বিষয়বস্তুতে চলুন

শৈশব সঙ্গীত/ফুলবালা

উইকিসংকলন থেকে


শৈশব সঙ্গীত।


ফুলবালা

গাথা।

তরল জলদে বিমল চাঁদিমা
সুধার ঝরণা দিতেছে ঢালি।
মলয় ঢলিয়া কুসুমের কোলে
নীরবে লইছে সুরভি ডালি।
যমুনা বহিছে নাচিয়া নাচিয়া,
গাহিয়া গাহিয়া অফুট গান;
থাকিয়া থাকিয়া, বিজনে পাপীয়া
কানন ছাপিয়া তুলিছে তান।
পাতায় পাতায় লুকায়ে কুসুম,
কুসুমে কুসুলে শিশির দুলে,
শিশিরে শিশিরে জোছনা পড়েছে,
মুকুতা গুলিন সাজায়ে ফুলে।

তটের চরণে তটিনী ছুটিছে,
ভ্রমর লুটিছে ফুলের বাস,
সেঁউতি ফুটিছে, বকুল ফুটিছে
ছড়ায়ে ছড়ায়ে সুরভি শ্বাস।
কুহরি উঠিছে কাননে কোকিল,
শিহরি উঠিছে দিকের বালা,
তরল লহরী গাঁথিছে আঁচলে
ভাঙ্গা ভাঙ্গা যত চাঁদের মালা।
ঝোপে ঝোপে ঝোপে লুকায়ে আঁধার
হেথা হোথা চাঁদ মারিছে উঁকি।
সুধীরে আঁধার ঘোমটা হইতে
কুমুমের থোলো হাসে মুচুকি।
এস কল্পনে! এ মধুর রেতে
দুজনে বীণায় পুরিব তান।
সকল ভুলিয়া হৃদয় খুলিয়া
আকাশে তুলিয়া করিব গান।
হাসি কহে বালা “ফুলের জগতে
যাইবে আজিকে কবি?
দেখিবে কত কি অভূত ঘটনা,
কতকি অভূত ছবি!

চারিদিকে ষেথা ফুলে ফুলে আলা
উড়িছে মধুপ-কুল।
ফুল দলে দলে ভ্রমি ফুল-বালা
ফুঁদিয়া ফুটায় ফুল।
দেখিবে কেমনে শিশির সলিলে
মুখ মাজি ফুলবালা
কুসুম রেণুর সিঁদুর পরিয়া
ফুলে ফুলে করে খেলা।
দেহখানি ঢাকি ফুলের বসনে,
প্রজাপতি পরে চড়ি,
কমল-কাননে কুসুম-কামিনী
ধীরে ধীরে যায় উড়ি।
কমলে বসিয়া মুচুকি হাসিয়া
দুলিছে লহরী ভরে,
হাসি মুখখানি দেখিছে নীরবে
সরসী আরসি পরে।
ফুল কোল হতে পাপড়ি খসায়ে
সলিলে ভাসায়ে দিয়া,
চড়ি সে পাতায় ভেসে ভেসে যায়
ভ্রমরে ভাকিয়া নিয়া।

কোলে ক’রে লয়ে ভ্রমরে তখন
গাহিবারে কহে গান।
গান গাওয়া হলে হরষে মোহিনী
ফুল মধু করে দান।
দুই চারি বালা হাত ধরি ধরি
কামিনী পাতায় বসি
চুপি চুপি চুপি ফুলে দেয় দোল
পাপড়ি পড়য়ে খসি।
দুই ফুলবালা মিলিবা কোথায়
গলা ধরাধরি করি
ঘাসে ঘাসে বাসে ছুটিয়া বেড়ায়
প্রজাপতি ধরি ধরি।
কুসুমের পরে দেখিয়া ভ্রমরে
আবরি পাতার দ্বার
ফুল ফাঁদে ফেলি পাখায় মাখায়
কুসুম রেণুর ভার।
ফাঁফরে পড়িয়া ভ্রমর উড়িয়া
বাহির হইতে চায়,
কুসুম রমণী হাসিয়া অমনি
ছুটিয়ে পালিয়ে যায়।

ভাকিয়া আনিয়া সবারে তখনি
প্রমোদে হইয়া ভোর
কহে হাসি হাসি করতালি দিয়া
"কেমন পরাগ চোর!"
এত বলি ধীরে কলপনা রাণী
বীণায় আভানি তান
বাজাইল বীণা আকাশ ভরিয়া
অবশ করিয়া প্রাণ!
গভীর নিশীথে সুদূর আকাশে
মিশিল বীণার রব,
ঘুম ঘোরে আঁখি মুদিয়া রহিল
দিকের বালিকা সব।
ঘুমায়ে পড়িল আকাশ পাতাল,
ঘুযায়ে পড়িল স্বরগ বালা,
দিগন্তের কোলে ঘুমায়ে পড়িল
জোছনা মাখানো জলদ মালা।
একি একি ওগো কলপনা সখি!
কোথায় অ'নিলে মোরে!
ফুলের পৃথিবী—ফুলের জগৎ—
স্বপন কি ঘুম ঘোরে?

হাসি কলপনা কহিল শোভনা
"মোর সাথে এস কবি!
দেখিবে কতকি অভূত ঘটনা
কতকি অভূত ছবি!
ওই দেখ ওই ফুল বালা গুলি
ফুলের সুরভি মাখিয়া গায়
শাদা শাদা ছোট পাখা গুলি তুলি
এফুলে ওফুলে উড়িয়া যায়!
এ ফুলে লুকায় ও ফুলে লুকায়
এ ফুলে ও ফুলে মারিছে উঁকি,
গোলাপের কোলে উঠিয়া দাঁড়ায়
ফুল টলমল পড়িছে ঝুঁকি।
ওই হোথা ওই ফুল-শিশু সাথে
বসি ফুল বালা অশোক ফুলে
দুজনে বিজনে প্রেমের আলাপ
কহে চুপি চুপি হৃদয় খুলে।
কহিল হাসিয়া কলপনা বালা
দেখায়ে কতকি ছবি;
"ফুল বালাদের প্রেমের কাহিনী
শুনিবে এখন কবি?”

এতেক শুনিয়া আমরা দুজনে
বসিনু চাঁপার তলে,
সুমুখে মোদের কমল কানন
নাচে সরসীর জলে।
এ কি কলপনা, একিলো তরুণী
দুরন্ত কুসুম শিশু,
ফুলের মাঝারে লুকায়ে লুকায়ে
হানিছে ফুলের ইষু।
চারিদিক হতে ছুটিয়া আসিয়া
হেরিয়া নূতন প্রাণী
চারিধার ঘিরি রহিল দাঁড়ায়ে
যতেক কুসুম-রাণী!
গোলাপ মালতী, শিউলী সেঁউতি
পারিজাত নরগেশ,
সব ফুলবাস মিলি এক ঠাঁই
ভরিল কানন দেশ।
চুপি চুপি আসি কোন ফুল শিশু
ঘা মারে বীণার পরে,
ঝন্‌ করি যেই বাজি উঠে তার
চমকি পলায় ভরে।

অমনি হাসিয়া কলপনা সখি
বীণাটি লইয়া করে,
ধীরি ধীরি ধীরি মৃদুলমৃদুল
বাজায় মধুর স্বরে।
অবাক্‌ হইয়া ফুলবালাগণ
মোহিত হইয়া তানে
নীরব হইয়া চাহিয়া রহিল
শোভনার মুখ পানে।
ধীরি ধীরি সবে বসিয়া পড়িল
হাত খানি দিয়া গালে,
ফুলে বসি বসি ফুল শিশুগণ
দুলিতেছে তালে তালে।
হেন কালে এক আসিয়া ভ্রমর
কহিল তাদের কানে—
"এখনো রয়েছে বাকী কত কাজ
বসে আছ এই খানে?
রঙ্গ দিতে হবে কুসুমের দলে
ফুটাতে হইবে কঁড়ি
মধুহীন কত গোলাপ কলিকা
রয়েছে কানন জুড়ি!"

অমনি যেনরে চেতন পাইয়া
যতেক কুসুম-বালা,
পাখাটি নাড়িয়া উড়িয়া উড়িয়া
পশিল কুসুম শালা।
মুখ ভারি করি ফুলশিশু দল
তুলিকা লইয়া হাতে,
মাখাইয়া দিল কত কি বরণ
কুসুমের পাতে পাতে।
চারি দিকে দিকে ফুল শিশুদল
ফুলের বালিকা কত
নীরব হইয়া রয়েছে বসিয়া,
সবাই কাজেতে রত।
চারিদিক এবে হইল বিজন,
কানন নীরব ছবি,
ফুলবালাদের প্রেমের কাহিনী
কহে কলপনা দেবী।

আজি পূরণিমা নিশি,
তারকা-কাননে বসি
অলস-নয়নে শশি
মৃদু-হাসি হাসিছে।
পাগল পরাণে ওর
লেগেছে ভাবের ঘোর,
যামিনীর পানে চেয়ে
কি যেন কি ভাষিছে!
কাননে নিঝর ঝরে
মৃদু কল কল স্বরে,
অলি ছুটাছুটি করে
গুন্‌ গুন্‌ গাহিয়া!
সমীর অধীর-প্রাণ
গাহিয়া উঠিছে গান,
তটিনী ধরেছে তান,
ডাকি উঠে পাপিয়া।
সুখের স্বপন মত
পশিছে সে গান যত—
ঘুমঘোরে জ্ঞান-হত
দিক-বধূ-শ্রবণে—

সমীর সভয় হিয়া
মৃদু মৃদু পা টিপিয়া
উঁকি মারি দেখে গিয়া
লতা-বধূ-ভবনে!
কুসুম-উৎসবে আজি
ফুলবালা ফুলে সাজি,
কত না মধুপ রাজি
এক ঠাঁই কাননে!
ফুলের বিছানা পাতি
হরষে প্রমোদে মাতি
কাটাইছে সুখ-রাতি
নৃত্য-গীত-বাদনে!


ফুল-বাস পরিয়া
হাতে হাতে ধরিয়া
নাচি নাচি ঘুরি আসে কুসুমের রমণী,
চুল গুলি এলিয়ে
উড়িতেছে খেলিয়ে,
ফুল-রেণু ঝরি ঝরি পড়িতেছে ধরণী।

ফুল-বাঁশী ধরিয়ে
মৃদু তান ভরিয়ে
বাজাইছে ফুল-শিশু বসি ফুল-আসনে।
ধীরে ধীরে হাসিয়া
নাচি নাচি আসিয়া
তালে তালে করতালি দেয় কেহ সঘনে।
কোনো ফুল রমণী
চুপি চুপি অমনি
ফুল-বালকের কানে কথা যায় বলিয়ে,
কোথাও বা বিজনে
বসি আছে দুজনে,
পৃথিবীর আর সব গেছে যেন ভুলিয়ে!
কোন ফুল বালিকা
গাঁথি ফুল-মালিকা
ফুল-বালকের কথা এক মনে শুনিছে,
বিব্রত শরমে,
হরষিত-মরমে,
আনত আননে বালা ফুল দল গুণিছে!

দেখেছ হোথায় অশোক বালক
মালতীর পাশে গিয়া,
কহিছে কত কি মরম-কাহিনী,
খুলিয়া দিয়াছে হিয়া।
ভ্রুকুটি করিয়া নিদয়া মালতী
যেতেছে সুদূরে চলি,
মৃদু-উপহাসে সরল প্রেমের
কোমল-হৃদয় দলি।
অধীর অশোক যদি বা কখনো
মালতীর কাছে আসে,
ছুটিয়া অমনি পলায় মালতী
বসে বকুলের পাশে।
থাকিয়া থাকিয়া সরোষ ভ্রূকুটি
অশোকের পানে হানে—
ভ্রূকুটি সে-গুলি বাণের মতন
বিঁধিল অশোক-প্রাণে।
হাসিতে হাসিতে কহিল মালতী
বকুলের সাথে কথা,
মলিন অশোক রহিল বসিয়া
হৃদয়ে বহিয়া ব্যথা।

দেখ দেখি চেয়ে মালতী হৃদয়ে
কাহারে সে ভাল বাসে!
বল দেখি মোরে, হৃদয় তাহার
রয়েছে কাহার পাশে?
ওই দেখ তার হৃদয়ের পটে
অশোকেরি নাম লিখা!
অশোকেরি তরে জ্বলিছে তাহার
প্রণয়-অনল-শিখা!
এই যে নিদয় চাতুরী সতত
দলিছে অশোক-প্রাণ—
অশোকের চেয়ে মালতী-হৃদয়ে
বিঁধিছে তাহার বাণ।
মনে মনে করে কত বার বালা,
অশোকের কাছে গিয়া—
কহিবে তাহারে মরম-কাহিনী
হৃদয় খুলিয়া দিয়া।
ক্ষমা চাবে গিয়া পায়ে ধরে তার,
খাইয়া লাজের মাথা—
পরাণ ভরিয়া লইবে কাঁদিয়া,
কহিবে মনের ব্যথা।

তবুও কি যেন আটকে চরণ,
সরমে সরে না বাণী,
বলি বলি করি বলিতে পারেনা
মনো-কথা ফুল-রাণী।
মন চাহে এক ভিতরে ভিতরে—
প্রকাশ পায় যে আর,
সামালিতে গিয়া নারে সামালিতে
এমন জ্বালা সে তার!
মলিন অশোক ম্রিয়মাণ মুখে
একেলা রহিল সেথা,
নয়নের বারি নয়নে নিবারি
হৃদয়ে হৃদয়-ব্যথা।
দেখেনি কিছুই, শোনে নি কিছুই
কে গায় কিসের গান,
রহিয়াছে বসি, বহি আপনার
হৃদয়ে বিঁধানো বাণ।
কিছুই নাহি রে পৃথিবীতে যেন,
সব সে গিয়েছে ভুলি,
নাহি রে আপনি—নাহি রে হৃদয়
রয়েছে ভাবনা-গুলি।

ফুল-বালা এক, দেখিয়া অশোকে
আদরে কহিল তারে,
কেনগো অশোক—মলিন হইয়া
ভাবিছ-বসিয়া কারে?”
এত বলি তার ধরি হাত-খানি
আনিল সভার পরে—
“গাওনা অশোক—গাও” বলি তারে
কত সাধাসাধি করে।
নাচিতে লাগিল ফুল-বালা দল—
ভ্রমর ধরিল তান—
মৃদু মৃদু মৃদু বিষাদের স্বরে
অশোক গাহিল গান।

গান।

গোলাপ ফুল—ফুটিয়ে আছে,
মধুপ হোতা যাস্‌নে—
ফুলের মধু লুটিতে গিয়ে
কাঁটার ঘা খাস্‌নে!
হেথায় বেলা, হোথায় চাঁপা,
শেফালী হোথা ফুটিয়ে—

ওদের কাছে মনের ব্যথা
বল্‌রে মুখ ফুটিয়ে!
ভ্রমর কহে, “হোথায় বেলা
হোথায় আছে নলিনী—
ওদের কাছে বলিব নাকো
আজিও যাহা বলিনি!
মরমে যাহা গোপন আছে
গোলাপে তাহা বলিব,
বলিতে যদি জ্বলিতে হয়
কাঁটারি ঘায়ে জ্বলিব!"

বিষাদের গান কেন গো আজিকে?
আজিকে প্রমোদ-রাতি!
হরষের গান গাওগো অশোক
হরষে প্রমোদে মাতি!
সবাই কহিল, “গাওগো অশোক,
গাওগো প্রমোদ-গান,
নাচিয়া উঠুক কুসুম-কানন
নাচিয়া উঠুক প্রাণ!"

কহিল অশোক “হরষের গান
গাহিতে বোল' না আর—
কেমনে গাহিব? হৃদয় বীণায়
বাজিছে বিষাদ তার।”
এতেক বলিয়া অশোক বালক
বসিল ভূমির পরে—
কে কোথায় সব, গেল সে ভুলিয়া
আপন ভাবনা ভরে!
কিছু দিন আগে—কি ছিল অশোক!
তখন আরেক ধারা,
নাচিয়া ছুটিয়া এখানে সেখানে
বেড়াত অধীর পারা!
নবীন যুবক, শোহন-গঠন,
সবাই বাসিত ভাল—
যেখানে যাইত অশোক যুবক
সেখান করিত আলো!
কিছু দিন হ'তে এ কেমন ভাব—
কোথাও না যায় আর।
একলা-টি থাকে বিরলে বসিয়া
হৃদয়ে পাষাণ ভার!

অরুণ-কিরণ হইতে এখন
বরণ বাহির করি
রাঙায় না আর ললিত বসন
মোহিনী তুলিটি ধরি।
পূরণিমা-রেতে জোছনা হইতে
অমিয় করিয়া চুরি
মধু নিরমিয়া নাহি রাখে আর
কুসুম পাতায় পূরি!

ক্রমশ নিভিল চাঁদের জোছনা,
নিভিল জোনাক পাঁতি—
পূরবের দ্বারে উষা উঁকি মারে,
আলোকে মিশাল রাতি!
প্রভাত-পাখীরা উঠিল গাহিয়া
ফুটিল প্রভাত-কুসুম-কলি—
প্রভাত শিশিরে নাহিবে বলিয়া
চলে ফুল-বালা পথ উজলি'।
তার পর-দিন রটিল প্রবাদ
অশোক নাইক ঘরে

কোথায় অবোধ কুসুম-বালক
গিয়েছে বিষাদ-ভরে!
কুসুমে কুসুমে পাতায় পাতায়
খুঁজিয়া বেড়ায় সকলে মিলি—
কি হবে—কোথাও নাহিক অশোক
কোথায় বালক গেল রে চলি!

কহে কলপনা, “খুঁজি চল গিয়া
অশোক গিয়াছে কোথা—
সুমুখে শোভিছে কুসুম-কানন
দেখ দেখি কবি হোথা!
ঘার উঁচু করি হোথা গরবিনী
ফুটেছে ম্যাগনোলিয়া—
কাননের যেন চখের সামনে
রূপরাশি খুলি দিয়া!
সাধাসাধি করে কত শত ফুল
চারি দিকে হেথা হোথা—
মুচকিয়া হাসে গরবের হাসি
ফিরিয়া না কয় কথা!

হ্যাদে দেখ কবি সরসী ভিতরে
কমল কেমন ফুটেছে!
এপাশে ওপাশে পড়িছে হেলিয়া—
প্রভাত সমীর উঠেছে!
ঘোমটা ভিতরে লোহিত অধরে
বিমল কোমল হাসি
সরসী-আলয় মধুর করেছে
সৌরভ রাশি রাশি!
নিরমল জলে নিরমল রূপে
পৃথিবী করিছে আলো
পৃথিবীর প্রেমে তবু নাহি মন,
রবিরেই বাসে ভাল!
কানন বিপিনে কত ফুল ফুটে
কিছুই বালা না জানে,
হৃদয়ের কথা কহে সুবদনী,
সখীদের কাণে কাণে।
হোথায় দেখেছ লজ্জাবতী লতা
লুটায়ে ধরণী পরে,
ঘাড় হেঁট করি কেমন রয়্যেছে
মরম-সরম-ভরে।

দূর হতে তার দেখিয়া আকার
মির যদিবা আসে
সরমে সভয়ে মলিন হইয়া
সোরে যায় এক পাশে!
গুণ গুণ করি যদিবা ভ্রমর
শুধায় প্রেমের কথা—
কাঁপে থর থর, না দেয় উতর,
হেঁট করি থাকে মাথা!
ওই দেখ হোথা রজনীগন্ধা
বিকাশে বিশদ বিভা,
মধুপে ডাকিয়া দিতেছে হাঁকিয়া
ঘাড় নাড়ি নাড়ি কিবা!

চমকিয়া কহে কল্পনা বালা,—
দেখিয়া কানন ছবি
ভুলিয়ে গেলাম যে কাজে আমরা
এসেছি এখানে কবি!
ওই যে মালতী বিরলে বসিয়া
সুবাস দিয়াছে এলি,'

মাথার উপরে আটকে তপন
প্রজাপতি পাখা মেলি!
এস দেখি কবি ওই খানটিতে
দাঁড়াই গাছের তলে,
শুনি চুপি চুপি, মালতী-বালারে
ভ্রমর কি কথা বলে!
কহিছে ভ্রমর “কুসুম-কুমারি—
বকুল পাঠালে মোরে,
তাই ত্বরা ক’রে এসেছি হেথায়
বারতা শুনাতে তোরে!
অশোক বালক কিযে হ'য়ে গেছে
সে কথা বলিব কারে!
তোর মত হেন মোহিনী বালারে
ভুলিতে কি কভু পারে?
তবু তারে আহা উপেখিয়া তুই
র’বি কি হেথায় বোন?
পরাণ সঁপিয়া অশোক তবুকি
পাবে নাকো তোর মন?
মনের হুতাশে আশারে পুড়ায়ে
উদাস হইয়া গেছে,

কাননে কাননে খুঁজিয়া বেড়াই
কে জানে কোথায় আছে!
চমকি উঠিল মালতী-বালিকা
ঘুম হ’তে যেন জাগি,
অবাক্‌ হইয়া রহিল বসিয়া
কি জানি কিসের লাগি!
“চলিয়া গিয়াছে অশোক কুমার?”
কহিল ক্ষণেক পর,
“চলিয়া গিয়াছে অশোক আমার
ছাড়িয়া আপন ঘর?
তবে আর আমি—বিষাদ কাননে
থাকিব কিসের আশে?
যাইব অশোক গিয়েছে যেখানে
যাইব তাহার পাশে!
বনে বনে ফিরি বেড়াব খুঁজিয়া
শুধাব' লতার কাছে,
খুঁজিব কুসুমে খুঁজিব পাতায়
অশোক কোথায় আছে!
খুঁজিয়া খুঁজিয়া অশোকে আমার
যায় যদি যাবে প্রাণ—

আমা হ’তে তবু হবে না কখনো
প্রণয়ের অপমান!”

ছাড়ি নিজ বন চলিল মালতী,
চলিল আপন মনে,
অশোক বালকে খুঁজিবার তরে
ফিরে কত বনে বনে।
"অশোক” “অশোক” ডাকিয়া ডাকিয়া
লতায় পাতায় ফিরে,
ভ্রমরে শুধায়, ফুলেরে শুধায়
"অশোক এখানে কি রে?”
হোথায় নাচিছে অমল সরসী
চল দেখি হোথা কবি—
নিরমল জলে নাচিছে কমল
মুখ দেখিতেছে রবি!
রাজহাঁস দেখ সাঁতারিছে জলে
শাদা শাদা পাখা তুলি,
পিঠের উপরে পাখার উপরে
বসি ফুল-বালা গুলি!

এখানেও নাই, চল যাই তবে—
ওই নিঝরের ধারে,
মাধবী ফুটেছে, শুধাই উহারে
বলিতে যদি সে পারে।
বেগে উথলিয়া পড়িছে নিঝর—
ফেন গুলি ধরি ধরি
ফুল শিশুগণ করিতেছে খেলা
রাশ রাশ করি করি!
আপনার ছায়া ধরিবারে গিয়া
না পেয়ে হাসিয়া উঠে—
হাসিয়া হাসিয়া হেথায় হোথায়
নাচিয়া খেলিয়া ছুটে!
ওগো ফুলশিশু! খেলিছ হোথায়
শুধাই তোমার কাছে,
অশোক বালকে দেখেছ কোথাও,
অশোক হেথা কি আছে?
এখানেও নাই, এস তবে, কবি,
কুসুমে খুঁজিয়া দেখি—
ওই যে ওখানে গোলাপ ফুটিয়া
হোথায় রয়েছে—এ কি?

এ কি গো ঘুমায়—হেথায়—হেথায়—
মুদিয়া দুইটি আঁখি,
গোলাপের কোলে মাথাটি সঁপিয়া
পাতায় দেহটি রাখি!
এই আমাদের অশোক বালক
ঘুমায়ে রয়েছে হেথা!
দুখিনী ব্যাকুলা মালতী-বালিকা
খুঁজিয়া বেড়ায় কোথা?
চল চল কবি চল দুই জনে
মালতীরে ডেকে আনি,
হরষে এখনি উঠিবে নাচিয়া
কাতরা কুসুম রাণী!

* * *

কোথাও তাহারে পেনুনা খুঁজিয়া
এখন কি করি তবে?
অশোক বালক না যায় কোথাও,
বুঝায়ে রাখিতে হবে!
গোলাপ-শয়নে ঘুমায় অশোক
দুখ তাপ সব ভুলি,

চল দেখি সেথা কহিব আমরা
সব কথা তারে খুলি!
দেখ দেখ কবি—অশোক-শিয়রে
ওই না মালতী হোথা?
গোলাপ হইতে লয়েছে তুলিয়া
কোলে অশোকের মাথা।
কতযে বেড়ানু খুঁজিয়া খুঁজিয়া
কাননে কাননে পশি!
কখন্‌ হেথায় এসেছে বালিকা?
রয়েছে হোথায় বসি!
ঘুমায়ে রয়েছে অশোক বালক
শ্রমেতে কাতর হয়ে,
মুখের পানেতে চাহিয়া মালতী
কোলেতে মাথাটি লয়ে!
ঘুমায়ে ঘুমায়ে অশোক বালক
সুখের স্বপন হেরে,
গাছের পাতাটি লইয়া মালতী
বীজন করিছে তারে।
নত করি মুখ দেখিছে বালিকা
দুখানি নয়ন ভরি,

নয়ন হইতে শিশিরের মত
সলিল পড়িছে ঝরি!
ঘুমায়ে ঘুমায়ে অশোকের যেন
অধর উঠিল কাঁপি!
"মালতী” “মালতী” বলিয়া বালার
হাত-টি ধরিল চাপি!
হরষে ভাসিয়া কহিল মালতী
হেঁট করি আহা মাথা—
"অশোক—অশোক—মালতী তোমার
এই যে রয়েছে হেথা!"
ঘুমের ঘোরেতে পশিল শ্রবণে
"এইযে রয়েছে হেথা!"
নয়নের জলে ভিজায়ে পলক
অশোক তুলিল মাথা!
একিরে স্বপন? এখনো একিরে
স্বপন দেখিছে নাকি?
আবার চাহিল অশোক বালক,
আবার মাজিল আঁখি!
অবাক্‌ হইয়া রহিল বসিয়া
বচন নাহিক সরে—

থাকিয়া থাকিয়া পাগলের মত
কহিল অধীর স্বরে!
"মালতী—মালতী—আমার মালতী!"
মালতী কহিল কাঁদি
"তোমারি মালতী! তোমারি মালতী!"
অশোকের হৃদয়ে বাঁধি!—
"ক্ষমা কর মোরে অশোক আমার—
কত না দিয়েছি জ্বালা—
ভাল বাসি বোলে ক্ষমা কর মোরে
আমি যে অবোধ বালা!
তোমার হৃদয় ছাড়িয়া কখন
আর না যাইব চলি,—
দিবস রজনী রহিব হেথায়
বিষাদ ভাবনা ভুলি!
ও হৃদয় ছাড়ি মালতীর আর
কোথায় আরাম আছে?
তোমারে ছাড়িয়া দুখিনী মালতী
যাবে আর কার কাছে?”
অশোকের হাতে দিয়া দুটি হাত
কত যে কাঁদিল বালা!

কাঁদিছে দুজনে বসিয়া বিজনে
ভুলিয়া সকল জ্বালা!
উড়িল দুজনে পাশাপাশি হয়ে
হাত ধরাধরি করি—
সাজিল তখন পৃথিবী জগৎ
হাসিতে আনন ভরি!
গাহিয়া উঠিল হরষে ভ্রমর,
নিঝর বহিল হাসি—
দুলিয়া দুলিয়া নাচিল কুসুম
ঢালিয়া সুরভি-রাশি!
ফিরিল আবার অশোকের ভাব
প্রমোদে পূরিল প্রাণ—
এখানে সেখানে বেড়ায় খেলিয়া
হরষে গাহিয়া গান।
অশোক মালতী মিলিয়া দুজনে
জোনাকের আলো জ্বালি
একই কুসুমে মাখায় বরণ,
মধু দেয় ঢালি ঢালি!

বরষের পরে এল হরষের যামিনী
আবার মিলিল যত কুসুমের কামিনী!
জোছনা পড়িছে ঝরি সুমুখের সরসে—
টলমল ফুল দলে,
ধরি ধরি গলে গলে,
নাচে ফুল বালা দলে,
মালা দুলে উরসে—
তখন সুখের তানে মরমের হরষে
অশোক মনের সাধে গীত ধারা বরষে।

গান।

দেখে যা—দেখে যা—দেখেযালো তোরা
সাধের কাননে মোর
(আমার) সাধের কুসুম উঠেছে ফুটিয়া,
মলয় বহিছে সুরভি লটিয়া রে—
(হেথা) জ্যোছনা ফুটে
তটিনী ছুটে
প্রমোদে কানন ভোর।

আয় আয় সখি আয় লো হেথা
দুজনে কহিব মনের কথা,
তুলিব কুসুম দুজনে মিলি রে—
(সুখে) গাঁথিব মালা,
গণিব তারা,
করিব রজনী ভোর!
এ কাননে বসি গাহিব গান
সুখের স্বপনে কাটাব প্রাণ,
খেলিব দুজনে মনেরি খেলা রে
(প্রাণে) রহিবে মিশি
দিবস নিশি
আধো আধো ঘুম-ঘোর!