বিষয়বস্তুতে চলুন

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র/অষ্টম পত্র

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পত্র

আমি বিলিতি মেয়েদের একটু নিন্দে করে লিখেছিলুম বলে বুঝি সেটা ভালো লেগেছে! কিন্তু আমি সেটা কেবল এক শ্রেণীর মেয়েদের একটা ভাগ দেখিয়েছিলুম মাত্র, তাঁরা হচ্ছেন fashionable মেয়ে, তাঁদের দোরস্ত করতে হলে দিন দুই আমাদের দিশি শ্বাশুড়ির ও ঘরের বিধবা ননদের হাতে তাঁদের রাখতে হয়। তাঁরা হচ্ছেন বড়োমানুষের মেয়ে কিম্বা বড়োমানুষের স্ত্রী— তাঁদের চাকর আছে, কাজ কর্ম করতে হয় না— একজন house-keeper আছে, সে বাড়ির সমস্ত ঘরকন্না তদারক করে একজন nurse আছে, সে ছেলেদের মানুষ করে— একজন governess আছেন (governess ভদ্রলোকের মেয়েদের থেকে নেওয়া হয়) তিনি ছেলেপিলেদের পড়াশুনো দেখেন ও অন্যান্য নানাবিধ তদারক করেন। তবে আর তাঁর পরিশ্রম করার কী রইল বলো! কেবল একটা ঘোরতর পরিশ্রম বাকি আছে— সেইটে তাঁর দিনের মধ্যে সকলের চেয়ে প্রধান পরিশ্রম, অর্থাৎ সাজসজ্জা করা। কিন্তু তার জন্য তাঁর lady's maid আছে, সুতরাং এমন সাধের পরিশ্রমটাও সমস্তটা তাঁকে নিজের হাতে করতে হয় না। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত দিনটা তাঁর হাতে আস্ত পড়ে রয়েছে। সকাল বেলায় বিছানায় প’ড়ে, দরজা জানালা বন্ধ ক’রে সূর্যের আলোক আসতে না দিয়ে, দিনটাকে কতকটা সংক্ষেপ করেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে break-fast খান ও এগারোটার আগে শয়নগৃহ থেকে বেরোলে যথেষ্ট ভোরে উঠেছেন মনে করেন। তার পরে সাজসজ্জা— সে বিষয়ে তোমাকে কোনো প্রকার খবর দিতে পারছি নে। শোনা যায় খুব সম্প্রতি বিলেতে স্নানটা fashion হয়েছে, কিন্তু fashionটা খুব কম দূর ব্যাপ্ত হয়েছে। সীমন্তিনীরা হাতের যতটুকু বেরিয়ে থাকে, মুখটি ও গলাটি, দিনের মধ্যে অনেকবার অতি যত্নে ধুয়ে থাকেন। বাকি অঙ্গ পরিষ্কার করবার তাঁরা তত আবশ্যক দেখেন না, কেননা মনোহরণের প্রধান সিঁধ মুখটিতে কোনো প্রকার মরচে না পড়লেই হল। মাসে দুবার একটা sponge-bath নিলেই তাঁরা যথেষ্ট মনে করেন; sponge bathএর অর্থ হচ্ছে একটা ভিজে স্পঞ্জ্ দিয়ে গা সাফ করে ফেলা, অর্থাৎ একটা ভিজে গামছা দিয়ে গা মোছা আর কী। আমি একটা ইংরেজ পরিবারের মধ্যে বাস করতে গিয়েছিলেম, তাঁরা আমি স্নান করি শুনে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের কোনো প্রকার স্নানের সরঞ্জাম ছিল না। সমস্ত আমার জন্যে ধার করে আনতে হয়েছিল, এমন বিপদ! যা হোক, আমাদের বিলাসিনী স্নান করলেন কি না বলতে পারি নে, তার পরে তাঁর সাজ সজ্জার বিষয়ে আমি নিতান্তই অনভিজ্ঞ। কাপড়ের এখানে একটু ফিতে, ওখানে একটু পাড়, কোথাও একটু এলোমেলো করে দেওয়া, কোথাও একটু পিন দিয়ে আটকে রাখা। কত প্রকার টুকরো-টুকরো জিনিসপত্র এঁটেসেঁটে, মুখে কত প্রকার রঙচঙ লেপে, মনোদুর্গ আক্রমণের জন্য যথাযোগ্য যুদ্ধসজ্জা সমাপ্ত হয়। তার পরে এই রকম বাহারে সাজ-সজ্জায় এক বান্‌ডিল রূপের মতো drawing-roomএর (অভ্যর্থনাশালার) কৌচে গিয়ে বসলেন; বাড়িতে লোক দেখা করতে এলে তাদের সঙ্গে আলাপচারি করা হচ্ছে তাঁর কাজ। অনেক লোক একসঙ্গে এলে তাঁর কর্তব্য হচ্ছে— তাঁর বাক্য ও হাসির অমৃত সকলকে সমানভাবে বিতরণ করা, বিশেষ কারও সঙ্গে বেশি কথা কওয়া বা বিশেষ কাউকে বেশি যত্ন করা কোনোমতে উচিত নয়। এ কাজটা অত্যন্ত দুরূহ, বোধ হয় অনেক অভ্যেসে দুরস্ত; হয়। আমি লক্ষ্য করে দেখি তাঁরা কী করে এ কাজ সিদ্ধ করেন। আমি দেখেছি তাঁরা একজনের মুখের দিকে চেয়ে একটা কথা কন, তার পরে শেষ করেই সকলের দিকে চেয়ে একবার হাসেন; কখনো বা তাঁরা একজনের মুখের দিকে চেয়ে একটা কথা আরম্ভ করেন, তার পর বলতে বলতে এক-এক বার করে সকলের মুখের দিকে চেয়ে নেন; কখনো বা তাস খেলবার সময় যে রকম করে চট‍্পট্ তাস বিতরণ করে তেমনি তাঁরা আগন্তুকদের একে একে করে একটি একটি কথার টুকরো ছড়িয়ে ছড়িয়ে দেন, এমন তাড়াতাড়ি ও এমন সহজে করেন যে তাঁদের হাতে যে অনেক কথার তাস গোছানো রয়েছে তা সহজেই বোঝা যায়। একজনকে বললেন: Lovely morning, isn't it? তার পরেই তাড়াতাড়ি আর-একজনের মুখের দিকে চেয়ে বললেন: কাল রাত্তিরে সংগীতশালায় মাডাম নীল্‌সন গান করেছিলেন, it was exquisite! যতগুলি মহিলা visitor বসেছিলেন সকলে ঐ কথায় এক-একটা বিশেষণ যোগ করতে লাগলেন— একজন বললেন ‘oh charming’, একজন বললেন ‘superb’, একজন বললেন ‘something unearthly’, আর একজন বাকি ছিলেন তিনি বললেন ‘isn’t it’। এই রকম সর্বদিক‍্ব্যাপী কথাবার্তা চলতে থাকে। আমার তো বোধ হয়, এ এক রকম সকাল বেলা উঠে কথোপকথনের মুগুর ভাঁজা। যা হোক, এই রকম মাঝে মাঝে visitor আনাগোনা করছে। বাকি সময় তিনি কী করেন? Mudie’s Libraryতে তিনি subscribe করেন, সেখেন থেকে অনবরত নভেলগুলো তাঁর ওখেনে যাতায়াত করতে থাকে। সেগুলো অনবরত গলাধঃকরণ করছেন। তা ছাড়া flirt করা আছে। flirt করা কী জানো? ভালোবাসার অভিনয় করা। দুই পক্ষেই জানছেন যে কেউ ভালোবাসছেন না, অথচ মিষ্টি হাসি ও মিষ্টি কথার অজস্র আদান-প্রদান চলছে। অভিনেত্রী হয়তো একটা অলীক ছুতো নিয়ে একটু অলীক অভিমান করলেন, অভিনেতা অমনি একটু সান্ত্বনার অভিনয় করলেন। একটা হয়তো রসিকতার কথা বললেন, অমনি অভিনেত্রী তাঁর তুষারহস্তে ক্ষুদ্র মুষ্টি উদ্যত করে আদর-মাখা রাগের অভিনয় করে বললেন: Oh you naughty, wicked, provoking man! naughty man অত্যন্ত তৃপ্তিসূচক হাস্য করলেন। এই রকম রসিকতা হাসি তামাসা ও মিষ্টি কথার ক্ষণস্থায়ী গোলাগুলি বর্ষণের নাম flirt করা। এতে অনেকটা সময় বেশ আমোদে কেটে যায়। তা ছাড়া (যদি তিনি miss হন) love making আছে। flirt করার সঙ্গে হয়তো তার অল্প তফাত আছে। তবে এটা flirt করার চেয়ে আর একটু গম্ভীর ও স্থায়ী পদার্থ— যদিও সকল সময়ে স্থায়ী হয় কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত বলতে পারি নে। অনেক চোখের জল ও নিশ্বেস খরচ করতে হয়, সহচরীদের কাছ থেকে অনেক রহস্যপূর্ণ ঠাট্টা ও চোক-টেপাটেপি খেতে হয়, ও দিনের মধ্যে দশবার করে blush করতে হয়। অজস্র নভেল পড়ে মনটা এমন romantic হয়ে দাঁড়ায় যে, একটু অবসর পেলেই ভালোবাসায় পড়তে ইচ্ছে করে, খাঁটি heroineএর মতো লম্বাচৌড়ো কাজ করতে ও লম্বাচৌড়ো কথা কইতে সাধ যায়। সুতরাং নভেল-পড়া মেয়েদের ভালোবাসায় পড়া অত্যন্ত আমোদের অবস্থা। চোখের জল ও নিশ্বেস ফেলতে হয় বটে; কিন্তু অনেক দিন থেকে তাঁদের বড়ো সাধ ছিল যে, একদিন এই রকম চোখের জল ও নিশ্বেস ফেলবার উপযুক্ত অবসর পান। এই রকম visitor অভ্যর্থনা করা, visit প্রত্যর্পণ করা, নতুন নভেল পড়া, নতুন fashion সৃষ্টি ও নতুন fashionএর অনুবর্তন করা, flirt এবং love করা হচ্ছে তাঁদের কাজ। এই রকম ফড়িঙের মতো ঘাসে ঘাসে লাফালাফি করে তাঁদের জীবনের বসন্তকাল কাটে। এঁরাই হচ্ছেন fashionable মেয়ের দল। আমি দেশে থাকতে এখানকার মেয়েদের যে রকম মনে করেছিলুম, এখেনে এসে তার সঙ্গে ঢের তফাত দেখছি। আমাদের দেশে যেমন ছেলেবেলা থেকে মেয়েদের বিয়ের জন্যে প্রস্তুত করে, লেখা পড়া শেখায় না, কেননা মেয়েদের আফিসে যেতে হবে না— এখেনেও তেমনি মার্ঘি দরে বিকোবার জন্যে মেয়েদের ছেলেবেলা থেকে পালিশ করতে থাকে, বিয়ের জন্যে যতদূর লেখা পড়া শেখা দরকার ততদূর শেখায়, তার বেশি শেখায় না, কেননা তাদের তো আফিসে যেতে হবে না! একটু গান গাওয়া, একটু পিয়ানো বাজানো, ভালো করে নাচা, খানিকটা French, একটু বোনা ও শেলাই করা জানলে, একটি মেয়েকে বিয়ের দোকানের জানলায় সাজিয়ে রাখবার উপযুক্ত বেশ একটি রঙচঙে পুতুল গড়ে তোলা হয়। এ বিষয়ে একটা দিশি পুতুল ও একটা বিলিতি পুতুলের যতটুকু তফাত, আমাদের দেশের ও এ দেশের মেয়েদের মধ্যে ঠিক ততটুকু তফাত মাত্র। দিশি পুতুলের অত সাজগোজ রঙচঙের আবশ্যক করে না, আমাদের দিশি মেয়েদের পিয়ানো ও অন্যান্য টুকিটাকি শেখবার আবশ্যক করে না— বিলিতি পুতুলের কিছু বাহার আবশ্যক করে, বিলিতি মেয়েদেরও অল্পস্বল্প লেখাপড়া শিখতে হয়—কিন্তু দুইই দোকানে বিক্রি হবার জন্যে তৈরি হয়। এখেনেও পুরুষেরাই হর্তাকর্তা, স্ত্রীরা তাদের সম্পত্তি। যেমন গাড়ি চালাবার জন্যে ঘোড়া আবশ্যক করে তেমনি সংসার চালাবার জন্যে একটা স্ত্রীর দরকার, স্ত্রী একটি আবশ্যক জিনিসপত্রের মধ্যে। স্ত্রীকে আজ্ঞা করা, স্ত্রীর মনের মুখে লাগাম লাগিয়ে নিজের ইচ্ছেমত চালিয়ে বেড়ানো স্বামীরা ঈশ্বরনির্দিষ্ট অধিকার মনে করেন। fashionable মেয়ে ছাড়া বিলেতে আরও অনেক রকম মেয়ে আছে, নইলে বিলেতে সংসার চলত না। মধ্যবিৎ গৃহস্থদের মেয়ের কতকটা মেহেন্নত করতে হয়, অতটা বাবুয়ানা করলে চলে না। সকালে উঠে একবার kitchen তদারক করতে যেতে হয়—kitchen পরিষ্কার আছে কি না, জিনিসপত্র যথাপরিমিত আনা হয়েছে কি না, যথাস্থানে রাখা হয়েছে কি না, ইত্যাদি দেখাশুনা করেন; রান্না ও খাবার জন্য জিনিস আনতে হুকুম দিতে হয়, পয়সা বাঁচাবার জন্য নানা প্রকার গিন্নিপনার চাতুরী খেলাতে হয়— কালকের মাংসের হাড়গোড় কিছু যদি অবশিষ্ট থাকে তা হলে বন্দোবস্ত করে তার থেকে আজকের সূপ চালিয়ে নেন, পরশু দিনকার বাসি রাঁধা মাংস যদি খাওয়াদাওয়ার পর খানিকটা বাকি থাকে তা হলে সেটাকে রূপান্তরিত করে আজকের টেবিলে আনবার সুবিধে করে দেন, এই রকম নানা প্রকার বন্দোবস্ত করতে হয়। তার পরে ছেলেদের জন্য মোজা কাপড়-চোপড় নিজের হাতে তৈরি করেন, এমন-কি নিজেরও অনেক কাপড় নিজে তৈরি করেন। এঁদের সকলের ভাগ্যে নভেল পড়া ঘটে ওঠে না; বড়ো জোর খবরের কাগজ পড়েন, তাও সকলে পড়েন না দেখেছি। অনেকের পড়াশুনার মধ্যে কেবল চিঠি পড়া ও চিঠি লেখা, দোকানদারদের বিল পড়া ও হিসাব লেখা। খানিকটা লেখাপড়ার চর্চা না থাকলে লেখাপড়ায় রুচি জন্মায় না। তাঁরা বলেন, ‘politics এবং অন্যান্য গ্রামভারি বিষয় নিয়ে পুরুষরা নাড়াচাড়া করুন; আমাদের কর্তব্য কাজ স্বতন্ত্র।’ তাই জন্যে তাঁরা লেখাপড়া চর্চা করেন না। যেন পরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে নিতান্ত সংকুচিত বলেই তাঁরা লেখাপড়া করেন না, যেন নিতান্ত অনধিকার প্রবেশ হয় বলেই তিনি প্রায় তাঁর স্বামীর Libraryতে পদার্পণ করেন না। কিন্তু আমি এর মধ্যে কর্তব্য অকর্তব্য কিছু দেখতে পাই নে; আসল কথাটা হচ্ছে, ইচ্ছে নেই। লাইব্রেরি যদি ball-room হত, তা হলে তাঁরা অধিকার অনধিকার নিয়ে বড়ো মাথা ঘোরাতেন না। আর politics যদি নভেলের ভায়রাভাই হত, তা হলে তাঁরা পুরুষের পাত থেকে politics নিয়ে দু হাতে করে গিলতেন। দুর্বলতা মেয়েদের একটা ভূষণ বলে গণ্য, এই জন্যে দুর্বলতা মেয়েদের একটা গর্বের বিষয়; মেয়েরা দু পা চলে একেবারে এলিয়ে পড়লে আমাদের চোকে যে কেমন একটু ভালো লাগে আমার বোধ হয় তার কারণ, ও রকম দেখলে আমাদের আশ্রয় দেবার প্রবৃত্তি চরিতার্থ হয়— আশ্রয় দেবার প্রবৃত্তি কতকটা গর্ব থেকে হয়। নিজের শক্তি খাটাবার একটা অবসর পেলুম ব’লে বেশ একটু তৃপ্তি হয়; বিশেষতঃ বেশ একটি সুন্দর পদার্থ যার দিকে আমাদের স্বভাবতঃ মনের টান, সে আমাদের আশ্রয়ে আমাদের ছায়ায় লতার মতো জড়িয়ে থাকুক তা আমাদের ইচ্ছে করে। এই জন্যে মেয়েদের দুর্বলতা আমাদের ভালো লাগে, তাই জন্যে আমরা তার মধ্যে একটু সৌন্দর্য দেখি, সুতরাং অনেক মেয়ে শ্রান্ত না হলেও এলিয়ে পড়েন—যিনি দশটা কাজ সহজে করতে পারেন তিনি দেড়খানা কাজ করেই হাঁপাতে থাকেন। বুদ্ধিবিদ্যার বিষয়েও এই রকম; মেয়েরা জাঁক করে বলেন, ‘আমরা, বাপু, ওসব politics science বুঝি নে, শুঝি নে।’ বিদ্যার অভাব, বুদ্ধির খর্বতা, একটা প্রকাশ্য জাঁকের বিষয় হয়ে ওঠে। পুরুষরা অমনি অতি স্নেহপূর্ণ আদর করে তাঁদের বলেন, ‘হাঁ, ঠাকরুনরা, তোমরা ঘরের লক্ষ্মী ঘরে থাকো, ছেলেপিলে মানুষ করো, ও-সকল শুষ্ক কাষ্ঠের বোঝা তোমাদের বইতে হবে না।’ ভাবটা যেন, ‘তোমাদের একটা মহা কষ্ট থেকে উদ্ধার করলেম।’ কিন্তু বিদ্যাচর্চা রহিত করলে একটা ভার থেকে মুক্ত করা হয় না, একটা অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এখানকার মধ্যবিৎ শ্রেণীর মেয়েরা বিদ্যাচর্চার দিকে ততটা মনোযোগ দেন না, তাঁদের স্বামীরাও তার জন্যে বড়ো দুঃখিত নন, তাঁদের জীবন হচ্ছে কতকগুলি ছোটোখাটো কাজের সমষ্টি। যা হোক, সমস্ত দিন এই রকম ছেলেদের দেখাশুনা ক’রে, কাপড় বুনে, visitorদের সঙ্গে কথাবার্তা করে কেটে যায়। সন্ধ্যে বেলায় স্বামী কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে এলেন, স্ত্রীর কাছ থেকে একটি আদরের চুম্বন উপার্জন করলেন (পরিবারবিশেষে যে তার অন্যথা হয় তা বলাই বাহুল্য)—ঘরে তাঁর জন্যে আগুন জ্বালানো আছে, খাবার সাজানো আছে। সন্ধ্যে বেলায় স্ত্রী হয়তো একটা সেলাই নিয়ে বসলেন, স্বামী তাঁকে একটি নভেল চেঁচিয়ে পড়ে শোনাতে লাগলেন, সুমুখে আগুন জ্বলছে, ঘরটি বেশ গরম, বাইরে হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে, জানলা-দরজাগুলি বন্ধ। হয়তো স্ত্রী পিয়ানো বাজিয়ে স্বামীকে খানিকটা গান শোনালেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী—courtshipএর সময় স্ত্রীর গলা অত্যন্ত ভালো লাগত, কিন্তু বিয়ের পর স্ত্রীর গান শুনতে খুব কম লোকের আগ্রহ হয়। রোজ রোজ সেই একই রকম গলা, একই ধাঁচের গান, শুনে খুব কম লোকেরই অরুচি না জন্মায়। গিন্নির গলা নেমন্তন্নের দিন কাজে লাগে; দশজন বন্ধুবান্ধবকে ডিনারে নেমন্তন্ন করলে যেমন টেবিল সাজাবার জন্যে অনেক জিনিস সিন্দুক থেকে বেরোতে থাকে যা সচরাচর ব্যবহার করা হয় না, তেমনি সেদিন স্ত্রীরও গলা বেরোয়। এখানকার মধ্যবিৎ শ্রেণীর গিন্নিরা এই রকম সাদাসিদে, যদিও তাঁরা ভালো করে লেখাপড়া শেখেন নি তবু তাঁরা অনেক বিষয় জানেন এবং তাঁদের বুদ্ধি যথেষ্ট পরিষ্কার। এ দেশে কথায়-বার্তায় জ্ঞানলাভ করা যায়। তাঁরা অন্তঃপুরে বদ্ধ নন; বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথাবার্তা কন, আত্মীয়সভায় একটা কোনো উচ্চ বিষয় নিয়ে চর্চা হলে তাঁরা শোনেন ও নিজের বক্তব্য বলতে পারেন— এই রকম করে অনেক জানতে পারেন ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা একটা বিষয়ের কত দিক দেখেন ও কিরকম চক্ষে দেখেন তা বেশ বুঝতে পারেন। সুতরাং একটা কথা উঠলে তিনি ভালো করে কইতে পারেন, কতকগুলো ছেলেমানুষি আকাশ-থেকে-পড়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন না ও বুঝতে না পেরে তাঁকে হাঁ করে থাকতে হয় না। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খুব সহজ ভাবে গল্পসল্প করতে পারেন, নিমন্ত্রণসভায় মুখ ভার করে বা লজ্জায় অবসন্ন হয়ে থাকেন না, পরিচিতদের সঙ্গে অন্যায় ঘেঁষাঘেঁষি নেই কিম্বা তাদের কাছ থেকে নিতান্ত অসামাজিক দূরেও থাকেন না। লোকসমাজে মুখটি খুব হাসিখুশি প্রসন্ন; যদিও নিজে খুব রসিকা নন কিন্তু হাসি তামাসা বেশ উপভোগ করতে পারেন, একটাকিছু ভালো লাগলে মন খুলে প্রশংসা করেন, একটা কিছু মজার কথা শুনলে প্রাণ খুলে হাস্য করেন। ঠোঁট বন্ধ করে থাকা ও লজ্জায় ম্রিয়মাণ হয়ে পড়া এখানকার মেয়েদের আচরণের আদর্শ নয়। মনে করে দেখো দেখি একটা নিমন্ত্রণসভায় ৩০টি মেয়ে ঘাড় হেঁট করে চুপচাপ বসে আছেন, সে সভায় পুরুষদের কী দুরবস্থা! ক্রমে ক্রমে তাঁদেরও মুখ বন্ধ হয়ে আসে, মনের ভিতর এক রকম অসোয়াস্তি উপস্থিত হয় ও ঘোমটা থাকলে ঘোমটা দিতে ইচ্ছে করে। লজ্জায় চুপচাপ করে থাকা অত্যন্ত অসামাজিক গুণ। তুমি তো কতকগুলো বাঘের মধ্যে গড় নি— আপনার জাত, মানুষ, বিশেষতঃ ভদ্রলোক— কোনো অভদ্র কুচরিত্র দলের মধ্যে গিয়ে পড় নি—তবে বেশ মিলে মিশে গল্পসল্প করবে না তো কী? লজ্জা দু দণ্ড দেখতে বেশ মন্দ লাগে না, হয়তো তার মধ্যে বেশ কবিত্ব-মাখা মাধুর্য দেখতে পাওয়া যায়— কিন্তু দিন রাত লজ্জার সঙ্গে কারবার করা অত্যন্ত যন্ত্রণা। দু-তিন ঘণ্টা পরিশ্রম করে একটা কথার উত্তর পেলেম, একবার সওয়া গেল—কিন্তু দিন রাত যদি ঐ রকম একটা কথা শোনবার জন্যে গলদ‍্ঘর্ম হতে হয় তা হলে তো বাঁচা যায় না। তুমি যদি আমার সঙ্গে মন খুলে আমোদ-প্রমোদ না কর তা হলে দায়ে পড়ে তোমার সংসর্গ ছেড়ে আমাকে অন্য সংসর্গ খুঁজতে হয়। বিয়ের মন্ত্র কিছু ভালোবাসা জন্মাবার মন্ত্র নয়, বিয়ে হলেই ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসাও নেই, অথচ আমার স্ত্রী যদি আমাকে কথায় বার্তায় আমোদে না রাখতে পারেন, তা হলে আমি আমার সেই মূক সঙ্গিনী ছেড়ে কি অন্যত্র আমোদের সন্ধান করব না? আমার তাই বোধ হয় মেয়েদের একটা অস্বাভাবিক লজ্জা ও সংকোচ চলে যাওয়া ভালো; যৌবনের একটা স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস, হৃদয়ের ও মনোবৃত্তির স্বাভাবিক বিস্তার শিক্ষা ও অভ্যেসের চাপে না পিষে ফেলা ভালো।

 আমি দিন-কতক আমার শিক্ষকের পরিবারের মধ্যে বাস করেছিলুম। সে বড়ো অদ্ভুত পরিবার। Mr. B মধ্যবিত্ত লোক। তিনি লাটিন ও গ্রীক খুব ভালো রকম জানেন। তাঁর ছেলেপিলে কেউ নেই— তিনি, তাঁর স্ত্রী, আমি আর একটা দাসী, এই চার জন মাত্র একটি বাড়িতে থাকতুম। Mr. —আধবুড়ো লোক, অত্যন্ত অন্ধকার মূর্তি, দিন রাত খুঁৎখুঁৎ খিট্‌থিট্ করেন, নীচের তলায় রান্নাঘরের পাশে একটি ছোট্টো-জানলা-ওয়ালা দরজাবদ্ধ অন্ধকার ঘরে থাকেন, একে তো সূর্যকিরণ সে ঘরে সহজেই প্রবেশ করতে পারে না তাতে জানলার ওপর একটা পর্দা ফেলা, চার দিকে পুরোনো ছেঁড়া ধুলো-মাখা নানা প্রকার আকারের ভীষণদর্শন গ্রীক লাটিন বইয়ে দেয়াল ঢাকা—ঘরে প্রবেশ করলে এক রকম বদ্ধ হাওয়ায় হাঁপিয়ে উঠতে হয়। এই ঘরটা হচ্ছে তাঁর study, এইখানে তিনি বিরক্ত মুখে পড়েন ও পড়ান। তাঁর মুখ সর্বদাই বিরক্ত, আঁট বুট জুতো পরতে বিলম্ব হচ্ছে, বুট জুতোর ওপর মহা চটে উঠলেন; যেতে যেতে দেয়ালের পেরেকে তাঁর পকেট আটকে গেল, রেগে ভুরু কুঁকড়ে ঠোঁট নাড়তে লাগলেন। তিনি যেমন খুঁতখুঁতে মানুষ তাঁর পক্ষে তেমনি খুঁতখুঁতের কারণ প্রতি পদে জোটে; আসতে যেতে তিনি চৌকাঠে হুঁচট খান, অনেক টানাটানিতে তাঁর দেরাজ খোলে না, যদি বা খোলে তবু যে জিনিস খুঁজছিলেন তা পান না, এক-এক দিন সকালে তাঁর studyতে এসে দেখি তিনি অকারণে বসে বসে ভ্রূকুটি করে, উ-আ করছেন— ঘরে একটি লোক নেই। কিন্তু B আসলে ভালোমানুষ, তিনি খুঁৎখুঁতে বটে কিন্তু রাগী নন, তিনি খিট্‌খিট্ করেন কিন্তু ধমকান না। নিদেন তিনি মানুষের ওপর কখনো রাগ প্রকাশ করেন না— Tiny বলে তাঁর একটা কুকুর আছে তার ওপরেই তাঁর যত আক্রোশ, সে একটু নড়লে-চড়লে তাকে ধমকাতে থাকেন আর দিন রাত তাকে লাথিয়ে লাথিয়ে একাকার করেন। তাঁকে আমি প্রায় হাসতে দেখি নি। তাঁর কাপড়-চোপড় ছেঁড়া অপরিষ্কার। মানুষটা এই রকম। তিনি এক কালে পাদ্রি ছিলেন; আমি নিশ্চয় বলতে পারি, প্রতি রবিবারে তাঁর বক্তৃতায় তিনি শ্রোতাদের নরকের বিভীষিকা দেখাতেন। Mr. —র এত কাজের ভিড়, এত লোককে তাঁর পড়াতে হত যে, এক-এক দিন তিনি ডিনার খেতে অবকাশ পেতেন না। এক-এক দিন তিনি বিছানা থেকে উঠে অবধি রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এমন অবস্থায় খিট্‌খিটে হয়ে ওঠা কিছু আশ্চর্য নয়। Mrs. B খুব ভালো মানুষ, অর্থাৎ রাগী উদ্ধত লোক নন। এক কালে বোধ হয় ভালো দেখতে ছিলেন। যত বয়স তার চেয়ে তাঁকে বড়ো দেখায়, চোখে চশমা পরেন— সাজগোজের বড়ো আড়ম্বর নেই। নিজে রাঁধেন, বাড়ির কাজকর্ম করেন (ছেলেপিলে নেই, সুতরাং কাজকর্ম বড়ো বেশি নয়)— আমাকে খুব যত্ন করতেন। খুব অল্প দিনেতেই বোঝা যায় যে, Mr. ও Mrs.এর মধ্যে বড়ো ভালোবাসা নেই। কিন্তু তাই বলে যে দুজনের মধ্যে খুব ঝগড়াঝাঁটি হয় তা নয়, নিঃশব্দে সংসার চলে যাচ্ছে। Mrs. B কখনো Mr. Bর studyতে যান না, সমস্ত দিনের মধ্যে খাবার সময় ছাড়া দুজনের মধ্যে আর দেখাশুনা হয় না, খাবার সময়ে দুজনে চুপচাপ বসে থাকেন, খেতে খেতে আমার সঙ্গে গল্প করেন, কিন্তু দুজনে পরস্পর গল্প করেন না। Mr. Bর আলুর দরকার হয়েছে, তিনি গোঁ গোঁ করতে করতে Mrs. Bকে বললেন: Some potatoes 1 (please কথাটা বললেন না কিম্বা শোনা গেল না।) Mrs. B বলে উঠলেন: I wish you were a little more polite. Mr. B বললেন: I did say please. Mrs. B বললেন: I didn't hear it. Mr. B বললেন: It was no fault of mine that you didn't! কথাটা সমস্তটা ভালো করে শোনা গেল না, এইখেনেই দুই পক্ষ চুপ করে রইলেন। মাঝের থেকে আমি অত্যন্ত অপ্রস্তুতে পড়ে যেতেম। একদিন আমি ডিনারে যেতে একটু দেরি করেছিলেম, গিয়ে দেখি Mrs. B Mr. Bকে ধমকাচ্ছেন, অপরাধের মধ্যে Mr. B মাংসের সঙ্গে একটু বেশি আলু নিয়েছিলেন। আমাকে দেখে Mrs. B ক্ষান্ত হলেন, Mr. B সাহস পেয়ে প্রতিহিংসা তোলবার জন্যে দ্বিগুণ করে আলু নিতে লাগলেন। Mrs. B তাঁর দিকে একটি নিরুপায় মর্মভেদী কটাক্ষপাত করলেন। দুই পক্ষই দুই পক্ষকে dear বা darling বলে ভুলেও সম্বোধন করেন না, কিম্বা কারও Christian নাম ধরে ডাকেন না, পরস্পর পরস্পরকে Mr. B ও Mrs. B বলে ডাকেন। আমার সঙ্গে Mrs. B হয়তো বেশ কথাবার্তা কচ্ছেন এমন সময় Mr. B এলেন, অমনি সমস্ত চুপচাপ। দুই পক্ষেই এই রকম। একদিন Mrs. B আমাকে piano শোনাচ্ছেন এমন সময় Mr. B এসে উপস্থিত হলেন, বললেন: When are you going to stop? Mrs. B বললেন: I thought you had gone out. পিয়ানে। থামল। তার পরে আমি যখনি পিয়ানো শুনতে চাইতেম Mrs. B বলতেন, ‘that horrible man যখন বাড়িতে না থাকবেন তখন শোনাব।’ আমি ভারী অপ্রস্তুতে পড়ে যেতুম। দুজনে এই রকম অমিল, অথচ সংসার বেশ চলে যাচ্ছে। Mrs. B রাঁধছেন-বাড়ছেন, কাজকর্ম করছেন, Mr. B রোজগার করে টাকা এনে দিচ্ছেন। দুজনে কখনো প্রকৃত ঝগড়া হয় না, কেবল কখনো কখনো দুই-একবার দুই-একটা কথা কাটাকাটি হত; তা এত মৃদু স্বরে যে পাশের ঘরের লোকের কানে পর্যন্ত পৌঁছায় না। যা হোক, আমি সেখানে দিন কতক থেকে বিব্রত হয়ে সে অশান্তির মধ্যে থেকে চলে এসে বেঁচেছি।