধানতম ও উৎকৃষ্ট ঔষধি বলিয়া প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছে। প্লীহার রক্তাবরোধ এবং বিবৃদ্ধতা কিছু দীর্ঘকাল স্থায়ী হইলে রক্তের শোনকনা (red corpuscles) সমূহের লৌহের পরিমাণের ন্যূনতা হয়। এ জন্য লৌহ প্রয়োগের আবশ্যকতা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে। লৌহ ঘটিত ঔষধির মধ্যে সল‍্ফেট অফ আয়রনে যেমন উপকার পাওয়া যায় এমন আর অন্য কোন প্রকার লৌহেতেই নয়। বিরেচক সহযোগে ইহার কার্য্যকারিতার বৃদ্ধি হইয়া থাকে। বিরেচক ঔষধ রক্তের জলীয়াংশের পরিমাণ হ্রাস করে। এজন্য রক্তরসের (Plasma) আপেক্ষিক গুরুত্ব বৃদ্ধি হয় এবং অন্তর্ব্বাহ ক্রিয়া দ্বারা শোনকনা সকলের জলীয় হিম্যাটিন্ পরিত্যক্ত হইয়া উহার স্থানে অপেক্ষাকৃত ঘনরক্তরস সন্নিবেশিত হয়। শোনকনা সকল এইরূপে অন্ত্ররস (chyle) অপেক্ষা ঘনতর রস প্রাপ্ত হওয়ায় অন্তর্ব্বাহ ক্রিয়া দ্বারা লৌহসংযুক্ত রস (chyle) আচোষণের উপযোগী হয়। বিরেচক সংযোগের আরো একটী গুণ এই যে লৌহ ব্যবহারে যে মলবদ্ধ হয় তাহা ইহা নিবারণ করে। কিন্তু তাই বলিয়া নিয়ত বিরেচক প্রয়োগ করা উচিত নয় কারণ তাহাতে পরিপাক শক্তির হ্রাসতা জন্মে। প্লীহার রক্তাবরোধ এবং বিবৃদ্ধতা এতদুভয়েই সলফেট্ অভ আয়রণের ফলোপধয়িতা লক্ষিত হইয়াছে। নিম্নলিখিত প্রণালীতে ইহা প্রয়োগ করিলে মহোপকার সংসাধিত হয়।

ফেরি সল‍্ফ ১ গ্রেণ
কুইনি: সল্‌ফ ১ গ্রেণ হইতে ৩ গ্রেণ
এসিড: সল্‌ফ ডাং ১০ বিন্দু
টিংচার কলম্ব ৩০ বিন্দু
ম্যাগ্‌নেসিয়া: সল্‌ফ ১ ড্রাম
ইন্‌ফিউজন্‌ কোয়াসিয়া ১ আউন্স

একত্রে মিশ্রিত কর। ইহা একমাত্রা। প্রতি দিবস এইরূপ তিন মাত্রা সেবন করিবে।

 প্লীহার বিবৃদ্ধতায়ও উক্ত ঔষধ ব্যবহার্য্য। ইহাতে ব্রোমাইড অফ পটাসিয়ম্ বিশেষ উপকারী। নিম্নমত প্রণালীতে আমি ইহা ব্যবহার করিয়া থাকি

ফেরি: এট্‌ কুইনি: সাইট্রাট: ৬ গ্রেণ
পটাসি ব্রোমিড ১০ গ্রেণ
লাইকর ষ্ট্রীকনিয়া ২ মিনিম্
টিংচার: জেন্সিয়ান্ কোং ৪০ বিন্দু
জল ১ আউন্স

ইহা একমাত্রা। এইরূপ দিবসে তিনবার সেবন করাইতে হইবে। এই ঔষধ সেবনের সঙ্গে সঙ্গে কম্পাউণ্ড অয়েণ্টমেণ্ট অফ আয়ডিন্ প্লীহার উপর মালিস করিলে পীড়া শীঘ্রই প্রশমিত হয়।

 ম্যালেরিয়া হইতে যকৃতের যত প্রকার পীড়া উৎপন্ন হয় তাহার মধ্যে উহার তরুণোগ্র ক্ষয় (acute atrophy of the liver) অতি ভয়ানক এই পীড়া যকৃত মধ্যে দৃঢ়রূপে সংস্থিত হইলে আর কিছুতেই নিস্কৃতি নাই। ইহাতে যকৃৎকোষ অতি সত্বরে সম্পূর্ণরূপ বিনষ্ট হইয়া যায় এজন্য পিত্ত নিঃস্রব ক্রমশঃ রুদ্ধ হইয়া রক্ত দূষিত হয়। অবসাদ, ভ্রম, প্রলাপ, বিকম্প, কোমা অর্থাৎ অচৈতন্য এবং মৃত্যু অতি শীঘ্র সংঘটিত হয়। চিকিৎসার দ্বারা কিছুমাত্র ফল প্রাপ্ত হওয়া যায় না। অতি বিরেচক পার্থিবাম্ল (mineral acids) এবং অবসাদ কালীন অস্থায়ী উত্তেজক (diffusible stemulant) কুইনাইন, বরফ, শীতল পান প্রভৃতি ব্যবহৃত হইয়া থাকে কিন্তু কিছুতেই উপকার দর্শে না।

 যকৃতের রক্তবরোধ—ইহা দ্বিবিধ; উদযুক্ত অর্থাৎ য়্যাকটিব এবং অনুদ‍্যুক্ত অর্থাৎ প্যাসিব্। উদযুক্ত রক্তাবরোধে যকৃতের কৈশিক ঝিল্লী এবং অনুদযুক্ত রক্তাবরোধে হিপ্যাটিক এবং পোট্যাল শীরা পীড়িত হইয়া থাকে। ম্যালেরিয়া দ্বারা উদযুক্ত রক্তাবরোধই সচরাচর সংঘটিত হয়। যকৃতের উপর ভার, এবং পূর্ণতানুভব; ঐ গ্রন্থির অল্প আয়তন বৃদ্ধি; দক্ষিণ স্কন্ধে বেদনা; শীরবেদনা এবং ক্ষুধা মান্দ; মানসিক অবসাদ; বমনেচ্ছা; অন্ত্র সমূহের জড়তা এবং পিত্তমিশ্র ভেদ প্রভৃতি লক্ষণ সকল এই পীড়ায় উৎপন্ন হইয়া থাকে। চিকিৎসা করণে অমনোযোগী হইয়া রোগী যদ্ইচ্ছা অত্যাচার করিলে যকৃতের প্রদাহ উপস্থিত হইয়া মৃত্যু হইতে পারে।

 চিকিৎসা-লাবণীক বিরেচক বিশেষতঃ সল‍্ফেট অফ সোডা এবং সল‍্ফেট অব ম্যাগনেসিয়া একত্র সেবনে প্রথমাবস্থায় যেমন উপকার দর্শে এমন আর অন্য কোন প্রকার বিরেচক দ্বারা হয় না। সলফেট অব, সোড়া ১ ডাম্সলফেট অব ম্যাগনেসিয়! ২ ডাম, লাইকর টেরাকৃসিক ৩০ মিনিম, কলম্বের ফণ্ট ১ আউন্স একত্র মিশ্রিত করিয়া প্রতিদিন প্রাতে সেবন করিলে মহোপকার সাধিত হয়। ইহার দ্বারা ধমণীসকলের রক্তের জলীয়াংশ বিনিঃসৃত হইয়া স্বাভাবিক অবস্থা প্রাপ্ত হয়। পড়ফিলিস্ ও নাইট্রোহাইড্রক্লরিক্ অম্ল ও এ পীড়ার পক্ষে মঙ্গলকর ব্যবস্থা। নির্ম্মল বায়ু সেবন, পরিমিত দৈহিক পরিশ্রম এবং সামান্য পুষ্টিকর খাদ্য। ভক্ষণ নিতান্ত আবশ্যক। যকৃতের রক্তবরোধ দীর্ঘকাল। স্থায়ী হইলে ইহার বিবৃদ্ধ ঘটিতে পারে। মেলেরিয়া ক্রান্ত প্রদেশ সমূহে ইহা সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয়। আয়ডাইড অফ পটাসিয়ামের সহিত বলকারক ঔষধ। সেবন এবং যকৃতের উপর কম্পাউণ্ড আয়ডি ওয়্যাট মেণ্ট, মালিস, দ্বারা পীড়া অনেক প্রশমিত হয়।

 কৃতের প্রদাহ হইলে লাবনীক বিরেচক দ্বারা প্রথমাবস্থায় অস্ত্রসমূহ পরিষ্কার রাখা নিতান্ত আবশ্যক। তদনন্তর রোগীকে সম্পূর্ণরূপে দৈহিক ও মানসিক বিশ্রাম লইতে আদেশ করিতে হইবে। স্থির ভাবে উত্তান শয়ন করিয়া থাকিলে আরও ভাল হয়। যকৃত প্রদেশে লাই করলিটী প্রয়োগ দ্বারা ফোস্কা উত্তোলন করায় উপকার। দর্শে। হাইড্রোক্লোরেট, অফ, য়্যামনিয়া অর্থাৎ নিসাদল দশ হইতে বিশ গ্রেণ মাত্রায় দিবসে তিন কিম্বা চারি বার সেবনে আশাতীত ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। কেবল মাত্র যকৃত প্রদাহে নিসাদল এক প্রকার বিশেষেষধ। (Specific) এমন কি যকৃতে পুযাধান (Suppuration) আরম্ভ হইলেও ইহা সেবনে প্রদাহ প্রশমিত হয়। ইহা যকৃতের প্রদাহ নাশক এবং প্রদাহোৎপাদিত পদার্থ সমূহের উপরও ইহার কার্যকারিতার বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়। কেবল মাত্র পরিবর্তক (alterative) বলিলে কেবল ইহার সাধারণ গুণ ব্যক্ত করা হয় বিশেষ গুণ তদ্বারা প্রকাশিত হয় না এজন্য প্রদাহনাশক বলিয়া ইহা এখানে অভিহিত হইল। যখন দেহস্থ অন্য কোন যন্ত্র পীড়িত না হইয়া কেবল মাত্র যকৃতের প্রদাহ বর্ত্তমনি থাকে, তখনই ইহার ফলেপকারিতার বিশেষ পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। যকৃতের প্রদাহে ইহা এক প্রকার অব্যর্থ ঔষধ বলিলেও বড় অত্যুক্তি হয় না। ইহার আর একটী গুণ এই যে দীর্ঘকাল সেবনে অন্যান্য পরিবর্তকের ন্যায় ইহা রক্তকে অধিকতর তরল ও দেহকে দূষিত করে না। প্রাচীন প্রদাহে ও বিবৃদ্ধতায়ও ইহা ব্যবহার্য। মাত্রা ৫ হইতে ২০ গ্রেণ।

 অন্যান্য ঔষধ(১) য়্যালোজ, এবং জেন্সিয়ানের সহিত অল্প মাত্রায় ইপিকাকুয়ানা। (২) ডাইলিউট, নাইট্টহাইডোরিক এসিডের সহিত লাইকর ট্যারেক্সকম ও কলম্ব ফণ্ট। (৩) সোডওয়াটার এবং এসিভ টারটারেট, অফ পটাসের পান। (৪) পডফিলিন, রেজিন গ্রেণ, ইপিক্যাক্ ১/২ গ্রেণ, জেনসিয়ে ৩ শ্রেণ একত্র মিশাইয়া একটি বটিকা প্রস্তুত হইবে, এই রূপ দিবসে ৩ টি সেবন। (৫) যকৃত স্থানে নাইট্টহাইড্রোক্লরি লোসন অর্থাৎ ধাবন প্রয়োগ। (৬) রক্তামশয় থাকিলে পভ ইপিক্যা কম ও পিত, অহিফেন এবং সংকোচক ঔষধ।

 প্রদাহ বৃদ্ধি হইয়া কখন কখন যকৃতে প্যাধান হয় অর্থাৎ যকৃত পাকিয়া যায়। এরূপ ঘটনা ম্যালেরিয়াক্রান্ত প্রদেশ সমূহে সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়। কেবল মাত্র ম্যালেরিয়া দ্বারা, সঙ্গতিপন্ন ব্যক্তিদিগের এ পীড়া উৎপন্ন হইতে সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়।; কিন্তু যে সমস্ত দুঃখী ব্যক্তিরা অবশ্যকীয় ব্যয়কর পথ্য ও উপযুক্ত চিকিৎসা প্রাপ্ত হয় না তাহাদেরই মধ্যে ইহা মধ্যে মধ্যে লক্ষিত হয়।

 সুরাপান জনিত যকৃতে যে পুঁযাধান হয় তাহা যেমন সাংঘাতিক ম্যালেরিয়েৎপাদিত পুঁযাধান তেমন নহে। রোগীর বল থাকিলে প্রায়ই আরোগ্য হইয়া থাকে।

 চিকিসা— বলকারক পথ্য, কারবনেট, অফ এমোনিয়া ও ডিকসন, সিন্‌কোনা; নাইটোমিউরিয়াটিক এসিড, কুইনাইন এবং সিনকোনা; পোর্ট, এবং মাংসের জুস যথেষ্ট পরিমাণে; পুয স্থির নির্ণিত হইলে টোকায়ূ ও ক্যানুলার দ্বারা স্ফোটক বিদ্ধ করিয়া পুঁয বহিস্কৃত করিয়া দেওয়া। টোকার প্রয়োগ করিবার পুর্বে জ্ঞাত হওয়া উচিত যে নিশ্চয় পুঁয হইয়াছে। তদনন্তর এক্স্ প্লোরিং নিডিল দ্বারা স্ফেটিক পরিক্ষা করিয়া তদভ্যন্তরে টোকার নিক্ষেপ করিতে হইবে। অধুনা স্পাইরমেট যন্ত্র হইয়া অনেক সুবিধা হইয়াছে। পুয বহিষ্কৃত করিয়া দেওয়ার পর নিম্ন লিখিত ঔষধি দ্বারা বিশেষ উপকার প্রাপ্ত হওয়া যায়।

 টিংচর ফেরি মিউরিয়ট  ৫ বিন্দু

 কুইনি সল্ফ ১ গ্রেণ

 এসিড, নাইট্রো: হাইড়ে।: ডাইলিউট,  ৫ বিন্দু,

 স্পিরিট ক্লোরোফর  ১০ বিন্দু

 টিং চর কলম্বা  ১/২ ভূমি

 জল  ১ আউন্স

 অর্ধ ছটাক পরিমাণ দিবসে তিন বার।

 গ, চ, পরামাণিক ১৮৭৩ সালের ২৬শে অক্টোবর মাসে শুলতানগাছার চিকিৎসালয়ে ভর্তি হয়। বয়ঃক্রম ২৬ বৎসর, শরীর অতি শীর্ণ, দেখিতে কেবল চর্মাবৃত কঙ্কাল মাত্র। যকৃতের স্ফোটফু এবং কচুয়েশন অর্থাৎ সন্দোলন, পাকশিয়ের কার্য বৈলক্ষণ্য, শীত বিহীন কম্প, মুখ পাও বর্ণ, পুঁয জ্বরের (Hectiofever) লক্ষণ সমস্ত স্পষ্ট চিহ্নিত ছিল। ২৭ অক্টোবর, ট্টোকার দ্বারা পুয বাহির করা হইল। পুঁয বহিষ্করণের পর রোগী অনেক সুস্থ হইল। শয্যা হইতে উথিত হইতে এবং পার্শ্ব পরিবর্তন করিতে বিশেষরূপে নিষেধ করা হইল। পথ্যের মধ্যে কেবল দুগ্ধ প্রতি দিবস দুই সের। পুয সঞ্চিত হইয়া আবার যন্ত্রণা উপস্থিত হওয়ায় তিনদিবস পরে পুনরায় পুর্ব্বমতে টোকার দ্বারা ২৪ আউন্স প্য বাহির করিলাম। এক্ষণ হইতে প্রতিদিন প্রাতে এবং বৈকালে ৮ শ্রেণ করিয়া নিশাদল এবং তিন বার করিয়া উল্লিখিত টিংচর ফেরি মিউরিয়াট, মিক্সচর সেবন করিতে দেওয়া হইল। দুই মাস পরে রোগী আরোগ্য হইয়া বিদায় লইল। আমার রোগ বিবরণ পুস্তক হইতে এইটী সংক্ষেপে অনুবাদ করিয়া দিলাম।

 প্লীহার রক্তবরোধ ও প্রদাহ হইতে ক্রমশঃ উহার বিবৃদ্ধতা এত বৃদ্ধি হয় যে প্রায় সমস্ত উদরগহর (abdo. ninal cavity) উহা দ্বারা পরিপূর্ণ হয়। যকৃতের এক প্রকার প্রাচীন (chronic) প্রদাহ বা বিবৃদ্ধতা (hypertr0 phy) ইহার আনুষঙ্গিক। প্লীহা ও যকৃতের এইরূপ দৈনিক অবস্থা উপস্থিত হইলে এক প্রকার মৃদু স্বল্প বিরাম জ্বর দিবা রাত্র ভোগ হইতে থাকে এবং দৈহিক অবসাদ ও মানসিক নিস্তেজতা দিন দিন বৃদ্ধি হয়। এ অবস্থায় ঘর্ম্মকারক ও মূত্রকারক ঔষধি প্রভৃতি দ্বারা জ্বর নিবারণ করিতে চেষ্টা করা দুরাশা মাত্র। এরূপ ব্যবস্থা দ্বারা কোন মঙ্গল না হইয়া বরং অনিষ্ট সাধিত হয়। অতএব এরূপ অবস্থায় এই সমস্ত ঔষধের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ তজ্জনিত দুর্বলতা ও অবসাদ বৃদ্ধি হইয়া মুখরোগ ও মৃত্যু শীঘ্রই উপস্থিত হয়। মাংস, মৎস্য, দুগ্ধ প্রভৃতি বলকারক পথ্য এবং লৌহঘটিত ঔষধি এ অবস্থায় ফলদায়ক। উল্লিখিত টিংচার ফেরি মিউরিয়াটিক মিশ্চ ব্যবহারে বিশেষ উপকার প্রাপ্তি হওয়া যায়। ক্ষেতপাপড়া, চিরেতা এবং গুলঞ্চের ডিকনের সহিত কারবনেট অফ আয়রণ,, এবং মধ্যে মধ্যে সলফেট, অফ ম্যাগনেশিয়া ও লাইকর ট্যারেসেকম্ কলম্বফণ্টের সহিত সেবনে আশু উপকার দর্শে।

 শোথ দ্বিবিধ, স্থানিক (local) এবং ব্যাপ্ত (general) স্থানিক শোথ যখন উদরগর মধ্যে পর্যবসিত হয়। তখন উহাকে জলোদরি কহে। যকৃতের বৈধানিক পীড়া { Structural disease) এবং প্লীহার অতিরিক্ত বিবৃদ্ধতা বর্তমান থাকিলে ইহা সংঘটিত হয়। কিছু দীর্ঘকাল স্থায়ী হইলে উহা কেবল উদর গহবর মধ্যে আবদ্ধ থাকে পদ বয়ের রন্ধ,ময় বিল্লীর (areolar tissue) জামধ্যে মাস্তুক রস নিঃসৃত হইয়া থাকে। ব্যাপ্ত শোথে উদর গহ্বর মধ্যে মাস্তুক রস যত থাকুক না থাকুক সমস্ত দেহের রন্ধ ময় ঝিল্লীতে উহা বিনিঃসৃত হইয়া থাকে। চিকিৎসা—দুগ্ধ শোথের একটী উৎকৃষ্ট ঔষধ। ইহার ন্যায় শোথের আর দ্বিতীয় ঔষধি নাই বলিলে কিছু মাত্র অত্যুক্তি হয় না। ব্যাপ্ত শেথ গ্রস্ত রোগী খাটী অর্থাৎ নির্জলা দুগ্ধ ভিন্ন যদি অন্য কোন প্রকার খাদ্য কিম্বা পানীয় ভক্ষণ বা পান না করে তাহার শোথ দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়। যদি রোগী সবল থাকে বকু, নাইট্রিক ইথর, নাইট্রেট, ও আসিটেট, অফ পটাস, কম্পাউণ্ড ইস্পিরিট আফজুনিপার, লিন্‌সিডটি প্রভৃতি মূত্রকারক ঔষধি ব্যবস্থা করা যাইতে পারে এবং এতদ্ব্যবহারে শোথ শীঘ্র উপশম হয়। ডিকক্স বকুর সহিত, মিউরিয়েট অফ এমনিয়া সেবনে অনেক সময় অপূর্ব ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই সমস্ত ঔষধ দ্বারা শেথ আরোগ্য হইলেও শেথের প্রকৃত কারণ অপসারিত না করিতে পারিলে পুনর্বার শোথ প্রকাশিত হইতে পারে। যকৃতের বিধান বিশেষ দোষিত কিম্বা বিনষ্ট হইলে শোথ একেবারে আরোগ্য হয় না, এবং রোগীও মৃত্যু গ্রাস হইতে নিষ্কৃতি পায় না। যদি জলোদরি প্রযুক্ত উদর অত্যন্ত স্ফীত হইয়া রোগী অত্যন্ত যন্ত্রণা ভোগ করিতে থাকে এবং শয়ন করিতে অক্ষম হয়। অথচ রোগী সবল ও তাহার হৃদূপিণ্ড ব্যাধিশূন্য থাকে ট্টোকার ক্যানুলার দ্বারা উদরবেধ (Paracentises abdominis) করিয়া জল বহিষ্কৃত করিয়া দিলে তৎক্ষণাৎ সমস্ত যন্ত্রণা উপশম হয় এবং যকৃতের বৈধানিক বিশেষ কোন পীড়া না থাকিলে টিংচর অফ ষ্টীল আদি বলকারক ঔষধ দ্বারা পীড়া সম্পূর্ণ আরোগ্য হইতে পারে। শুলতানগাছার চিকিৎসালয়ে দুইটী ব্যাপ্ত শোথ গ্রস্ত রোগী ট্যাপ করিয়া এবং তদুপরে টিংচর অফ ষ্টীল দ্বারা আরোগ্য করা হয়। এই দুইটী রোগীর শোথ এরূপ ভয়ানক ও যন্ত্রণাদায়ক হইয়াছিল যে অশু উদরবেধ দ্বারা উদর গহবরস্থ জল বহিষ্কৃত করিয়া না দিলে দুই এক দিবসের মধ্যেই মৃত্যু গ্রাসে পতিত হইত।

 শোথ অন্যান্য নানা কারণে উৎপন্ন হইতে পারে কিন্তু যাহা ম্যালেরিয়া সম্ভত তাহারই চিকিৎসা এস্থলে সংক্ষেপে বর্ণিত হইল।

 মুখরোগ (cancrum-oris) ইহা অতি ভয়ানক পীড়া এবং ইহার মৃত্যু সংখ্যাও অধিক। প্লীহা কিম্বা যকৃতের বিবৃদ্ধতা প্রযুক্ত দৈহিক অবসাদ সংঘটিত হইলে ম্যালেরিয়াক্রান্ত প্রদেশে ইহা সচরাচর দৃষ্টি গোচর হয়। ইহা গণ্ডের এক প্রকার কোথ (Gangrene)

 চিকিৎসা-ক্ষত স্থানে নাইট্রেট, অফ সিলভার এবং কখন কখন নাইট্রিক এসিড, প্রয়োগ, কারবলিক্ এসিড ধাবন ও কন্‌ডিস্ সলিউসন, দ্বারা কুল্লি বা পিচকারি করিলে উপকার দর্শিতে পারে। ডিকসন সিকোনার সহিত কারবলিক এসিড পিচকারি করিলে অধিকতর ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। ইহার সঙ্গে মধ্যে মধ্যে ক্লোরেট অফ পটাস ও জল মিশ্রিত ব্রাণ্ডির কুলিও মন্দ নয়। গণ্ড ফুটিয়া গেলে কাবলিক এসিড পিচকারি ও কাবলিক অইল প্রয়োগ এবং টিংচর অফ ষ্টীল সেবন করিলে অনেক উপকার হইবার সম্ভাবনা। বাহ্য প্রয়োগের সহিত অভ্যন্তরিক সেবনীয় ঔষধির বিশেষ প্রয়োজন। ব্রাণ্ডি, এমনিয়া, সিনকোনা, অল্প মাত্রায় কুইনাইন এবং ক্লোরেট অল্পটাশ ও নাকটিক এসিড আভ্যন্তরিক ব্যবহার যোগ্য। টিংচর ফেরি পারক্লোরিড় ইহার সর্বোৎকৃষ্ট ঔষধি। নিম্নলিখিত মত আমি ইহাকে ব্যবহার করি।

 টিং ফেরিমিটরিয়াট  ১০ বিন্দু

 কুইনি সালফ  ১ গ্রেণী

 টিং জেনসেন, কম্পাউণ্ড  ৩০ বিন্দু

 স্পিরিটঃ ক্লোরোফর  ১৫ বিন্দু

 লাইকারঃ ষ্ট্রিকনিয়া  ১ বিন্দু

 জল  ১ আউন্স

 ইহা এক মাত্রা। এই রূপ দিবসে তিন মাত্রা সেবন করাইবেক।

 ডিম্ব, মাংস এবং বিশেষতঃ দুগ্ধ এই পীড়ার সুপথ্য। দুগ্ধ রোগী যত পারে পান করিবে।

 তরুণোগ্রি রক্তামসির চিকিৎসা—এই পীড়ার প্রথমাবস্থায় অন্ত্রস্থ শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর উদ্বিপনা ও প্রদাহ প্রশমিত করিতে চেষ্টা করিতে হইবে এজন্য স্নিগ্ধকারক (demuleents) পানীয় পদার্থ প্রচুর পরিমাণে সেবন করিতে দিতে হইবেক। সাগু, এরারুট, দুগ্ধ, মাংসের জুস প্রভৃতি লঘু পথ্য ব্যবহার্য্য। যদি অন্ত্র মধ্যে গুটলি বদ্ধ থাকে ক্যাস্টর অয়েল দ্বারা অন্ত্র পরিষ্কৃত করিতে হইবেক। এরূপে অন্ত্রের উগ্রতা ও উদ্দীপকত কিছু উপশম হইলে ইপিক্যাকুয়ানা ব্যবহার দ্বারা বিশেষ ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। ইপিক্যাকুয়ানা তরুগ্রে রক্তামাশার অদ্বিতীয় ঔষধ বলিলেও কিছু মাত্র অত্যুক্তি হয় না। আত্রায় ইহা বমনকারক কিন্তু অধিক মাত্রায় সচরাচর বমন হয় না। প্রদহিত অস্ত্রের শ্লেষ্মা নিঃসরণ এবং যকৃৎ ও অন্ত্রের কৈশিক নাড়ীর রক্ত সঞ্চালন প্রকৃতিস্থ করিয়া ইহা উপকার প্রদর্শন করে। ক্লোরাইন, ১৫ মিনিম কিম্বা ২ গ্রেণ অহিফেন ইপিক্যাকুয়ানা প্রয়োগের ২০ মিনিট পূর্বে সেবন করাইতে হইবে। এতৎ সেবনে ইপিকাকুয়ানার বমনশক্তি নিবারিত হয়। উত্তপ্ত তিশির পুলটিসের উপর এক কিম্বা দুই চামচ মসটার্ড ছড়াইয়া দিয়া উহা উদরোপরি প্রয়োগ করিতে হইবে। তদনন্তর ৩০ হইতে ৪০ গ্রেণ ইপিক্যাকুয়ানা এক মাত্রায় মিউসিলেজ জলের সহিত সেবন করাইলে রোগী প্রায় আরোগ্য হয় এবং দ্বিতীয় মাত্রার আবশ্যক হয় না। যদি আবশ্যক হয়, ৬, ১১ কিম্বা ২৪ ঘণ্টা পর একবার মাত্র দিবে।

 যদি প্রদাহ বর্ধিত হইয়া বিধানোপাদন সমূহ বিকৃত হইয়া পড়ে তাহা হইলে পীড়িত বিধান (Structures) সকলকে যথাসাধ্য বিশ্রাম দিতে ও রোগীকে সবল রাখিতে হইবে। এজন্য প্রথমতঃ ইপিকাকুয়ানা তদপর বলকারক, সঙ্কোচক এবং অহিফেন ঘটিত ঔষধ সমস্তের উপর নির্ভর করিতে হইবে। যদি রোগী অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়ে, স্যালিস, কুইনাইন, সিন্‌কোনা, কসকেরিলা এবং দুগ্ধ সাগু, অসিদ্ধ অণ্ড, মাংসের জুস প্রভৃতি ব্যবহারে উপকার দর্শে। বেল এবং কুরচি এ পীড়ার দুইটিমহৌষধ। ম্যালেরিয়া উৎপাদিত স্নায়ুশূল এবংঅপআর রোগ কুইনাইন সেবনে আরোগ্য হয়। সম্প্রতি একটি অপম্মার গ্রস্থ রোগীকে কুইনাইন সেবন করাইয়া আরোগ্য করিয়াছি। ব্রোমাইড অব পট্যাসিম, য্যাসফেটিড। জিঙ্ক প্রভৃতি দীর্ঘকাল ব্যবহারে ও ইহার কিছুমাত্র উপকার দর্শে নাই বরং উত্তরোত্তর পাড়া বৃদ্ধি। হইয়াছিল। কুইনাইন প্রয়োগ করিবার পূর্বে রোগীর অবস্থা ক্রমশঃ এরূপ হইয়াছিল যে দিবা রাত্রের মধ্যে ৩০। ৩৫ বার মূচ্ছা ও আক্ষেপ হইত এবং কোন কোন দিন আক্ষেপ আরম্ভ হইয়া ২৪ হইতে ৩০ ঘণ্টা পর্যন্ত। অবস্থিতি করিত। এ সময়ের মধ্যে রোগীকে জয় | পর্যন্ত পানি করা যাইত না। যে দিবস হইতে কুই নাইন প্রয়োগ করিতে আরম্ভ করা হইল সেই দিন। হইতেই পীড়া উপশম হইতে লাগিল এবং একমাসের মধ্যে রোগী আরোগ্যলাভ করিল কুইনাইন ভিন্ন যে হয়, আরোগ্য হইবার অন্য কোন উপায় ছিল না।


সম্পূর্ণ।


PRINTED BY B. P. Y. AT THE B. P. M's PRESS,
No. 22 Jhamapooker Lane, Calcuta.

  1. কম্পাউণ্ড ডিক্‌সন্ অফ নিম এই মত প্রস্তুত করিবে—নিম ছালের ভিতরকার শ্বেত বর্ণ সূক্ষ্ম পর্দা ছাল ১ ড্রাম্ গুলঞ্চ ১ অউন্স, ক্ষেত পাপড়া ১ অউন্স, চিরতা ১ অউন্স, ধনে ১ অউন্স, পল্‌তা ১ ভরি, জল ১৬ অউন্স। একত্রে সিদ্ধ করিয়া ৪ অউন্স থাকিতে নামাইয়া লইবে।