ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/২৫
২৫
লক্ষীপুর মৌজার দায়িত্ব নিয়ে বিপিনচন্দ্র অনেকগুলো জনহিতকর কাজের উদ্যোগ নিয়ে মণিপুরি, ডিমাসা এবং বাঙালিদের মধ্যে জনপ্রয়তা অর্জন করেছেন। অনুজ যতিকে সঙ্গে না পেলেও সে যে নিজস্ব মতে চলে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এতে তিনি তৃপ্ত। তাঁর রায়বাহাদুর খেতাব প্রাপ্তিতে যতি খুশি হয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করে গেছে। তবে এ খেতাব প্রাপ্তির পর আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ অভিনন্দন জানানোর অজুহাতে তাঁর কাছারিতে এসে ভিড় জমাচ্ছেন। শিলচর শহরে কয়েকটি ছাপাখানা হয়েছে, আর এখান থেকে ছাপিয়ে গদ্যে পদ্যে অভিনন্দন পত্রও নিয়ে আসছেন অনেকে। তিনি তো জানেন, এসবের পেছনে একটা উদ্দেশ্য আছে। তবে হেড়ম্ব রাজসভার মন্ত্রিত্ব গেলেও ব্রিটিশরাজ প্রদত্ত এ পদ যদি তাঁকে প্রজাদের কোন মঙ্গল করতে সহায়তা করে তবেই তিনি তৃপ্ত। অবশ্য স্বদেশিরা যদি সাহেবদের দেশ থেকে বিতাড়ন করে, বা আদৌ যদি এরা সফল হয় তবে পরিস্থিতি কী হবে কে জানে। কিন্তু এ মুহূর্তে রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, পুলিশ প্রতিরক্ষা এবং কৃষির উন্নতিকল্পে কিছু কাজ করিয়ে নেওয়া যে আশু প্রয়োজন নিজ গ্রামে স্থাপিত রাজা স্কুলের আরও কিছু কাজ করা প্রয়োজন, ‘শিক্ষাভাণ্ডার’টিও সমৃদ্ধ করা দরকার। মাথার মধ্যে আরও কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠার চিন্তাও রয়েছে। লক্ষীপুর মৌজায় অন্তত একটি পাঠশালা আর একটি এম-ই স্কুল স্থাপনের যে খুব প্রয়োজন। দ্বিতীয়বার চিফ কমিশনারের দায়িত্ব নেওয়ার পর মহামান্য আর্চডেইল আর্ল সাহেবকে অভিনন্দনসূচক পত্রে এ প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে রাখলেন। সাহেবও ধন্যবাদ জানিয়ে বিপিনচন্দ্রের জনকল্যাণমূলক কাজের পরিকল্পনায় যথেষ্ট উৎসাহ দেখালেন।
সাহেবের আমন্ত্রণ পেয়ে একটি সৌজন্যমূলক সাক্ষাতের জন্য বিপিনচন্দ্র কয়েকদিনের জন্য শিলং শৈল রাজধানী নগরীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সিলেট থেকে ছাতক হয়ে মানুষের কাঁধে চড়ে একটা সহজ রাস্তা আছে। কিন্তু মানুষের কাঁধে চড়ে? না বাবা। তবে আয়োজনটি সুন্দর। একটি হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার বিশেষ, নাম থাবা। খাসিয়া পালোয়ান এ থাবাটি নিজ স্কন্ধে স্থাপন করলে আলাদা একটি সিঁড়ি বা আর কিছুর সাহায্যে যাত্রী এতে চড়ে বসেন। বাহকের কাঁধের দুই দিকে ভার সমান ভাবে বণ্টন হয়ে গেলে মাথার উপর কোনও চাপ থাকে না। তবুও বিপিনচন্দ্র পায়ে হেঁটেই পাহাড়ি পথটুকু পেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্তে অটল। তিনি খবর পেয়েছেন গৌহাটি হয়ে শিলং যাওয়ার রাস্তাও যথেষ্ট ভালো হয়েছে। দু-একটা মোটর গাড়ি চলে আজকাল। সাহেবসুবারা এসব চড়ে আসা যাওয়া করছেন। গৌহাটির প্রতিষ্ঠিত বাঙালি ব্যবসায়ী-ঠিকাদার, মুর্শিদাবাদি শেখসাহেব নাকি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যাবার জন্য ঐ রাস্তাটিকে আরও একটু মেরামত করে দিয়েছেন।
বিপিনচন্দ্র আশাবাদী আর্চডেইল সাহেবের সঙ্গে তাঁর এবারকার সাক্ষাৎকার ফলপ্রসূ হবেই। বছর ছয়েক আগে অস্থায়ী ভাবে চিফ কমিশনার বা লাটসাহেবের দায়িত্বে থাকাকালীন আর্লসাহেব সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ পরিদর্শন শেষ করে কাছাড় পরিভ্রমণে এলে শিলচর মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান কামিনীকুমার চন্দ, ক্রীড়াবিদ নলিনীমোহন গুপ্ত এবং লোক্যাল বোর্ডের সদস্য বিপিনচন্দ্রও তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন। এবার বিপিনচন্দ্র লাটসাহেবকে পুনরায় কাছাড় পরিদর্শনের সনির্বন্ধ আমন্ত্রণ জানিয়ে এলেন।
লাটসাহেব অবশ্য কথা রেখেছেন। তাঁর কার্যকাল শেষ হবার আগে শুধু কাছাড় পরিক্রমণই নয়, একেবারে লক্ষীপুর পর্যন্ত ভ্রমণসূচিকে সম্প্রসারিত করেন, যার ফলস্বরূপ লক্ষীপুরবাসী পেলেন জমি, বাড়ি এবং নগদ অর্থ সহ একটি স্কুল, নাম আর্ল এম-ই স্কুল। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্ত সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত আলোকবৃত্ত থেকে আনেক দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত অঞ্চলটিতে শিক্ষার একটি প্রদীপ তো জ্বলে উঠল এ বিদেশি প্রশাসকের আনুকূল্যে, পেছনে রয়েছেন দেশীয় মৌজাদার, রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্র, যাঁর বাড়ি এখান থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল পশ্চিমে জাটিঙ্গা নদীর তীরে।