শৈশব সঙ্গীত/দিকবালা

উইকিসংকলন থেকে

দূর আকাশের পথ উঠিছে জলদ রথ,
নিম্নে চাহি দেখে কবি ধরণী নিদ্রিত।
অস্ফুট চিত্রের মত নদনদী পরবত,
পৃথিবীর পটে যেন রয়েছে চিত্রিত!
সমস্ত পৃথিবী ধরি একটি মুঠায়
অনন্ত সুনীল সিন্ধু সুধীরে লুটায়।
হাত ধরাধরি করি দিক্‌-বালা গণ
দাঁড়ায়ে সাগর-তীরে ছবির মতন।
কেহবা জলদময় মাখায়ে জোছানা।
নীল দিগন্তের কোলে পাতিছে বিছানা।
মেখের শয্যায় কেহ ছড়ায়ে কুন্তল
নীরবে ঘুমাইতেছে নিদ্রায় বিহ্বল।
সাগর তরঙ্গ তার চরণে মিলায়,
লইয়া শিথিল কেশ পবন খেলায়।

কোন কোন দিকবালা বসি কুতূহলে
আকাশের চিত্র আঁকে সাগরের জলে।
আঁকিল জলদ-মালা চন্দ্রগ্রহ তারা,
রঞ্জিল সাগর, দিয়া জোছনার ধরা।
পাপিয়ার ধ্বনি শুনি কেহ হাসি মুখে,
প্রতিধ্বনি রমণীরে জাগায় কৌতুকে!
শুকতারা প্রভাতের ললাটে ফুটিল,
পূরবের দিক্‌দেবী জাগিয়া উঠিল।
লোহিত কমল করে পূরবের দ্বার
খুলিয়া—সিন্দূর দিল সীমন্তে উষার।
মাজি দিয়া উদয়ের কনক সোপান,
তপনের সারথীরে করিল আহ্বান।
সাগর-উর্ম্মির শিরে সোনার চরণ
ছুঁয়ে ছুঁয়ে নেচে গেল দিক্‌-বালাগণ।
পূরব দিগন্তকোলে জলদ গুছায়ে
ধরণীর মুখ হ’তে আঁধার মুছায়ে,
বিমল শিশির জলে ধুইয়া চরণ,
নিবিড় কুন্তলে মাখি কনক কিরণ,
সোনার মেঘের মত আকাশের তলে,
কনক কমল সম মানসের জলে,

ভাসিতে লাগিল যত দিক্‌-বালাগণে,
উলসিত তনুখানি প্রভাত পবনে।
ওই হিম-গিরি পরে কোন দিক্‌-বালা
রঞ্জিছে কনক-করে নীহারিকা-মালা!
নিভৃতে সরসী-জলে করিতেছে স্নান,
ভাসিছে কমলবনে কমল বয়ান।
তীরে উঠি মালা গাঁথি শিশিরের জলে
পরিছে তুষার-শুভ্র সুকুমার গলে।
ওদিকে দেখেছ ওই সাহারা প্রান্তরে,
মধ্যে দিক-দেবী শুভ্র বালুকার পরে।
অঙ্গ হতে ছুটিতেছে জ্বলন্ত কিরণ,
চাহিতে মুখের পানে ঝলসে নয়ন।
আঁকিছে বালুকাপুঞ্জে শত শত রবি,
আঁকিছে দিগন্ত-পটে মরীচিকা-ছবি।
অন্যদিকে কাশ্মীরের উপত্যকা-তলে,
পরি শত বরণের ফুল মালা গলে,
শত বিহঙ্গের গান শুনিতে শুনিতে,
সরসী লহরী মালা গুনিতে গুনিতে,
এলায়ে কোমল তনু কমল কাননে,
আলসে দিকের বালা মগন স্বপনে।

ওই হোথা দিক্‌দেবী বসিয়া হরষে
ঘুরায় ঋতুর চক্র মৃদুল পরশে।
ফুরায়ে গিয়েছে এবে শীত-সমীরণ,
বসন্ত পৃথিবী তলে অর্পিবে চরণ।
পাখীরে গাহিতে কহি অরণ্যের গান,
মলয়ের সমীরণে করিয়া আহ্বান,
বনদেবীদের কাছে কাননে কাননে
কহিল ফুটাতে ফুল দিক‍্‌দেবীগণে।
বহিল মলয়-বাযু কাননে ফিরিয়া,
পাখীরা গাহিল গান কানন ভরিয়া।
ফুল-বালা-সাথে আসি বন-দেবীগণ
ধীরে দিক‍্‌-দেবীদের বন্দিল চরণ।