রাজমোহনের স্ত্রী/অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
যাহারা বন্দী করিল ও যে বন্দী হইল
আমাদিগকে দৃশ্যান্তরে যাইতে হইবে। ঘরখানি দেখিলে মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়, মেঝে হইতে ছাদের দূরত্ব অতি সামান্য; একটি মাত্র প্রদীপের ক্ষীণ আলোক গম্ভীরদর্শন স্থূল প্রাচীর-গাত্রে পড়িয়া ঘরখানিকে অধিকতর ভয়াবহ করিয়া তুলিয়াছিল। কক্ষটি আকারে ও আয়তনে এত ক্ষুদ্র, ইহার উচ্চতা এমন কম যে, দেখিলে মনে হয়, সাধারণ মানুষের বসবাসের জন্য ইহা সৃষ্ট হয় নাই, অপরাধীদিগের উপযুক্ত করিয়াই ইহা নির্ম্মিত। কক্ষটির একটি মাত্র দরজা, ক্ষুদ্র কিন্তু স্থূল লৌহ-নির্ম্মিত; দরজার আয়তনের তুলনায় ইহার হুড়কা ও খিল একটু বিরাটই বলিতে হইবে। এতদ্সত্ত্বেও এই কক্ষটির দৃঢ়তায় সন্দিহান হইয়াই যেন গৃহনির্ম্মাতা অদ্ভুত সাবধানতা অবলম্বন করিবার জন্য লৌহের পাত দিয়া সমস্ত কক্ষটি মুড়িয়া দিয়াছে। সেই অস্পষ্ট কম্পমান আলোকে কৃষ্ণবর্ণ ধাতু যেন ভ্রূকুটি করিতেছিল, মানুষকে জীবন্ত কবর দিবার যেন প্রতীক্ষা করিতেছিল। পূর্ব্বোক্ত লৌহ দ্বার ব্যতীত যাতায়াতের আর একটি সত্য অথবা নকল পথ এই কক্ষে ছিল। আগেরটির মতন ইহাও একটি দরজা, কক্ষের এক কোণে অবস্থিত এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় পাশ্ববর্ত্তী কোনও কক্ষে এই দ্বার দিয়া গমনাগমন চলে। ইহা কিন্তু আয়তনে আরও ক্ষুদ্র, এত ক্ষদ্র যে একটি শিশু হামা গুড়ি দিয়া সেই দরজা পার হইতে পারে। যে ভীষণদর্শন কক্ষটির কথা হইতেছিল, তাহাতে আসবাব-পত্রাদি কিছুই ছিল না—তাহা সম্পূর্ণ খালি ছিল। কক্ষের একটি মাত্র অধিবাসী, একজন পুরুম—কক্ষস্থিত প্রদীপের অস্পষ্ট কম্পমান আলোকে প্রতীয়মান হইতেছিল যে, সে কক্ষমধ্যে পদচারণা করিতেছে। পুরুষটি আর কেহই নহে, আমাদের মাধব ঘোষ।
পাঠকের বিস্মিত হইবার কারণ নাই; মাধবকে যাহারা বন্দী করিয়াছিল, তাহারা এইখানেই তাহাকে আটক করিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু তাহারা কেহই সেখানে উপস্থিত ছিল না। গভীর নিশীথের অর্দ্ধেক অতিবাহিত হইয়াছে। দরজার অর্গল বাহির হইতে বন্ধ ছিল এবং মাধব ঘোষ অন্তত বর্ত্তমানে কিছুকালের জন্য জীবন্ত কবরে সমাহিত হইয়াছিল। তথাপি তাহার নির্ভীক চিত্ত দমিয়া যায় নাই, তাহার আশাভঙ্গ হয় নাই। একটা ঘৃণা ও বিরক্তির ভাব তাহার মনকে আশ্রয় করিয়াছিল। সেই নির্জ্জন কক্ষে দীর্ঘপদসঞ্চারে পায়চারি করিতে করিতে মাধবের মনে এই সঙ্কল্প জাগ্রত হইল যে, যে ভয়ঙ্কর চরিত্রের দুর্ব্বৃত্তেরা তাহাকে বন্দী করিয়াছে, তাহাদের কোন ও অত্যাচারকেই সে গ্রাহ্য করিবে না।
অবশেষে দরজার বাহিরের তালার চাবি খোলার শব্দ হইল। তাহার পর খিল খোলার শব্দ; হুড়কো এবং শিকল খুব সাবধানে খোলা হইল; সেই বিরাট দরজার পাল্লা দুইটির কব্জা ক্যাঁচক্যাঁচ করিয়া উঠিল এবং যে দুই বর্ব্বর দস্যু তাহাকে বন্দী করিয়াছিল, তাহারা নিঃশব্দে কক্ষে প্রবেশ করিয়া তেমনই সাবধানতার সহিত দরজা বন্ধ করিল।
মাধব অসীম ঘৃণাভরে একট কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, কিন্তু তাহাদের আগমন যেন সে লক্ষ্যই করে নাই এমন ভাবে পূর্ব্ববৎ পদচারণা করিতে লাগিল। সর্দ্দার ও ভিখু উভয়েই প্রদীপের কাছ ঘেঁষিয়া বসিল। ভিখু কটিদেশপ্রলম্বিত একটি ঝুলি হইতে সামান্য পরিমাণ গাঁজা ও অতি ক্ষুদ্র মস্তকবিহীন একটি কলিকা বাহির করিয়া গাঁজাটুকু বাঁ হাতের তালুতে রাখিয়া ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের প্রবল চাপ দিয়া তাহা টিপিতে লাগিল— গাঁজা কলিকায় সাজিবার পূর্ব্বে এইরূপ করিতে হয়। সর্দ্দার ততক্ষণে বাতিটা একটু উস্কাইয়া লইতে লইতে ব্যঙ্গ করিয়া বলিতে লাগিল, বাবু যে দেখছি আজ রাত্রে বড় ভাল মানুষটি!
পায়চারিরত মাধব একটু থামিয়া দুর্ব্বৃত্তের মুখের দিকে চাহিল; তাহার চেহারা দেখিয়া মনে হইল যেন সে কিছু একটা জবাব দিবে। কিন্তু সে তাহা না করিয়া সহসা পিছন ফিরিয়া পূর্ব্বের মত নিঃশব্দে পায়চারি করিতে লাগিল। ততক্ষণে গাঁজা প্রস্তুত হইয়াছে। কলিকাতে অগ্নিসংযোগ করিয়া দস্যু দুইজন তাহা টানিতে শুরু করিয়াছে। বন্দীর নীরব ঘৃণায় তাহারা যেন উত্ত্যক্ত হইয়া উঠিল। এতক্ষণ পর্য্যন্ত কোন অপমানসূচক কথাবার্ত্তা হইতে তাহারা বিরত ছিল। সাধারণত দেখা যায় যে, যে ব্যক্তি শ্রদ্ধার উদ্রেক করিতে পারে অতি নীচ হিতাহিত ー বিবেচনাশূন্য বর্ব্বর ও দূর হইতে তাহার সম্মান বজায় রাখিয়া চলে; তাহাদের মনে কেন জানি না, একটা ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা জাগিয়া থাকে। পাঠকেরা লক্ষ্য করিয়াছেন, সর্দ্দার ঠিক সে শ্রেণীর বর্ব্বর ছিল না! তথাপি বন্দীর গর্ব্বিত দৃষ্টি ও কঠোর গাম্ভীর্য্য তাহাকে রসিকতার অবকাশ দেয় নাই। কিন্তু গঞ্জিকার ধূমে তাহার সংযম টলিয়া গেল।
ব্যঙ্গের হাসি হাসিয়া সে বলিয়া ফেলিল, বাবু, কল্কিতে দু-একটা টান দিয়ে দেখবেন? শপথ ক’রে বলছি গাঁজা যা সাজ হয়েছে, তাতে লাখোপতিও দুই-এক টান দিলে দোষ হবে না।
মাধব তবুও কোন কথা বলে না। সর্দ্দার যেন একটু দমিয়া গেল। সে ঘন ঘন গাঁজায় দম দিতে দিতে তাহার সঙ্গীর সহিত কুৎসিত বাক্যালাপে রত হইল।
পরিশেষে মাধব তাহার নীরবতা ভঙ্গ করিয়া প্রশ্ন করিল, তোমার মনিব আমাকে নিয়ে কি করতে চায়, বলতে পার? আমাদের কোনও মনিব নাই, গজ গজ করিতে করিতে এই কথা বলিয়া সর্দ্দার আবার গাঁজা ও অশ্লীল কথাবার্ত্তায় রত হইল।
মাধব আবার বলিল, মনিব না হোক এ কাজে তোমাদের যে ভাড়া করেছে সে—
পূর্ব্ববৎ কঠোর স্বরে সর্দ্দার জবাব দিল, ভাড়া আমাদের কেউ করে নি —সে গাঁজা টানিয়াই চলিল।
—এ কাজ যার হুকুমে তোমরা করেছ—মাধব বলিল।
—কারো হুকুমে নয়। —সর্দ্দার জবাব দিল।
—কেউ নয়? তবে কি আমাকে নিয়ে খেলা করবার জন্যে ধ’রে এনেছ?
সর্দ্দার তৎক্ষণাৎ উত্তর করিল, খেলা নয়। আমাদের টাকার দরকার, টাকা চাই।
গর্ব্বিত সর্দ্দারের বিশ্বাস ছিল যে, সে ধনী এবং প্রতিপত্তিশালী লোকদের আতঙ্কস্বরূপ, তাহাদের প্রতিপত্তি নষ্ট করাই তাহার কাজ; মাধবের শান্ত সংযত ব্যবহার ও উদ্ধত ভাষা তাহার সেই গর্ব্বে আঘাত করিল। সেও মাধবকে উত্তর-প্রত্যুত্তরে আঘাত দিতে কৃতসঙ্কল্প হইল।
মাধব প্রশ্ন করিল, টাকা তোমাদের দেবে কে?
সর্দ্দার বলিল, ভেবে দেখ |
—সে ভাবনা আমার নয়।
একটা গভীর চাপা দীর্ঘনিশ্বাসের মত শব্দে কথোপকথননিরত ব্যক্তিরা চমকিয়া উঠিল।
ভিখু বিস্ময়ে চীৎকার করিয়া উঠিল, ও আবার কি?
সর্দ্দারও বিস্মিত হইয়াছিল, সেও বলিয়া উঠিল, তাই তো, ওটা আবার কি?—তিনজনেই কিয়ৎকালের জন্য নীরব রহিল।
সর্দ্দার বলিল, এ ঘরে আর কেউ আছে নাকি? তা হ’লে ব্যাপারটা মন্দ গড়ায় না। দেখি।
তাহার যেখানে বসিয়া ছিল, সেখান হইতেই সেই অস্পষ্ট আলোকেই ঘরের সমস্ত অংশ যতদূর সম্ভব দৃষ্ট হইতেছিল—সর্দ্দার তথাপি উঠিয়া দাঁড়াইল এবং ঘরের সকল কোণই পরীক্ষা করিল। কিন্তু আর কিছুই সে দেখিতে পাইল না। পূর্ব্বস্থানে ফিরিয়া আসিতে আসিতে সে বলিল, অবাক কাণ্ড বটে! মরুকগে যাক। হুজুর আমার মনিবের কথা বলছিলেন, তিনি কে হুজুরের জানা আছে কি?
তাহার ভাষা ও কণ্ঠস্বরে মাধব অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু বিরক্তি চাপিয়া সে সংক্ষেপে জবাব দিল, হ্যাঁ জানি, মথুর ঘোষ। তার মতলবটা আমাকে জানাবে কি?
ভিখু বিস্ময়ে হাঁ করিয়া ফেলিল, সর্দ্দারের কানে কানে বলিল, ব্যাপার কি, সব জেনে ফেলেছে দেখছি!
সর্দ্দার তেমনই চাপা গলায় বলিল, বোকার ডিম, এতে অবাক হবার কি আছে! রাধানগরে আর কার এমন লোহার পাতমোড়া কয়েদখানা আছে?
কিন্তু সে মাধবের প্রশ্নের কোনও জবাব দিল না; মাধবের গর্ব্ব খর্ব্ব করিবার সঙ্কল্পবশতও বটে, আবার তাহাকে একটু খেলাইয়া তাহার নিজের মতলব হাঁসিল করিবার জন্যও বটে, সে চুপ করিয়া রহিল। কিন্তু গাঁজার ধোঁয়ায় ভিখুর মেজাজ তখন চড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল। সে সাধারণত কথা কম বলে, কিন্তু গঞ্জিকা-মহিমায় তাহার সে মৌন-বাঁধ দ্রুত ভাঙিতে শুরু করিয়াছিল।
সে বলিয়া উঠিল, ভালরে ভাল, আমরা টাকা চাই, ও রক্তমাংসের জীবটিকে নিয়ে করব কি!
সর্দ্দার বলিল, খেয়ে ফেল্, গিলে ফেল্—
সর্দ্দারের রসিকতায় ভিখু কর্কশ কণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। কিন্তু তাহার হাসি সম্পূর্ণ হইতে না হইতেই ভয়ে তাহার মুখের হাসি মুখে মিলাইল; আবার সেই চাপা আর্ত্তনাদ শ্রুত হইল; এবার যেন ঠিক ছাদের কাছ হইতে শব্দটা আসিতেছিল।
আতঙ্কিত সর্দ্দার চীৎকার করিয়া উঠিল, আবার!
ভিখু তখন ভয়বিমূঢ়, অপদেবতাদের কথা তাহার মনে ভিড় করিয়া আসিতেছিল। মাধবও অস্বস্তি অনুভব করিতেছিল, কিন্তু অন্য কারণে।
ভিখু ফিসফিস করিয়া বলিল, জায়গাটা অনেক দিন খালি পড়েছিল, কে জানে সেই সুযোগে তাঁরা সব এখানে ডেরা বেঁধেছেন কি না!
অধিকতর সাহসী সর্দ্দারের মনে যদিও অপদেবতাদের যথেষ্ট ভয় ছিল, তথাপি সে খানিকক্ষণ সে ভয়কে আমল দিল না। এই সকল দস্যুদের উপজীবিকাই এরূপ যে, তাহাদিগকে এমন নিঃসঙ্গ নির্জ্জন ভয়সঙ্কুল স্থানে সচরাচর চলাফেরা করিতে হয়—যেখানে গেলে সাধারণ লোকের নানাবিধ অপদেবতার ভয় জাগা স্বাভাবিক। তাহাদের অশিক্ষিত মনে ভয় যে থাকে না তাহা নয়, তবু অভ্যাসবশত তাহারা নিজেদের অনেকটা শক্ত করিয়া রাখে।
সর্দ্দার বলিল, হয়তো আশেপাশে কেউ লুকিয়ে আছে, আমি দেখছি। ভিখু, তুই বাবুর ওপর নজর রাখ্।
সর্দ্দার ধুতির খানিকটা অংশ ছিঁড়িয়া লইয়া সলিতার মত পাকাইয়া প্রদীপের তৈলে তাহা সিঞ্চিত করিয়া তাহাতে অগ্নিসংযোগ করিল এবং এই অপরূপ দীপ হস্তে সাবধানে দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিল। বারান্দার সমস্ত অন্ধিসন্ধি সে খুঁজিয়া দেখিল। পাশাপাশি তিনটি ঘর, মাঝেরটিতে মাধবকে ধরিয়া রাখা হইয়াছিল; এই তিনটি ঘরসংলগ্ন বারান্দাটা। বারান্দায় কিছু না দেখিতে পাইয়া সে প্রাচীরবেষ্টিত সামনের খোলা উঠানে নামিয়া খুঁজিতে লাগিল। কিন্তু ফলোদয় হইল না। সে বিরক্ত হইয়া সন্দিগ্ধভাবে পুনরায় কক্ষে প্রবেশ করিল। ভিখু এতক্ষণে সত্যসত্যই আতঙ্কিত হইয়াছিল। তাড়াতাড়ি সেই স্থান পরিত্যাগ করিবার বাসনায় সে সর্দ্দারের কনুইয়ে চিমটি কাটিয়া ইশারায় শীঘ্র কাজ সারিয়া লইতে বলিল।
সর্দ্দার বুঝিল, বলিল, দেরি হয়ে যাচ্ছে, এটা আমাদের ঘুমোবার জায়গা নয় মাধববাবু। আমাদের শর্ত্তে যদি রাজি হও, তোমাকে এখুনি ছেড়ে দি।
মাধব নিজের সুবিধাটা হৃদয়ঙ্গম করিল, তাচ্ছিল্য ভরে সে বলিল, কি শর্ত্ত?
—তোমার খুড়োর উইলটি আমাদের হাতে দাও।
বিশেষ না ভাবিয়া মাধব জবাব দিল, সেটা তো এখানে আমার কাছে নেই —মাধব আবার পায়চারি করিতে লাগিল।
সর্দ্দারও সংক্ষেপে বলিল, তা হ’লে এখানেই পচে ম’র, আমরা চাবি নিয়ে চললাম।
—আচ্ছা ধর, উইলটা আমি দিতেই চাই, এখানে থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করি কি ক’রে?
দস্যু এবার নিজের সুযোগ বুঝিল, বলিল, সে ব্যবস্থা তুমিই করবে। একটা মতলব ঠিক ক’রে ফেল। তোমার অবস্থায় পড়লে আমি, যারা আমাকে বন্দী করেছে, তাদেরই কারু হাতে বাড়িতে চিঠি লিখে পাঠাতাম, তার হাতে উইল পাঠিয়ে দিতে বলতাম।
—যদি বাড়িতে জিজ্ঞেস করে, আমি কোথা থেকে চিঠি দিচ্ছি, কি জবাব দেবে?
পুনরায় সেই অপার্থিব শব্দ তাহাদের কর্ণে প্রবেশ করিল। একটা অত্যন্ত চাপা মৃদু আর্ত্তনাদ—মানুষে সে প্রকার শব্দ করিতে পারে না। এবারও মনে হইল ছাদ হইতে শব্দটা আসিতেছে!
দস্যু দুইজন ভয়ে উঠিয়া দাঁড়াইল; মাধব বিচলিত হইল।
সে প্রশ্ন করিল, দোতলায়, ঠিক ওপরে কি ঘর আছে?
উভয় দস্যুই সমস্বরে জবাব দিল, না, না।
সর্দ্দার বলিল, দাঁড়াও, আমি ছাদে গিয়ে দেখছি।
সর্দ্দারের মত পাকা ডাকাতের পক্ষে অনতিউচ্চ ছাদে উঠা কঠিন হইল না। লাফাইয়া প্রাচীর বাহিয়া সে ছাদে উঠিল, কিন্তু সেখানে কিছুই দেখিতে পাইল না। ছাদের আলিসায় ভর দিয়া সে বাড়িটির পিছনের দিকে নীচে চাহিয়া দেখিল। কোথায় ও কিছু নাই। বিরক্ত ও চিন্তান্বিত অবস্থায় সে পুনরায় ঘরে ফিরিয়া আসিল।
মাধব যেন সহসা একটা কিনারা দেখিতে পাইল। সে প্রশ্ন করিল, আচ্ছা, এই ঘরের পাশে আর ও দুটো ঘর আছে, না?
সর্দ্দার বলিল, হ্যাঁ, সেই রকমই তো বোধ হয়।
—আর কাউকেও কি ওই ঘরের কোনটাতে ধ’রে এনে রেখেছ?
一না।
—হয়তো আর কেউ ধ’রে এনেছে। মনে হচ্ছে, ওই শয়তানের কবলে প’ড়ে আর কোনও হতভাগ্য ভীষণ দুর্দ্দশাপন্ন হয়ে আর্ত্তনাদ করছে। —মাধব যেন আত্মগত ভাবেই কথাগুলি বলিল —গিয়ে দেখতে পার ওখানে কেউ আছে কি না?
সর্দ্দার ও প্রায় নিজের মনেই বলিল, তুমি বোধ হয় ঠিক ধরেছ। দরজায় নিশ্চয়ই তালা দেওয়া আছে। তা হ’লে ও আমি চেঁচিয়ে প্রশ্ন করব, কেউ ভেতরে থাকলে জবাব পাব নিশ্চয়ই।
সর্দ্দার পুনরায় আর একটি সলিতা পাকাইয়া তাহা লইয়া অগ্রসর হইল। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে, দুইটি ঘরের দরজাই খোলা—কেহ কোথাও নাই।
মাধব এবার সত্য সত্যই বিস্ময়বিমূঢ় হইল। সে বুঝিতে পারিল যে, যেখানে যেখানে লোক থাকা সম্ভব সর্ব্বত্রই অনুসন্ধান করা হইয়াছে। দস্যু-সর্দ্দার এইবার অপদেবতার অধিষ্ঠান সম্বন্ধে প্রায় নিঃসন্দেহ হইয়া উঠিয়াছিল। আতঙ্ক-বিহ্বল ভিখু সর্দ্দরের কাছ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল।
সর্দ্দার মাধবকে বলিল, দেখ আমরা আর এখানে থাকব না। দেবতাদের গতিবিধি দেবতারাই জানেন। তোমার কিছু বলবার থাকে বল, নইলে তোমাকে বন্ধ ক’রে আমরা চললাম।
মাধব দেখিল, তাহাদের শর্তে রাজি না হইলে আর উপায় নাই। যদি তাহারা দরজা বন্ধ করিয়া চলিয়া যায়, আবার যে কবে সে বন্ধ দরজা খুলিবে কেহ বলিতে পারে না। যদি সে রাজি হয় তাহা হইলে এমনও হইতে পারে যে, তাহার চিঠি দেখিয়া অনুসন্ধান করিতে করিতে তাহার আত্মীয়দের কেহ তাহার সন্ধান করিতে পারে। সে একবার শেষ চেষ্টা করিয়া দেখিতে চাহিল।
সর্দ্দারকে লক্ষ্য করিয়া সে বলিল, তোমার দরকার টাকা, উইলটা যদি তুমি পাও তা হ’লে কিছু টাকাও পাবে। কত টাকা তুমি পাবে আমাকে বল, আমি তার দ্বিগুণ দিচ্ছি—উইলের বদলে টাকা নিয়ে আমাকে ছেড়ে দাও।
—না, না। অততে আমাদের দরকার নেই। আমরা এত বোকা নই যে বিশ্বাস করব তোমাকে। একবার ছাড়া পেলে তুমি আমাদের কলা দেখাতে ছাড়বে না। চিঠি দাও, নইলে আমরা চললাম।
ঘরের ভিতরেই কোথায় যেন কাপড়ের খস খস আওয়াজ হইল। দস্যুরা পরস্পর মুখ-চাওয়াচাওয়ি করিল, আর অপেক্ষা না করিয়া পলায়ন করাটাই যেন তাহারা নিরাপদ মনে করিতেছিল। মাধব তাহাদের মুখ দেখিয়া তাহাদের মনের অবস্থা বুঝিল, সে কাগজ ও কলম চাহিল। কাগজ-কলম তাহাদের সঙ্গেই ছিল। মাধব কাগজ-কলম লইয়া বাড়িতে প্রধান আমলার নামে চিঠি লিখিতে বসিল।
সর্দ্দার বলিল, আমি ব’লে যাই, তুমি লেখ; ফাঁকি দিয়ে যে আমাকে ধরিয়ে দেবে সেটি আমি হতে দিচ্ছি না। মনে রেখো, আমি এক সময় তোমার মত লিখতে পড়তে জানতাম।
মাধব অবাক হইয়া সর্দ্দারের দিকে চাহিল। সে সর্দ্দারের কথায় রাজি হইয়া তাহার নির্দ্দেশমত লিখিতে বসিল। সর্দ্দার বলিতে শুরু করিল, কিন্তু তখন অপদেবতার ভয় তাহার মনে নানা উত্তেজনার সৃষ্টি করিতেছিল, সে শান্তভাবে চিঠি লিখাইতে পারিতেছিল না। মাধব লিখিতে লাগিল।
সেই মুহূর্ত্তে শিকলের গভীর ঝনঝন শব্দের সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রবল দাপাদাপির আওয়াজ বজ্রনির্ঘোষের মত সেই ভীত আতঙ্কিত দলের কানে প্রবেশ করিল। পরক্ষণেই সেই অপার্থিব আর্ত্তনাদ —আরও উচ্চ আরও কর্কশ। ভিখু এক লাফে বারান্দায় পড়িয়া চীৎকার করিতে করিতে বাড়ির বাহির হইয়া গেল। সর্দ্দার ও বিচলিত হইয়া বারান্দায় আসিল। সে সেখানে যে দৃশ্য দেখিল, তাহাতেই আতঙ্কবিমূঢ় হইয়া দরজায় তালা বন্ধ করিবার অপেক্ষা না করিয়াই, পিছনে না চাহিয়াই দ্রুতগতিতে পলায়ন করিল। মাধব সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ করিল।
ওই সকল অলৌকিক শব্দ এবং দস্যু দুইজনের অতর্কিত পলায়নে মাধব স্বয়ং এতদূর কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়াছিল যে, নিজের অবস্থা সম্যক উপলব্ধি করিবার সামর্থ্য তাহার ছিল না। সে কিয়ৎকালের জন্য স্থাণুর মত দাঁড়াইয়া রহিল, কি বলিবে স্থির করিতে পারিল না। কিন্তু পরক্ষণেই সে নিজের ব্যবহারে লজ্জিত হইয়া রমণীসুলভ ভয় পরিত্যাগ করিয়া বারান্দায় লাফাইয়া পড়িল। কিছুই প্রথমে দৃষ্টিগোচর হইল না। খানিকক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া সে দেখিল, বারান্দার একটি দরজা হইতে খোলা উঠানে একটি আলোকরেখা পতিত হইয়াছে। সেই দিক লক্ষ্য করিয়া সে ধাবমান হইল, দেখিল, দরজাটি উন্মুক্ত এবং একজন রমণী সেই নির্জ্জন স্থানে দাঁড়াইয়া আছে। একটি ছোট লণ্ঠন মাটির উপর রক্ষিত। সেই লণ্ঠনটি হাতে তুলিয়া ভাল করিয়া দেখিতে গিয়া মাধব যাহা দেখিল, তাহাতে তাহার বিস্ময়ের অবধি রহিল না।
মাধব সবিস্ময়ে আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল, তারা!
তারাও বিস্ময়ে নির্ব্বাক হইয়াছিল, সে বলিল, মাধব!
কিন্তু উপর হইতে তখন ও সেই ব্যথিত আর্ত্তনাদ শ্রুত হইতেছিল।