শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত/অগ্নি ক্রীড়া

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম
অগ্নি ক্রীড়া

 ১৯২০ সালে সমগ্র ভারতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ হয়। বাংলাদেশে উহার পরিচালন ভার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন গ্রহণ করেন। ছাত্রগণ স্কুল কলেজ ছাড়িবে— উকিলব্যারিষ্টার আইন ব্যবসায় পরিত্যাগ করিবেন, কেহ কাউন্সিলে যাইবে না— গবর্ণমেণ্টের উপাধি বর্জ্জন করা হইবে— বিদেশী দ্রব্য কেহ কিনিবে না; এই পাঁচরকমের বয়কট্ সেই অসহযোগ নীতির মূল মন্ত্র ছিল। ইহার প্রচারের জন্য সমস্ত দেশে, গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে সভা সমিতি বক্তৃতা, পিকেটিং অর্থাৎ বিরোধকারী দিগকে বাধা দেওয়া চলিতে লাগিল, যুবকেরা স্বেচ্ছা-সেবকদল গঠন করিয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। কর্ম্মী চাই— কর্ম্মী চাই এই রব উঠিল।

 ভদ্রমহিলাগণও পুরুষের সহিত কর্ম্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সহধর্ম্মিণী পূজনীয়া শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁহাদের নেত্রীর পদ গ্রহণ করিলেন। তাঁহারা সহধর্ম্মী মহিলাদের মধ্যে উর্ম্মিলা দেবী, সুনীতি দেবী, সন্তোষ কুমারী দাশগুপ্তা, মোহিনী দেবী, হেমপ্রভা মজুমদার, বগলা সোম, উমা দেবী, ইহাদের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের পল্লীগ্রাম ও মফঃস্বল হইতেও বহুসংখ্যক মহিলা কর্ম্মী আসিতে লাগিল। সে কি উৎসাহ— কি উদ্দীপনা, কি এক অপূর্ব্ব কর্ম্ম চঞ্চলতা দেখিয়াছিলাম। এইসকল মহিলা কর্ম্মীদিগকে সংঘবদ্ধ করিবার নিমিত্ত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন নারী-কর্ম্ম-মন্দির প্রতিষ্ঠা করিলেন। ইহার সম্বন্ধে পরে বলিব।

 পুলিশ চারিদিকে খুব ধর-পাকড় আরম্ভ করিল। মহিলা কর্ম্মীরাও পুলিশের হাতে নিস্তার পান নাই। আমরা কয়েকজন পতিতা নারী মিলিয়া একটা ছোট দল গঠন করিলাম। আমাদের বাবুগণ পশ্চাতে থাকিয়া আমাদিগকে পরামর্শ ও উৎসাহ দিতেন। ইতিপূর্ব্বে ইষ্টবেঙ্গল সাইক্লোন ফণ্ডের জন্য চাঁদা তুলিতে যাইয়া আমারা বাহিরের ভদ্রলোকদের সঙ্গে মিশিবার সুযোগ পাইয়াছি। তাহাতে আমাদের সাহস, চতুরতা ও দক্ষতা বাড়িয়াছিল। অনেক ছোট বড় দেশনেতার সহিত পরিচয় হইয়াছিল। এবার যখন আমরা পুনরায় কার্য্যক্ষেত্রে নামিলাম, তখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সহকর্মী। অতিশয় সুখী হইলেন এবং আমাদিগকে বিবিধ প্রকারে সাহায্য করিলেন।

 এই অসহযোগ আন্দোলনের উত্তেজনা এত তীব্র ও পূবল হইয়া উঠিল যে, একসঙ্গে সকলে কাজ করিবার সময় মনে থাকিতনা যে, আমরা অস্পৃশ্য ঘৃণিত বেশ্যা— আর ইঁহারা সম্মানিত ভদ্র গৃহস্থ যুবক। সেই কর্ম্মী যুবকেরাও ভুলিয়া যাইত যে তাহারা বারবনিতার সহিত চলাফেরা করিতেছে। যে সকল পবিত্র-চরিত্র ব্যক্তি কখনও বেশ্যালয়ে আসেন নাই বা আসিবার কল্পনাও করেন নাই, তাঁহাদের সঙ্গে আমরা এই অসহযোগ আন্দোলনের নেশায় মাতিয়া এক ঘোটব গাড়ীতে বেড়াইয়াছি, হাস্য পরিহাসের সহিত তাঁহাদের সঙ্গে কথাও বলিয়াছি। সকলে আমাদের স্বার্থত্যাগের প্রশংসা করিতেন— গর্ব্বের আনন্দে আমাদের বুক ফুলিয়া উঠিত।

 একদিন কর্ম্মশেষে গৃহে ফিরিবার পূর্ব্বে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নিকট বিদায় লইবার সময় তাঁহাকে প্রণাম করিলাম। তিনি স্নেহভরে আমাদের আশীর্ব্বাদ করিলেন। একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি সেইস্থানে বসিয়াছিলেন। আর কেহ ছিলেন না। আমরা যে বারবনিতার দল, তাহা তিনি বুঝিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে তিনি প্রশ্ন করিলেন “শেষ কালে এরাও এসে কাজে নেমেছে— এটা কি ভাল হচ্ছে মি: দাশ?” চিত্তরঞ্জন শ্লেষের সহিত উত্তর করিলেন “আপনারা হ’লেন রুচিবাগীশের দল। আমার সঙ্গে আপনাদের মিলবে না। সঞ্জীবনী-সম্পাদক কেষ্ট মিত্তিরের কাছে যান। তিনি আপনাদের মনের মত লোক। কেশব সেনের সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত হ’য়ে উদার মত অবলম্বন করবার জন্য সাধারণ-ব্রাহ্মসমাজের সৃষ্ট হ’ল; কিন্তু শেষে উহারই মধ্যেও ক্ষুদ্রতা দেখা দিল। কূপের মত এতটুকু হলে হবে না— সমুদ্রের মত প্রশস্ত বিশাল হ’য়ে সকলকে গ্রহণ করা চাই। পাশ্চাত্য দেশে কি দেখছেন? আমাদেরও তাই করতে হবে। যাদের ঘৃণায় দূরে ঠেলে রেখেছি, তারাই আজ এগিয়ে আসছে। এ শুভলক্ষণ, আমি আস্তকুঁড়ের আবর্জনায় এক অপূর্ব্ব শক্তির সন্ধান পেয়েছি।”

 আমরা চলিয়া আসিলাম। তাঁহার ঊর্ক বিতর্ক কতদূর চলিয়াছিল জানি না। কিন্তু আজ দেখিতেছি, আমরা দেশবন্ধুর আশা পূর্ণ করিতে পারি নাই। আমরা সেই মহাপুরুষের সুখের স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া দিয়াছি। তিনি মনে করিয়াছিলেন, দেশ সেবার অনলে আমাদের সকল পাপ দগ্ধ হইয়া যাইবে। তাহা হইল না। দেশকর্ম্মীদের সহিত বারবনিতাদের এই প্রকার অবাধ মেলা-মেশার ফল ভাল হইল না।

 আগুন লইয়া খেলা বড় বিপজ্জনক। সকলে তাহা পারে না। আমাদিগকে কর্ম্মক্ষেত্রে আনিয়া দেশ-নায়ক গণ ভুল করিয়াছিলেন। সৎকার্য্যের অনুষ্ঠানে একটা পতিব্রতার ভিত্তির প্রয়োজন। আমাদের তাহা ছিল না। আমরা শুদ্ধচিত্ত ও সংযত না হইয়াই একটী গুরুতর কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছিলাম। মিথ্যাচার, প্রতারণা, ছলনা, ইন্দ্রিয়পরতা এই সব হইল বারবনিতাদের চরিত্রের প্রধান লক্ষণ। দেশের কার্য্যে ব্রতী হইলেও আমাদের এই সকল দুষ্প্রবৃত্তিই আমাদিগকে পরিচালিত করিল। সুতরাং কথায় যে বলে “শিকগড়িতে বানর”—আমাদেরও হইল তাহাই।

 যে সকল কর্ম্মী যুবকের চরিত্র-বল এমন ছিল যে একটা সিগারেট পর্য্যন্ত কখনও খায় নাই, তাহারা কেহ কেহ এই অসহযোগ আন্দোলনের কর্ম্মক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে মিশিয়া মদ্য-পান পর্য্যন্ত শিখিয়াছে। যে সকল যুবক এমন পবিত্র চিত্ত ছিল যে স্ত্রীলোকের সহিত কথা কহিবার সময় মাথা তুলিত না— তাহারা আমাদের সংসর্গে আসিয়া এখন বেশ্যা দূরে থাক্, কুলবধূর সহিত নির্ল্লজ্জের মত কুৎসিতু হাস্য পরিহাস করিতে অনেকে লজ্জিত হয় না। পতিতানারীদের একটী প্রধান স্বভাব এই যে তাহারা সচ্চরিত্র ও সংযত-চিত্ত পুরুষ দেখিলে তাহাকে হস্তগত করিতে বিশেষ চেষ্টা করে এবং তাহার সংযম ও পবিত্রতাকে বিনষ্ট করা একটা বীরত্বের কার্য্য বলিয়া মনে করে।

 আমি জানি, আমরা যে কয়জন এই অসহযোগ আন্দোলনের কার্য্য করিতে গিয়াছিলাম, তাহার প্রত্যেকে অনেক দেশকর্ম্মী যুবক দিগকে প্রলুব্ধ করিয়াছিল। আমিও সেই অপরাধ হইতে মুক্ত নহি। এমন কি কেহ কেহ পিতৃতুল্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের পারিষদদিগের প্রতিও কটাক্ষ হানিতে ছাড়ে নাই। বাড়ীতে ফিরিয়া আমরা এই আলোচনাই করিতাম, —কে কয়টা নূতন ‘বাবু’ জুটাইয়াছে— কার ঘরে কোন দেশকর্ম্মী আসিলেন— পরের টাকায় কেমন পান সিগারেট খাওয়া হইল— মোটর চড়া গেল— ট্যাক্সী ভাড়ার টাকা হইতে কে কত টাকা আঁচলে বাঁধিয়াছে, ইত্যাদি।

 আমার যে শুধু যুবকদের অধঃপাতে লইয়া গিয়াছি, তাহা নহে। গৃহস্থ ঘরের কন্যা ও বধুরাও আন্দোলনে যোগ দিয়া বাহিরে আসিয়াছিলেন। অবশ্য উহারা উদার, শিক্ষিত পরিবারেরই বৌঝি। সাধারণতঃ গোঁড়া হিন্দুরা তাঁহাদের অন্তঃপুরের স্ত্রীলোকদিগকে এ-ভাবে বাহিরে যাইতে দেন না। গৃহস্থ ঘরের যে সকল মহিলা আমাদের সহিত কার্য্য করিতেন তাঁহাদের কাহারও সহিত নানা কুকথা প্রসঙ্গে আমাদের আলাপ হইত। আমি জানি, কয়েকটী ভদ্র গৃহস্থের বধু অসহযোগ আন্দোলন প্রচারের কার্য্য করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা আর তাঁহাদের স্বামীর নিকট ফিরিয়া যান নাই। কেহ কোন কার্য্য আরম্ভ করিয়াছেন— কেহ বা কোন দেশকর্ম্মীর সহিত অবৈধ প্রণয়ে আসক্ত হইয়াছেন, কেহ কেহ স্বামী-স্ত্রী ভাবে বাস করিতেছেন। এই সকল দেশকর্ম্মীর আচরণ সকল লোকই জানে, অথচ তাহারা ভোট দিয়া এই প্রকার সাধুবেশী লম্পট স্বভাব ব্যক্তিদিগকেই করর্পোরেশন, কাউন্সিলে প্রেরণ করে। সমাজের অন্ধতা এতদূর গভীর।

 এই সম্পর্কে একটী কথা বলিতেছি। মফঃগ্বলের এক ব্রাহ্মণ গৃহস্থ যুবকের স্ত্রী অসহযোগ আন্দোলনে মহিলা কর্ম্মীদের সহিত কার্য্য করিতে আসিয়াছিলেন, এই বধুটী পরমাসুন্দরী— আমি তাঁহাকে স্বচক্ষে দেখিয়াছি। তাঁহার সহিত আমার একদিন কথাবার্ত্তাও হইয়াছে। এই পুস্তকখানি যদি কখনও তাঁহার হাতে পরে, তবে তিনি হয়ত আমাকে চিনিতে পারিবেন। তাঁহার সহিত আমার অল্প পরিচয়েই একটু বন্ধুত্ব জন্মিয়াছিল। তাঁহার সম্পর্কিত ঘটনা এখানে প্রকাশ করিতে বাধ্য হইয়াছি বলিয়া আমি তাঁহার নিকট ক্ষমা চাহিতেছি। তিনি যে অধঃপাতে গিয়াছেন, তার জন্য অংশতঃ কে দায়ী, তাহা আমি জানি।

 আমার মনে আছে, আমি ব্রাহ্মণ কুলবধূটীর সহিত একটু অন্তরঙ্গভাবে নানা ভাবের আলাপ করিয়াছিলাম। তিনি এক দেশকর্ম্মী কায়স্থ যুবকের সহিত অবৈধ প্রণয়ে আসক্ত হইয়া ছেন। এই যুবটী উচ্চ শিক্ষিত আকুমার ব্রহ্মচারী ছিলেন। আমি প্রথমে একটু আশ্চর্য্য হইলাম। কারণ, আমার এমন সুন্দরী যুবতী বন্ধুটী যে শেষকালে একটা বাঙ্গাল যুবকের প্রেমে মজিরে তাহা ভাবি নাই। একবার এই ব্রাহ্মণ বধূটী অপর কতিপয় মহিলাকর্ম্মীর সহিত প্রচার কার্য্য করিবার নিমিত্ত পূর্ব্ববঙ্গে গিয়াছিলেন। এই ব্রাহ্মণ-বধূটী নারী-কর্ম্ম-মন্দিরের এক নির্জ্জন কক্ষে ঐ চির-কুমার কর্ম্মীর নিকট গীতা পড়িতেন।

 আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি, মফঃস্বল হইতে যে সকল মহিলাকর্ম্মী আসিয়াছিলেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কলিকাতায় তাঁহাদের থাকিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। তাহা হইতেই নারী-কর্ম্ম-মন্দিরের সৃষ্টি হয়। প্রথমে উহা ভবানীপুরে দেশবন্ধুর সাক্ষাৎ তত্ত্বাবধানে ছিল। তাঁহার অন্যতম সহকারী শ্রীযুক্ত বসন্ত কুমার মজুমদার মহাশয়ের পত্নী শ্রীযুক্তা হেমপ্রভা মজুমদার যখন কর্ম্মক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা দেখাইলেন, তখন তাঁহার উপরেই নারী-কর্ম্ম-মন্দিরের ভার অর্পিত হয়, এবং উহা কলিকাতা সীতারাম ঘোষের ষ্ট্রীটে স্থানান্তরিত হয়।

 সেই ব্রাহ্মণ বধূটী স্বামী ছাড়িয়া আসিবার পর আর গৃহে যান নাই— কলিকাতাতেই থাকেন। নব প্রণয়ীর সহিত অবৈধ সংসর্গের ফলে তাঁহার গর্ভসঞ্চারের লক্ষণ দেখা যায়। তখন দেশ-কর্ম্মী যুবকটী সেই বধূটীকে লইয়া পলায়ন করিলেন। যাঁহারা এই অবৈধ প্রণয়ে বাধা দিয়াছিলেন, তাঁহারা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে এ বিষয়ে জানান। কারণ যুবকটী তাঁহার বিশেষ প্রিয় ছিল কিন্তু তিনি ইহার কোন প্রতিকার করিতে পারেন নাই।

 কর্ম্মীদলের মধ্যে নারী পুরুষেয় এই প্রকার কলুষিত সম্মিলনের অনেক ঘটনা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন জানিতেন। কিন্তু তিনি যখন দেখিলেন, আর কিছুতেই তাহা প্রতিরোধ করিতে পারিতেছেন না, নীতি-হীনতার জন্য চরিত্রবান কয়েকটি বিশিষ্ট কর্ম্মী চলিয়া গেলেন, তখন দুশ্চিন্তায় তাঁহার হৃদয় দমিয়া গেল— দেহ ভাঙ্গিয়া পড়িল— স্বাস্থ্য নষ্ট হইল। অর্থলোভী কর্ম্মীগণ তাঁহার নিকট হইতে অতিরিক্ত অর্থশোষণ করিতে লাগিল, তদুপরি এই দারুণ আঘাত পাইয়া তিনি আর মাথা তুলিতে পারেন নাই। তাঁহার মৃত্যুর পর শবদেহ লইয়া যে বিরাট শোক যাত্রা হইয়াছিল তাহাতে যোগ দিবার জন্য আমাদের পল্লী হইতে পতিতাগণ গিয়াছিল। আমি যাই নাই। কোন বন্ধুর নিকট বলিয়াছিলাম, দেখুন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে আমরাই মেরেছি। তাঁর অকাল মৃত্যুর জন্য আমরাও দায়ী। দেশ সেবার ছল করে আমরা তাঁহার কর্ম্মীর দলের স্তরে স্তরে পাপের বিষ ছড়িয়ে দিয়েছি। জীবিত অবস্থায় এইভাবে তাঁকে আমরা আঘাত করেছি। আজ মৃত্যুর স্পর্শে যখন তিনি বিশুদ্ধ হয়ে স্বর্গে চলেছেন, তখন আর আমার মত পতিতার পাপ দৃষ্টি যেন তাঁহার পবিত্র মুখের উপরে না পরে।” এই ভাবিয়াই আমি দেশবন্ধুকে শেষ দেখা দেখি নাই।

 এখন সেই ব্রাহ্মণ বধূটী তাহার প্রণয়ীর সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী ভাবে বাস করিতেছেন। তাঁহাদের নাকি সন্তান জন্মিয়াছে। সমাজে তাঁহারা এক প্রকার নিঃসঙ্কোচে চলিতেছেন। ব্রহ্মচর্য্য ব্রতাবলম্বী উচ্চ শিক্ষিত (?) দেশকর্ম্মী যুবক এইরূপে পরদার গ্রহণ করিয়া সমাজে মর্য্যাদা লাভ করিয়াছেন— এখন রাজ-দরবারেও তাঁহার উচ্চ আসন। হায় সমাজ, পুরুষের বেলায় তুমি অন্ধ!

 পিকেটিং করিবার সময় পুলিশ মহিলা কর্ম্মীদেরও গ্রেপ্তার করিত। একবার শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী ও শ্রীযুক্তা বগলা সোম প্রভৃতিকে থানায় নিয়া সাবধান করিরা ছাড়িয়া দেওয়া হয়। আমরা পুলিশকে ভয় করিতাম না। কারণ ঘাঁটির পাহারাওয়ালা হইতে পুলিশের উচ্চ কর্ম্মচারী পর্য্যন্ত সকলের সহিত আমাদের বিশেষ পরিচয় থাকে। আমাদের কয়েক জনকেও পুলিশ ধরিয়া থানায় নিয়াছিল। সেখানে প্রধান কর্ম্মচারী আমাকে দেখিয়াই একটু মুচকি হাসিলেন। দেখিলাম তিনি আমার পরিচিত। বিখ্যাত অভিনেত্রী নীরদা সুন্দরীর গৃহে তাঁহার সহিত আমার আলাপ হয়। কলিকাতার মধ্যে সকলেই এই ব্রাহ্মণ-বংশীয় পুলিশ কর্ম্মচারীকে ভালরূপ জানেন। বলা বাহুল্য তিনি আমাদিগকে মুক্ত করিয়া দিলেন।

 ইহার কিছুদিন পরে উত্তর বঙ্গে ভীষণ জলপ্লাবন হয়। বন্যাবিধ্বস্ত লোকদের সাহায্যের জন্য কলিকাতায় নানাপ্রকারে চাঁদা তোলা হইতে থাকে। ইহার জন্য এক কেন্দ্রীয় সমিতি গঠিত হয়। আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান অধিনায়ক হইয়াছিলেন। ছাত্র ও যুবকেরা রাস্তায় রাস্তায় গান গাহিয়া ভিক্ষা করিতে আরম্ভ করিল— ধনী লোক স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়া বহু অর্থ দান করিলেন—থিয়েটার,বায়স্কোপ কোম্পানীর মালিকেরা বেনিফিট নাইটএর ধ্বন্দোবস্ত করিলেন;— ছোট ছোট ক্লাব ও নানাপ্রকার সমিতি অভিনয়াদি আমোদ-প্রমোদের দ্বারা অর্থ সংগ্রহ করিলেন, গভর্ণমেণ্টের পক্ষ হইতেও সাহায্যের জন্য সামান্য টাকা মঞ্জুর হইল।

 অসহযোগ আন্দলনের সময় প্রকাশ্য কর্ম্ম ক্ষেত্রে নামিয়া আমাদের সাহস বাড়িয়াছিল। সুতরাং এই ব্যপারেও আমরা উাসীন রহিলাম না। আমাদের দল পূর্ব্ব হইতেই এক প্রকার গঠিত ছিল। তবে এবার উহাকে আরও বড় করিতে হইল। আমরা প্রস্তাব করিলাম, নিজেদের মধ্যে চাঁদা না তুলিয়া দল বাঁধিয়া গান গাহিয়া রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করিতে হইবে। তদনুসারে হাড়কাটা গলি, রামবাগান, সোনাগাছি, ফুলবাগান, চাঁপাতলা, আহিরীটোলা, জোড়াসাঁকো, সিঙ্গলা, কেরাণীবাগান প্রভৃতি বিভিন্ন পল্লীর পতিতাগণ পৃথক পৃথক দল গঠন করিয়া রাস্তায় ভিক্ষা করিতে বাহির হইল।

 সে এক অপূর্ব্ব দৃশ্য! কলিকাতায় অধিবাসীগণ স্তম্ভিত হইয়া গেল। এক এক দলে প্রায় ৫০/৬০ জন পতিতা নারী— তাহাদের পরিধানে গেরুয়া রংয়ের লালপাড় সাড়ী— এলো চুল পিঠের উপর ছড়ান— কপালে সিঁদুরের ফোঁটা—কণ্ঠে মধুর সঙ্গীত মনোহর চলনভঙ্গী, সঙ্গে করেকজন পুরুষ ক্লেরিয়নেট ও হারমনিয়ম বাজাইতেছে। অগ্রে অগ্রে দুইটি নারী একখানি শালুর নিশান ধরিয়া যায়, তাহাতে কোন্ পাড়ার পতিতা নারী সমিতি, তাহা লিখিত আছে। তাহার পশ্চাতে অপর দুই নারী একখানি কাপড় ধরিয়াছে, তাহাতে দাতাগণ টাকা, পয়সা নোট প্রভৃতি ফেলিয়া দিতেছে। আর দুইজন স্ত্রীলোক পুরাতন বস্ত্র সংগ্রহ করিতেছে।

 বেশ্যাদের মধ্যে অনেকেই যে খুব সুন্দরী তাহা নহে, তবে তাহারা সকলেই নিতান্ত কুৎসিং একথাও সত্য নয়। যাহা হউক, সাজিয়া বাহির হইলে পতিতা নারীদের সকলকেই সুন্দরী দেখায়। কারণ, ইহার উপরেই তাহাদের ব্যবসার ভিত্তি। রূপ দেখাইয়া জনসাধারণকে প্রলুব্ধ করিবার জন্য কলিকাতার রাজপথে বেশ্যাদের দাঁড়াইবার নিয়ম নাই। তাহা হইলে তাহাদিশকে পুলিশে বাঁধিয়া নেয়। প্রলুব্ধ করিবার জন্য তাহারা তাহাদের দরজার চৌকাঠের বাহিরে আসিতে পারে না। সুতরাং, খাঁটি বেশ্যা পল্লীতেও তিন চারিটী স্ত্রীলােককে কদাচ রাস্তার উপরে এক সঙ্গে দেখা যায়। এমন অবস্থায় যদি বেশ্যারা দল বাঁধিয়া গান গাহিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া চলিতে থাকে, তবে তাহা সাধারণ লােকের চক্ষে কেমন লাগে তাহা একবার ভাবিয়া দেখুন।

 আমি পূর্ব্বই বলিয়াছি, নিত্য অসংযম ও ভােগ লালসার মধ্যে থাকাতে পতিতা নারীদের চরিত্রে কুভাবই প্রবল থাকে। অসহযােগ আন্দোলনে দেশপ্রীতির ভাব, অথবা বন্যা-পীড়িতের সাহায্যে ভিক্ষা করার কার্য্যে দয়ার ভাব পতিতা নারীদের চিত্তকে বিশেষ অধিকার করে নাই। আমরা নিজেদের লোকের সম্মুখে জাহির করিবার একটা সুযােগ পাইয়া তাহার উপযুক্ত ব্যবস্থা করিয়াছি, এইমাত্র। সকলে না হউক অন্ততঃ অনেকে।

 আমরা যখন ভিক্ষা করিতে বাহির হইতাম তখন শত শত লোক আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলিত।

 বন্যা-পীড়িত দুর্দশাগ্রস্থ নরনারীর দুঃখে কাতর হইয়া সকলেই আমাদের তহবিলে টাকা দিত না; আমাদের রূপ দেখিয়া, আমাদের গান শুনিয়া, আমাদের কটাক্ষ খাইয়া, তাহারা মুগ্ধ হইয়া টাকা দিয়া যাইত। ছাত্র ও যুবকের দলে এত লােকের ভিড় হইত না।

 সকালে ও সন্ধ্যায় দুই বেলাই পতিতা নারীর দল অর্থ সংগ্রহ করিতে বাহির হইত। আমরা বহু সহস্র টাকা পাইয়াছিলাম, কিন্তু নানা অপব্যয় করিবার পর তাহার অংশ বিশেষ মাত্র কেন্দ্রীয় সমিতির তরবিলে পৌঁছিয়াছে। আমরা যাহা কিছু দিয়াছি, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাহাই সাদরে গ্রহণ করিয়াছেন। আমাদের টাকা লইতে সুনীতিবাদী ব্যক্তিদের আপত্তি ছিল; কিন্তু আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁহাদিগকে বুঝাইয়া মত করিলেন।

 ক্রমশঃ আমরা ভদ্র গৃহস্থ পরিবারের যুবক ও কুলবধুদের সহিত মেলামেশা করিবার অধিক সুযােগ পাইতে লাগিলাম। অবশ্য পূর্ব্বে যে তাহা ছিলনা এমন নয়। দ্বাদশ গােপাল, তারকেশ্বর, কালীঘাট প্রভৃতি তীর্থস্থানে ও মেলায় আমাদের অবাধ গতিবিধি ছিল, এখনও আছে। তাহাতে ও সমজের কিছু অবনতি ঘটিতেছে। তবে সে সকল স্থলে প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম্মানুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকে— পতিতা নারীদের সহিত অলাপ পরিচয় করিবায় বিশেষ প্রলােভন অথবা অবসর কাহারও ঘটেনা। কিন্তু এবার অসােহযােগ আন্দোলন উপলক্ষ্য করিয়া আমরা যে ভাবে বাহির হইলাম, তাহাতে ভদ্র পুরুষ ও মহিলাদের সহিত আমাদের কথাবার্ত্তা প্রয়োজন বশতঃ অনিবার্য্যই ছিল। মেলায় অথবা তীর্থস্থলে জনতার মধ্যে পতিতা নারীগণ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে, তাহারা সাধারণের চক্ষে অমন জাজ্বল্যমান হয়না। কিন্তু আমরা ভিক্ষার ছলে অথবা পিকেটিং করিবার জন্য যেমন দলবদ্ধ হইয়া বাহির হইতাম, তাহাতে সর্বসাধারণের মুগ্ধদৃষ্টি আমাদের প্রতি আকৃষ্ট না হইয়া যাইত না।

 মহাত্মা গান্ধীর অসহযােগ আন্দোলনের অন্তর্গত আরও কয়েকটি প্রধান বিষয় ছিল,—অস্পৃশ্যতা দূর, চরকা ও খদ্দর। আমাদের পতিতা নারীসমাজে ইহার ফল কিরূপ হইয়াছিল, তাহা সংক্ষেপে বলিতেছি। অস্পৃশ্যতা দূর বলিতে মহাত্মা গান্ধী বােধ হয় এই বুঝিয়াছিলেন যে, হাড়ী, মুচি, ডােম, চণ্ডাল, পারিয়া, দুলে বাগ্দী, সাঁওতাল, দোসাদ প্রভৃতি নিম্ন শ্রেণীর লোক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকিলে তাহাদের পরিবেশিত অন্নজল উচ্চ বর্ণের লােক গ্রহণ করিতে পারিবেন, এবং এই সকল অন্ত্যজ জাতির লােক শুদ্ধদেহে ও পবিত্র পরিচ্ছদে দেব-মন্দিরে প্রবেশ করিতে পারিবে। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর কোন কোন ভক্ত বেশ্যাদিগকেও অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত মনে করিয়া তাহাদিগকে ভদ্রসমাজে ‘চল’ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। একথা বােধ হয় সকলেই জানেন, পতিতার গৃহে যে সকল ভদ্রলােক গমন করেন, তাহারা গােপনে সেই নারীর স্পৃষ্ট সর্ব্বপ্রকার খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করেন— শুধু গ্রহণ করেন বলিলে কথাটা অসম্পূর্ণ থাকে— গ্রহণ করিয়া কৃতার্থ হন। যে কার্য্যটী গােপনে হইয়া থাকে, তাহা প্রকাশ্যে করাই এই গান্ধী-ভক্তদের উদ্দেশ্য ছিল। দেবমন্দিরে প্রবেশ বেশ্যাদের পক্ষে কখনও নিষিদ্ধ হয় নাই। তাহাদের সাজ পােষাক দেখিয়া পুরােহিত ঠাকুরের চমক লাগিয়া যায়—প্রচুর দক্ষিণার লােভে, তিনি— না বলিতেই দ্বার উন্মুক্ত করিতে আদেশ দেন।

 পতিতাদের প্রতি এই অপূর্ব্ব সহানুভূতির ফলে নানাস্থানে পতিতা নারীসঙ্ঘ স্থাপিত হইল। তন্মধ্যে বরিশালের বেশ্যা-সমিতিই অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল। সেই সময়ে আমার বন্ধু কালীদাসীর বাড়ীতে বরিশাল হইতে একটী বারবনিতা আসে। তাহার নাম এখন ঠিক মনে হইতেছে না, বােধ হয় বসন্তকুমারী হইবে। যাহা হউক, এই বসন্তকুমারীকে লইয়া এক তরুণ ছাত্র-যুবক কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যুবকটী কোন ধনী ব্যবসায়ীর পুত্র। বাপের লোহার সিন্দুক ভাঙ্গিয়া আটশত কাটা লইয়া পতিতা-প্রণয়িণীকে কলিকাতায় আনিলেন। বসন্তকুমারীর মুখে শুনিলাম, বরিশালের এক বিখ্যাত দেশকর্ম্মী দার্শনিক ব্যক্তি তরুণ যুবকদের দ্বারা পতিতালয়ে অসহযোগ মন্ত্র প্রচার করিতেছেন। তথাকার বারবণিতাগণ চরকায় সূতা কাটিতেছে ও খদ্দর পরিধান আরম্ভ করিয়াছে। আমি এত উৎসাহিত হইলাম যে আমিও একটা চরকা কিনিয়া ফেলিলাম— খদ্দরের শাড়ী ব্লাউজ পড়িতে লাগিলাম।

 আমার চেষ্টায় রামবাগানে দশ বার জন পতিতা নারী চরকায় সূতা কাটিতে লাগিল। কেহ কেহ খদ্দর পড়িতে আরম্ভ করিল। কিন্তু দুই মাসের মধ্যে সব শেষ। চরকা খদ্দর বন্ধ হইয়া গেল। তা’ হইবার কথা— কারণ সংযম ও পবিত্রতার ভিত্তি ব্যতীত উহা দাঁড়াইতে পারে না।

 একদিন দেখিলাম কোন খবরের কাগজে লেখা হইয়াছে— “কি দুঃখের বিষয়— অশ্বিনীকুমারের বরিশালে আজ যুবকেরা পতিতার সংষ্পর্শে যাইতে কিছুমাত্র লজ্জিত হয় না।” আমি বসন্তকুমারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম “ভাই, তোমাদের করিশালে অশ্বিনীকুমার কে? বসন্ত বলিল “আমি তিন মাস পূর্ব্বে ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া হইতে বরিশালে আসি। অশ্বিনীকুমারের পরিচয় আমি জানিনা— উনি বোধ হয় জানিতে পারেন।” বসন্ত তাহার বাবুকে লক্ষ্য করিয়া বলিল। যুবকটী পার্শ্ববর্ত্তী পালঙ্কের উপর শুইয়া পান চিবাইতে চিবাইতে বিকৃতস্বরে গাহিতেছিলেন—

“এখনও তারে চোখে দেখিনি,
শুধু বঁশী শুনেছি।
মন প্রাণ যা’ ছিল তা’ দিয়ে ফেলেছি”।—

 বসন্তের কথায় আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “অশ্বিনী বাবুর নাম শুনেন নি!— স্বনামধন্য পুরুষ অশ্বিনীকুমার দত্ত। আপনি এত পড়াশুনা করেছেন—তাঁর ভক্তিযােগ পড়েন নি?— একবার পড়ে দেখবেন। পবিত্র চরিত্রের এমন উচ্চ আদর্শ আর কোথাও নাই! অশ্বিনী বাবুর হাতে গড়া বরিশাল।” আমি বলিলাম “সেই অশ্বিনী কুমার দত্ত! হাঁ, তার নাম আমি জানি।”

 আমি তাঁর মুখের উপর জবাব দিলাম “আপনিও সেই বরিশালেরই যুবক—না?” যুবকটী নির্ল্লজ্জের মত পুনরায় গাহিতে লাগিল—

“শুধু স্বপনে এসেছিল যে,
নয়ন কোনে হেসেছিল সে”—

আমি বিরক্ত হইয়া উঠিয়া আসিলাম। আমার মনে হইল, মানুষ এই বড় ভণ্ড হইতে পারে— একটা মহান আদর্শকে প্রশংসা কর্‌বার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কার্য্য দ্বারা অম্লান বদনে তাহাকে পদদলিত করিয়া যায়। যাহা হউক, বসন্তের প্রণয়ী এই যুবকটী আমাকে একদিন অশ্বিনী বাবুর 'ভক্তিযোগ' পুস্তকখানি আনিয়া দিলেন। বলিলেন, “ইহা আমার উপহারস্বরূপ গ্রহণ করুণ।” সেই অবধি আমি ভক্তিযােগ মাঝে মাঝে পাঠ করিতাম।

এই পতিতা-নারী-সমিতির প্রভাব ক্রমশঃ এতদূর বিস্তৃত হইল যে একদল সুনীতি-জ্ঞান-সম্পন্ন ব্যক্তি ইহার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইলেন। সঞ্জীবনী সম্পাদক শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র প্রথমাবধি ইহার বিরুদ্ধে ছিলেন। ঐ সংবাদ পত্রে তিনি চিরদিন এই সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য প্রকাশ করিয়া থাকেন। হিমাচলের মত দৃঢ় চিত্ত এই মহাপুরুষকে আমি জীবনে কয়েকবার মাত্র দেখিয়াছি; তাহাতে তাঁহাকে দেবতা সদৃশ বলিয়া আমার মনে হইয়াছে— তাঁহার কথা আমি আর ও দুইটী পতিতা নারীর মুখে শুনিয়াছি— তাহাদের নাম সুরুচি ও ঊষাবালা। যথাস্থানে ইহাদের কথা বলা হইবে।

 শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র মহাশয়ের সম্বন্ধে এখানে আরও দুই একটা কথা না বলিয়া পারিলাম না। তাঁহার সুনীতি ও পবিত্রতার আদর্শের তুলনায় আমরা অতি হীন— নরকের কীটানুকীট। তথাপি তাঁহার কথা এই জন্য বলিতেছি, তাহাতে আমার চরিত্র আরও পরিস্ফুট হইবে। কৃষ্ণবাবু দুর্নীতিকে কখনও কোন মিথ্যা অজুহাতে ক্ষমা করেন নাই— কাহাকেও ছাড়িয়া কথা কহেন নাই। রবীন্দ্রনাথ থিয়েটারের অভিনেত্রীদের গান শিখাইতে যান বলিয়া তাঁহাকে তিরস্কার করিয়াছে— আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র পতিতার দান গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া তাঁহার উপরও দোষারোপ করিয়াছেন— ডাক্তার বিমল চন্দ্র ঘোষ ‘সরষূ সদনের’ সাহায্যার্থ বেশ্যার দ্বারা নাট্যাভিনয় করিয়াছেন বলিয়া তাঁহার অজস্র নিন্দাবাদ করিয়াছেন— শ্রীযুক্তা জ্যোতিশ্বরী গাঙ্গুলী মিনার্ভা থিয়েটারে বেশ্যাদের সভায় মহিলা ভলাণ্টিয়ারদের নেত্রী হইয়াছিলেন বলিয়া তৎসম্বন্ধে তীব্র মন্তব্য করিয়াছেন। ইঁহারা সকলেই ব্রাহ্ম সমাজের এক এক জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। আমার সকল প্রণয়ীই ইঁহাকে ভয় করিত। মহাত্মা গান্ধী যখন বঙ্গদেশ পরিভ্রমণ করেন, তখন তিনি বরিশালে গমন করিলে সেখানকার পতিতা-নারী-সমিতি তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করে। কিন্তু মাহাত্মা গান্ধী সেই সমিতিতে যান নাই। তিনি বলেন “পতিতারা যদি একত্র মিলিত হইয়া সমিতি গঠন করে তবে দেশের চোর ডাকাতরাও সমিতি গঠন করিবে।” সেই দার্শনিক দেশকর্ম্মী মহাশয় মহাত্মাজীর তিরস্কার লাভ করিয়া এক্ষণে বরিশালের কর্ম্ম ক্ষেত্র হইতে নাকি চলিয়া গিয়াছেন।

 আমার জীবনেও এদিকে দুর্য্যোগ ঘনাইয়া আসিতেছিল। রাজনৈতিক আন্দোলনে বাহির হইয়া দেশকর্ম্মী যুবকদের মধ্যে বিচরণ করিবার সময় আমি আত্ম-সংযম করিতে পারি নাই। আমার কায়িক ও মানসিক অপরাধ হইয়াছে। যেখানে শিক্ষার অভাব— যেখানে শাসন নাই— যেখানে অহঙ্কারই প্রবল, সেখানে এরূপ ত হবেই। আমার সেই ব্যাঙ্কের কর্ম্মচারী— পাধ্যায় বাবুটী আমার বে-চাল লক্ষ্য করিয়াছেন— আমার আচরণ সন্দেহের চক্ষে দেখিয়াছেন।

 এদিকে তিনিও অপরাধী হইয়াছিলেন। আমি তাঁহাকে থিয়েটারে একটু বেশী যাওয়া-আসা করিতে দেখিলাম। একদিন থিয়েটারে গ্রীন্ রুম্ বা সাজ ঘরে কোন অভিনেত্রীর সহিত তাঁহার হাস্য পরিহাসের সময় আমার দৃষ্টি সেই দিকে পরিল। আমরা দু’জনেই থিয়েটার দেখিতে গিয়াছিলাম। আমাকে বক্সে রাখিয়া তিনি ছল করিয়া বাহিরে গিয়াছিলেন; গোপনে আমিও গিয়াছিলাম।

 আমাদের দুজনেরই হৃদয় বর্ষার বিদ্যুৎপূর্ণ দুইখানি মেঘের মত পরস্পর নিকটে আসিতেছিল। আশঙ্কা করিতেছিলাম, একদিন দিগ দিগন্ত কম্পিত করিয়া দারুণ বজ্রপাত হইবে।