বিষয়বস্তুতে চলুন

রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ/১২

উইকিসংকলন থেকে

(১২)

উদয়পুর অধিকার ও অমরমাণিক্যের মৃত্যু

 বিজয়ী হইয়া মুকুট পরিবেন এই দুরন্ত আশা লইয়া রণনায়করূপে যুঝা মঘ সৈন্যের সম্মুখীন হইতে লাগিলেন। যুঝার বয়স তখন ২৫, যুদ্ধ বিদ্যায় অনভিজ্ঞ অথচ দুর্জ্জয় আত্মাভিমান। রাজধর প্রমাদ গণিলেন, তিনি যুদ্ধ চালনার সুযোগ না পাইয়া শিবিরের সম্মুখ রক্ষা করিতে লাগিলেন। এদিকে যুঝা পর্ব্বত আক্রমণ করিয়া মঘসৈন্য হঠাইতে হঠাইতে অপর প্রান্তে মাঠে আসিয়া পড়িলেন,—তখন দূরে মঘ দুর্গ দেখা গেল। যুঝার সঙ্কল্প হইল দুর্গ জয় করিবেন। মঘেরা তখন ত্রিশ হাজার বন্দুক হইতে অনবরত অনল বর্ষণ করিতে লাগিল।

 দুর্গজয় করিবার অভিলাষে যুঝা রাজধরের জয়মঙ্গল হস্তী আরোহণে যাইতেছিলেন কাযেই বিপক্ষের গোলা লাগিবার সুবিধা হইয়াছিল। যখন হস্তীর উপর উঠিতেছিলেন তখন বিপক্ষের গোলা লাগিয়া হস্তী নড়িয়া উঠিল এবং যুঝা হাওদা হইতে নীচে পড়িয়া গেলেন—দৈবচক্রে হাতীর পায়ের আঘাতে যুঝা প্রাণত্যাগ করেন। এইরূপে নিজ হঠকারিতায় যুঝা প্রাণ হারাইলেন। অমর দুর্লভ ও রাজধর উভয়ই পশ্চাদ্‌ভাগে ছিলেন। যুঝার মৃত্যুতে যখন চারিদিকে দারুণ বিশৃঙ্খলা হইয়া পড়িল তখন বর্শা আসিয়া রাজধরের অঙ্গে বিদ্ধ হয় তাহাতে প্রচুর রক্তপাতে যুবরাজ অবসন্ন হইয়া পড়েন। হাতীর উপর হইতে তাঁহাকে নামাইয়া শিবিরে আনা হয়। আঘাত এত গুরুতর হইয়াছিল যে একমাত্র কপালে রাজযোগ ছিল বলিয়াই সে যাত্রা তিনি টিকিয়া গেলেন। অমরদুর্লভ মঘের দুর্ব্বার স্রোত রোধ করিতে পারিলেন না। সুতরাং ত্রিপুর সৈন্য ভীষণ ভাবে পরাজিত হইল। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠারা যেরূপ দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছিল এই মঘসমরেও ত্রিপুরশক্তি অত্যন্ত হীনবল হইয়া পড়িল।

 ভগ্নদূত মুখে এই সংবাদ পাইয়া অমরমাণিক্যের দুঃখের সীমা রহিল না—একে পুত্রশোক তদুপরি ত্রিপুর বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ে তাঁহার মাথায় যেন আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। কিন্তু বসিয়া থাকিবার উপায় নাই, যে অসি সাহায্যে তিনি সিংহাসন নিষ্কণ্টক করিয়াছিলেন সেই অসিতে ভর করিয়া শেষ ভাগ্য পরীক্ষার জন্য যুদ্ধ-যাত্রার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কেবলি মনে পড়িতে লাগিল, তাঁহারি যে বাহুবলে ত্রিপুরা রাজ্য পূর্ব্বরাজাদের সময়ে সুরক্ষিত ছিল সে বাহুবলের কোথায় অভাব ঘটিল যে ত্রিপুরা রাজ্য টলমল করিতেছে!

 ভগ্নহৃদয়ে মহারাজ চট্টল শিবিরে পৌঁছিলেন। রাজধর পিতার চরণে লুটাইয়া নিবেদন করিলেন যে যুঝার হঠকারিতাই যুদ্ধে হারিবার প্রধান কারণ, যুঝা কাহারও নেতৃত্ব মানিবার পাত্র নহেন, নিজের বুদ্ধিতে কায করায় সমস্তই পণ্ড হইয়াছে। অমরমাণিক্য ছত্রভঙ্গ সৈন্য একত্র করিয়া একবার শেষ চেষ্টা পাইলেন। স্বয়ং দুর্গের ভার রাখিয়া যুদ্ধ চালনা করিতে লাগিলেন, দুই হাজার পাঠান অশ্বারোহী মঘ সৈন্য আক্রমণ করিল, ঘোর যুদ্ধ বাঁধিয়া গেল। রণক্ষেত্র দেখিতে দেখিতে দুই লক্ষ মঘ সৈন্যে ছাইয়া গেল, ত্রিপুরার হতাবশিষ্ট সেনা এই লোকবলের সহিত কি করিয়া লড়িবে? পাঠানেরা রণে ভঙ্গ দিয়া যে যেদিকে পারিল পলাইল, মহারাজ এই সংবাদ শুনিয়া বুঝিলেন সমুদ্র তরঙ্গ রোধ করিবার উপায় নাই সুতরাং ত্রিপুর শিবির উঠাইয়া ফেলিয়া চৌদোলে উদয়পুর চলিয়া আসিলেন।

 রাজধানীতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই খবর পাওয়া গেল মঘরাজ বিজয়োল্লাসে উদয়পুর নিতে আসিতেছেন। অমরমাণিক্য আত্মরক্ষার কোন পথ না পাইয়া উদয়পুর ত্যাগে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। গভীর মনোদুঃখে পরিজনসহ ডোমঘাট পথে অরণ্যে প্রবেশ করিলেন, বিলাসবৈভবের উদয়পুর যেন শ্মশান হইয়া গেল। রাজহীন রাজ্যে বাস অসম্ভব দেখিয়া অনেকেই মহারাজের অনুগমন করিল। শৌর্য্যবীর্য্যের আধার উদয়পুর একটি কঙ্কালের ন্যায় পড়িয়া রহিল।

 এদিকে মঘরাজ উদয়পুর প্রবেশ করিলেন, তাঁহার সৈন্যেরা লুটপাট করিল। পনর দিন অবস্থানের পর মহারাজ বুড়ামঘী নামে এক সর্দ্দারকে মঘ সৈন্যের সহিত উদয়পুরে স্থাপন করিয়া প্রস্থান করেন। মহারাজ অমরমাণিক্য বনে বনে ফিরিতে লাগিলেন, উদয়পুর-লুণ্ঠন সংবাদ তাঁহার হৃদয়ে যেন শেল বিদ্ধ করিল। এক এক দিন নিবিড় সন্ধ্যায় বনানীর অন্তরালে বসিয়া নিজের ভাগ্যবিপর্য্যয়ের কথা ভাবিতেন আর দর দর ধারে চক্ষের জল বহিয়া যাইত। তাঁহার নিঃশ্বাসে সমবেদনায় বনে মর্ম্মর ধ্বনি জাগিত, পাখীরা কূজনবিরত হইত, একটি একটি করিয়া আকাশে তারা ফুটিত, ভাগ্যহীন অমরের প্রতি যেন তাহারা নিষ্পলক চাহিয়া থাকিত।

 আষাঢ় মাস উপস্থিত, মহারাণীর সহিত আলাপ করিয়া মহারাজ স্থির করিলেন কুমার রাজধরকে রাজপাটে বসাইয়া তিনি বিদায় লইবেন। সেই মতে সকল অনুষ্ঠান হইল। আষাঢ় মাস, জলে ভরা নদী, মহারাজ নৌবিহার ইচ্ছা করিলেন। পালে পালে নৌকা সাজিল, মনুনদীর তীরে তেতৈয়া নামক স্থানে আসিয়া নৌবহর থামিল। স্বদেশের এই ঘোর বিপদ তাঁহার প্রাণে এতই বাজিয়াছিল যে বাঁচিতে তাঁহার আর সাধ ছিল না। তীর্থ-মৃত্যুতে চন্দ্রলোক-গতি হয় ইহা শাস্ত্রোক্তি। পবিত্র মনুনদীতে স্নাত হইয়া মৃত্যু ইচ্ছা করিয়া মহারাজ অহিফেন ভক্ষণ করেন, তাহাতেই তাঁহার মৃত্যু হয়। মনুনদীতীরে তাঁহার চিতানলে মহাদেবী সহমৃতা হইলেন। জীবনের গভীর দুঃখ চিতানলে নির্ব্বাণ লাভ করিল। ফিনিসীয় মহাবীর হ্যানিবলের ন্যায় অমরমাণিক্যের জীবন-নাট্য বড়ই বিয়োগান্তক।