বিষয়বস্তুতে চলুন

লোকরহস্য (১৯৩৯)/বর্ষ সমালোচন

উইকিসংকলন থেকে

বর্ষ সমালোচন

 সম্বাদ পত্রের প্রথা আছে, নব বর্ষ প্রবৃত্ত হইলে গত বর্ষের ঘটনা সকল সমালোচনা করিতে হয়। বঙ্গদর্শন[] সম্বাদ পত্র নহে, সুতরাং বঙ্গদর্শন বর্ষসমালোচনে বাধ্য নহে। কিন্তু আমাদের কি সাধ করে না? যেমন অনেকে রাজা না হইয়াও রাজকায়দায় চলেন, যেমন অনেকে কালা বাঙ্গালি হইয়াও সাহেব সাজিবার সাথে কোট পেণ্টেলুন আঁটেন, আমরাও তেমনি ক্ষুদ্র মাসিক পত্রিকা হইয়াও, দোর্দ্দণ্ড প্রচণ্ড প্রতাপশালী সম্বাদ পত্রের অধিকার গ্রহণ করিব, ইচ্ছা করিয়াছি।

 কিন্তু মনুষ্যজাতির এমনই দুরদৃষ্ট যে, যে যখন যে সাধ করে, তাহার সেই সাথে তখন বিঘ্ন ঘটে। নূতন বৎসর গিয়াছে পৌষ মাসে, আমরা লিখিতেছি অগ্রহায়ণ মাসের বঙ্গদর্শন! সর্ব্বনাশ, এ যে রাম না হইতে রামায়ণ! সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, বঙ্গদর্শন রচনাসম্বন্ধে কোন নিয়মই মানে না—অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী। অতএব আমরা মনের সাধ মনে না মিটাইয়া, সে সাধে বিষাদ ইত্যাদি অনুপ্রাসের লোভ সম্বরণ করিয়া অগ্রহায়ণ মাসেই ১৮৭৫ শালের সমালোচন করিব। অতএব হে গত বর্ষ! সাবধান হও, তোমাকে সমালোচন করিব।

 গত বৎসরে রাজকার্য্য কিরূপে নির্ব্বাহ প্রাপ্ত হইয়াছে, তদ্বিষয়ে অনেক অনুসন্ধান করিয়া জানিয়াছি যে, এই বৎসরের তিন শত পঁয়ষট্টি দিবস ছিল, এক দিনও কম হয় নাই। প্রতি দিবসে ২৪টি করিয়া ঘণ্টা, এবং প্রতি ঘণ্টায় ৬০টি করিয়া মিনিট ছিল। কোনটির আমরা একটিও কম পাই নাই। রাজপুরুষগণ ইহাতে কোন প্রকার হস্তক্ষেপণ করেন নাই। ইহাতে তাঁহাদিগের বিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায় বটে। অনেকে বলেন যে, এ বৎসরে গোটাকত দিন কমাইয়া দিলে ভাল হইত; আমরা এ কথার অনুমোদন করি না; দিন কমাইলে কেবল চাকুরিয়াদিগের বেতন লাভ, এবং সম্বাদপত্রলেখকদিগের শ্রমলাঘব; সাধারণের কোন লাভ নাই; (আমরা মাসিক, ১২ মাসে বারখানি কেহ ছাড়িবে না।) তবে গ্রীষ্মকালটি একেবারে উঠাইয়া দিলে ভাল হয় বটে। আমরা কর্ত্তৃপক্ষগণকে অনুরোধ করিতেছি, বার মাসই শীতকাল থাকে, এমন একটি আইন প্রচারের চেষ্টা দেখুন।

 আমরা শুনিয়া দুঃখিত হইলাম, এ বৎসর সকলেরই এক এক বৎসর পরমায়ু চুরি গিয়াছে। কথাটায় আমরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি না। আমরা প্রত্যক্ষ দেখিতেছি, আমাদের ৭১ বৎসর বয়স ছিল, এ বৎসর ৭২ হইয়াছে। যদি পরমায়ু চুরি গেল, তবে এক বৎসর বাড়িল কি প্রকারে? নিন্দক সম্প্রদায়ই এমত অযথার্থ প্রবাদ রটাইয়াছে।

 এ বৎসর যে সুবৎসর ছিল, তাহার বিশেষ প্রমাণ এই যে, এ বৎসর অনেকেরই সন্তান জন্মিয়াছে। টিষ্টিমেষ্টেল ডিপার্টমেণ্টের সুদক্ষ কর্ম্মচারিগণ বিশেষ তদন্তে জানিয়াছেন যে, কাহারও কাহারও পুত্র হইয়াছে, কাহারও কন্যা হইয়াছে, এবং কাহার গর্ভস্রাব হইয়া গিয়াছে। দুঃখের বিষয় এই যে, এ বৎসর কতকগুলি মনুষ্য, অধিক নহে, রোগাদিতে মরিয়াছে। শুনিয়াছি যে, এদেশীয় কোন মহাসভা পার্লিমেণ্টে আবেদন করিবেন যে, এই পুণ্যভূম ভারতরাজ্যে মনুষ্য না মরিতে পায়। তাঁহারা এইরূপ প্রস্তাব করেন যে, যদি কাহারও নিতান্ত মরা আবশ্যক হয়, তবে সে পুলিষে জানাইয়া অনুমতি লইয়া মরিবে।

 এ বৎসরে ফাইন্যান্‌সিয়ল ডিপার্টমেণ্টের কাণ্ড অতি বিচিত্র—আমরা শ্রুত হইয়াছি যে, গবর্ণমেণ্টের আয়ও হইয়াছে, ব্যয়ও হইয়াছে। ইহা বিস্ময়কর হউক বা না হউক, বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, ইহাতে গবর্ণমেণ্টের টাকা, হয় কিছু উদ্বর্ত্ত হইয়াছে, নয় কিছু অকুলান হইয়াছে, নয় ঠিক ঠিক মিলিয়া গিয়াছে। আগামী বৎসর (৭৬ শালে) টেক্স বসিবে কি না, তাহা এক্ষণে বলা যায় না, কিন্তু ভরসা করি, ৭৭ শালের এপ্রিল মাসে আমরা এ কথা নিশ্চিত বলিতে পারিব।

 এ বার বিচারালয় সকলের কার্য্যের আমরা বিশেষ সুখ্যাতি করিতে পারিলাম না। সত্য বটে যে, যে নালিশ করিয়াছে, তাহার বিচার হইয়াছে বা হইবে, এমন উদ্যোগ আছে, কিন্তু যাহারা নালিশ করে নাই, তাহাদের পক্ষে কোন বিচার হয় নাই। আমরা ইহা বুঝিতে পারি না; যেখানে সাধারণ বিচারালয়, সেখানে নালিশ করুক বা না করুক, বিচার চাই। কেহ রৌদ্র চাহুক বা না চাহুক, সূর্য্যদেব সর্ব্বত্র রৌদ্র করিয়া থাকেন, কেহ বৃষ্টি চাহুক বা না চাহুক, মেঘ ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে বৃষ্টি করিয়া থাকেন, এবং কেহ বিচার চাহুক বা না চাহুক, বিচারকের উচিত, গৃহে গৃহে ঢুকিয়া বিচার করিয়া আসেন। যদি কেহ বলেন যে, বিচারকগণ এরূপ বিচারার্থ গৃহে গৃহে প্রবেশ করিতে গেলে গৃহস্থগণের সম্মার্জনী সকল অকস্মাৎ বিঘ্ন ঘটাইতে পারে, তাহাঁতে আমাদের বক্তব্য যে, গবর্ণমেণ্টের কর্ম্মচারিগণ সম্মার্জনীকে তাদৃশ ভয় করেন না— সম্মার্জনীর সঙ্গে নিম্নশ্রেণীর হাকিমদিগের বিলক্ষণ পরিচয় আছে, এবং প্রায় প্রত্যহ ইহার সঙ্গে তাঁহাদের আলাপ হইয়া থাকে। যেমন ময়ূর সর্পপ্রিয়, ইঁহারাও তেমনি সম্মার্জনীপ্রিয়— দেখিলেই প্রায় ভক্ষণ করিয়া থাকেন। আমরা এমনও শুনিয়াছি যে, গবর্ণমেণ্টের কোন অধস্তন কর্ম্মচারী প্রস্তাব করিয়াছেন যে, যেমন উচ্চশ্রেণীর কর্ম্মচারিগণের পুরস্কারের জন্য “অর্ডর অব দি ষ্টার অব ইণ্ডিয়া” সংস্থাপিত করা হইয়াছে, সেইরূপ নিম্নশ্রেণীর কর্ম্মচারিগণের জন্য “অর্ডর অব দি ব্রুম্‌ষ্টিক্” সংস্থাপিত করা হউক। এবং বিশেষ বিশেষ গুণবান্ ডিপুটি এবং সবজজ প্রভৃতিকে বাছিয়া বাছিয়া লাকলাইনের দড়িতে এই মহারত্নটিকে বাঁধিয়া তাঁহাদিগের গলদেশে লম্বমান করিয়া দেওয়া হউক। তাঁহাদের চাপকান চেন চাদরবিভূষিত সদাকম্পবান্ বক্ষে ইহা অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিবে। রাজপ্রসাদস্বরূপ প্রদত্ত হইলে ইহা যে সাদরে গৃহীত হইবে, তাহা আমরা শপথ করিয়া বলিতে পারি। আমাদের কেবল আশঙ্কা এই যে, এত উমেদওয়ার যুটিবে যে, ঝাঁটার সঙ্কুলান করা ভার হইবে।

 গত বৎসর সুবৃষ্টি হইয়াছিল। কিন্তু সর্ব্বত্র সমান হয় নাই। ইহা মেঘদিগের পক্ষপাত বটে। যে সকল দেশে বৃষ্টি হয় নাই, সে সকল দেশের লোকে গবর্ণমেণ্টে এই মর্ম্মে আবেদন করিয়াছেন যে, ভবিষ্যতে যাহাতে সর্ব্বত্র সমান বৃষ্টি হয়, এমন কোন উপায় উদ্ভুত হউক। আমাদিগের বিবেচনায় ইহার সদুপায় নিরূপণ জন্য একটি কমিটি সংস্থাপিত করা উচিত। কোন কোন মান্য সহযোগী বলেন যে, যদি সরকার হইতে মেঘদিগের বারবরদারি বরাদ্দ হয়, তাহা হইলে তাহাদিগের কোন দেশেই যাইবার আর আপত্তি থাকে না। কিন্তু আমাদিগের বিবেচনায় ইহাতেও সুবিধা হইবে না—কেন না, বঙ্গদেশের মেঘ সকল অত্যন্ত সৌদামিনীপ্রিয়—সৌদামিনীগণকে ছাড়িয়া টাকার লোভেও দেশদেশান্তরে যাইতে স্বীকার করিবে না। আমরা প্রস্তাব করি যে, মেঘ সকল এবালিশ করিয়া দিয়া, ভিস্তীর বন্দোবস্ত করা হউক। ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে এক একজন চাপরাশী বা সুযোগ্য ডিপুটি এক একজন ভিস্তীকে দীর্ঘ বংশখণ্ডে বাঁধিয়া ঊর্দ্ধে উত্থিত করিয়া তুলিয়া ধরিবেক, ভিস্তী তথা হইতে ক্ষেত্রে জল ছড়াইয়া, পারে ত নামিয়া আসিবে। ভাল হয় না?

 আমাদের দেশের কামিনীগণ যে দেশহিতৈষিণী নন—নহিলে ভিস্তীর প্রয়োজন হইত না। তাঁহারা যদি প্রাত্যহিক সাংসারিক কান্নাটা মাঠে গিয়া কাঁদিয়া আসেন, তাহা হইলে অনায়াসেই কৃষিকার্য্যের সুবিধা হয় ও মেঘ ডিপার্টমেণ্ট এবালিশ করা যাইতে পারে। তবে আমরা লোকের শারীরিক ও মানসিক মঙ্গলার্থ বলি যে, আকাশবৃষ্টির পরিবর্ত্তে নারীনয়নাশ্রুর আদেশ করিতে গেলে, একটু পাকা রকম পুলিষের বন্দবস্ত করা চাই। মেঘের বিদ্যুতে অধিক প্রাণী নাশ হয় না; কিন্তু রমণীনয়নমেঘের কটাক্ষ-বিদ্যুতে, মাঠের মাঝখানে চাষা-ভূষোর ছেলেদের কি হয় বলা যায় না—পুলিষ থাকা ভাল।

 শুনিলাম, শিক্ষাবিভাগে বড় গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে। শুনিয়াছি, অনেক বিদ্যালয়ের ছাত্রেরা এক একটা কাণমাপা কাটি প্রস্তুত করিয়াছে। তাহাদের মনে ঘোর সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে—তাহারা বলে, অধ্যাপকদিগের শ্রবণেন্দ্রিয়গুলি মাপিয়া দেখিব—নহিলে তাঁহাদিগের নিকট পড়িব না। আমরা ভরসা করি, মাপকাটি ছোট পড়িবে, এমত সম্ভাবনা কোথাও নাই।

 যাহা হউক, দুর্বৎসর হউক, সুবৎসর হউক, তিনটি নিগূঢ় তত্ত্ব আমরা স্থির জানিতে পারিতেছি—তদ্বিষয়ে কোন সংশয় নাই।

 প্রথম, বৎসরটি চলিয়া গিয়াছে। এ বিষয়ে মতান্তর নাই।

 দ্বিতীয়, বৎসর গিয়াছে, আর ফিরিবে না। ফিরাইবার জন্য কেহ কোন উদ্যোগ পাইবেন না। নিষ্ফল হইবে।

 তৃতীয়, ফিরে আর না ফিরে, পাঠক! আপনার ও আমার পক্ষে সমান কথা, কেন না, আপনার ও আমার পঁচাত্তরেও ঘাস জল, ছিয়াত্তরেও ঘাস জল। আপনার মঙ্গল হউক, আপনি ঘাস জলের প্রতি দৃষ্টি রাখিবেন।

  1. এই প্রবন্ধ প্রথম বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হয়।