রোকেয়া রচনাবলী/মতিচূর (প্রথম খণ্ড)/অর্দ্ধাঙ্গী

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

অদ্ধাঙ্গী

কোন রোগীর চিকিৎসা করিতে হইলে প্রথমে রোগের অবস্থা জানা আবশ্যক। তাই অবলাজাতির উন্নতির পথ আবিষ্কার করিবার পূর্বে তাহাদের অবনতির চিত্র দেখাইতে হয়। আমি “স্ত্রীজাতির অবনতি” শীর্ষক প্রবন্ধে ভগিনিদিগকে জানাইয়াছি যে, আমাদের একটা রোগ আছে—দাসত্ব। সে রোগের কারণ এবং অবস্থা কতক পরিমাণে ইতঃপূর্ব্বে বর্ণনা করা হইয়াছে। এক্ষণে আমরা দেখাইতে চেষ্টা করিব, সেই রোগ হওয়ায় আমাদের সামাজিক অবস্থা কেমন বিকৃত হইয়াছে। ঔষধ পথ্যের বিধান স্থানান্তরে দেওয়া হইবে।

 এইখানে গোড়া পর্দাপ্রিয় ভগ্নীদের অবগতির জন্য দু একটা কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক বোধ করি। আমি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হই নাই। কেহ যদি আমার স্ত্রীজাতির অবনতি” প্রবন্ধে পর্দাবিদ্বেষ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য দেখিতে না পান, তবে আমাকে মনে করিতে হইবে আমি নিজের মনোভাব উত্তমরূপে ব্যক্ত করিতে পারি নাই, অথবা তিনি প্রবন্ধটি মনোযোগ সহগরে পাঠ করেন নাই।

 সে প্রবন্ধে প্রায় সমগ্র নারীজাতির উল্লেখ আছে। সকল সমাজের মহিলাগণই কি অবরোধে বন্দিনী থাকেন? অথবা তাহারা পর্দানশীন নহেন বলিয়া কি আমি তাহাদিগকে সম্পূর্ণ উন্নত বলিয়াছি? আমি মানসিক দাসত্বের (enslaved মনের আলোচনা করিয়াছি।

 কোন একটা নুতন কাজ করিতে গেলে সমাজ প্রথমতঃ গোলযোগ উপস্থিত করে এবং পারে সেই নূতন চালচলন সহিয়া লয়, তাহারই দৃষ্টান্তস্বরূপ পাসী মহিলাদের পরিবর্তিত অবস্থার উল্লেখ করিয়াছি। পূর্বে তাহারা ছত্রব্যবহারেরও অধিকারিণী ছিলেন না, তারপর তাহাদের বাড়াবাড়িটা সীমা লঘন করিয়াছে, তবু ত পৃথিবী ধ্বংস হয় নাই। এখন পাসী মহিলাদের পর্দামোচন হইয়াছে সত্য, কিন্তু মানসিক দাসত্ব মোচন হইয়াছে কি? অবশ্যই হয় নাই। আর ঐ যে পর্দা ছাড়িয়াছেন, তাহা দ্বারা তাঁহাদের স্বকীয় বুদ্ধিবিবেচনার ত কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। পার্সী পুরুষগণ কেবল অন্ধভাবে বিলাতী সভ্যতার অনুকরণ করিতে যাইয়া স্ত্রীদিগকে পর্দার বাহিরে আনিয়াছেন। ইহাতে অবলাদের জীবনীশক্তির ত কিছু পরিচয় পাওয়া যায় না—তাঁহারা যে জড়পদার্থ, সেই জড়পদার্থই আছেন। পুরুষ যখন তাহাদিগকে • অন্তঃপুরে রাখিতেন, তাহারা তখন সেইখানে থাকিতেন। আবার পুরুষ যখন তাহাদের “নাকের দড়ী” ধরিয়া টানিয়া তাঁহাদিগকে মাঠে বাহির করিয়াছেন, তখনই তাঁহারা পর্দার বাহির হইয়াছেন। ইহাতে রমণীকুলের বাহাদুরী কি? ঐরূপ পর্দা-বিরোধ কখনই প্রশংসনীয় নহে।

 কলম্বস যখন আমেরিকা আবিষ্কার করিতে কুতসঙ্কল্প হন, তখন লোকে তাঁহাকে বাতুল বলে নাই কি? নারী আপন স্ব-স্বামিত্ব বুঝিয়া আপনাকে নরের ন্যায় শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করিতে চাহে, ইহাও বাতুলতা বই আর কি?

 পুরুষগণ স্ত্রীজাতির প্রতি যতটুকু সম্মান প্রদর্শন করেন, তাহাতে আমরা সম্পূর্ণ তৃপ্ত হইতে পারি না। লোকে কালী, শীতলা প্রভৃতি রাক্ষস-প্রকৃতির দেবীকে ভয় করে, পূজা করে, সত্য। কিন্তু সেইরূপ বাঘিনী, নাগিনী, সিংহী প্রভৃতি “দেবীও কি ভয় ও পূজা লাভ করে না? তবেই দেখা যায় পূজাটা কে পাইতেছেন,—রমণী কালী, না রাক্ষসী নৃমুণ্ডমালিনী?

 নারীকে শিক্ষা দিবার জন্য গুরুলোকে সীতা দেবীকে আদর্শরূপে দেখাইয়া থাকেন। সীতা অবশ্যই পর্দানশীন ছিলেন না। তিনি রামচন্দ্রের অর্ধাঙ্গী, রাণী, প্রণয়িনী এবং সহচরী। আর রামচন্দ্র প্রেমিক, ধার্ম্মিক—সবই। কিন্তু রাম সীতার প্রতি যে ব্যবহার করিয়াছেন, তাহাতে প্রকাশ পায় যে, একটি পুতুলের সঙ্গে কোন বালকের যে সম্বন্ধ, সীতার সঙ্গে রামের সম্বন্ধও প্রায় সেইরূপ। বালক ইচ্ছা করিলে পুতুলকে প্রাণপণে ভালবাসিতে পারে; পুতুল হারাইলে বিরহে অধীর হইতে পারে; পুতুলের ভাবনায় অনিদ্রায় রজনী যাপন করিতে পারে; পুতুলটা যে ব্যক্তি চুরি করিয়াছিল, তাহার প্রতি খড়গহস্ত হইতে পারে; হারান পুতুল ফিরিয়া পাইলে আহলাদে আটখানা হইতে পারে; আবার বিনা কারণে রাগ করিয়াও পুতুলটা কাদায় ফেলিয়া দিতে পারে,—কিন্তু পুতুল বালকের কিছুই করিতে পারে না, কারণ হস্তপদ থাকা সত্ত্বেও পুত্তলিকা অচেতন পদার্থ! বালক তাহার পুতুল স্বেচ্ছায় অনলে উৎসর্গ করিতে পারে, পুতুল পুড়িয়া গেল দেখিয়া ভূমে লুটাইয়া ধূলি-ধূসরিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে কঁদিতে পারে!!

 রামচন্দ্র “স্বামিত্বের” ষোল আনা পরিচয় দিয়াছেন!! আর সীতা? —কেবল প্রভু রামের সহিত বনযাত্রার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, তাঁহারও ইচ্ছা প্রকাশের শক্তি আছে। রাম বেচারা অবোধ বালক, সীতার অনুভব শক্তি আছে, ইহা তিনি বুঝিতে চাহেন নাই, কেন, বুঝিয়া কার্য করিতে গেলে স্বামিত্বটা পূর্ণমাত্রায় খাটান যাইত না;—সীতার অমন পবিত্র হৃদয়খানি অবিশ্বাসের পদাঘাতে দলিত ও চূর্ণ করিতে পারা যাইত না!

 আচ্ছা, দেশ কালের নিয়মানুসারে কবির ভাষায় স্বর মিলাইয়া না হয় মানিয়া লই যে, আমরা স্বামীর দাসী নহি অর্ধাঙ্গী। আমরা তাহাদের গৃহে গৃহিণী, মরণে (না হয়, অন্ততঃ তাহাদের চাকুরী উপলক্ষে যথা তথা) অনুগামিনী, সুখ দুঃখে সমভাগিনী, ছায়াতুল্যা সহচরী ইত্যাদি।  কিন্তু কলিযুগে আমাদের ন্যায় অর্ধাঙ্গী লইয়া পুরুষগণ কিরূপ বিকলাঙ্গ হইয়াছেন, তাহা কি কেহ একটু চিন্তাচক্ষে দেখিয়াছেন? আক্ষেপের (অথবা “প্রভুদের সৌভাগ্যের বিষয় যে, আমি চিত্রকর নহি নতুবা এই নারীরূপ অৰ্দ্ধাঙ্গ লইয়া তাহাদের কেমন অপরূপ মূর্তি হইয়াছে, তাহা আঁকিয়া দেখাইতাম॥

 শুক্লকেশ বুদ্ধিমানগণ বলেন যে, আমাদের সাংসারিক জীবনটা দ্বিচক্র শকটের ন্যায় ঐ শকটের এক চক্র পতি, অপরটি পত্নী। তাই ইংরাজী ভাষায় কথায় কথায় স্ত্রীকে অংশিণী “partner") উত্তমার্ধ (better half) ইত্যাদি বলে। জীবনের কর্ত্তব্য অতি গুরুতর, সহজ নহে:

“সুকঠিন গার্হস্থ্য ব্যাপার
সুশৃখলে কে পারে চালাতে ?
রাজ্যশাসনের রীতি নীতি
সূক্ষ্মভাবে রয়েছে ইহাতে।”

 বােধ হয় এই গার্হস্থ্য ব্যাপারটাকে মস্তকস্বরূপ কল্পনা করিয়া শাস্ত্রকারগণ পতি ও পত্নীকে তাহার অঙ্গস্বরূপ বলিয়াছেন। তবে দেখা যাউক বর্ত্তমান যুগে সমাজের মূর্ত্তিন কেমন

 মনে করুন কোন স্থানে পূর্বদিকে একটি বৃহৎ দর্পণ আছে, যাহাতে আপনি আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে পারেন। আপনার দক্ষিণাঙ্গভাগ পুরুষ এবং বামাঙ্গভাগ স্ত্রী। এই দর্পণের সম্মুখে দাড়াইয়া দেখুন:

 আপনার দক্ষিণ বাহু দীর্ঘ (ত্রিশ ইঞ্চি) এবং সুল, বামবাহু দৈর্ঘ্যে চবিবশ ইঞ্চি এবং ক্ষীণ। দক্ষিণ চরণ দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি, বাম চরণ অতিশয় ক্ষুদ্র। দক্ষিণ স্কন্ধ উচ্চতায় পাঁচ ফিট, বাম স্কন্ধ উচ্চতায় চারি ফিট! তবেই মাথাটা সােজা থাকিতে পারে না, বাম দিকে ঋকিয়া পড়িতেছে। কিন্তু আবার দক্ষিণ কর্ণর্ভারে বিপরীত দিকেও একটু ঝুঁকিয়াছে!) দক্ষিণ কর্ণ হস্তিকর্ণের ন্যায় বৃহৎ, বাম কর্ণ রাসভকর্ণের ন্যায় দীর্ঘ! দেখুন!—ভাল করিয়া দেখুন, আপনার মূর্তিটা কেমন!! যদি এ মূর্তিটা অনেকের মনােমত না হয়, তবে দ্বিচক্র শকটের গতি দেখাই। যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছােট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না; সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না।

 সমাজের বিধি ব্যবস্থা আমাদিগকে তাহাদের অবস্থা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক রাখিয়াছে; তাহাদের সুখ দুঃখ এক প্রকার, আমাদের সুখ দুঃখ অন্য প্রকার। এস্থলে বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “নবদম্পতীর প্রেমালাপ কবিতার দুই চারি ছত্র উদ্ধৃত করিতে বাধ্য হইলাম—

 “বর। কেন সখি কোণে কাদিছ বসিয়া?
 “কনে। পুষি মেনিটিরে ফেলিয়া এসেছি ঘরে।


 “বর। কি করিছ বনে কুঞ্জভবনে?
 “কনে। খেতেছি বসিয়া টোপা কূল।

 “বর। জগৎ ছানিয়া, কি দিব আনিয়া জীবন করি ক্ষয়?

 তোমা তরে সখি, বল করিব কি?

 “কনে। আরো কূল পাড় গোটা ছয়।

 “বর। বিরহের বেলা কেমনে কাটিবে?

 “কনে। দেব পুতুলের বিয়ে!”

 সুতরাং দেখা যায় কন্যাকে এরূপ শিক্ষা দেওয়া হয় না, যাহাতে সে স্বামীর ছায়াতুল্যা সহচরী হইতে পারে। প্রভুদের বিদ্যার গতির সীমা নাই, স্ত্রীদের বিদ্যার দৌড় সচরাচর “বোধোদয়” পর্যন্ত!

 স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রস্তু (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন! স্বামী যখন কল্পনা-সাহায্যে সুদুর আকাশে গ্রহনক্ষত্রমালা বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্যমণ্ডলের ঘনফল তুলাদণ্ড ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল ডাল ওজন করেন এবং রাধুনীর গতি নির্ণয় করেন। বলি জ্যোতির্বেত্তা মহাশয়, আপনার পার্শ্বে আপনার সহধম্মিণী কই? বোধ হয়, গৃহিণী যদি আপনার সঙ্গে সূর্যমণ্ডলে যান, তবে তথায় পঁহুছিবার পূর্বেই পথিমধ্যে উত্তাপে বাষ্পীভূত হইয়া যাইবেন। তবে সেখানে গৃহিণীর যাওয়াই ভাল!!

 অনেক বলেন, স্ত্রীলোকদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নাই। মেয়েরা চক, চোষ্য বঁধিতে পারে, বিবিধ প্রকার সেলাই করিতে পারে, দুই চারি খানা উপন্যাস পাঠ করিতে পারে, ইহাই যথেষ্ট। আর বেশী আবশ্যক নাই। কিন্তু ডাক্তার বলেন যে আবশ্যক আছে, যেহেতু মাতার দোষ গুণ লইয়া পুত্রগণ ধরাধামে অবতীর্ণ হয়। এইজন্য দেখা যায় যে, আমাদের দেশে অনেক বালক শিক্ষকের বেত্রতাড়নায় কণ্ঠস্থ বিদ্যার জোরে এফ, এ, বি, এ, পাশ হয় বটে; কিন্তু বালকের মনটা তাহার মাতার সহিত রান্নাঘরেই ঘুরিতে থাকে। তাহাদের বিদ্যাপরীক্ষায় এ কথার সত্যতার উপলব্ধি হইতে পারে।[১]

 আমার জনৈক বন্ধু তাঁহার ছাত্রকে উত্তর দক্ষিণ প্রভৃতি দিঙনির্ণয়ের কথা (cardinal points) বুঝাইতেছিলেন। শেষে তিনি প্রশ্ন করিলেন, “যদি তোমার দক্ষিণ হস্ত পশ্চিমে এবং বাম হস্ত পূর্বে থাকে, তবে তোমার মুখ কোন্ দিকে হইবে?” উত্তর পাইলেন “আমার পশ্চাৎ দিকে।”

 যাহারা কন্যার ব্যায়াম করা অনাবশ্যক মনে করেন, তাঁহারা দৌহিত্রকে হৃষ্টপুষ্ট “পাহলওয়ান” দেখিতে চাহেন কি না? তাহাদের দৌহিত্র ঘুষিটা খাইয়া থাপড়টা মারিতে পারে, এরূপ ইচ্ছা করেন কি না? যদি সেরূপ ইচ্ছা করেন, তবে বোধ হয়, তঁহারা সুকুমারী গোলাপ-লতিকায় কঁঠাল ফলাইতে চাহেন!! আর যদি তাহারা ইচ্ছা করেন যে দৌহিত্রও বলিষ্ঠ না হয়, বরং পয়জার পেটা হইয়া নত মস্তকে উচ্চৈঃস্বরে বলে, “মা মারো! চোট লাগতা হায়!!” এবং পয়জার লাত শেষ হইলে দূরে গিয়া প্রহারকাকে শাসাইয়া বলে যে, “কায় মারতা থা? হাম নালিশ করেগা!” তাহা হইলে আমি তাহাদিগকে আমার বক্তব্য বুঝাইতে অক্ষম।

 খ্রীষ্টিয়ানসমাজে যদিও স্ত্রীশিক্ষার যথেষ্ট সুবিধা আছে, তবু রমণী আপন স্বত্ব ষোল আনা ভোগ করিতে পায় না। তাহাদের মন দাসত্ব হইতে মুক্তি পায় না। স্বামী ও স্ত্রী কতক পরিমাণে জীবনের পথে পাশাপাশি চলিয়া থাকেন বটে; কিন্তু প্রত্যেক উত্তমাদ্ধই (Better half) তাহার অংশীর (partner-এর জীবনে আপন জীবন মিলাইয়া তন্ময়ী হইয়া যান না। স্বামী যখন ঋণজালে জড়িত হইয়া ভাবিয়া ভাবিয়া মরমে মরিতেছেন, স্ত্রী তখন একটা নূতন পীর (bonnet-এর চিন্তা করিতেছেন। কারণ তাহাকে কেবল মূর্তিমতী কবিতা হইতে শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে—তাই তিনি মনোরমা কবিতা সাজিয়া থাকিতে চাহেন। ঋণদায়রূপ গদ্য (prosaic) অবস্থা তিনি বুঝিতে অক্ষম।

 এখন মুসলমানসমাজে প্রবেশ করা যাউক। মুসলমানের মতে আমরা পুরুষের “অর্ধেক”, অর্থাৎ দুইজন নারী একজন নরের সমতুল্যা। অথবা দুইটি ভ্রাতা ও একটি ভগিনী একত্র হইলে আমরা “আড়াই জন” হই। আপনারা “মুহম্মদীয় আইনে” দেখিতে পাইবেন যে বিধান আছে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অর্ধেক ভাগ পাইবে। এ নিয়মটি কিন্তু পুস্তকেই সীমাবদ্ধ। যদি আপনারা একটু পরিশ্রম স্বীকার করিয়া কোন ধনবান মুসলমানের সম্পত্তি বিভাগ করা দেখেন, কিম্বা জমীদারী পরিদর্শন করিতে যান, তবে দেখিবেন কার্যতঃ কন্যার ভাগে শূন্য (০) কিংবা যৎসামান্য পড়িতেছে।

 আমি এখন অপার্থিব সম্পত্তির কথা বলিব। পিতার স্নেহ, যত্ন ইত্যাদি অপার্থিব সম্পত্তি। এখানেও পক্ষপাতিতার মাত্রা বেশী। ঐ যত্ন, স্নেহ, হিতৈষিতার অর্ধেকই আমরা পাই কই? যিনি পুত্রের সুশিক্ষার জন্য চারি জন শিক্ষক নিযুক্ত করেন, তিনি কন্যার জন্য দুই জন শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত করেন কি? যেখানে পুত্র তিনটা (বি,এ, পর্যন্ত) পাশ করে, সেখানে কন্যা দেড়টা পাশ (এণ্ট্রাসি পাশ ও এফ, এ, ফে) করে কি? পুত্রদের বিদ্যালয়ের সংখ্যা

করা যায় না, বালিকাদের বিদ্যালয় সংখ্যায় পাওয়াই যায় না! যে স্কুলে ভ্রাতা “শমস-উলওলামা”[২] সেস্থলে ভগিনী “নজম-উল-ওলামা হইয়াছেন কি? তাহাদের অন্তঃপুর গগনে; অসংখ্য “নজমন্নেসা” “শমূসন্নেসা” শোভা পাইতেছেন বটে। কিন্তু আমরা সাহিত্য-গগর্মে “নজম-উ-ওলামা” দেখিতে চাই।

 আমাদের জন্য এদেশে শিক্ষার বন্দোবস্ত সচরাচর এইরূপ— প্রথমে আরবীয় বর্ণমালা, অতঃপর কোরাণ শরীফ পাঠ। কিন্তু শব্দগুলির অর্থ বুঝাইয়া দেওয়া হয় না, কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যে টীয়াপাখীর মত আবৃত্তি কর। কোন পিতার হিতৈষণার মাত্রা বৃদ্ধি হইলে, তিনি দুহিতাকে “হাফেজা” করিতে চেষ্টা করেন। সমুদয় কোরাণখানি যাহার কণ্ঠস্থ থাকে, তিনিই “হাফেজ।” আমাদের আরবী শিক্ষা ঐ পর্য্যন্ত! পারস্য এবং উর্দ শিখিতে হইলে, প্রথমেই “করিমা বখশা এবর হালেমা” এবং একেবারে (উর্দু) “বানাত নাশ” পড়![৩] একে আকার ইকার নাই, তাতে আবার আর কোন সহজপাঠ্য পুস্তক পূর্বে পড়া হয় নাই সুতরাং পাঠের গতি দ্রুতগামী হয় না। অনেকের ঐ কয়খানি পুস্তক পাঠ শেষ হওয়ার পূর্বেই কন্যা-জীবন শেষ হয়। বিবাহ হইলে বালিকা ভাবে, “যাহা হোক, পড়া হইতে রক্ষা পাওয়া গেল!” কোন কোন বালিকা রন্ধন ও সূচীকর্ম্ম সুনিপুণা হয়। বঙ্গদেশেও বালিকাদিগকে রীতিমত বঙ্গভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় না। কেহ কেহ উর্দু পড়িতে শিখে, কিন্তু কলম ধরিতে শিখে না। ইহাদের উন্নতির চরম সীমা সমা চুমকির কারুকার্য্য, উলের জুতা মোজা ইত্যাদি প্রস্তুত করিতে শিক্ষা পর্যন্ত।

 যদি ধর্মগুরু মোহাম্মদ (দঃ) আপনাদের হিসাব নিকাশ লয়েন যে, “তোমরা কন্যার প্রতি কিরূপ ন্যায় ব্যবহার করিয়াছ?” তবে আপনারা কি বলিবেন?

 পয়গম্বরদের ইতিহাসে শুনা যায়, জগতে যখনই মানুষ বেশী অত্যাচার অনাচার করিয়াছে, তখনই এক-একজন পয়গম্বর আসিয়া দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করিয়াছেন। আরবে স্ত্রীজাতির প্রতি অধিক অত্যাচার হইতেছিল; আরববাসিগণ কন্যাহত্যা করিতেছিল, তখন হজরত মোহাম্মদ (দঃ) কন্যাকুলৈর রক্ষকস্বরূপ দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন। তিনি কেবল বিবিধ ব্যবস্থা দিয়াই ক্ষান্ত থাকেন নাই, স্বয়ং কন্যা পালন করিয়া আদর্শ দেখাইয়াছেন। তাহার জীবন ফাতেমাময় করিয়া দেখাইয়াছেন— কন্যা কিরূপ আদরণীয়া। সে আদর, সে স্নেহ জগতে অতুল।

 আহা! তিনি নাই বলিয়া আমাদের এ দুর্দশা। তবে আইস ভগিনীগণ! আমরা সকলে সমস্বরে বলি:

 “করিমা ববশা এবর হালেমা!” করিম (ঈশ্বর) অবশ্যই কৃপা করিবেন। যেহেতু “সাধনায় সিদ্ধি।” আমরা “করিমের” অনুগ্রহলাভের জন্য যত্ন করিলে অবশ্যই তাহার করুণা লাভ করিব। আমরা ঈশ্বর ও মাতার নিকট ভ্রাতাদের “অর্ধেক” নহি। তাহা হইলে এইরূপ স্বাভাবিক বন্দোবস্ত হইত—পুত্র যেখানে দশ মাস স্থান পাইবে, দুহিতা সেখানে পাঁচ মাস? পুত্রের জন্য যতখানি দুগ্ধ আমদানী হয়, কন্যার জন্য তাহার অর্ধেক! সেরূপ ত নিয়ম নাই! আমরা জননীর স্নেহ মমতা ভ্রাতার সমানই ভোগ করি। মাতৃহৃদয়ে পক্ষপাতিতা নাই। তবে কেমন করিয়া বলিব, ঈশ্বর পক্ষপাতী? তিনি কি মাতা অপেক্ষা অধিক করুণাময় নহেন?

 আমি এবার রন্ধন ও সূচীকার্য্য সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহাতে আবার যেন কেহ মনে করেন যে আমি সূচীকর্ম্ম ও রন্ধনশিক্ষার বিরোধী। জীবনের প্রধান প্রয়োজনীয় বস্তু অন্নবস্ত্র; সুতরাং রন্ধন ও সেলাই অবশ্য শিক্ষণীয়। কিন্তু তাই বলিয়া জীবনটাকে শুধু রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নহে॥

 স্বীকার করি যে, শারীরিক দুর্বলতাবশতঃ নারীজাতি অপর জাতির সাহায্যে নির্ভর করে। তাই বলিয়া পুরুষ “প্রভু হইতে পারে না। কারণ জগতে দেখিতে পাই, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিকট কোন না কোন প্রকার সাহায্য প্রার্থনা করে, যেন একে অপরের সাহায্য ব্যতীত চলিতে পারে না। তরুলতা যেমন বৃষ্টির সাহায্য প্রার্থী, মেঘও সেইরূপ তরুর সাহায্য চায়। জল বৃদ্ধির নিমিত্ত নদী বর্ষার সাহায্য পায়, মেঘ আবার নদীর নিকট ঋণী। তবে রঙ্গিনী কাদম্বিনীর “স্বামী”, না কাদম্বিনী তরঙ্গিণীর “স্বামী”? এ স্বাভাবিক নিয়মের কথা ছাড়িয়া কেবল সামাজিক নিয়মে দৃষ্টিপাত করিলেও আমরা তাহাই দেখি।

 কেহ সত্রধর, কেহ তন্তুবায় ইত্যাদি। একজন ব্যারিষ্টার ডাক্তারের সাহায্য প্রার্থী, আবার ডাক্তারও ব্যারিষ্টারের সাহায্য চাহেন। তবে ডাক্তারকে ব্যারিষ্টারের স্বামী বলিব, না ব্যারিষ্টার ডাক্তারের স্বামী? যদি ইহাদের কেহ কাহাকে “স্বামী” বলিয়া স্বীকার না করেন, তবে শ্রীমতীগণ জীবনের চিরসঙ্গী শ্রীমানদিগকে “স্বামী” ভাবিবেন কেন?

 আমরা উত্তমার্ধ (better halves} তাহারা নিকৃষ্টার্দ্ধ (worse halves), আমরা অর্দ্ধাঙ্গী, তাহারা অর্দ্ধাঙ্গ। অবলার হাতেও সমাজের জীবন মরণের কাটি আছে, যেহেতু “না জাগিলে সব ভারত-ললনা” এ ভারত আর জাগিতে পারিবে না। প্রভুদের ভীরুতা কিম্বা তেজস্বিতা জননীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে কেবল শারীরিক বলের দোহাই দিয়া অদূরদর্শী ভ্রাতৃমহোদয়গণ যেন শ্রেষ্ঠত্বের দাবী না করেন।

 আমরা পুরুষের ন্যায় সুশিক্ষা ও অনুশীলনের সম্যক সুবিধা না পাওয়ায় পশ্চাতে পড়িয়া আছি। সমান সুবিধা পাইলে আমরাও কি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে পারিতাম না? আশৈশব আত্মনিন্দা শুনিতেছি, তাই এখন আমরা অন্ধভাবে পুরুষের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করি, এবং নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে করি। অনেক সময় “হাজার কোক ব্যাটা ছেলে!” বলিয়া ব্যাটা ছেলেদের দোষ ক্ষমা করিয়া অন্যায় প্রশংসা করি। এই ত ভুল।[৪]

 আমি ভগিনীদের কল্যাণ কামনা করি, তাঁহাদের ধর্ম্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া তাহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না। মানসিক উন্নতি করিতে হইলে হিন্দুকে হিন্দুত্ব বা খ্রীষ্টানকে খ্রীষ্টানী ছাড়িতে হইবে এমন কোন কথা নাই। আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়াও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায়। আমরা যে কেবল উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই।

 অনেকে হয়ত ভয় পাইয়াছেন যে, বোধ হয় একটা পত্নীবিদ্রোহের আয়োজন করা হইতেছে। অথবা ললনাগণ দলে দলে উপস্থিত হইয়া বিপক্ষকে রাজকীয় কার্য্যক্ষেত্র হইতে তাড়াইয়া দিয়া সেই পদগুলি অধিকার করিবেন—শামলা, চোগা, আইন কানুনের পাঁজি পুঁথি লুঠিয়া লইবেন! অথবা সদলবলে কৃষিক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া কৃষকগুলিকে তাড়াইয়া দিয়া। তাহাদের শস্যক্ষেত্র দখল করিবেন, হাল গরু কাড়িয়া লইবেন, তবে তাহাদের অভয় দিয়া বলিতে হইবে—নিশ্চিন্ত থাকুন।

 পুরুষগণ আমাদিগকে সুশিক্ষা হইতে পশ্চাৎপদ রাখিয়াছেন বলিয়া আমরা অকর্ম্মণ্য হইয়া গিয়াছি। ভারতে ভিক্ষু ও ধনবান—এই দুই দল লোক অলস; এবং ভদ্রমহিলার দল কর্তব্য অপেক্ষা অল্প কাজ করে। আমাদের আরাম-প্রিয়তা খুব বাড়িয়াছে। আমাদের হস্ত, পদ, মন, চক্ষু ইত্যাদির সদ্ব্যবহার করা হয় না। দশজন রমণীর একত্র হইলে ইহার উহার—বিশেষতঃ আপন আপন অর্ধাঙ্গের নিন্দা কিংবা প্রশংসা করিয়া বাক্‌পটুতা দেখায়। আবশ্যক হইলে কোন্দলও চলে।

 আশা করি এখন “স্বামী” স্থলে “অর্দ্ধাঙ্গ” শব্দ প্রচলিত হইবে।

  1. “দাসী” পত্রিকা হইতে কতকলি প্রশ্লোর উদ্ধৃত করিবার লোভ সম্পশ করিতে পারিতেছি না:
    প্রশ্ন। When was Cromwell born (ওয়েলের জন্ম কখন হইয়াছিল)।
    উত্তর। In the year 140 when he was fourteen years old (১৬৪৯ সালে যখন তিনি চৌদ্দ বৎসরের ছিলেন)।
    প্রশ্ন। Describe his continentat policy (তাহার রাষ্ট্রীয় নীতি বর্ণনা কর।
    উত্তর। He was honest and truthful and he had nine children (তিনি সাধু প্রকৃতি এবং সত্যবাদী ছিলেন এবং তাঁহাও নয়জন সন্ত্রানসন্ততি ছিল)।
    প্রশ্ন। What is the adjective of ass (দ্দভের বিশেষণ কি?
    উত্তর। Assansole (আসানসোল)। প্রশ্ন। Who was Chandra Gupta (চন্দ্রগুপ্ত কে)?
     উত্তর। Chandra Gupta was the granddaughter of Asoka (চন্দ্রগুপ্ত অশোকের দৌহিত্রী)। “পরীক্ষারহস্য। 'কলা ঝলসাইতে লাগিল ইহার ইংরাজী অনুবাদ করিতে বলা হইয়াছিল। একজন ছাত্র লিখিয়াছেন, 'roasted some plantations'? আর একজন লিখিয়াছেন, 'roasted some plantagenets'; অপর একজন লিখিয়াছেন, 'Tasted some plaintiffs' কেই মনে করিবেন না যে, ইহা কল্পিত উত্তর। সত্য সত্যই এরূপ উত্তর পাওয়া গিয়াছে।”
  2. “গমস্-উল-ওলামা”, পণ্ডিতদের উপাধি বিশেষ। ঐ শব্দগুলির অনুবাদ এইরূপ হয় শসল, $un; ওলামা, ("আলম” শব্দের বচন) leared men, এইরূপ নম্-উল-ওলামা অর্থে the star of the learned men (or women!) বুঝিতে হইবে।
  3. এইখানে একটি দশম বর্ষের বালিকার গল্প মনে পড়িল। পল্লীগ্রামে অনেকের বাড়ী ধান ভানিবার জন্য “ভানানী” নিযুক্ত হয়। সেই বালিকা “বানাতন নাশ” পড়িতে যাইয়া হোসেন আরার মেজাজের বর্ণনাটা হৃদয়ঙ্গম করা অপেক্ষা ভালানীদের ধানভানা কাটা সহজ মনে করিত। তাই সুযোগ পাইলেই সে টেকিশালে গিয়া দুই এক সের ধান্যের শ্রাদ্ধ করি! সে ধান্য হইতে তুকূল পরিষ্কার পাওয়া যাইত না- তাহা “Whole meal” ময়দার ন্যায় ধান্যষ-তল মিশ্রিত এক প্রকার অদ্ভুত সামগ্রী হইত। যে রোগীদের ঐন্য হোলমিল ময়দার ব্যবস্থা দেওয়া হয়, তাঁহাদের জন্য উক্র হোল-মিলতুলচুর্ণ অবশ্যই উপকারী খাদ্য, সন্দেহ নাই!!
  4. এস্থলে জনৈক নারীহিতৈষী মহাত্মার উর্দু গাথা মনে পড়িল। তিনি (১৯০৫ খৃষ্টাব্দের কোন মাসিক পত্রিকায় লিখিয়াছেন, “জগতে তোমাদের নিন্দাগীতি এত দূর উচ্চরণে গাওয়া গিয়াছে যে শষে তোমরা ও জগতের কথায় বিশ্বাস করিয়া ভাবিলে যে আমরা বাস্তবিক বিদ্যালতের উপযুক্ত নহি। সুতরাং মূখতার কুফল ভোগের নিমিত্ত তোমরা নত মস্তকে প্রস্তুত হইলে।” কি চমৎকার সত্য কথা। জগদীশ্বর উক্ত কবিকে দীর্ঘজীবী করুন!