সংকলন/পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি

উইকিসংকলন থেকে

পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি

হারুনা-মারু জাহাজ

 ৩ অক্টোবর, ১৯২৪। এখনো সূর্য ওঠে নি। আলোকের অবতরণিকা পূর্ব-আকাশে। জল স্থির হয়ে আছে সিংহবাহিনীর পায়ের তলাকার সিংহের মতো। সূর্যোদয়ের এই আগমনীর মধ্যে মজে গিয়ে আমার মুখে হঠাৎ ছন্দে-গাঁথা এই কথাটা আপনিই ভেসে উঠল—

হে ধরণী, কেন প্রতিদিন
তৃপ্তিহীন
একই লিপি পড় বারে বারে।

 বুঝতে পারলুম, আমার কোনো একটি আগন্তুক কবিতা মনের মধ্যে এসে পৌঁছবার আগেই তার ধুয়োটা এসে পৌঁচেছে। এই রকমের ধুয়ো অনেক সময়ে উড়ো বীজের মতো মনে এসে পড়ে, কিন্তু সব সময়ে তাকে এমন স্পষ্ট ক’রে দেখতে পাওয়া যায় না।

 সমুদ্রের দূর তীরে যে-ধরা আপনার নানারঙা আঁচলখানি বিছিয়ে দিয়ে পুবের দিকে মুখ ক’রে একলা বসে আছে, ছবির মতো দেখতে পেলুম, তার কোলের উপর একখানি চিঠি পড়ল খসে, কোন্ উপরের থেকে। সেই চিঠিখানি বুকের কাছে তুলে ধরে সে একমনে পড়তে বসে গেল; তাল-তমালের নিবিড় বনচ্ছায়া পিছনে রইল এলিয়ে, শুয়ে-পড়া মাথার থেকে ছড়িয়ে-পড়া এলোচুল।

 আমার কবিতার ধুয়ো বলছে, প্রতিদিন সেই একই চিঠি। সেই একখানির বেশি আর দরকার নেই; সেই ওর যথেষ্ট। সে এত বড়ো, তাই সে এত সরল। সেই একখানিতেই সব আকাশ এমন সহজে ভরে গেছে।

 ধরণী পাঠ করছে কত যুগ থেকে। সেই পাঠ করাটা আমি মনেমনে চেয়ে দেখছি। সুরলোকের বাণী পৃথিবীর বুকের ভিতর দিয়ে, কণ্ঠের ভিতর দিয়ে, রূপে রূপে বিচিত্র হয়ে উঠল। বনে বনে হল গাছ, ফুলে ফুলে হল গন্ধ, প্রাণে প্রাণে হল নিশ্বসিত। একটি চিঠির সেই একটিমাত্র কথা— সেই আলো। সেই সুন্দর, সেই ভীষণ; সেই হাসির ঝিলিকে ঝিকিমিকি, সেই কান্নার কাঁপনে ছলছল।

 এই চিঠি পড়াটাই সৃষ্টির স্রোত— যে দিচ্ছে আর যে পাচ্ছে, সেই দুজনের কথা এতে মিলেছে, সেই মিলনেই রূপের ঢেউ। সেই মিলনের জায়গাটা হচ্ছে বিচ্ছেদ। কেননা দূর-নিকটের ভেদ না ঘটলে স্রোত বয় না, চিঠি চলে না। সৃষ্টি-উৎসের মুখে কী-একটা কাণ্ড আছে, সে এক ধারাকে দুই ধারায় ভাগ করে। বীজ ছিল নিতান্ত এক, তাকে দ্বিধা ক’রে দিয়ে দুখানি কচি পাতা বেরোল, তখনি সেই বীজ পেল তার বাণী। নইলে সে বোবা, নইলে সে কৃপণ, আপন ঐশ্বর্য আপনি ভোগ করতে জানে না। জীব ছিল একা, বিদীর্ণ হয়ে স্ত্রী-পুরুষে সে দুই হয়ে গেল। তখনি তার সেই বিভাগেব ফাঁকের মধ্যে বসল তার ডাক-বিভাগ। ডাকের পর ডাক, তার অন্ত নেই। বিচ্ছেদের এই ফাঁক একটা বড়ো সম্পদ; এ নইলে সব চুপ, সব বন্ধ। এই ফাঁকটার বুকের ভিতর দিয়ে একটা অপেক্ষার ব্যথা, একটা আকাঙ্ক্ষার টান টন্‌টন্‌ করে উঠল; দিতে-চাওয়াব আর পেতে-চাওয়ার উত্তর-প্রত্যুত্তর এপারে ওপারে চালাচালি হতে লাগল। এতেই হলে উঠল সৃষ্টিতরঙ্গ; বিচলিত হল ঋতুপর্যায়— কখনো-বা গ্রীষ্মের তপস্যা, কখনো বর্ষার প্লাবন, কখনো-বা শীতের সংকোচ, কখনো-বা বসন্তের দাক্ষিণ্য।

 একে যদি মায়া বল তো দোষ নেই, কেননা এই চিঠিলিখনের অক্ষরে আবছায়া, ভাষায় ইশারা; এর আবির্ভাব তিরোভাবের পুরো মানে সব সময়ে বোঝা যায় না। যাকে চোখে দেখা যায় না সেই উত্তাপ কখন্ আকাশপথ থেকে মাটির আড়ালে চলে যায়; মনে ভাবি, একেবারেই গেল বুঝি। কিছু কাল যায়, একদিন দেখি, মাটির পর্দা ফাঁক করে দিয়ে একটি অঙ্কুর উপরের দিকে কোন্-এক আর-জন্মের চেনা-মুখ খুঁজছে। যে-উত্তাপটা ফেরার হয়েছে ব’লে সেদিন রব উঠল সেই তো মাটির তলার অন্ধকারে সেঁধিয়ে কোন্ ঘুমিয়েপড়া বীজের দরজায় বসে বসে ঘা দিচ্ছিল। এমনি ক’রেই কত অদৃশ্য ইশারার উত্তাপ এক হৃদয়ের থেকে আর এক হৃদয়ের ফাঁকে ফাঁকে কোন্ চোরকোঠায় গিয়ে ঢোকে, সেখানে কার সঙ্গে কী কানাকানি করে জানি নে, তার পরে কিছুদিন বাদে একটি নবীন বাণী পর্দার বাইরে এসে বলে “এসেছি”।

 আমার সহযাত্রী বন্ধু আমার ডায়ারি পড়ে বললেন, “তুমি ধরণীর চিঠি-পড়ায় আর মানুষের চিঠি-পড়ায় মিশিয়ে দিয়ে একটা যেন কী গোল পাকিয়েছ। কালিদাসের মেঘদূতে বিরহী-বিরহিণীর বেদনাটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তোমার এই লেখায় কোন্‌খানে রূপক, কোন্‌খানে সাদা কথা, বোঝা শক্ত হয়ে উঠেছে।”

 আমি বললুম, কালিদাস যে মেঘদূত কাব্য লিখেছেন সেটাও বিশ্বের কথা। নইলে তার এক প্রান্তে নির্বাসিত যক্ষ রামগিরিতে, আর-এক প্রান্তে বিরহিণী কেন অলকাপুরীতে। স্বর্গমর্তের এই বিরহই তো সকল সৃষ্টিতে। এই মন্দাক্রান্তাছন্দেই তো বিশ্বের গান বেজে উঠছে। বিচ্ছেদের ফাঁকের ভিতর দিয়ে অণুপরমাণু নিত্যই যে অদৃশ্য চিঠি চালাচালি করে, সেই চিঠিই সৃষ্টির বাণী। স্ত্রীপুরুষের মাঝখানেও, চোখে চোখেই হোক, কানে কানেই হোক, মনে মনেই হোক, আর কাগজে পত্রেই হোক, যে চিঠি চলে সেও ওই বিশ্বচিঠিরই একটি বিশেষ রূপ।

লিপি

হে ধরণী, কেন প্রতিদিন
তৃপ্তিহীন
একই লিপি পড় ফিরে ফিরে।
প্রত্যুষে গোপনে ধীরে ধীরে
আঁধারের খুলিয়া পেটিকা,
স্বর্ণবর্ণে-লিখা
প্রভাতের মর্মবাণী
বক্ষে টেনে আনি
গুঞ্জরিয়া কত ঘুরে আবৃত্তি কর যে মুগ্ধ মনে।

বহু যুগ হয়ে গেল কোন্ শুভক্ষণে
বাষ্পের গুণ্ঠনখানি প্রথম পড়িল যবে খুলে,
আকাশে চাহিলে মুখ তুলে।
অমর জ্যোতির মূর্তি দেখা দিল আঁখির সম্মুখে।
রোমাঞ্চিত বুকে
পরম বিস্ময় তব জাগিল তখনি।
নিঃশব্দ বরণমন্ত্রধ্বনি
উচ্ছ্বসিল পর্বতের শিখরে শিখরে।
কলোল্লাসে উদ্ঘোষিল নৃত্যমত্ত সাগরে সাগরে—
‘জয়, জয়, জয়।’
ঝঞ্ঝা তার বন্ধ টুটে ছুটে ছুটে কয়
‘জাগো রে জাগো রে’
বনে বনান্তরে।

প্রথম সে দর্শনের অসীম বিস্ময়
এখনো যে কাঁপে বক্ষোময়।
তলে তলে আন্দোলিয়া উঠে তব ধূলি,
তৃণে তৃণে কণ্ঠ তুলি
ঊর্ধ্বে চেয়ে কয়—
‘জয়, জয়, জয়।’
সে-বিস্ময় পুষ্পে পর্ণে গন্ধে বর্ণে ফেটে ফেটে পড়ে;
প্রাণের দুরন্ত ঝড়ে,
রূপের উন্মত্ত নৃত্যে, বিশ্বময়
ছড়ায় দক্ষিণে বামে সৃজন প্রলয়;
সে-বিস্ময় সুখে দুঃখে গর্জি উঠি কয়—
‘জয়, জয়, জয়।’

তোমাদের মাঝখানে আকাশ অনন্ত ব্যবধান,
ঊর্ধ্ব হতে তাই নামে গান।
চিরবিরহের নীল পত্রখানি-’পরে
তাই লিপি লেখা হয় অগ্নির অক্ষরে।
বক্ষে তারে রাখ,
শ্যাম আচ্ছাদনে ঢাক;
বাক্যগুলি
পুষ্পদলে রেখে দাও তুলি’—
মধুবিন্দু হয়ে থাকে নিভৃত গোপনে,
পদ্মের রেণুর মাঝে গন্ধের স্বপনে
বন্দী করো তারে,
তরুণীর প্রেমাবিষ্ট আঁখির ঘনিষ্ঠ অন্ধকারে

রাখ তারে ভরি,
সিন্ধুর কল্লোলে মিলি নারিকেলপল্লবে মর্মরি
সে-বাণী ধ্বনিতে থাকে তোমার অন্তরে,
মধ্যাহ্নে শোন সে-বাণী অরণ্যের নির্জন নির্ঝরে।

বিরহিণী, সে-লিপির যে উত্তর লিখিতে উন্মনা
আজো তাহা সাঙ্গ হইল না।
যুগে যুগে বারম্বার লিখে লিখে
বারম্বার মুছে ফেল; তাই দিকে দিকে
সে ছিন্ন কথার চিহ্ন পুঞ্জ হয়ে থাকে;
অবশেষে একদিন জ্বলজ্জটা ভীষণ বৈশাখে
উন্মত্ত ধূলির ঘূর্ণিপাকে
সব দাও ফেলে
অবহেলে,
আত্মবিদ্রোহের অসন্তোষে।
তরে পরে আরবার বসে বসে
নূতন আগ্রহে লেখ নূতন ভাষায়।
যুগযুগান্তর চলে যায়।

কত শিল্পী, কত কবি তোমার সে-লিপির লিখনে
বসে গেছে একমনে।
শিখিতে চাহিছে তব ভাষা,
বুঝিতে চাহিছে তব অন্তরের আশা।
তোমার মনের কথা আমারি মনের কথা টানে,
চাও মোর পানে।

চকিত ইঙ্গিত তব, বসনপ্রান্তের ভঙ্গীখানি
অঙ্কিত করুক মোর বাণী।
শরতে দিগন্ততলে
ছলছলে
তোমার যে-অশ্রুর আভাস,
আমার সংগীতে তারি পড়ুক নিশ্বাস।
অকারণ চাঞ্চল্যের দোলা লেগে
ক্ষণে ক্ষণে ওঠে জেগে
কটিতটে যে-কলকিঙ্কিণী,
মোর ছন্দে দাও ঢেলে তারি রিনিরিনি,
ওগো বিরহিণী।
দূর হতে আলোকের বরমাল্য এসে
খসিয়া পড়িল তব কেশে,
স্পর্শে তারি কভু হাসি কভু অশ্রুজলে
উৎকণ্ঠিত আকাঙ্ক্ষায় বক্ষতলে
ওঠে যে-ক্রন্দন,
মোর ছন্দে চিরদিন দোলে যেন তাহারি স্পন্দন।
স্বর্গ হতে মিলনের সুধা
মর্তের বিচ্ছেদপাত্রে সংগোপনে রেখেছ, বসুধা;
তারি লাগি নিত্যক্ষুধা,
বিরহিণী অয়ি,
মোর সুরে হোক জ্বালাময়ী।

৪ অক্টোবর, ১৯২৪