রাজসিংহ (১৮৮৫)/ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

 রাণাকে বিদায় দিয়া, মাণিকলাল রূপনগরের সেনার পশ্চাৎ পশ্চাৎ পর্ব্বতারোহণ করিল। পলায়নপরায়ণ, মোগলসেনা তৎকর্ত্তৃক তাড়িত হইয়া যে যেখানে পাইল পলায়ন করিল। তখন মাণিলাল রূপনগরের সৈনিকদিগকে বলিলেন; “শত্রুদল পলায়ন করিয়াছে—আর কেন বৃথা পরিশ্রম করিতেছে? কার্য্য সিদ্ধ হইয়াছে, রূপনগরে ফিরিয়া যাও।” সৈনিকেরাও দেখিল—তাও বটে, সম্মুখশত্রু আর কেহ নাই। তখন তাহারা মহারাজা রাজসিংহের জয়ধ্বনি তুলিয়া রণজয়গর্ব্বে গৃহাভিমুখে ফিরিল। দণ্ডকাল মধ্যে পার্ব্বত্য পথ জনশূন্য হইল—কেবল হত ও আহত মনুষ্য ও অশ্ব সকল পড়িয়া রহিল। দেখিয়া উচ্চ পর্ব্বতের উপরে, প্রস্তরসঞ্চালনে যে সকল রাজপুত নিযুক্ত ছিল, তাহারা নামিল। এবং কোথাও কাহাকেও না দেখিয়া রাণা অবশিষ্ট সৈন্য সহিত অবশ্য উদয়পুর যাত্রা করিয়াছেন বিবেচনা করিয়া তাহারাও তাঁহার সন্ধানে সেই পথে চলিল। পথিমধ্যে রাজসিংহের সহিত সাক্ষাৎ হইল। সকলে একত্রে উদয়পুরে চলিলেন।

 সকলে জুটিল—কেবল মাণিকলাল নহে। মাণিকলাল, নির্ম্মলকে লইয়া বিব্রত। সকলকে গুছাইয়া পাঠাইয়া দিয়া, নির্ম্মলের কাছে আসিয়া জুটিল। তাহাকে কিছু ভোজন করাইয়া, গ্রাম হইতে বাহক ও দোলা লইয়া আসিল। দোলায় নির্ম্মলকে তুলিয়া, যে পথে রাণা গিয়াছেন সে পথে না গিয়া ভিন্ন পথে চলিল—বমাল সমেত ধরা পড়ে, এমত ইচ্ছা রাখে নাই।

 মাণিকলাল নির্ম্মলকে লইয়া পিসীর বাড়ী উপস্থিত হইল। পিসীমাকে ডাকিয়া বলিল, “পিসী মা, একটা বউ এনেছি।” বধূ দেখিয়া পিসীমা কিছু বিষণ্ণ হইলেন—মনে করিলেন— লাভের যে আশা করিয়াছিলাম—বধূ বুঝি তাহার ব্যাঘাত করিবে। কি করে, দুইটা আশরাফি নগদ লইয়াছে—একদিন অন্ন না দিয়া বহুকে তাড়াইয়া দিতে পারিবে না। সুতরাং বলিল, “বেশ বউ।”

 মাণিকলাল বলিল, “পিসী—বহুর সঙ্গে আমার আজিও বিবাহ হয় নাই।”

 পিসীমা বুঝিলেন, তবে এটা উপপত্নী। যো পাইয়া বলিল, “তবে আমার বাড়ীতে—”

 মাণিকলাল। “তার ভাবনা কি? বিয়ে দাও না? আজই বিবাহ হউক।”

 নির্ম্মল লজ্জায় অধোবদন হইল।

 পিসী মা আবার যো পাইলেন, বলিলেন, “সে ত সুখের কথা—তোমার বিবাহ দিব না ত কার বিবাহ দিব? তা বিবাহে ত কিছু খরচ চাই?”

 মাণিকলাল বলিল, “তার ভাবনা কি?”

 পাঠকের জানা থাকিতে পারে, যুদ্ধ হইলেই লুঠ হয়। মাণিকলাল যুদ্ধক্ষেত্র হইতে আসিবার সময়ে নিহত মোগলশিপাহীদিগের বস্ত্রমধ্যে অনুসন্ধান করিয়া কিছু সংগ্রহ করিয়া আসিয়াছিলেন—ঝনাৎ করিয়া পিসীর কাছে গোটাকত আশরাফি ফেলিয়া দিলেন, পিসী মা আনন্দে পরিপ্লুত হইয়া তাহ কুড়াইয়া লইয়া পেটারায় তুলিয়া রাখিয়া বিবাহের উদ্যোগ করিতে বাহির হইলেন। বিবাহের উদ্যোগের মধ্যে ফুল চন্দন, ও পুরোহিত সংগ্রহ, সুতরাং আশরাফিগুলি পিসী মাকে পেটরা হইতে আর বাহির করিতে হইল না। মাণিকলালের লাভের মধ্যে তিনি যথাশাস্ত্র নির্ম্মলকুমারীর স্বামী হইলেন।

 ইহার পর বলা বাহুল্য যে নির্ম্মলকুমারী পরিণীতা হইয়া স্বামীকর্ত্তৃক উদয়পুরে আনীতা এবং রাজপুরী মধ্যে চঞ্চলকুমারীর নিকট প্রেরিতা হইলেন। ইহাও বলা বাহুল্য যে চঞ্চলকুমারী উদয়পুরের রাণার রাজমহিষী হইলেন। এবং মাণিকলাল রাজদরবারে সম্মানিত হইয়া উচ্চ পদলাভ করিলেন। তাঁহার কন্যাটি নির্ম্মলকুমারীর জিম্মায় রহিল। পিসী মার সঙ্গে আর বড় সম্বন্ধ রহিল না।

 ঔরঞ্জেব শিশুপালের দশাপ্রাপ্ত হইয়া দেবীরের ক্ষেত্রে রাজসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ করিলেন। সেখানেও শিশুপালের দশান্তর প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সে সকল কথা বলা হইল না।

সম্পূর্ণ।