বিষয়বস্তুতে চলুন

রাজর্ষি/ষট‍্‌ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

""

ষট‍্‌ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

বিল্বন ফিরিয়া গিয়া দেখিলেন, ইতিমধ্যে রাজা কুকিদের বিদায় করিয়া দিয়াছেন। তাহারা রাজ্যমধ্যে উপদ্রব আরম্ভ করিয়া দিয়াছিল। সৈন্যদল প্রায় ভাঙিয়া দিয়াছেন। যুদ্ধের উদ্‌‍যোগ বড়ো একটা কিছু নাই। বিল্বন ফিরিয়া আসিয়া রাজাকে সমস্ত বিবরণ বলিলেন।

রাজা কহিলেন, “তবে ঠাকুর, আমি বিদায় হই। নক্ষত্রের জন্য রাজ্য ধন রাখিয়া দিয়া চলিলাম।”

বিল্বন কহিলেন, “অসহায় প্রজাদিগকে পরহস্তে ফেলিয়া দিয়া তুমি পলায়ন করিবে, ইহা স্মরণ করিয়া আমি কোনোমতেই প্রসন্ন মনে বিদায় দিতে পারি না মহারাজ! বিমাতার হস্তে পুত্রকে সমর্পণ করিয়া ভারমুক্ত মাতা শান্তিলাভ করিলেন, ইহা কি কল্পনা করা যায়?”

রাজা কহিলেন, “ঠাকুর, তোমার বাক্য আমার হৃদয়ে বিদ্ধ হইয়া প্রবেশ করে। কিন্তু এবার আমাকে মার্জনা করো, আমাকে আর অধিক কিছু বলিয়ো না। আমাকে বিচলিত করিবার চেষ্টা করিয়ো না। তুমি জানো ঠাকুর, আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম রক্তপাত আর করিব না, সে প্রতিজ্ঞা আমি ভাঙিতে পারি না।”

বিল্বন কহিলেন, “তবে এখন মহারাজ কী করিবেন?”

রাজা কহিলেন, “তবে তোমাকে সমস্ত বলি। আমি ধ্রুবকে সঙ্গে করিয়া বনে যাইব। ঠাকুর, আমার জীবন অত্যন্ত অসম্পূর্ণ রহিয়া গিয়াছে। যাহা মনে করিয়াছিলাম তাহার কিছুই করিতে পারি নাই– জীবনের যতখানি চলিয়া গেছে তাহা ফিরিয়া পাইয়া আর নূতন করিয়া গড়িতে পারিব না– আমার মনে হইতেছে, ঠাকুর, অদৃষ্ট যেন আমাদিগকে তীরের মতো নিক্ষেপ করিয়াছে, লক্ষ্য হইতে যদি একবার একটু বাঁকিয়া গিয়া থাকি, তবে আর যেন সহস্র চেষ্টায় লক্ষ্যের মুখে ফিরিতে পারি না। জীবনের আরম্ভ-সময়ে আমি সেই যে বাঁকিয়া গিয়াছি, জীবনের শেষকালে আমি আর লক্ষ্য খুঁজিয়া পাইতেছি না। যাহা মনে করি তাহা আর হয় না। যে সময়ে জাগিলে আত্মরক্ষা করিতে পারিতাম সে সময়ে জাগি নাই, যে সময়ে ডুবিয়াছি তখন চৈতন্য হইয়াছে। সমুদ্রে পড়িলে লোকে যেভাবে কাষ্ঠখণ্ড অবলম্বন করে আমি বালক ধ্রুবকে সেইভাবে অবলম্বন করিয়াছি। আমি ধ্রুবের মধ্যে আত্মসমাধান করিয়া ধ্রুবের মধ্যে পুনর্জন্ম লাভ করিব। আমি প্রথম হইতে ধ্রুবকে মানুষ করিয়া গড়িয়া তুলিব। ধ্রুবের সহিত তিলে তিলে আমিই বাড়িতে থাকিব। আমার মানবজন্ম সম্পূর্ণ করিব। ঠাকুর, আমি মানুষের মতো নই, আমি রাজা হইয়া কী করিব!”

শেষ কথাটা রাজা অত্যন্ত আবেগের সহিত উচ্চারণ করিলেন– শুনিয়া, ধ্রুব রাজার হাঁটুর উপর তাহার মাথা ঘষিয়া ঘষিয়া কহিল, “আমি আজা।”

বিল্বন হাসিয়া ধ্রুবকে কোলে তুলিয়া লইলেন। অনেকক্ষণ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া অবশেষে রাজাকে কহিলেন, “বনে কি কখনো মানুষ গড়া যায়? বনে কেবল একটা উদ্ভিদ পালন করিয়া তোলা যাইতে পারে। মানুষ মনুষ্যসমাজেই গঠিত হয়।”

রাজা কহিলেন, “আমি নিতান্তই বনবাসী হইব না, মনুষ্যসমাজ হইতে কিঞ্চিৎ দূরে থাকিব মাত্র, অথচ সমাজের সহিত সমস্ত যোগ বিচ্ছিন্ন করিব না। এ কেবল দিনকতকের জন্য।”

এ দিকে নক্ষত্ররায় সৈন্য-সমেত রাজধানীর নিকটবর্তী হইলেন। প্রজাদের ধনধান্য লুণ্ঠিত হইতে লাগিল। প্রজারা কেবল গোবিন্দমাণিক্যকেই অভিশাপ দিতে লাগিল। তাহারা কহিল, “এ সমস্তই কেবল রাজার পাপে ঘটিতেছে।” রাজা একবার রঘুপতির সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিলেন। রঘুপতি উপস্থিত হইলে তাঁহাকে কহিলেন, “আর কেন প্রজাদিগকে কষ্ট দিতেছ? আমি নক্ষত্ররায়কে রাজ্য ছাড়িয়া দিয়া চলিয়া যাইতেছি। তোমার মোগল-সৈন্যদের বিদায় করিয়া দাও।”

রঘুপতি কহিলেন, “যে আজ্ঞা, আপনি বিদায় হইলেই আমি মোগল-সৈন্যদের বিদায় করিয়া দিব– ত্রিপুরা লুণ্ঠিত হয় ইহা আমার ইচ্ছা নহে।”

রাজা সেইদিনই রাজ্য ছাড়িয়া যাত্রার উদ্‌‍যোগ করিলেন, তাঁহার রাজবেশ ত্যাগ করিলেন, গেরুয়া বসন পরিলেন। নক্ষত্ররায়কে রাজার সমস্ত কর্তব্য স্মরণ করাইয়া এক দীর্ঘ আশীর্বাদ-পত্র লিখিলেন।

অবশেষে রাজা ধ্রুবকে কোলে তুলিয়া বলিলেন, “ধ্রুব, আমার সঙ্গে বনে যাবে বাছা?” ধ্রুব তৎক্ষণাৎ রাজার গলা জড়াইয়া কহিল, “যাব।”

এমন সময়ে রাজার সহসা মনে হইল ধ্রুবকে সঙ্গে লইয়া যাইতে হইলে তাহার খুড়া কেদারেশ্বরের সম্মতি আবশ্যক; কেদারেশ্বরকে ডাকাইয়া রাজা কহিলেন, “কেদারেশ্বর, তোমার সম্মতি পাইলে আমি ধ্রুবকে আমার সঙ্গে লইয়া যাই।”

ধ্রুব দিনরাত্রি রাজার কাছেই থাকিত, তাহার খুড়ার সহিত তাহার বড়ো একটা সম্পর্ক ছিল না, এইজন্যই বোধ করি রাজার কখনো মনে হয় নাই যে, ধ্রুবকে সঙ্গে লইয়া গেলে কেদারেশ্বরের কোনো আপত্তি হইতে পারে।

রাজার কথা শুনিয়া কেদারেশ্বর কহিল, “সে আমি পারিব না মহারাজ।”

শুনিয়া রাজার চমক ভাঙিয়া গেল। সহসা তাঁহার মাথায় বজ্রাঘাত হইল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “কেদারেশ্বর, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো।”

কেদারেশ্বর। না মহারাজ, বনে যাইতে পারিব না।

রাজা কাতর হইয়া কহিলেন, “আমি বনে যাইব না; আমি ধনজন লইয়া লোকালয়ে থাকিব।”

কেদারেশ্বর কহিল, “আমি দেশ ছাড়িয়া যাইতে পারিব না।”

রাজা কিছু না বলিয়া গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। তাঁহার সমস্ত আশা ম্রিয়মাণ হইয়া গেল। নিমেষের মধ্যে সমস্ত ধরণীর মুখ যেন পরিবর্তিত হইয়া গেল। ধ্রুব আপন মনে খেলা করিতেছিল– অনেকক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন অথচ তাহাকে যেন চোখে দেখিতে পাইলেন না। ধ্রুব তাঁহার কাপড়ের প্রান্ত ধরিয়া টানিয়া কহিল, “খেলা করো।”

রাজার সমস্ত হৃদয় গলিয়া অশ্রু হইয়া চোখের কাছে আসিল, অনেক কষ্টে অশ্রুজল দমন করিলেন। মুখ ফিরাইয়া ভগ্নহৃদয়ে কহিলেন, “তবে ধ্রুব রহিল। আমি একাই যাই।”

অবশিষ্ট জীবনের সুদীর্ঘ মরুময় পথ যেন নিমেষের মধ্যে বিদ্যুদালোকে তাঁহার চক্ষুতারকায় অঙ্কিত হইল।

কেদারেশ্বর ধ্রুবের খেলা ভাঙিয়া দিয়া তাহাকে বলিল, “আয় আমার সঙ্গে আয়।”

বলিয়া তাহার হাত ধরিয়া টানিল। ধ্রুব ক্রন্দনের স্বরে বলিয়া উঠিল, “না।”

রাজা সচকিত হইয়া ধ্রুবের দিকে ফিরিয়া চাহিলেন। ধ্রুব ছুটিয়া আসিয়া রাজাকে জড়াইয়া ধরিয়া তাড়াতাড়ি তাঁহার দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ লুকাইল। রাজা ধ্রুবকে কোলে তুলিয়া লইয়া তাহাকে বুকের মধ্যে চাপিয়া রাখিলেন। বিশাল হৃদয় বিদীর্ণ হইতে চাহিতেছিল, ক্ষুদ্র ধ্রুবকে বুকের কাছে চাপিয়া হৃদয়কে দমন করিলেন। ধ্রুবকে সেই অবস্থায় কোলে রাখিয়া তিনি দীর্ঘ কক্ষে পদচারণ করিতে লাগিলেন। ধ্রুব কাঁধে মাথা রাখিয়া অত্যন্ত স্থির হইয়া পড়িয়া রহিল।

অবশেষে যাত্রার সময় হইল। ধ্রুব রাজার কোলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। ঘুমন্ত ধ্রুবকে ধীরে ধীরে কেদারেশ্বরের হস্তে সমর্পণ করিয়া রাজা যাত্রা করিলেন।