বিষয়বস্তুতে চলুন

ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/৩১

উইকিসংকলন থেকে

৩১

শিলং গৌহাটি হয়ে বাড়ি আসা অবধি রায়বাহাদুরের শরীর আর জায়গায় আসছে না। বিছানায় শুতে গেলেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। সারাটা দিন, সারাটা রাত ইজিচেয়ারে বসতে বসতে কোমর অবশ হবার জোগাড়।

শহরের ডাক্তার এসে দু’দিন দেখে গেছেন। কিছু ঔষধ কলিকাতা থেকে আনাতে হবে। দেখা যাক কবিরাজরা কী বলেন। যে ব্যক্তি একটা দিনও ঘরে অলস বসে থাকার নন তিনি যদি সারাটা মাস দরজা বন্ধ করে চোখ বুজে বসে কাতরাতে থাকেন তবে গ্রাম শহর সর্বত্র কানাঘুষো হবেই। এরই মাঝে একদিন কালাইনের অভয়চরণ দেশমুখ্য কর্তা দেখতে এলেন। তিনি সচরাচর কোথাও যান না। গম্ভীর হয়ে অনেকক্ষণ বসে বলে গেলেন ন্যায়পঞ্চানন কবিরাজ মশাইকে আজই খবর দেওয়া হোক। শহর থেকে যোগেন্দ্র উকিল এসেছিলেন কাছারিতে কয়েকটি নালিশের প্রসঙ্গে আলোচনা করতে। রায়বাহাদুর রইলেন নির্বাক। নায়েব নবকিশোর সেন ভয়ে কাছে আসতেই পারছেন না। অনেকগুলো দলিল এবং মোক্তারনামায় দস্তখত করার ব্যাপার ছিল। কিন্তু কে যাবে সামনে? প্রভুভক্ত মোবেশ্বর আলি বারান্দার নীচে সর্বক্ষণ একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে হুকুমের অপেক্ষায়। কিন্তু ওদিক থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। গত তিরিশ বছর এ বাড়িকে এত নিরাই ঝিম্বরা অবস্থায় সে দেখেনি। গাছের পাখি, বাথানের গরু মহিষ, এমনকি গাছের পাতারাও বুঝি জেনে গেছে এ বাড়ির নীরবতা এখন ভাঙার সময় না।

 বারান্দায় দাঁড়ানো মোবেশ্বরের চোখে একবার চোখ পড়ে যাওয়াতে ওইদিক থেকে ইশারা। চৌকাঠের সামনে দাঁড়িয়ে ‘জি বাবু’ উচ্চারণ করতেই রায়বাহাদুর অনেক কষ্টে বললেন, ‘যতি’। মোবেশ্বর আলির মাথায় বাজ পড়ল। এই সময় এই বাবুর নাগাল পাওয়া কি কম মেহনতের কাম? কোথায় গিয়ে ধরবে এই বাবুকে? বুড়াবাবুর শ্রাদ্ধশান্তি শেষ হইলে পর তো এক্ষেণে এই বাবু লাগামছাড়া ঘোড়া। কোন সময় কোন বিদেশি মানুষ আইয়া ধরিয়া কই যে লইয়া যায় কে জানে। ঘরর এইনর কুনও নিষেদ বুদ অয় বিলকুল মানইন না। আইজ কাটিগড়া, কাইল তাপাং, এর বাদে বিন্নাকান্দি, উধারবন্দ, সাবাজপুর, বাঁশকান্দি—এই তো চক্কর। পাগলের মতো মোবেশ্বর আলি ঘর থেকে বেরোলো। তাঁকে আজ যে করেই হোক যতিবাবুর কাছে পৌঁছাতেই হবে। হাজির করাতে হবে রায়বাহাদুরের সামনে। আইজ বড়ো মুসিবত এই পরিবারর উপরে।

 কনিষ্ঠ ভ্রাতার কানে সবই গেছে, কিন্তু তলে তলে জল যে এত দূর গড়িয়েছে তা বিশ্বাস হচ্ছে না।

 ভগ্নীপতি যোগেন্দ্র কর, পুরোহিত চক্রবর্তী মশাই, পুবের বাড়ির নায়েব গগন মজুমদার, লক্ষীপুর মৌজার সেরেস্তাদার, সারদা ফরেস্টার আর বাজারের মহাজনগোষ্ঠীর অনেকেই আজ রায়বাহাদুরকে দেখতে এসেছেন। যতিবাবু ঘরে ঢুকতেই ভিড় একটু হালকা হল। যোগেন্দ্র কর সামনে ঝুঁকে বললেন,

 —যতিকে কিছু বলবেন? আমরা বাইরে যাই।

 রায়বাহাদুর খুব মৃদু স্বরে দু’বার ‘যতি’, ‘যতি’ বলে ডাকলেন। সামনের চেয়ারটা একেবারে কাছে টেনে কনিষ্ঠ ভ্রাতা ঝুঁকে পড়লেন। রায়বাহাদুরের এত কাছে কোন দিন তাঁর বসা হয়নি। কয়েকটি ছেঁড়া ছেঁড়া বাক্য উচ্চারিত হল,

 —তোমার উপর অনেক বোঝা...। পরিবার, গ্রাম, প্রজা ছাড়াও আরও অ-নে-ক কিছু। সামলাতে হবে। অনেক দিক... ওইদিকের।

 অনেক কষ্টে কথাগুলো বলে হাঁফাতে লাগলেন। বিচক্ষণ ভ্রাতার বুঝতে অসুবিধা হল না, ওইদিকের মানে সিলেট-শিলঙের সব কানাঘুষো তাঁরও কানে এসেছে।

 তিনি কী আর বলবেন?

 —আগে আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন দেখি, তখন সব কথা হবে। আমি আর বসলে আপনার বিশ্রামের ব্যাঘাত হবে।

 কিন্তু রায়বাহাদুরের যেন আরও কিছু বলার আছে। হঠাৎ যেন তাঁর প্রচণ্ড ক্রোধ হল। বেশ উষ্মার সঙ্গে নিমাতার সেবা, মন্দির, নিমাতার সম্পত্তির কথা প্রসঙ্গে বললেন,

 —জাগ্রত দেবী মা নিমাতা। পরিবারের উপর বিপর্যয় আসবে যদি... এ পর্যন্ত বলে হাঁফাতে লাগলেন।

 যতীন্দ্রমোহনকে কেউ কোনওদিন বিচলিত হতে দেখেনি। কিন্তু বিচলিত হবারই কথা এগুলো। মৃত্যুপথ যাত্রী ব্যক্তিটির আশঙ্কার জায়গাটি কোথায়? নিমাতার সম্পদ কি কোথাও অরক্ষিত রয়েছে? তিনি তো এদিকে দৃষ্টিপাতই করেননি কোনওদিন। এখন মনে হচ্ছে কোথাও একটা বড়ো রকমের গণ্ডগোল রয়ে গেছে।

 রায়বাহাদুরকে আশ্বস্ত করে তিনি বললেন,

 —আপনি এ সব নিয়ে অযথা চিন্তা করবেন না। কেউ কিছু নষ্ট করতে পারবে না। আপনি আজ অনেকক্ষণ কথা বলেছেন। আমরা বসলে আরও বলবেন। আমি বরং রোজ একবার এসে আপনাকে দেখে যাব, আপনার সব কথা শুনব।

 রায়বাহাদুর হাতের ইশারায় নবকিশোর সেন মশাইকে ডাকলেন। কাঠের আলমারির দিকে আঙুল দেখাতেই তিনি ভেতর থেকে বের করলেন কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট। শয্যাশায়ী বিপিনচন্দ্র মোড়কটি খুলে প্রিয় ভ্রাতার হাতে তুলে দিলেন একটি বই। যতীন্দ্রমোহন পাতা উলটে দেখেন ইংরেজিতে লেখা To Babu Jatindra Mohan। নীচে ইংরেজিতে একটা সই। অগ্রজর হাত থেকে এটাই তাঁর প্রথম উপহার। যতীন্দ্রমোহনের চক্ষু ঝাপসা হয়ে গেল। বই বন্ধ করতেই আখ্যাপত্র স্পষ্ট হল, ‘হেড়ম্ব রাজ্যের দণ্ডবিধি’।

 উঠে প্রণাম করে বিদায় নিয়ে বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই ডাকপিয়ন হাতে তুলে দিল একখানা চিঠি। বন্ধখাম ছিঁড়ে বের করতেই দেখা গেল স্বরাজ্য দলের সভাপতি শ্রী তরুণরাম ফুকন মহাশয়ের অভিনন্দন। যতীন্দ্রমোহনকে এবার নির্বাচনী ঝামেলায় যেতে হচ্ছে না। তৃতীয় আইন পরিষদে শিলচর নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে স্বরাজ্য দলের পক্ষে তাঁর প্রার্থিত্বে এবার কোনল প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। অতএব...। মনে হল এক্ষুনি ছুটে যান পশ্চিমের বাড়িতে। কিন্তু না, এখনও তো সরকারি ঘোষণার বাকি। এটা তো প্রাথমিক খবর।

 ধীরে সুস্থে চান খাওয়া সেরে নিজের ঘরে ঢুকে সুরুচি দেবীর সামনে চিঠিটা খুলে ধরে বললেন,

 —পড়ো।

 —আমার সঙ্গে তামাশা করছ? আমি ইংরেজি পড়তে পারি নাকি?

 —কেন? সেদিন যে খুব লিখেছিলে, ‘ইংরেজি বাহিরনামা আমি নিজে লিখেছি’।

 —ওঃ ওই পর্যন্তই। এর বেশি আর পারছি কই? পারছি কই? তোমার তো সময়ই হয় না।

 —এসব বললে চলবে না, এখন তোমাকে ইংরেজি শিখতে হবে। আমি শিলঙে আইন পরিষদে সদস্য হতে চলেছি।

 —কী বলছ? পড়ে বোঝাও। তবে আগে বলো ওবাড়ির ভাসুর ঠাকুরকে কেমন দেখলে?

 কথাটি আর শেষ হল না। বাইরের থেকে মোবেশ্বর আলির ‘বাবু, বাবু’ দুইটি ডাকেই সারা বাড়ি যা বোঝার বুঝে নিল। নিমেষের মধ্যে সারা গ্রাম উত্তাল হয়ে উঠল, রায়বাহাদুর আর নেই। মানুষজনের হাঁক ডাক, গাড়িঘোড়ার শব্দ, শোকার্তদের মিছিল। সাত গ্রাম পেরিয়ে, শহর বস্তি পেরিয়ে হিন্দু মুসলিম, ধনী গরিব সবার গতি আজ একই দিকে। রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্রকে শেষ দেখা দেখতে চায় সবাই।