রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/প্রথম পরিচ্ছেদ/১১

উইকিসংকলন থেকে

(১১)

বরবক্রে ত্রিপুররাজধানী স্থানান্তর

 দাক্ষিণ অনুজ দশ ভাই সহ রাজপাট লইয়া স্থানান্তরে সরিয়া গেলেন। এইখানেই ত্রিপুররাজগণের প্রথম কিরাত রাজ্য শেষ হইল। মহারাজ দ্রুহ্যু হইতে একাদিক্রমে একই-স্থানে এতকাল রাজপাট ছিল, এইবার কিরাত দেশের অপরাংশে সরিয়া আসিলেন। দ্রুহ্যুর কিরাতজয় প্রসঙ্গে পাইয়াছি দ্রুহ্যু কপিল বা ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে ত্রিবেগ স্থলে তাঁহার রাজপাট স্থাপন করেন। এতদিন পরে হেড়ম্ব-রাজের সৈন্য দাক্ষিণকে কপিল তীর হইতে বরবক্রতীরে বিতাড়িত করিল। বরবক্র (বরাক) নদীই ত্রিপুরায় প্রবেশ করিয়া মেঘনা নাম ধারণ করিয়াছে। ত্রিপুররাজবংশ, দক্ষিণ হইতেই কপিল বা ব্রহ্মপুত্র নদীরতীর পরিত্যাগ করিয়া মেঘনা বা বরবক্র প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত হইল। হেড়ম্বরাজ কপিল তীর অধিকার করিয়া রহিলেন আর দাক্ষিণ বরবক্রের উজানে খলংমাতে রাজ্য করিতে লাগিলেন। দাক্ষিণ হেড়ম্ব রাজ্যের সীমায় কুকি স্থানের অনেকটা হেড়ম্ব রাজকে ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইলেন।

 খলংমা নদীর তীরে দাক্ষিণ রাজত্ব করিতে লাগিলেন, এস্থানে আসিয়া তাঁহারা পূর্ব্ব-সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িলেন। এতকাল বসবাসে সে স্থান উন্নত হইয়াছিল, আচার নিষ্ঠা মার্জ্জিত হইয়াছিল। সেই স্থান হেড়ম্বরাজ লইয়া গেলেন। সুতরাং নূতন দেশে অসংস্কৃত আচারের মধ্যে পুনরায় আসিয়া পড়িলেন, ইহা যেন বনবাসের মত ঠেকিতে লাগিল। এখানে আসিয়া পাত্র মিত্র লইয়া দাক্ষিণ রাজঠাট বসাইলেন সত্য কিন্তু তাঁহার মন মিশিল না। তাঁহার কুলে মদ্যাদি অনাচার ঢুকিতে লাগিল এবং পানাসক্ত হইয়া ইহারা আত্মকলহে রত হইল। পরস্পর বিবাদ, ক্রমে তুমুল রণে পরিণত হইল, মহারাজ দাক্ষিণ সে কলহ থামাইতে বৃথাই চেষ্টা পাইলেন। ফলে পঞ্চাশ হাজার ত্রিপুরবীর সেই গৃহবিবাদে প্রাণ হারাইল। মহারাজ দাক্ষিণ ভাবিলেন—এ কেমন স্থানে আসিলাম, আমার স্বজন যেন যদুবংশের ন্যায় ধ্বংস হইয়া গেল! হায়, হায়, একি হইল! এইসব দুশ্চিন্তায় খলংমা দেশ ত্যাগ করিতে ইচ্ছা করিলেন কিন্তু তাঁহার আয়ু ফুরাইয়া আসিয়াছিল। প্রায় সমস্ত জীবন ঝড়ঝঞ্ঝায় কাটাইয়া দাক্ষিণ মরিয়া শান্তি পাইলেন।

 দাক্ষিণের পর তাঁহার ৫২ম পুরুষ পর্য্যন্ত খলংমাতেই রাজত্ব করেন। এই সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনার কথা পাওয়া যায় না। ইহা যেন যুরুপীয় ইতিহাসের Dark Age অন্ধকারযুগের ন্যায়। তাঁহার ত্রিপঞ্চাশত্তম পুরুষ বিমারের পুত্র কুমার পরম ধার্ম্মিক রাজা ছিলেন। তিনি শিব ভক্ত ছিলেন। মনু নদীর তীরে শ্যাম্বল নগরে যাইয়া তিনি শিবলিঙ্গ দর্শন করেন। শিবারাধনায় তন্ময় হইয়া তিনি খলংমা নদীর তীর হইতে রাজধানী উঠাইয়া মনু নদীর তীরে শ্যাম্বল নগরে স্থাপন করেন। শ্যাম্বল হয়ত শিবের শম্ভু-নামেরই অপভ্রংশ! কুমারের পর তিন জন রাজার সময়ে ঘটনার উল্লেখ নাই বলিলেই হয়, চতুর্থ রাজা মৈছিলির সম্বন্ধে একটি শিব উপাখ্যান আছে। মৈছিলিরাজ বড়ই ক্রোধী ছিলেন। পুত্রলাভের জন্য তিনি মহাদেব ধ্যান করেন; চতুর্দ্দশ দেবতাগৃহে চন্তাই সহিত তিনি ছিলেন। ধ্যানে তুষ্ট হইয়া শিব দর্শন দিলেন কিন্তু রাজাকে কহিলেন—তোর পুত্র হইবে না, তুই অপুত্রক থাকিবি। রাজা এত ক্রোধী ছিলেন যে মহাদেবের এই বাকো তাঁহার রাগের সীমা রহিল না, তিনি মহাদেবকে ভয় করা দূরে থাকুক, আরাধ্য দেবতাকে বধ করিতেই উদ্যত হইলেন। দেবদেব মহাদেবকে লক্ষ্য করিয়া তীর ছুঁড়িলেন। তীর মহাদেবের পায়ে লাগিল। মহাদেব তাঁহাকে শাপ দিলেন—তুই অন্ধ হইয়া যা। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই মৈছিলিরাজ অন্ধ হইয়া গেলেন। হায়, হায়, একি হইল! রাজা করুণ স্বরে আর্ত্তনাদ করিতে লাগিলেন। চন্তাই শিবের নিকট ধন্না দিয়া পড়িলেন হে আশুতোষ, সন্তানের অপরাধ ক্ষমা কর। রাজার চক্ষু ভাল করিয়া দাও। শিবের আদেশ হইল, যদি নররক্ত দেওয়া যায় তবে ইহার চক্ষু ভাল হইবে এবং এসময় ব্যাপিয়া ব্রহ্মচর্য্যে বাস করিতে হইবে। এইরূপ অনুষ্ঠানে রাজা দৃষ্টি ফিরিয়া পাইলেন, কিন্তু ব্রহ্মচর্য্যের ব্যাঘাত ঘটামাত্র রাজার মৃত্যু হইল। রাজার ব্যবহারে শিব ত্যক্ত হইয়া চন্তাইকে আদেশ করিয়াছিলেন কলিযুগে লোকের পাপমতি হেতু আর তাঁহার সাক্ষাৎ মিলিবেনা, পূজার সময়ে শুধু তাঁহার পায়ের চিহ্ন দেখা যাইবে। সেই মতে শিব অন্তর্দ্ধান হইয়া গেলেন। মৈছিলিরাজের পর প্রতীত পর্য্যন্ত সাত জন নৃপতি হন, ইঁহাদের সময়ে কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা পাওয়া যায় না।