রাজসিংহ/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 অনন্ত মিশ্র, চঞ্চলকুমারীর পিতৃকুলপুরোহিত। কন্যানির্ব্বিশেষে, চঞ্চলকুমারীকে ভাল বসিতেন। তিনি মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত। সকলে তাঁহাকে ভক্তি করিত। চঞ্চলের নাম করিয়া তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠাইবামাত্র তিনি অন্তঃপুরে আসিলেন—কুলপুরোহিতের অবারিত দ্বার। পথিমধ্যে নির্ম্মল তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিল।—এবং সকল কথা বুঝাইয়া দিয়া ছাড়িয়া দিল।

 বিভূতিচন্দনবিভূষিত, প্রশস্ত ললাট, দীর্ঘকায়, রুদ্রাক্ষ শোভিত, হাস্যবদন, সেই ব্রাহ্মণ চঞ্চলকুমারীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। নির্ম্মল দেখিয়াছিল, যে চঞ্চল কাঁদিতেছে কিন্তু আর কাহারও কাছে চঞ্চল কাঁদিবার মেয়ে নহে। গুরুদেব দেখিলেন, চঞ্চল স্থিরমূর্ত্তি। বলিলেন,

 “মা লক্ষ্মী,—আমাকে স্মরণ করিয়াছ কেন?”

 চ। আমাকে বাঁচাইবার জন্য। আর কেহ নাই যে আমায় বাঁচায়।

 অনন্ত মিশ্র হাসিয়া বলিলেন, “বুঝেছি রুক্মিণীর বিয়ে, সেই পুরোহিত বুড়াকেই দ্বারকার যেতে হবে। তা দেখ দেখি মা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে কিছু আছে কিনা—পথ খরচটা জুটিলেই আমি উদয়পুরে যাত্রা করিব।”

 চঞ্চল, একটী জরির থলি বাহির করিয়া দিল। তাহাতে আশরফি ভরা। পুরোহিত দুইটা আশরফি লইয়া অবশিষ্ট ফিরাইয়া দিলেন—বলিলেন, “পথে অন্নই খাইতে হইবে—আশরফি খাইতে পারিব না। একটি কথা বলি, পারিবে কি?”

 চঞ্চল বলিলেন, “আমাকে আগুনে ঝাঁপ দিতে বলিলেও, আমি এ বিপদ হইতে উদ্ধার হইবার জন্য তাও পারি। কি আজ্ঞা করুন।”

 মিশ্র। রাণা রাজসিংহকে একখানি পত্র লিখিয়া দিতে পারিবে?

 চঞ্চল ভাবিল। বলিল, “আমি বালিকা— পুরস্ত্রী; তাঁহার কাছে অপরিচিতা—কি প্রকারে পত্র লিখি? কিন্তু আমি তাঁহার কাছে যে ভিক্ষা চাহিতেছি, তাহাতে লজ্জারই বা স্থান কই? লিখিব?”

 মিশ্র। আমি লিখাইয়া দিব, না আপনি লিখিবে?

 চ। আপনি বলিয়া দিন।

 নির্ম্মল সেখানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সে বলিল,

 “তা হইবে না। এ বামুনে বুদ্ধির কাজ নয়—এ মেয়েলি বুদ্ধির কাজ। আমরা পত্র লিখিব। আপনি প্রস্তুত হইয়া আসুন।”

 মিশ্রঠাকুর চলিয়া গেলেন কিন্তু গৃহে গেলেন না। রাজা বিক্রমসিংহের নিকট দর্শন দিলেন। বলিলেন, “আমি দেশপর্য্যটনে গমন করিব, মহারাজকে আশীর্ব্বাদ করিতে আসিয়াছি।” কি জন্য কোথায় যাইবেন, রাজা তাহা জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ তাহা কিছুই প্রকাশ করিয়া বলিলেন না। তথাপি তিনি যে উদয়পুর পর্য্যন্ত যাইবেন তাহা স্বীকার করিলেন। এবং রাণার নিকট পরিচিত হইবার জন্য একখানি লিপির জন্য পার্থিত হইলেন। রাজাও পত্র দিলেন।

 অনন্ত মিশ্র রাজার নিকট হইতে পত্র সংগ্রহ করিয়া চঞ্চল কুমারীর নিকট পুনরাগমন করিলেন। ততক্ষণ চঞ্চল ও নির্ম্মল, দুইজনে দুই বুদ্ধি একত্র করিয়া একখানি পত্র সমাপন করিয়াছিল। পত্র শেষ করিয়া রাজনন্দিনী একটা কৌটা হইতে অপূর্ব্ব শোভাবিশিষ্ট মুকুতাবলয় বাহির করিয়া ব্রাহ্মণের হস্তে দিয়া বলিলেন, “রাণা পত্র পড়িলে, আমার প্রতিনিধি স্বরূপ আপনি এই রাখি বাঁধিয়া দিবেন।” রাজপুত কুলের যিনি চূড়া তিনি কখন রাজপুতকন্যার প্রেরিত রাখি অগ্রাহ্য করিবেন না।”

 মিশ্রঠাকুর স্বীকৃত হইলেন। রাজকুমারী তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বিদায় করিলেন।