রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ/১০

উইকিসংকলন থেকে

(১০)

রাম মাণিক্য

 ১৬৭৩ খৃষ্টাব্দে যুবরাজ রামদেব মাণিক্য উপাধি গ্রহণ পূর্ব্বক পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। রামমাণিক্যের শাসনকাল ঘটনা বিরল। তাঁহার চিত্তের ঔদার্য্যসূচক একটি কাহিনী আজিও এদেশে প্রচলিত আছে। সরাইলের জমিদার নুরমহম্মদের পুত্র নাছির শিকার উপলক্ষে রাজপুত্র চন্দ্রসিংহের মৃত্যুর কারণ হওয়ায় ত্রিপুর দরবার ইহার শাস্তি বিধানে উদ্যত হইলে, জমিদার নুরমহম্মদ পুত্রকে স্বয়ং শাস্তির জন্য মহারাজের নিকট পাঠাইয়া দেন। যখন নাছিরকে মহারাজের সম্মুখে আনা হইল, তখন রামমাণিক্যের হৃদয় গলিয়া গেল। তিনি বলিলেন—‘পুত্রহন্তাকে বধ করিয়া কি লাভ হইবে, যিনি সৃষ্টির কর্ত্তা তিনিই ইহার ব্যবস্থা করিবেন,’ এই বলিয়া নাছিরকে মুক্তি দিলেন। উক্ত ঘটনা দ্বারা মহারাজের অপূর্ব্ব চিত্ত-সংযমেরই পরিচয় পাওয়া যায়, এরূপ ক্রোধ সংবরণ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় একান্ত বিরল।

 নক্ষত্র রায়[১] হইতে মুর্শিদাবাদের নবাবের সহিত রাজদ্রোহসূচক সূত্র দৃষ্ট হয়, সেই সূত্র অবলম্বনে তাঁহার পিতার ন্যায় তাঁহারও বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলিল। রামমাণিক্যের অনুজ দুর্গাঠাকুর-তনয় দ্বারকা নক্ষত্ররায়ের অভিনয় সুরু করেন। তিনি গোপনে মুর্শিদাবাদ যাইয়া নবাবের সাক্ষাৎ কামনা করেন। নবাব সকাশে ষড়যন্ত্রের বিষয় চাপিয়া যাইয়া কৌশলে কেবল এইটুকু জানান যে রামমাণিক্য বার্দ্ধক্য হেতু একেবারে স্থবির, রাজ্যশাসনে অপারগ। মুখে না বলিলেও ইঙ্গিতে বুঝাইতে চাহিলেন যদি নবাব সৈন্য সাহায্য করেন তবে দ্বারকা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইয়া নবাবের নিকট আত্মবিক্রয় করিতে পারেন। সুচতুর নবাব দ্বারকার বাক্য প্রত্যয় না করিয়া নিজ অনুচর পাঠাইয়া দেন।

 নবাবের অনুচর এদিক সেদিক ঘুরিয়া সকল খবর সংগ্রহ করিল, তারপর নবাবের গোচর করিল। নবাব যখন দ্বারকার চক্রান্ত বুঝিলেন তখন চক্রান্তকারীরা সরিয়া পড়িল।

 স্বীয় নামে রামমাণিক্য রামসাগর খনন করেন। ১৬৮১ খৃষ্টাব্দে মহারাজ কালপ্রাপ্ত হইলেন।[২]

  1. রাজমালায় ঠাকুর উপাধি নক্ষত্র রায়ের সহিত যুক্ত দেখিতে পাওয়া যায়। রত্নমাণিক্যও রাজা হইবার পূর্ব্বে রত্ন ঠাকুর নামে আখ্যাত হইতেন, তাঁহার অন্যান্য ভাইদের নামের সঙ্গেও ঠাকুর উপাধিযুক্ত দেখিতে পাওয়া যায়। সে সময়ে ঠাকুর উপাধি বর্ত্তমানের মহারাজ কুমার ও কুমারের স্থলবর্ত্তী ছিল।
     “মহারাজ রামমাণিক্য স্বীয় জ্যেষ্ঠ পুত্র রত্নদেব ঠাকুরকে যৌবরাজ্যে এবং “বড়ঠাকুর” নামে একটি নূতন পদ সৃষ্টি করিয়া দ্বিতীয় পুত্র দুর্জ্জয়দেব ঠাকুরকে ঐ পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।” কৈলাস সিংহের রাজমালা—৯৫ পৃঃ।
  2. উদয়পুরে গোপীনাথের মন্দিরের পশ্চিমভাগে একটি মন্দির আছে উহার অস্পষ্ট শিলালিপি পাঠে প্রতীত হয় তিনি ১৫৯৫ শকাব্দে বিষ্ণুর উদ্দেশে ঐ মন্দির নির্ম্মাণ করেন। গোমতী নদীর উত্তর পারে ভগ্নপ্রায় রাজপ্রাসাদের সংলগ্ন মন্দির গাত্রে শিলালিপি পাঠে জানা যায় রামমাণিক্য ১৫৯৯ শকাব্দে তাঁহার পিতার স্বৰ্গলাভ কামনায় বিষ্ণুর উদ্দেশে ঐ মন্দির দান করেন।