শকুন্তলা (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৫৪)/চতুর্থ অঙ্ক

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ অঙ্ক


 এইরূপে কিয়দিন অতীত হইল। পরিশেষে রাজা, গান্ধর্ব্ববিধানে শকুন্তলার পাণিগ্রহ সমাধান পূর্ব্বক ধর্ম্মারণ্যে কিছু দিন অবস্থিতি করিয়া, নিজ রাজধানী প্রস্থান করিলেন।

 রাজা প্রস্থান করিলে পর, এক দিবস অনসুয়া প্রিয়ংবদাকে কহিতে লাগিলেন সখি! যদিও শকুন্তলা গান্ধর্ব্ব বিবাহ দ্বারা আপুন অনুৰূপ পতি লাভ করিয়াছে,তথাপি আমার এই ভাবন হইতেছে যে পাছে রাজা নগরে গিয়। অন্তঃপুরবাসিনীদিগের সমাগমে শকুন্তলাকে ভুলিয়া যান। প্রিয়ংবদা কহিলেন সখি! সে সন্দেহ করি ও না; তেমন আকৃতি কখন গুণশূন্য হয় না। কিন্তু আমার আর ভাবনা হইতেছে, না জানি, তাত কণু এই বৃত্তান্ত শুনিয়া কি করেন। অনসূয়া কহিলেন সখি! আমার বোধ হইতেছে তিনি শুনিয়া রুষ্ট অথবা অসন্তুষ্ট হইবেন না; এ তাঁহার অনভিমত কর্ম্ম হয় নাই। কেন না, তিনি প্রথমাবধিই এই সঙ্কল্প করিয়াছেন গুণবান পাত্রে কন্যা প্রতিপাদন করিবেন; যদি দৈবই তাহা সম্পন্ন করিল তাহা হইলে তিনি বিনা আয়াসে কৃতকার্য্য হইলেন। সুতরাং ইহাতে তাঁহার রোষ বা অসন্তোষের বিষয় কি। উভয়ে এইরূপ কথোপকথন করিতে করিতে আশ্রমকুটীরের কিঞ্চিৎ দূরে পুষ্প চয়ন করিতে লাগিলেন।

 এ দিকে শকুন্তলা রাজার চিন্তায় একান্ত নিমগ্ন হইয়া একাকিনী কুটীরে উপবিষ্টা আছেন। এমত সময়ে দুর্ব্বাসা ঋষি আসিয়া শকুন্তলাকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন আমি অতিথি। শকুন্তলা এককালে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়া ছিলেন সুতরাং দুর্বাসার কথা শুনিতে পাইলেন না। দুর্ব্বাসা অবজ্ঞা দর্শনে রোষপরবশ হইয়া কহিলেন আঃ পাপীয়সি - তুমি অতিথির অপমান করিলে। তুমি যাহার চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া আমাকে অবজ্ঞা করিলে; আমি এই শাপ দিতেছি; তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিলেও সে তোমাকে স্মরণ করিবেক না।

 প্রিয়ংবদা “শুনিতে পাইয়া ব্যাকুল হইয়া কহিতে লাগিলেন হয়! হায়! কি সর্ব্বনাশ হইল; শূন্য হৃদয়া শকুন্তলা কোন পূজনীয় ব্যক্তির নিকট অপরাধিনী হইল। এই বলিয়া সেই দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিতে লাগিলেন সখি! যে সে নয়, ইনি দুর্বাসা; ইঁহার কথায় কথায় কোপ; ঐ দেখ, শাপ দিয়া রোষভরে সত্বরে প্রস্থান করিতেছেন। অনসূয়া কহিলেন প্রিয়ংবদে! বৃথা আক্ষেপ করিলে আর কি হইবে বল; শীঘ্র গিয়া পায় ধরিয়া ফিরাইয়া আন; আমি পাদ্য অর্ঘ্য প্রভৃতি প্রস্তুত করিয়া রাখিতেছি। প্রিয়ংবদা দুর্ব্বাসার পশ্চাৎ ধাবমানা হইলেন। অনসূয়া কুটীরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

 অনসূয়ার কুটীরে পহুছিবার পূর্ব্বেই, প্রিয়ংবদ পথিমধ্যে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন সখি! জানই ত, সে স্বভাবতঃ অতি কুটিলহৃদয়; সে কি কাহারও অনুনয় গ্রহণ করে; তথাপি অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া কিঞ্চিৎ শান্ত করিয়াছি। যখন দেখিলাম নিতান্তই ফিরিবেন না, তখন চরণে ধরিয়া এই নিবেদন করিলাম ভগবন্‌! সে তোমার কন্যা, তোমার প্রভাব ও মহিমা কি জানে। কৃপা করিয়া তাহার এই প্রথমাপরাধ ক্ষমা করিতে হইবেক। তখন তিনি-কহিলেন আমি যাহা কহিয়াছি কোন ক্রমেই অন্যথা হইবার নহে; তবে যদি কোন অভিজ্ঞান দর্শাইতে পারে তাহ হইলেই তাহার শাপ মোচন হইবেক। এই বলিয়াই চলিয়া গেলেন। অনসূয়া কহিলেন ভাল আশ্বাসের পথ হইয়াছে; রাজর্ষি প্রস্থান কালে শকুন্তলার অঙ্গুলীতে এক স্বনামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় পরাইয়া দিয়া গিয়াছেন। অতএব শকুন্তলার হস্তেই শকুন্তলার শাপ মোচনের উপায় রহিয়াছে। রাজা যদিই বিস্মৃত হন, তাহার সেই স্বনামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় দেখাইলেই স্মরণ হইবে। এইৰূপ কথোপকথন করিতে করিতে কুটীরাভিমুখে চলিলেন।

 কিয়ৎক্ষণ পরে উভয়ে কুটীর দ্বারে উপস্থিত হইয়। দেখিলেন শকুন্তলা করতলে কপোল বিন্যাস করিয়া স্পন্দহীনা মুদ্রিতনয়না চিত্রার্পিতার ন্যায় উপবিষ্ট আছেন। তখন প্রিয়ংবদা কহিলেন অনসূয়ে! দেখ দেখ, শকুন্তল। পতিচিন্তায় মগ্ন হইয়া একবারে বাহ্যজ্ঞানশুন্য হইয়া রহিয়াছে; ও কি অতিথি অভ্যাগতের তত্ত্বাবধান করিতে পারে। অনসূয়া কহিলেন সখি! এই বৃত্তান্ত আমাদের দুজনের মনে মনেই থাকুক। কোন মতেই কর্ণান্তর করা হইবেক না; শকুন্তলা শুনিলে প্রাণে বাচিবেক না। প্রিয়ংবদা কহিলেন সখি! তুমি কি পাগল হয়েছ; এ কথাও কি শকুন্তলাকে শুনাতে হয়; কোন ব্যক্তি উষ্ণোদকে নবমালিকা সেচন করে।

 কিয়দ্দিন পরে মহর্ষি কণ্ব সোমতীর্থ হইতে প্রত্যাগমন করিলেন। এক দিবস তিনি অগ্নিগুহে প্রবিষ্ট হইয়া হোমকার্য্য সম্পাদন করিতেছেন, এমত সময়ে দৈববাণী হইল ‘মহর্ষে! রাজা দুষ্মন্ত, মৃগয়া উপলক্ষে তোমার তপোবনে আসিয়া, শকুন্তলার পাণিগ্রহণ করিয়া গিয়াছেন এবং শকুন্তলাও তৎসহযোগে গর্ভবতী হইয়াছেন”। মহর্ষি, এই ৰূপে শকুন্তলাপরিণয় বৃত্তাস্ত অবগত হইয়া, তাহার অগোচরে ও সম্মতি ব্যতিরেকে সম্পন্ন হইয়াছে বলিয়া, কিঞ্চিন্মাত্রও রোষ বা অসন্তোষ প্রদর্শন করিলেন না। বরং যৎপরোনাস্তি প্রীত হইয়। কহিতে লাগিলেন আমার পরম সৌভাগ্য যে শকুন্তলা এতাদৃশ সৎপাত্রের হস্তগত হইয়াছে। অনন্তর শকুন্তলার নিকটে গিয়া সাতিশয় পরিতোষ প্রদর্শন করিয়া কহিলেন বৎসে! আমি তোমার পরিণয় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া অনির্ব্বচনীয় প্রীতি প্রাপ্ত হইয়াছি; এবং অদ্যই, দুই শিষ্য ও গোতমীকে সমভিব্যাহারে দিয়া, তোমাকে ভর্তৃসন্নিধানে পাঠাইয়। দিতেছি। অনন্তর কণ্বের আদেশানুসারে শকুন্তলার প্রস্থানের উদ্যোগ হইতে আরম্ভ হইল।

 প্রস্থানসময় উপস্থিত হইল। গোতমী এবং শার্ঙ্গরব ও শারদ্বত নামে দুই শিষ্য শকুন্তলা সমভিব্যহারে গমনের নিমিত্ত প্রস্তুত হইলেন। অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা যথাসম্ভব বেশ ভূষা সমাধান করিয়া দিলেন। মহর্ষি শোকাকুল হইয়। মনে মনে কহিতে লাগিলেন অদ্য শকুন্তলা যাইবে বলিয়া আমার মন উৎকণ্ঠিত হইতেছে, নয়ন বাষ্পবারিপরিপূর্ণ হইতেছে, কণ্ঠরোধ হইয়া বাক্‌শক্তিরহিত হইতেছি, জড়তায় নিতান্ত অভিভূত হইতেছি। কি আশ্চর্য্য! আমি বনবাসী, স্নেহবশতঃ আমারও ঈদৃশ বৈক্লব্য উপস্থিত হইতেছে, না জানি সংসারীরা এমত অবস্থায় কি দুঃসহ ক্লেশ ভোগ করিয়া থাকে। বুঝিলাম স্নেহ অতি বিষম বস্তু! পরে শোকাবেগ সংবরণ করিয়া শকুন্তলাকে কহিলেন বৎসে! বেলা হইতেছে, প্রস্থান কর, আর অনর্থক কাল হরণ করিতেছ কেন। এই বলিয়া তপোবনতরুদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন হে সন্নিহিত তরুগণ! যিনি তোমাদিগকে জলসেক না করিয়া কদাচ অগ্রে জলপান করিতেন না, যিনি ভূষণপ্রিয়া হইয়াও স্নেহবশতঃ তোমাদের পল্লব ভঙ্গ করিতেন না, তোমাদের কুসুম প্রসবের সময় উপস্থিত হইলে যাঁহার আনন্দের সীমা থাকিত না, সেই শকুন্তলা পতিগৃহ যাইতেছেন তোমরা সকলে অনুমতি কর।

 অনন্তর, সকলে গাত্রোথান করিলেন। শকুন্তল,গুরুজনদিগকে প্রণাম করিয়া,প্রিয়ংবদার নিকটে গিয়া অশ্রুপূর্ণ নয়নে কহিতে লাগিলেন সখি! আর্য্যপুত্রকে দেখিবার নিমিত্ত আমার চিত্ত অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়াছে বটে; কিন্তু তপোবন পরিত্যাগ করিয়া যাইতে আমার পা উঠিতেছে না। প্রিয়ংবদা কহিলেন সখি! তুমিই ষে কেবল তপোবন বিরহেকাতরা হইতেছ এৰূপ নহে; তোমার বিরহে তপোবনের কি অবস্থা হইতেছে দেখ। দেঁখ! সচেতন জীব মাত্রেই নিরানন্দ ও শোকাকুল হইয়াছে—হরিণ গণ আহার বিহারে পরাঙ্মুখ হইয়া স্থির হইয়া রহিয়াছে, মুখের গ্রাস মুখ হইতে পড়িয়া যাইতেছে; ময়ুর মধুরী নৃত্য পরিত্যাগ করিয়। উৰ্দ্ধমুখ হইয়া রহিয়াছে; কোকিলগণ আম্রমুকুলের রসাস্বাদে বিমুখ হইয়া নীরব হইয়া আছে; মধুকর মধুকরী মধুপানে বিরত হইয়াছে ও গুন গুন ধ্বনি পরিত্যাগ করিয়াছে।

 কণ্ব কহিলেন বৎসে! আর কেন বিলম্ব কর,বেলা হয়। তখন শকুন্তলা কহিলেন তাত! বনতোষিণীকে সম্ভাষণ না করিয়। যাইব না। এই বলিয়া বনতোষিণীর নিকটে গিয়া কহিলেন বনতোল্লিণি! শাখাবাহুদ্বারা আমাকে স্নেহভরে আলিঙ্গন কর; আজি অবধি আমি দুরবর্ত্তিনী হইলাম। অনন্তর অনুসূয়া ও প্রিয়ংবদাকে কহিলেন সখি! আমি বনতোষিণীকে তোমাদের হস্তে সমর্পণ করিলাম। তাঁঁহারা কহিলেন,সখি! আমাদিগকে কাহার হস্তে সমর্পণ করিলে বল। এই বলিয়া শোকাকুল হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। তখন কণ্ব কহিলেন অনস্থয়ে! প্রিয়ংবদে! তোমরা কি পাগল হইলে, তোমরা কোথায় শকুন্তলাকে সান্ত্বনা করিবে, না হইয়া, তোমরাই রোদন করিতে আরম্ভ করিলে।

 এক পূর্ণগর্ভা হরিণী কুটীরের প্রান্তে শয়ন করিয়াছিল; তাহার দিকে দৃষ্টিপাত হওয়াতে,শকুন্তলা কণ্বকে কহিলেন তাত! এই হরিণী নির্ব্বিঘ্নে প্রসব হইলে আমাকে সংবাদ দিবে, ভুলিবে না বল। কণ্ব কহিলেন, না বৎসে! আমি কখনই বিস্মৃত হইব না।

 কয়েক পদ গমন করিয়া শকুন্তলার গতিভঙ্গ হইলে, শকুন্তলা কহিলেন আমার অঞ্চল ধরিয়া কে টানে; এই বলিয়া মুখ ফিরাইলেন। কী কহিলেন বৎসে তুমি জননীর ন্যায় যাহাকে প্রতিপালন করিয়াছিলে, যাহার আহারের নিমিত্ত শ্যামাক আহরণ করিতে, যাহার মুখ কুশের অগ্র ভাগ দ্বারা ক্ষত হইলে ইঙ্গুদীতৈল দিয়া ব্রণ শোষণ করিয়া দিতে, সেই মাতৃহীন হরিণশিশু তোমার গমন রোধ করিতেছে। শকুন্তলা তাহার গাত্রে হস্ত প্রদান করিয়া কহিলেন বাছা! আর আমার সঙ্গে এস কেন, ফিরিয়া যাও, আমি তোমাকে পরিত্যাগ করিয়া যাইতেছি। তুমি মাতৃহীন হইলে আমি তোমাকে প্রতিপালন করিয়াছিলাম; এখন আমি চলিলাম; অতঃপর তাত কণ্ব তোমার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। এই বলিয়া রোদন করিতে করিতে চলিলেন। তখন কণ্ব কহিলেন বৎসে শান্ত হও, অশ্রুবেগ সংবরণ কর, পথ দেখিয়া চল, উচ্চ নীচ না দেখিয়া পদক্ষেপ করাতে বারংবার আঘাত লাগিতেছে।

 এইৰূপ নানা কারণে গমনের বিলম্ব দেখিয়া শার্ঙ্গরব কণ্বকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন ভগবন্! আপনকার আর অধিক দূর সঙ্গে আসিবার আবশ্যক নাই; এই স্থলেই যাহা বলিতে হয় বলিয়া দিয়া প্রতিগমন করুন। কণ্ব কহিলেন তবে আইস এই ক্ষীরবৃক্ষের ছায়ায় দণ্ডায়মান হই। অনন্তর সকলে সন্নিহিত ক্ষীরপাদপচ্ছায়ায় অবস্থিত হইলে কণ্ব কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া শার্ঙ্গরবকে কহিলেন বৎস! তুমি, শকুন্তলাকে সম্মুখে রাখিয়া, রাজাকে, আমার নাম গ্রহণ করিয়া, কহিবে “আমরা বনবাসী তপস্যায় কাল যাপন করি; তুমি অতি প্রধান বংশে জন্ম গ্রহণ করিয়াছ, এবং বন্ধুবর্গের অগোচরে স্বেচ্ছাক্রমে শকুন্তলাতে স্নেহ প্রদর্শন করিয়াছ; এই সমস্ত বিবেচনা করিয়া অন্যান্য সহধর্ম্মিণীর ন্যায় শকুন্তলাতেও স্নেহ দৃষ্টি রাখিবে। আমাদের এই পর্য্যন্ত প্রার্থনা। ইহার ভাগ্যে থাকে অধিক হইবেক; তাহা আমাদিগের বলিয়া দিবার নয়”।

 শার্ঙ্গরবের প্রতি এই সন্দেশ নির্দেশ করিয়া শকুন্তলাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন বৎসে: এক্ষণে তোমাকেও কিছু উপদেশ দিব। আমরা বনবাসী বটি কিন্তু লৌকিক বৃত্তান্তেরও নিতান্ত অনভিজ্ঞ নহি। তুমি পতিগৃহে গিয়া গুরুজনদিগের শুশ্রুষা করিবে, সপত্নীদিগের সহিত প্রিয়সখীব্যবহার করিবে, স্বামী কাকর্শ্য প্রদর্শন করিলেও রোষবশা হইয়া প্রতিকূলচারিণী হইবে না, পরিচারিণীদিগের প্রতি সম্পূর্ণ দয়া দক্ষিণ্য প্রদর্শন করবে, এবং সৌভাগ্য গর্ব্বে গর্ব্বিত হইবে না। যুবতীরা এৰূপ ব্যবহারিণী হইলেই গৃহিণীপদে প্রতিষ্ঠিত হয়, বিপরীতকারিণীরা কুলের কণ্টক স্বৰূপ। ইহা কহিয়া কহিলেন দেখ; গোতমীই বা কি বলেন। গোতনী কহিলেন বধুদিগকে এই বই আর কি কহিয়া দিতে হইবেক। পরে শকুন্তলাকে কহিলেন বাছা! উনি যে গুলি বলিলেন সকল মনে রাখিও।

 এইৰূপে উপদেশ প্রদান সমাপ্ত হইলে, কণ্ব শকুন্তলাকে কহিলেন বঙ্গ আমরা আর অধিক দূর যাইব না। আমাকে ও সখীদিগকে আলিঙ্গন কর। শকুন্তলা অশ্রুপূর্ণ নয়নে কহিলেন অনসূয়া প্রিয়ংবদাও কি এই খান হইতে ফিরিয়া যাইবে। ইহার সেই পর্য্যন্ত আমার সঙ্গে যাউক। কণ্ব কহিলেন বৎসে। ইহাদের বিবাহ হয় নাই। অতএব সে পর্য্যন্ত যাওয়া উপযুক্ত নয়; গোতমী তোমার সঙ্গে যাবেন। শকুন্তলা পিতাকে আলিঙ্গন করিলেন। দুই চক্ষে ধারা বহিতে লাগিল। তখন কণ্ব কহিলেন বৎসে! এত কাতর হইতেছ কেন; তুমি পতিগৃহে গিয়া গৃহিণী পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া সাংসারিক কার্য্যে অনুক্ষণ এৰূপ ব্যস্ত থাকিবে যে আমার বিরহজনিত শোক অনুভব করিবার অবকাশ পাইবে না। শকুস্তল পিতার চরণে নিপতিত হইয়া কহিলেন তাত! আবার কত দিনে এই তপোবনে আসিব। কণ্ব কহিলেন বৎসে! সসাগরা ধরিত্রীর একাধিপতির মহিষী হইয়া, এবং অপ্রতিহতপ্রভাব স্বীয় তনয়কে সিংহাসনে সন্নিবেশিত ও তদীয় হস্তে সমস্ত সাম্রাজ্যের ভার সমর্পিত দেখিয়া, পতি সমভিব্যাহারে পুনর্ব্বার এই শান্তরসাস্পদ তপোবনে আসিবে।

 শকুন্তলাকে এই ৰূপ শোকাকুলা দেখিয়া গোতমী কহিলেন বাছা! আর কেন, ক্ষান্ত হও, যাবার বেলা বহিয়া যায়। সখীদিগকে যাহা কহিতে হয় কহিয়া লও। আর বিলম্ব করা হয় না। তখন শকুন্তলা সখীদিগের নিকটে গিয়া কহিলেন সখি! তোমরা উভয়ে আমাকে এককালে আলিঙ্গন কর। উভয়ে আলিঙ্গন করিলেন। তিন জনেই রোদন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে সখীরা শকুন্তলাকে কহিলেন সখি! - যদি রাজা শীঘ্র চিনিতে না পারেন তবে তাহাকে তাঁহার স্বনামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় দেখাইও। শকুন্তলা শুনিয়া সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া কহিলেন সখি! তোমরা এমন কথা বলিলে কেন বল। আমার হৃৎকম্প হইতেছে। সখীরা কহিলেন না সখি, ভীত হইও না; স্নেহের স্বভাবই এই অনিষ্ট আশঙ্কা করে।

 এইৰূপে ক্রমে ক্রমে সকলের নিকট বিদায় লইয়া শকুন্তলা,গোতমী প্রভৃতি সমভিব্যাহারে, দুষ্মন্ত রাজধানী প্রতি প্রস্থান করিলেন। মহর্ষি কণ্ব, অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা এক দৃষ্টিতে শকুন্তলার দিকে চাহিয়া রহিলেন। ক্রমে ক্রমে শকুন্তলা দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলে অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। মহর্ষিও দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন অনসূয়ে! প্রিয়ংবদে! তোমাদের সহচরী প্রস্থান করিয়াছেন। এক্ষণে শোকাবেগ সংবরণ করিয়া আমার সহিত আশ্রমে প্রতিগমন কর। এই বলিয়া মহর্ষি আশ্রমাভিমুখ হইলেন এবং তাঁহারাও তাঁঁহার অনুগামিনী হইলেন। যাইতে যাইতে মহর্ষি মনে মনে কহিতে লাগিলেন যেমন, স্থাপিত ধন ধনস্বামীকে প্রত্যপণ করিলে লোক নিশ্চিন্ত ও সুস্থ হয় তদ্রুপ, আদ্য আমি শকুন্তলাকে পতিগৃহে প্রেরণ করিয়া নিশ্চিন্ত ও সুস্থ হইলাম।