সটীক মেঘনাদবধ কাব্য/সপ্তম সর্গ
সপ্তম সর্গ
উদিলা আদিত্য এবে উদয়-অচলে,
পদ্মপর্ণে সুপ্ত দেব পদ্মযোনি যেন,
উন্মিলী নয়ন-পদ্ম সুপ্রসন্নভাবে,
চাহিলা মহীর পানে। উল্লাসে হাসিলা
কুসুমকুন্তলা মহী, মুক্তামালা গলে।
উৎসবে মঙ্গলবাদ্য উথলে যেমতি
দেবালয়ে, উথলিল সুস্বরলহরী
নিকুঞ্জে। বিমল জলে শোভিল নলিনী;
নিশার শিশিরে যথা অবগাহে দেহ
কুসুম, প্রমীলা সতী, সুবাসিত জলে
স্নানি, পীনপয়োধরা বিনাইলা বেণী।
শোভিল মুকুতাপাঁতি সে চিকণ-কেশে,
চন্দ্রমার রেখা যথা ঘনাবলী মাঝে
শরদে। রতনময় কঙ্কণ লইলা
ভূষিতে মৃণালভুজ সুমৃণালভুজা;—
বেদনিল বাহু, আহা, দৃঢ় বাঁধে যেন,
কঙ্কণ। কোমল কণ্ঠে স্বর্ণকণ্ঠমালা
ব্যথিল কোমল-কণ্ঠে। সম্ভাষি বিস্ময়ে
বসন্তসৌরভা সখী বাসন্তীরে, সতী
কহিলা,—“কেন লো সই, না পারি পরিতে
অলঙ্কার? লঙ্কাপুরে কেন বা শুনিছি
রোদন-নিনাদ দূরে, হাহাকার ধ্বনি?
বামেতর আঁখি মোর নাচিছে সতত;
কাঁদিয়া উঠিছে প্রাণ, না জানি, স্বজনি!
হায় লো, না জানি আজি পড়ি কি বিপদে?
যজ্ঞাগারে প্রাণনাথ, যাও তাঁর কাছে
বাসন্তি! নিবার, যেন না যান সমরে
এ কুদিনে বীরমণি। কহিও জীবেশে,
অনুরোধে দাসী তাঁর ধরি পা-দুখানি।”
নীরবিলা বীণাবাণী। উত্তরিলা সখী
বাসন্তী;—“বাড়িছে ক্রমে শুন কাণ দিয়া,
আর্ত্তনাদ, সুবদনে! কেমনে কহিব
কেন কাঁদে পুরবাসী? চল আশুগতি
দেবের মন্দিরে যথা দেবী মন্দোদরী
পূজিছেন আশুতোষে! মত্ত রণমদে
রথ, রথী, গজ, অশ্ব চলে রাজপথে;
কেমনে যাইব আমি যজ্ঞাগারে, যথা
সাজিছেন রণবেশে সদা রণজয়ী
কান্ত তব, সীমন্তিনি?” চলিলা দুজনে
চন্দ্রচূড়ালয়ে, যথা রক্ষঃকুলেশ্বরী
আরাধেন চন্দ্রচূড়ে রক্ষিতে নন্দনে—
বৃথা! ব্যগ্রচিত্ত দোঁহে চলিলা সত্বরে।
বিরসবদন এবে কৈলাস-সদনে
গিরিশ। বিষাদে ঘন নিশ্বাসি ধূর্জ্জটি,
হৈমবর্তী-পানে চাহি কহিলা; “হে দেবি!
পূর্ণ মনোরথ তব, হত রথিগতি
ইন্দ্রজিৎ কাল-রণে! যজ্ঞাগারে বলী
সৌমিত্রি, নাশিল তারে মায়ার কৌশলে।
পরম-ভকত মম রক্ষঃকুলনিধি,
বিধুমুখি! তার দুঃখে সদা দুঃখী আমি।
এই যে ত্রিশূল, সতি! হেরিছ এ করে,
ইহার আঘাত হ’তে গুরুতর বাজে
পুত্ত্রশোক! চিরস্থায়ী, হায়, সে বেদনা,—
সর্ব্বহরকাল তাহে না পারে হরিতে।
কি কবে রাবণ, সতি, শুনি হত রণে
পুত্ত্রবর? অকস্মাৎ মরিবে, যদ্যপি
নাহি রক্ষি রক্ষে আমি রুদ্রতেজোদানে।
তুষিনু বাসবে, সাধ্বি! তব অনুরোধে;
দেহ অনুমতি এবে তুষি দশাননে।”
উত্তরিলা কাত্যায়নী; “যাহা ইচ্ছা কর,
ত্রিপুরারি! বাসবের পূরিবে বাসনা,
ছিল ভিক্ষা তব পদে, সফল তা এবে।
দাসীর ভকত প্রভু, দাশরথি-রথী;
এ কথাটি, বিশ্বনাথ! থাকে যেন মনে!
আর কি কহিবে দাসী ও পদ-রাজীবে?”
হাসিয়া স্মরিলা শূলী বীরভদ্রশূরে।
ভীষণ-মূরতি রথী প্রণমিল পদে
সাষ্টাঙ্গে, কহিলা হর; “গতজীব রণে
আজি ইন্দ্রজিৎ, বৎস! পশি যজ্ঞাগারে,
নাশিল সৌমিত্রি তারে উমার প্রসাদে।
ভয়াকুল দূতকুল এ বারতা দিতে
রক্ষোনাথে। বিশেষতঃ, কি কৌশলে বলী
সৌমিত্রি নাশিলা রণে দুর্ম্মদ-রাক্ষসে,
নাহি জানে রক্ষোদূত। দেব ভিন্ন, রথি!
কার সাধ্য দেবমায়া বুঝে এ জগতে?
কনক-লঙ্কায় শীঘ্র যাও, ভীমবাহু!
রক্ষোদূতবেশে তুমি; ভর, রুদ্রতেজে,
নিকষানন্দনে আজি আমার আদেশে।”
চলিলা আকাশ-পথে বীরভদ্র বলী
ভীমাকৃতি; ব্যোমচর নমিলা চৌদিকে
সভয়ে; সৌন্দর্য্যতেজে হীনতেজাঃ রবি,
সুধাংশু নিরংশু যথা সে রবির তেজে।
ভয়ঙ্করী শূলছায়া পড়িল ভূতলে।
গম্ভীর নিনাদে নাদি অম্বুরাশিপতি
পূজিলা ভৈরব-দূতে। উত্তরিলা রথী
রক্ষঃপুরে; পদচাপে থর থর থরি
কাঁপিল কনক-লঙ্কা, বৃক্ষশাখা যথা,
পক্ষীন্দ্র গরুড় বৃক্ষে পড়ে উড়ি যবে।
পশি যজ্ঞাগারে শূর দেখিলা ভূতলে,
বীরেন্দ্র! প্রফুল্ল, হায়, কিংশুক যেমতি
ভূপতিত বনমাঝে প্রভঞ্জনবলে,
সজল-নয়নে বলী হেরিলা কুমারে।
ব্যথিল অমর-হিয়া মর-দুঃখ হেরি।
কনক-আসনে যথা দশানন রথী,
রক্ষঃকুলচুড়ামণি, উতরিল তথা
দূতবেশে বীরভদ্র, ভস্মরাশি-মাঝে
গুপ্ত বিভাবসুসম তেজোহীন এবে!
প্রণামের ছলে বলী আশীষি রাক্ষসে,
দাঁড়াইলা করপুটে, অশ্রুময় আঁখি,
সম্মুখে। বিস্ময়ে রাজা সুধিলা;—“কি হেতু,
হে দূত! রসনা তব বিরত সাধিতে
স্বকর্ম্ম? মানব রাম, নহ ভৃত্য তুমি
রাঘবের, তবে কেন হে সন্দেশবহ,
মলিন বদন তব? দেবদৈত্যজয়ী
লঙ্কার পঙ্কজরবি সাজিছে সমরে
আজি, অমঙ্গল-বার্ত্তা কি মোরে কহিবে?
মরিল রাঘব যদি ভীষণ অশনি-
সম প্রহরণে রণে, কহ সে বারতা,
প্রসাদি তোমারে আমি।” ধীরে উত্তরিলা
ছদ্মবেশী;—“হায়, দেব, কেমনে নিবেদি
অমঙ্গল-বার্ত্তা পদে, ক্ষুদ্র প্রাণী আমি।
অভয় প্রদান অগ্রে, হে কর্ব্বুরপতি,
কর দাসে।” ব্যগ্রচিত্তে উত্তরিলা বলী;—
“কি ভয় তোমার দূত? কহ ত্বরা করি,
শুভাশুভ ঘটে ভবে বিধির বিধানে।
দানিনু অভয়, ত্বরা কহ বার্ত্তা মোরে।”
বিরূপাক্ষচর বলী রক্ষোদূত বেশী
কহিলা;—“হে রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, হত রণে আজি
কর্ব্বুর-কুলের গর্ব্ব মেঘনাদ রথী।”
যথা যবে ঘোর-বনে নিষাদ বিঁধিলে
মৃগেন্দ্রে নশ্বর-শরে, গর্জ্জি ভীমনাদে
পড়ে মহীতলে হরি, পড়িলা ভূপতি
সভায়। সচিববৃন্দ হাহাকার রবে,
বেড়িল চৌদিকে শূরে; কেহ বা আনিল
সুশীতল-বারি পাত্রে, বিউনিল কেহ।
রুদ্রতেজে বীরভদ্র আশু চেতনিলা
রক্ষোবরে। অগ্নিকণা-পরশে যেমতি
বারুদ, উঠিয়া বলী, আদেশিলা দূতে;—
“কহ দূত, কে বধিল চিররণজয়ী
ইন্দ্রজিতে আজি রণে? কহ শীঘ্র করি।”
উত্তরিলা ছদ্মবেশী;—“ছদ্মবেশে পশি
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে সৌমিত্রি-কেশরী,
রাজেন্দ্র, অন্যায়-যুদ্ধে বধিল কুমতি
বীরেন্দ্রে। প্রফুল্ল, হায়, কিংশুক যেমতি
ভূ-পতিত বনমাঝে প্রভঞ্জন-বলে,
মন্দিরে দেখিনু শূরে। বীরশ্রেষ্ঠ তুমি,
রক্ষোনাথ, বীরকর্ম্মে ভুল শোক আজি।
রক্ষঃকুলাঙ্গনা, দেব, আদ্রিবে মহীরে
চক্ষুঃজলে। পুত্ত্রহানী শত্রু যে দুর্ম্মতি,
ভীম-প্রহরণে তারে সংহারি সংগ্রামে,
তোষ তুমি, মহেষ্বাস, পৌরজনগণে।”
আচম্বিতে দেবদূত অদৃশ্য হইলা,
স্বর্গীয়-সৌরভে সভা পূরিল চৌদিকে!
দেখিলা রাক্ষসনাথ দীর্ঘজটাবলী,
ভীষণ ত্রিশূল-ছায়া! কৃতাঞ্জলিপুটে
প্রণমি, কহিলা শৈব;—“এত দিনে, প্রভু,
ভাগ্যহীন ভৃত্যে এবে পড়িল কি মনে
তোমার? এ মায়া, হায়, কেমনে বুঝিব
মূঢ় আমি, মায়াময়? কিন্তু অগ্রে পালি
আজ্ঞা তব, হে সর্ব্বজ্ঞ! পরে নিবেদিব
যা কিছু আছে এ মনে ও রাজীব-পদে।”
সরোষে—তেজস্বী আজি মহারুদ্রতেজে-
কহিলা রাক্ষসশ্রেষ্ঠ;—“এ কনকপুরে,
ধনুর্দ্ধর আছ যত, সাজ শীঘ্র করি
চতুরঙ্গে! রণরঙ্গে ভুলিব এ জ্বালা—
এ বিষম জ্বালা যদি পারিরে ভুলিতে।”
উথলিল সভাতলে দুন্দুভির ধ্বনি,
শৃঙ্গনিনাদক যেন, প্রলয়ের কালে,
বাজাইলা শৃঙ্গবরে গম্ভীর-নিনাদে।
যথা সে ভৈরব-রবে কৈলাস-শিখরে
সাজে আশু ভূতকুল, সাজিল চৌদিকে
রাক্ষস; টলিল লঙ্কা বীরপদভরে!
বাহিরিল অগ্নিবর্ণ-রথগ্রাম বেগে
স্বর্ণধ্বজ; ধূমবর্ণ-বারণ, আস্ফালি
ভীষণ-মুদ্গর শুণ্ডে; বাহিরিল হ্রেষে
তুরঙ্গম, চতুরঙ্গে আইলা গর্জ্জিয়া
চামর, অমর-ত্রাস; রথিবৃন্দ-সহ
উদগ্র, সমরে উগ্র; গজবৃন্দ-মাঝে
বাস্কল, জীমূতবৃন্দ-মাঝারে যেমতি
জীমূতবাহন বজ্রী ভীম-বজ্র করে!
বাহিরিল হুহুঙ্কারি আসিলোমা বলী
অশ্বপতি; বিড়ালাক্ষ পদাতিকদলে
মহাভয়ঙ্কর রক্ষঃ, দুর্ম্মদ সমরে!
আইল পতাকিদল, উড়িল পতাকা,
ধূমকেতুরাশি যেন উদিল সহসা
আকাশে! রাক্ষসবাদ্য বাজিল চৌদিকে।
যথা দেবতেজে জন্মি দানবনাশিনী
চণ্ডী, দেব অস্ত্রে সতী সাজিলা উল্লাসে
অট্টহাসি, লঙ্কাধামে সাজিলা ভৈরবী
রক্ষঃকুল-অনীকিনী—উগ্রচণ্ডা রণে।
গজরাজতেজঃ ভুজে; অশ্বগতি পদে;
স্বর্ণরথ শিরঃচূড়া; অঞ্চল পতাকা
রত্নময়; ভেরী, তুরী, দুন্দুভি, দামামা
আদি বাদ্য সিংহনাদ! শেল, শক্তি, জাঠি,
তোমর, ভোমর, শূল, মুষল, মুদ্গর,
পট্টিশ, নারাচ, কৌন্ত—শোভে দন্তরূপে।
জনমিল নয়নাগ্নি সাঁজোয়ার তেজে।
থর থর থরে মহী কাঁপিলা সঘনে;
কল্লোলিলা উথলিয়া সভয়ে জলধি;
অধীর ভূধরব্রজ, ভীমার গর্জ্জনে—
পুনঃ যেন জন্মি চণ্ডী নিনাদিলা রোষে।
চমকি শিবিরে শূর রবিকুল-রবি
কহিলা সম্ভাষি মিত্র-বিভীষণে;—“দেখ,
হে সখে, কাঁপিছে লঙ্কা মুহুর্মুহুঃ এবে
ঘোর ভূকম্পনে যেন! ধূমপুঞ্জ উড়ি
আবরিছে দিননাথে ঘন-ঘনরূপে;
উজলিছে নভঃস্থল ভয়ঙ্করী বিভা,
কালাগ্নিসম্ভবা যেন। শুন, কাণ দিয়া,
কল্লোল, জলধি যেন উথলিছে দূরে
লয়িতে প্রলয়ে বিশ্ব।” কহিলা সত্রাসে
পাণ্ডু-গণ্ডদেশ—রক্ষঃ, মিত্র-চূড়ামণি,—
“কি আর কহিব, দেব! কাঁপিছে এ পুরী
রক্ষোবীর পদভরে, নহে ভূকম্পনে।
কালাগ্নিসম্ভবা বিভা নহে যা দেখিছ
গগনে, বৈদেহীনাথ! স্বর্ণ-বর্ম্ম-আভা
অস্ত্রাদির তেজঃ সহ মিশি উজলিছে
দশদিশ। রোধিছে যে কোলাহল, বলি,
শ্রবণকুহর এবে, নহে সিন্ধুধ্বনি;
গরজে রাক্ষসচমু, মাতি বীরমদে।
আকুল পুত্ত্রেন্দ্রশোকে সাজিছে সুরথী
লঙ্কেশ। কেমনে কহ রক্ষিবে লক্ষ্মণে,
আর যত বীরে, বীর! এ ঘোর সঙ্কটে?”
সুস্বরে কহিলা প্রভু;—“যাও ত্বরা করি
মিত্রবর, আন হেথা আহ্বানি সত্বরে
সৈন্যাধ্যক্ষদলে তুমি। দেবাশ্রিত সদা,
এ দাস; দেবতাকুল রক্ষিবে দাসেরে।”
শৃঙ্গ ধরি রক্ষোবর নাদিলা ভৈরবে।
আইলা কিষ্কিন্ধ্যানাথ গজপতি-গতি;
রণবিশারদ শূর অঙ্গদ; আইলা
নল, নীল দেবাকৃতি; প্রভঞ্জনসম
ভীমপরাক্রম হনু; জাম্বুবান বলী;
বীরকুলর্ষভ বীর শরভ; গবাক্ষ,
রক্তাক্ষ, রাক্ষসত্রাস; আর নেতা যত।
সম্ভাষি বীরেন্দ্র দলে যথাবিধি বলী
রাঘব, কহিলা প্রভু;— “পুত্রশোকে আজি
বিকল রাক্ষসপতি সাজিছে সত্বরে
সহ রক্ষঃ-অনীকিনী; সঘনে টলিছে
বীরপদভরে লঙ্কা। তোমরা সকলে
ত্রিভুবনজয়ী রণে; সাজ ত্বরা করি;
রাখ গো রাঘবে আজি এ ঘোর বিপদে।
স্ববন্ধুবান্ধবহীন বনবাসী আমি
ভাগ্যদোষে; তোমরা হে রামের ভরসা,
বিক্রম, প্রতাপ, রণে। একমাত্র রথী
জীবে লঙ্কাপুরে এবে; বধ আজি তারে,
বীরবৃন্দ! তোমাদেরি প্রসাদে বাঁধিনু
সিন্ধু; শূলিশম্ভুনিভ কুম্ভকর্ণ-শূরে
বধিনু তুমুল যুদ্ধে; নাশিল সৌমিত্রি
দেবদৈত্যনরত্রাস ভীম মেঘনাদে।
কুল, মান, প্রাণ মোর রাখ হে উদ্ধারি,
রঘুবন্ধু, রঘুবধূ, বদ্ধা কারাগারে
রক্ষঃ-ছলে। স্নেহপণে কিনিয়াছ রামে
তোমরা; বাঁধ হে আজি কৃতজ্ঞতা পাশে
রঘুবংশে, দাক্ষিণাত্য! দাক্ষিণ্য প্রকাশি।”
নীরবিলা রঘুনাথ সজল-নয়নে।
বারিদপ্রতিম স্বনে স্বনি উত্তরিলা
সুগ্রীব;—“মরিব, নহে মারিব রাবণে,—
এ প্রতিজ্ঞা, শূরশ্রেষ্ঠ, তব পদতলে।
ভুঞ্জি রাজ্যসুখ, নাথ, তোমার প্রসাদে
ধনমানদাতা তুমি, কৃতজ্ঞতা পাশে
চিরবাঁধা, এ অধীন, ও পদপঙ্কজে।
আর কি কহিব শূর? মম সঙ্গিদলে
নাহি বীর, তব কর্ম্ম সাধিতে যে ডরে
কৃতান্তে। সাজুক রক্ষঃ, যুঝিব আমরা
অভয়ে।” গর্জ্জিলা রোষে সৈন্যাধ্যক্ষ যত,
গর্জিলা বিকট ঠাট জয়রাম নাদে।
সে ভৈরব-রবে রুষি, রক্ষ:—অনীকিনী
নিনাদিলা বীরমদে; নিনাদেন যথা
দানবদলনী দুর্গা দানবনিনাদে—
পূরিল কনকলঙ্কা গম্ভীর নির্ঘোষে।
কমল-আসনে যথা বসেন কমলা,
রক্ষঃকুলরাজলক্ষ্মী, পশিল সে স্থলে
আরাব; চমকি সতী উঠিলা সত্বরে।
দেখিলা পদ্মাক্ষী, রক্ষঃ সাজিছে চৌদিকে
ক্রোধান্ধ; রাক্ষসধ্বজ উড়িছে আকাশে,
জীবকুল-কুলক্ষণ! বাজিছে গম্ভীরে
রক্ষোবাদ্য। শূন্যপথে চলিলা ইন্দিরা,—
শরদিন্দুনিভাননা—বৈজয়ন্তধামে।
বাজিছে বিধি-বাদ্য ত্রিদশ আলয়ে।
নাচিছে অপ্সরাবৃন্দ; গাইছে সুতানে
কিন্নর; সুবর্ণাসনে দেবদেবীদলে
দেবরাজ, বামে শচী সুচারুহাসিনী;
অনন্ত বসন্তানিল বহিছে সু-স্বনে;
বর্ষিছে মন্দার-পুঞ্জ গন্ধর্ব্ব চৌদিকে।
পশিলা কেশব-প্রিয়া দেবসভাতলে।
প্রণমি কহিলা ইন্দ্র,—“দেহ পদধুলি,
জননি! নিঃশঙ্ক দাস তোমার প্রসাদে।
গতজীব রণে আজি দুরন্ত রাবণি!
ভুঞ্জিব স্বর্গের সুখ নিরাপদে এবে।
কৃপাদৃষ্টি যার প্রতি কর, কৃপাময়ি,
তুমি, কি অভাব তার?” হাসি উত্তরিলা
রত্নাকর-রত্নোত্তমা ইন্দিরা-সুন্দরী,—
“ভূতলে পতিত এবে, দৈত্যকুলরিপু,
রিপু তব; কিন্তু সাজে রক্ষোবলদলে
লঙ্কেশ, আকুল রাজা প্রতিবিধানিতে
পুত্ত্রবধ! লক্ষ রক্ষঃ সাজে তার সনে।
দিতে এ বারতা, দেব। আইনু এদেশে।
সাধিল তোমার কর্ম্ম সৌমিত্রি-সুমতি;
রক্ষ তারে, আদিতেয়! উপকারী জনে,
মহৎ যে প্রাণ-পণে উদ্ধারে বিপদে।
আর কি কহিব, শত্রু? অবিদিত নহে
রক্ষঃকুলপরাক্রম! দেখ চিন্তা করি,
কি উপায়ে, শচীকান্ত! রাখিবে রাঘবে!”
উত্তরিলা দেবপতি;—“স্বর্গের উত্তরে,
দেখ চেয়ে, জগদম্বে! অম্বর-প্রদেশে;—
সুসজ্জ অমরদল। বাহিরায় যদি
রণ-আশে মহেষ্বাস রক্ষঃকুলপতি,
সমরিব তার সঙ্গে রঙ্গে, দয়াময়ি!—
না ডরি রাবণে, মাতঃ, রাবণি-বিহনে।”
বাসবীয় চমূ রমা দেখিলা চমকি
স্বর্গের উত্তরভাগে। যত দূর চলে
দেবদৃষ্টি, দৃষ্টি-দানে হেরিলা সুন্দরী
রথ, গজ, অশ্ব, সাদী, নিষাদী, সুরথী,
পদাতিক যমজয়ী, বিজয়ী সমরে।
গন্ধর্ব্ব, কিন্নর, দেব, কালাগ্নি-সদৃশ
তেজে; শিখিধ্বজরথে স্কন্দ তারকারি
সেনানী, বিচিত্র রথে চিত্ররথ রথী।
জ্বলিছে অম্বর যথা বন দাবানলে;
ধূমপুঞ্জসম তাহে শোভে গজরাজি;
শিখারূপে শূলগ্রাম ভাতিছে ঝলসি
নয়ন। চলপা যেন অচলা, শোভিছে
পতাকা: রবিপরিধি জিনি তেজোগুণে,
ঝকঝকে চর্ম্ম; বর্ম্ম ঝলে ঝলঝলে।
সুধিলা মাধবপ্রিয়া;—“কহ দেবনিধি
আদিতেয়, কোথা এবে প্রভঞ্জন-আদি
দিক্পাল? ত্রিদিবসৈন্য শূন্য কেন হেরি
এ বিরহে? উত্তরিলা শচীকান্ত বলী;—
“নিজ নিজ রাজ্য আজি রক্ষিতে দিক্পালে
আদেশিনু, জগদম্বে! দেবরক্ষোরণে,
(দুর্জ্জয় উভয় কুল) কে জানে কি ঘটে?—
হয় ত মজিবে মহী, প্রলয়ে যেমতি,
আজি; এ বিপুল সৃষ্টি যাবে রসাতলে।”
আশীষিয়া সুকেশিনী কেশববাসনা
দেবেশে, লঙ্কায় মাতা সত্বরে ফিরিলা
সুবর্ণ ঘনবাহনে; পশি স্বমন্দিরে,
বিষাদে কমলাসনে বসিলা কমলা,—
আলো করি দশদিশ রূপের কিরণে,
বিরসবদন, মরি, রক্ষঃকুল-দুঃখে।
রণমদে মত্ত, সাজে রক্ষঃকুলপতি;—
হেমকূট-হৈমশৃঙ্গ-সমোজ্জ্বল তেজে
চৌদিকে রথীন্দ্রদল! বাজিছে অদূরে
রণবাদ্য; রক্ষোধ্বজ উড়িছে আকাশে,
অসংখ্য রাক্ষসবৃন্দ নাদিছে হুঙ্কারে
হেনকালে সভাতলে উত্তরিলা রাণী
মন্দোদরী, শিশুশূন্য নীড় হেরি যথা
আকুলা কপোতী, হায়! ধাইছে পশ্চাতে
সখীদল। রাজপদে পড়িলা মহিষী।
যতনে সতীরে তুলি, কহিলা বিষাদে,
রক্ষোরাজ;—“বাম এবে, রক্ষঃকুলেন্দ্রাণি।
আমা দোঁহা প্রতি বিধি! তবে যে বাঁচিছি
এখনও, সে কেবল প্রতিবিধিৎসিতে
মৃত্যু তার! যাও ফিরি শূন্য-ঘরে তুমি;—
রণক্ষেত্রযাত্রী আমি, কেন রোধ মোরে?
বিলাপের কাল, দেবি! চিরকাল পাব!
বৃথা রাজ্যসুখে, সতি! জলাঞ্জলি দিয়া,
বিরলে বসিয়া দোঁহে স্মরিব তাহারে
অহরহঃ। যাও ফিরি; কেন নিবাইবে
এ রোষাগ্নি অশ্রুনীরে, রাণি মন্দোদরি!
বন-সুশোভন শাল ভূপতিত আজি,
চূর্ণ তুঙ্গতম শৃঙ্গ গিরিবর-শিরে;
গগনরতন-শশী চিররাহুগ্রাসে।”
ধরাধরি করি সখী লইলা দেবীরে
অবরোধে। ক্রোধভরে বাহিরি, ভৈরবে
কহিলা রাক্ষসনাথ, সম্বোধি রাক্ষসে;—
“দেব-দৈত্য-নর-রণে যার পরাক্রমে
জয়ী রক্ষঃ-অনীকিনী; যার শরজালে
কাতর দেবেন্দ্রসহ দেবকুলরথী;
অতল-পাতালে নাগ, নর নরলোকে;—
হত সে বীরেশ আজি অন্যায়-সময়ে,
বীরবৃন্দ! চোরবেশে পশি দেবালয়ে,
সৌমিত্রি বধিল পুত্রে নিরস্ত্র সে যবে
নিভৃতে। প্রবাসে যথা মনোদুঃখে মরে
প্রবাসী, আসন্নকালে না হেরি সম্মুখে
স্নেহপাত্র তার যত—পিতা, মাতা, ভ্রাতা,
দয়িতা—মরিল আজি স্বর্ণ-লঙ্কাপুরে,
স্বর্ণলঙ্কা-অলঙ্কার। বহুকালাবধি
পালিয়াছি পুত্ত্রসম তোমা সবে আমি;—
জিজ্ঞাসহ ভূমণ্ডলে, কোন্ বংশখ্যাতি
রক্ষোবংশখ্যাতিসম? কিন্তু দেব-নরে
পরাভবি, কীর্ত্তিবৃক্ষ রোপিনু জগতে
বৃথা। নিদারুণ-বিধি, এতদিনে এবে
বামতম মম প্রতি; তেঁই শুখাইল
জলপূর্ণ আলবাল অকাল-নিদাঘে!
কিন্তু না বিলাপি আমি। কি ফল বিলাপে?
আর কি পাইব তারে? অশ্রুবারিধারা,
হায় রে, দ্রবে কি কভু কৃতান্তের হিয়া
কঠিন? সমরে এবে পশি বিনাশিব
অধর্ম্মী সৌমিত্রি মূঢ়ে, কপট-সমরী;—
বৃথা যদি যত্ন আজি, আর না ফিরিব—
পদার্পণ আর নাহি করিব এ পুরে
এ জন্মে! প্রতিজ্ঞা মম এই, রক্ষোরথি!
দেব-দৈত্য-নর-ত্রাস তোমরা সমরে,
বিশ্বজয়ী; স্মরি তারে, চল রণস্থলে;—
মেঘনাদ হত রণে, এ বারতা শুনি,
কে চাহে বাঁচিতে আজি এ কর্ব্বুরকুলে,
কর্ব্বুরকুলের গর্ব্ব মেঘনাদ বলী।”
নীরবিলা সহেষ্বাস নিশ্বাসি বিষাদে।
ক্ষোভে রোষে রক্ষঃসৈন্য নাদিলা নির্ঘোষে,
তিতিয়া মহীরে, মরি, নয়ন আসারে।
শুনি সে ভীষণ স্বন নাদিলা গম্ভীরে
রঘুসৈন্য। ত্রিদিবেন্দ্র নাদিলা ত্রিদিবে।
রুষিলা বৈদেহীনাথ, সৌমিত্রি-কেশরী,
সুগ্রীব, অঙ্গদ, হনু, নেতৃনিধি যত
রক্ষোযম; নল, নীল, শরভ সুমতি,—
গর্জ্জিল বিকট ঠাট জয়রাম নাদে।
মন্দ্রিলা জীমূতবৃন্দ আবরি অম্বরে;
ইরম্মদে ধাঁধি বিশ্ব, গর্জ্জিল অশনি;
চামুণ্ডার হাসিরাশি-সদৃশ হাসিল
সৌদামিনী, যবে দেবী হাসি বিনাশিলা
দুর্ম্মদ দানবদলে, মত্ত রণমদে।
ডুবিলা তিমিরপুঞ্জে তিমির-বিনাশী
দিনমণি; বায়ুদল বহিলা চৌদিকে
বৈশ্বানর-শ্বাসরূপে; জ্বলিল কাননে
দাবাগ্নি; প্লাবন নাদি গ্রাসিল সহসা
পুরি পল্লী; ভূকম্পনে পড়িল ভূতলে
অট্টালিকা, তরুরাজী; জীবন ত্যজিল
উচ্চ কাঁদি জীবকুল, প্রলয়ে যেমতি!
মহাভয়ে ভীত মহী কাঁদিয়া চলিলা
বৈকুণ্ঠে। কনকাসনে বিরাজেন যথা
মাধব, প্রণমি সাধ্বী আরাধিলা দেবে;—
“বারে বারে অধিনীরে, দয়াসিন্ধু তুমি,
হে রমেশ! তরাইলা বহু মূর্ত্তি ধরি;—
কুর্ম্মপৃষ্ঠে তিষ্ঠাইলা দাসীরে প্রলয়ে
কূর্ম্মরূপে; বিরাজিনু দশনশিখরে
আমি, (শশাঙ্কের দেহ কলঙ্কের রেখা
সদৃশী) বরাহমূর্ত্তি ধরিলা যে কালে,
দীনবন্ধু! নরসিংহবেশে বিনাশিয়া
হিরণ্যকশিপু দৈত্য, জুড়ালে দাসীরে
খর্ব্বিলা বলির গর্ব্ব খর্ব্বাকারছলে,
বামন! বাঁচিনু, প্রভু, তোমার প্রসাদে।
আর কি কহিব নাথ? পদাশ্রিতা দাসী,
তেঁই পাদপদ্মতলে এ বিপত্তিকালে।”
হাসি সুমধুর স্বরে সুধিলা মুরারি;—
“কি হেতু কাতরা আজি, কহ জগন্মাতঃ
বসুধে? আয়াসে আজি কে, বৎসে, তোমারে?
উত্তরিলা কাঁদি মহী;—“কি না তুমি জান,
সর্ব্বজ্ঞ। লঙ্কার পানে দেখ প্রভু চাহি।
রণে মত্ত রক্ষোরাজ; রণে মত্ত বলী
রাঘবেন্দ্র; রণে মত্ত ত্রিদিবেন্দ্র রথী!
মদকল-করীত্রয় আয়াসে দাসীরে।
দেবাকৃতি রথিপতি সৌমিত্রি-কেশরী
বধিলা সংগ্রামে আজি ভীম মেঘনাদে;
আকুল বিষম-শোকে রক্ষঃকুলনিধি
করিল প্রতিজ্ঞা, রণে মারিবে লক্ষ্মণে;
করিলা প্রতিজ্ঞা ইন্দ্র রক্ষিতে তাহারে
বীরদর্পে;—অবিলম্বে, হায়, আরম্ভিবে
কাল-রণ, পীতাম্বর! স্বর্ণ-লঙ্কাপুরে,
দেব-রক্ষঃ-নর রোষে। কেমনে সহিব
এ ঘোর-যাতনা, নাথ, কহ ত আমারে?”
চাহিলা রমেশ হাসি স্বর্ণলঙ্কা-পানে।
দেখিলা রাক্ষসবল বাহিরিছে দলে
অসংখ্য, প্রতিঘ-অন্ধ, চতুঙ্কন্ধরূপী।
চলিছে প্রতাপ আগে জগত কাঁপায়ে;
পশ্চাতে শবদ চলে শ্রবণ বধিরি;
চলিছে পরাগ পরে দৃষ্টিপথ রোধি
ঘন-ঘনাকাররূপে। টলিছে সঘনে
স্বর্ণলঙ্কা। বহির্ভাগে দেখিলা শ্রীপতি
রঘুসৈন্য; ঊর্ম্মিকুল সিন্ধুমুখে যথা
চির-অরি প্রভঞ্জন দেখা দিলে দূরে।
দেখিলা পুণ্ডরীকাক্ষ, দেবদল বেগে
ধাইছে লঙ্কার পানে, পক্ষিরাজ যথা
গরুড়, হেরিয়া দূরে সদা-ভক্ষ্য ফণী,
হুঙ্কারে! পূরিছে বিশ্ব গম্ভীর নির্ঘোষে!
পলাইছে যোগিকুল যোগ-যাগ ছাড়ি;
কোলে করি শিশুকুলে কাঁদিছে জননী,
ভয়াকুলা; জীবব্রজ ধাইছে চৌদিকে
ছন্নমতি। ক্ষণকাল চিন্তি চিন্তামণি
(যোগীন্দ্র-মানস-হংস) কহিলা মহীরে;—
“বিষম বিপদ, সতি! উপস্থিত দেখি
তব পক্ষে! বিরূপাক্ষ, রুদ্রতেজোদানে,
তেজস্বী করিলা আজি রক্ষঃকুলরাজে।
না হেরি উপায় কিছু; যাহ তাঁর কাছে,
মেদিনি!” পদারবিন্দে কাঁদি উত্তরিলা
বসুন্ধরা;—“হায় প্রভু! দুরন্ত সংহারী
ত্রিশূলী; সতত রত নিধনসাধনে।
নিরন্তর তমোগুণে পূর্ণ ত্রিপুরারি।
কাল-সর্প-সাধ, শৌরি! সদা দগ্ধাইতে,
উগরি বিষাগ্নি, জীবে। দয়াসিন্ধু তুমি,
বিশ্বম্ভর; বিশ্বভার তুমি না বহিলে,
কে আর বহিবে, কহ? বাঁচাও দাসীরে,
হে শ্রীপতি! এ মিনতি ও রাঙ্গা-চরণে!”
উত্তরিলা হাসি বিভু;—“যাও নিজ স্থলে,
বসুধে! সাধিব কার্য্য তোমার, সম্বরি
দেববীর্য্য। না পারিবে রক্ষিতে লক্ষ্মণে
দেবেন্দ্র, রাক্ষস-দুঃখে দুঃখী উমাপতি।”
মহানন্দে বসুন্ধরা গেলা নিজস্থলে।
কহিলা গরুড়ে প্রভু;—“উড়ি নভোদেশে,
গরুত্মান্! দেবতেজঃ হর আজি রণে,
হরে অম্বুরাশি যথা তিমিরারি রবি;
কিম্বা তুমি, বৈনতেয়! হরিলা যেমতি
অমৃত। নিস্তেজ দেবে আমার আদেশে।”
বিস্তারি বিশাল পক্ষ, উড়িলা আকাশে
পক্ষিরাজ; মহাছায়া পড়িল ভূতলে,
আঁধারি অযুত বন, গিরি, নদ, নদী।
যথা গৃহমাঝে বহ্নি জ্বলিলে উত্তেজে,
গবাক্ষ-দুয়ার পথে বাহিরায় বেগে
শিখাপুঞ্জ, বাহিরিল চারিদ্বার দিয়া
রাক্ষস, নিনাদি রোষে; গর্জ্জিল চৌদিকে
রঘুসৈন্য; দেববৃন্দ পশিলা সমরে।
আইলা মাতঙ্গবর ঐরাবত, মাতি
রণরঙ্গে; পৃষ্ঠদেশে দম্ভোলিনিক্ষেপী
সহস্রাক্ষ, দীপ্যমান মেরুশৃঙ্গ যথা
রবি করে, কিম্বা ভানু মধ্যাহ্নে; আইলা
শিখিধ্বজ-রথে রথী স্কন্দ তারকারি
সেনানী; বিচিত্র রথে চিত্ররথ রথী;
কিন্নর, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, বিবিধ বাহনে।
আতঙ্কে শুনিলা লঙ্কা স্বর্গীয়-বাজনা;
কাঁপিল চমকি দেশ অমর-নিনাদে!
সাষ্টাঙ্গে প্রণমি ইন্দ্রে কহিলা নৃমণি;
“দেবকুলদাস দাস, দেবকুলপতি!
কত যে করিনু পুণ্য পূর্ব্বজন্মে আমি,
কি আর কহিব তার? তেঁই সে লভিনু
পদাশ্রয় আজি তব এ বিপত্তি কালে,
বজ্রপাণি! তেঁই আজি চরণ-পরশে
পরিত্রিলা ভূমণ্ডল ত্রিদিবনিবাসী।”
উত্তরিলা স্বরীশ্বর সম্ভাষি রাঘবে;—
“দেবকুলপ্রিয় তুমি, রঘুকুলমণি!
উঠি দেবরথে, রথি! নাশ বাহুবলে
রাক্ষস অধর্ম্মাচারী। নিজ-কর্ম্ম-দোষে
মজে রক্ষঃকুলনিধি; কে রক্ষিবে তারে?
লভিনু অমৃত যথা মথি জলদলে,
লণ্ডভণ্ডি লঙ্কা আজি, দণ্ডি নিশাচরে,
সাধ্বী মৈথিলীরে, শূর, অর্পিবে তোমারে
দেবকুল। কত কাল অতল-সলিলে
বসিবেন আর রমা, আঁধারি জগতে?”
বাজিল তুমুল রণ দেবরক্ষোনরে!
অম্বুরাশিসম কম্বু ঘোষিল চৌদিকে
অযুত; টঙ্কারি ধনুঃ ধনুর্দ্ধর বলী
রোধিলা শ্রবণপথ! গগন ছাইয়া
উড়িল কলম্বকুল, ইরম্মদতেজে
ভেদি, বর্ম্ম, চর্ম্ম, দেহ, বহিল প্লাবনে
শোণিত। পড়িল রক্ষোনরকুলরথী;
পড়িল কুঞ্জরপুঞ্জ, নিকুঞ্জে যেমতি
পত্র প্রভঞ্জনবলে; পড়িল নিনাদি
বাজীরাজী; রণভূমি পূরিল ভৈরবে!
আক্রমিলা সুরবৃন্দে চতুরঙ্গ-বলে
চামর—অমরত্রাস। চিত্ররথ রথী
সৌরতেজঃ রথে শূর পশিলা সংগ্রামে,
বারণারি সিংহ যথা হেরি সে বারণে।
আহ্বানিল ভীমরবে সুগ্রীবে উদগ্র
রথীশ্বর; রথচক্র ঘুরিল ঘর্ঘরে
শতজলস্রোতোনাদে। চালাইলা বেগে
বাস্কল মাতঙ্গযূথে, যুথনাথ যথা
দুর্ব্বার, হেরিয়া দূরে অঙ্গদে; রুষিলা
যুবরাজ, রোষে যথা সিংহশিশু হেরি
মৃগদলে। অসিলোমা, তীক্ষ্ণ-অসি করে,
বাজীরাজী সহ ক্রোধে বেড়িল শরভে
বীরর্ষভ। বিড়ালাক্ষ (বিরূপাক্ষ যথা
সর্ব্বনাশী) হনূ সহ আরম্ভিলা কোপে
সংগ্রাম। পশিলা রণে দিব্যরথে রথী
রাঘব, দ্বিতীয়, আহা, স্বরীশ্বর যথা
বজ্রধর। শিখিধ্বজ স্কন্দ তারকারি,
সুন্দর লক্ষ্মণ-শূরে দেখিলা বিস্ময়ে
নিজ প্রতিমূর্ত্তিমর্ত্যে। উড়িল চৌদিকে
ঘনরূপে রেণুরাশি; টলমল টলে
টলিলা কনক-লঙ্কা; গর্জ্জিলা জলধি।
সৃজিলা অপূর্ব্ব-ব্যূহ শচীকান্ত বলী।
বাহিরিলা রক্ষোরাজ পুষ্পক-আরোহী
ঘর্ঘরিল রথচক্র নির্ঘোষে, উগরি
বিস্ফুলিঙ্গ; তুরঙ্গম হ্রেষিল উল্লাসে।
রতনসম্ভবা বিভা, নয়ন ধাঁধিয়া,
ধায় অগ্রে, ঊষা যথা, একচক্র-রথে
উদেন আদিত্য যবে উদয়-অচলে!
নাদিল গম্ভীরে রক্ষঃ হেরি রক্ষোনাথে।
সম্ভাষি সারথিবরে, কহিলা সুরথী;—
“নাহি যুঝে নর আজি, হে সূত, একাকী,
দেখ চেয়ে। ধূমপুঞ্জে অগ্নিরাশি যথা,
শোভে অসুরারিদল রঘুসৈন্য মাঝে।
আইলা লঙ্কায় ইন্দ্র শুনি হত রণে
ইন্দ্রজিৎ।” স্মরি পুত্ত্রে রক্ষঃকুলনিধি,
সরোষে গর্জ্জিয়া রাজা কহিলা গভীরে;—
“চালাও, হে সূত! রথ, যথা বজ্রপাণি
বাসব।” চলিল রথ মনোরথগতি।
পলাইল রঘুসৈন্য, পলায় যেমনি
মদকল-করীরাজে হেরি উর্দ্ধশ্বাসে
বনবাসী। কিম্বা যথা ভীমাকৃতি-ঘন,
বজ্র-অগ্নিপূর্ণ, যবে উড়ে বায়ুপথে
ঘোরনাদে, পশুপক্ষী পলায় চৌদিকে
আতঙ্কে! টঙ্কারি ধনুঃ, তীক্ষ্ণতর-শরে
মুহূর্ত্তে ভেদিলা ব্যূহ বীরেন্দ্র-কেশরী,
সহজে প্লাবন যথা ভাঙে ভীমাঘাতে
বালিবন্ধ! কিম্বা যথা ব্যাঘ্র নিশাকালে
গোষ্ঠবৃতি। অগ্রসরি শিখিধ্বজ-রথে,
শিঞ্জিনী আকর্ষি রোষে তারকারি বলী
রোধিলা সে রথগতি। কৃতাঞ্জলিপুটে
নমি শূরে, লঙ্কেশ্বর কহিলা গম্ভীরে;—
“শঙ্করী-শঙ্করে, দেব, পূজে দিবানিশি
কিঙ্কর। লঙ্কায় তবে বৈরিদল-মাঝে
কেন আজি হেরি তোমা? নরাধম রামে
হেন আনুকুল্য দান কর কি কারণে,
কুমার? রথীন্দ্র তুমি; অন্যায়-সমরে
মারিল নন্দনে মোর লক্ষ্মণ; মারিব
কপটসমরী মূঢ়ে; দেহ পথ ছাড়ি!”
কহিলা পার্ব্বতীপুত্ত্র; “রক্ষিব লক্ষ্মণে,
রক্ষোরাজ! আজি আমি দেবরাজাদেশে।
বাহুবলে, বাহুবল, বিমুখ আমারে,
নতুবা এ মনোরথ নারিবে পূর্ণিতে!”
সরোষে, তেজস্বী আজি মহারুদ্রতেজে,
হুঙ্কারি হানিল অস্ত্র রক্ষঃকুলনিধি
অগ্নিসম, শরজালে কাতরিয়া রণে
শক্তিধরে! বিজয়ারে সম্ভাষি অভয়া
কহিলা; “দেখ্লো সখি! চাহি লঙ্কাপানে,
তীক্ষ্ণ-শরে রক্ষেশ্বর বিঁধিছে কুমারে
নির্দ্দয়; আকাশে দেখ, পক্ষীন্দ্র হরিছে
দেবতেজঃ; যা লো তুই সৌদামিনীগতি,
নিবার্ কুমারে, সই। বিদরিছে হিয়া
আমার, লো সহচরি। হেরি রক্তধারা
বাছার কোমল দেহে। ভকত-বৎসল
সদানন্দ; পুত্রাধিক স্নেহেন ভকতে;
তেঁই সে রাবণ এবে দুর্ব্বার সমরে,
স্বজনি!” চলিলা আশু সৌরকররূপে
নীলাম্বরপথে দূতী। সম্বোধি কুমারে
বিধুমুখী, কর্ণমূলে কহিলা;—“সম্বর
অস্ত্র তব, শক্তিধর, শক্তির আদেশে।
মহারুদ্রতেজে আজি পূর্ণ লঙ্কাপতি।”
ফিরাইলা রথ হাসি স্কন্দ তারকারি
মহাসুর। সিংহনাদে কটক কাটিয়া
অসংখ্য, রাক্ষসনাথ ধাইলা সত্বরে
ঐরাবত-পৃষ্ঠে যথা দেব বজ্রপাণি।
বেড়িল গন্ধর্ব্ব-নর শত প্রসরণে
রক্ষেন্দ্রে; হুঙ্কারি শূর নিরস্তিলা সবে
নিমিষে, কালাগ্নি যথা ভস্মে বনরাজী।
পলাইলা বীরদল জলাঞ্জলি দিয়া
লজ্জায়! আইলা রোষে দৈত্যকুল-অরি,
হেরি পার্থে কর্ণ যথা কুরুক্ষেত্র-রণে।
ভীষণ তোমর রক্ষঃ হানিলা হুঙ্কারি
ঐরাবত-শিরঃ লক্ষ্যি। অর্দ্ধপথে তাহে
শর-বৃষ্টি স্বরীশ্বর কাটিলা সত্বরে।
কহিলা কর্ব্বুরপতি গর্ব্বে সুরনাথে;—
“যার ভয়ে বৈজয়ন্তে, শচীকান্ত বলি!
চির কম্পমান তুমি, হত সে রাবণি,
তোমার কৌশলে, আজি কপট-সংগ্রামে।
তেঁই বুঝি আসিয়াছ লঙ্কাপুরে তুমি,
নির্লজ্জ! অবধ্য তুমি, অমর; নহিলে
দমনে শমন যথা, দমিতাম তোমা
মুহূর্ত্তে। নারিবে তুমি রক্ষিতে লক্ষ্মণে,
এ মম প্রতিজ্ঞা দেব!” ভীম গদা ধরি,
লম্ফ দিয়া রথীশ্বর পড়িলা ভূতলে,
সঘনে কাঁপিলা মহী পদযুগভরে,
ঊরুদেশে কোষে অসি বাজিল ঝন্ঝনি।
হুঙ্কারি কুলিশী রোষে ধরিলা কুলিশে!
অমনি হরিল তেজঃ গরুড়; নারিলা
নাড়িতে দম্ভোলি দেব দম্ভোলি নিক্ষেপী!
প্রহারিলা ভীম গদা গজরাজশিরে
রক্ষোরাজ, প্রভঞ্জন যেমতি, উপাড়ি
অভ্রভেদী মহীরুহ, হানে গিরিশিরে
ঝড়ে। ভীমাঘাতে হস্তী নিরস্ত, পড়িলা
হাঁটু গাড়ি। হাসি রক্ষঃ উঠিলা স্বরথে।
যোগাইলা মুহূর্ত্তেকে মাতলি সারথি
সুরথ; ছাড়িলা পথ দিতিসুতরিপু
অভিমানে। হাতে ধনুঃ, ঘোর-সিংহনাদে
দিব্য রথে দাশরথি পশিলা সংগ্রামে।
কহিলা রাক্ষসপতি; “না চাহি তোমারে
আজি হে বৈদেহীনাথ! এ ভবমণ্ডলে
আর এক দিন তুমি জীব নিরাপদে।
কোথা সে অনুজ তব কপট-সমরী
পামর? মারিব তারে; যাও ফিরি তুমি
শিবিরে, রাঘবশ্রেষ্ঠ!” নাদিলা ভৈরবে
মহেষ্বাস, দূরে শূর হেরি রামানুজে।
বৃষপালে সিংহ যথা, নাশিছে রাক্ষসে
শূরেন্দ্র; কভু বা রথে, কভু বা ভূতলে।
চলিল পুষ্পক বেগে ঘর্ঘরি নির্ঘোষে
অগ্নিচক্রসম চক্র বর্ষিল চৌদিকে
অগ্নিরাশি; ধূমকেতু-সদৃশ শোভিল
রথচূড়ে রাজকেতু। যথা হেরি দূরে
কপোত, বিস্তারি পাখা, ধায় বাজপতি
অম্বরে; চলিলা রক্ষঃ, হেরি রণভূমে
পুত্ত্রহা সৌমিত্রি-শূরে; ধাইলা চৌদিকে
হুহুঙ্কারে দেব-নর রক্ষিতে শূরেশে।
ধাইলা রাক্ষসবৃন্দ হেরি রক্ষোনাথে।
বিড়ালাক্ষ রক্ষঃশূরে বিমুখি সংগ্রামে,
আইলা অঞ্জনাপুত্ত্র,—প্রভঞ্জনসম
ভীমপরাক্রম হনূ, গর্জ্জি ভীম-নাদে।
যথা প্রভঞ্জনবলে উড়ে তুলারাশি
চৌদিকে; রাক্ষসবৃন্দ পলাইলা রড়ে
হেরি যমাকৃতি বীরে। রুষি লঙ্কাপতি
চোক্ চোক্ শরে শূর অস্থিরিলা শূরে
অধীর হইলা হনূ, ভূধর যেমতি
ভূকম্পনে। পিতৃপদ স্মরিলা বিপদে
বীরেন্দ্র, আনন্দে বায়ু নিজ বল দিলা
নন্দনে, মিহির যথা নিজ করদানে
ভূষেণ কুমুদবাঞ্ছা সুধাংশুনিধিরে।
কিন্তু মহারুদ্রতেজে তেজস্বী সুরথী
নৈকষেয়, নিবারিলা পবনতনয়ে,—
ভঙ্গ দিয়া রণরঙ্গে পলাইলা হনূ।
আইলা কিষ্কিন্ধ্যাপতি, বিনাশি সংগ্রামে
উদগ্রে বিগ্রহপ্রিয়। হাসিয়া কহিলা
লঙ্কানাথ;—“রাজ্যভোগ ত্যজি কি কুক্ষণে,
বর্ব্বর! আইলি তুই এ কনকপুরে!
ভ্রাতৃবধূ তারা তোর তারাকারা রূপে
তারে ছাড়ি কেন হেথা রথিকুল-মাঝে
তুই, রে কিষ্কিন্ধ্যানাথ? ছাড়িনু, যা চলি
স্বদেশে। বিধবাদশা কেন ঘটাইবি
আবার তাহার, মূঢ়? দেবর কে আছে
আর তার?” ভীমরবে উত্তরিলা বলী
সুগ্রীব;—“অধর্ম্মাচারী কে আছে জগতে
তোর্ সম, রক্ষোরাজ? পরদারা লোভে
সবংশে মজিলি, দুষ্ট! রক্ষঃকুলকালি
তুই, রক্ষঃ! মৃত্যু তোর্ আজি মোর হাতে।
উদ্ধারিব মিত্রবধূ বধি আজি তোরে।”
এতেক কহিয়া বলী গর্জ্জি নিক্ষেপিলা
গিরিশৃঙ্গ। অনম্বর আঁধারি ধাইল
শিখর; সুতীক্ষ্ণ শরে কাটিলা সুরথী
রক্ষোরাজ, খান খান করি সে শিখরে।
টঙ্কারি কোদণ্ড পুনঃ রক্ষঃ-চূড়ামণি
তীক্ষ্ণতম শরে শূর বিঁধিলা সুগ্রীবে
হুঙ্কারে। বিষমাঘাতে ব্যথিত সুমতি,
পলাইলা; পলাইলা সত্রাসে চৌদিকে
রঘুসৈন্য, (জল যথা জাঙাল ভাঙিলে
কোলাহলে); দেবদল, তেজোহীন এবে,
পলাইলা নরসহ ধুমসহ যথা
যায় উড়ি অগ্নিকণা বহিলে প্রবলে
পবন সম্মুখে রক্ষঃ হেরিলা লক্ষ্মণে
দেবাকৃতি। বীরমদে দুর্ম্মদ সমরে
রাবণ, নাদিলা বলী হুহুঙ্কার রবে;—
নাদিলা সৌমিত্রি-শূর নির্ভয়-হৃদয়ে,
নাদে যথা মত্তকরী মত্তকরিনাদে!
দেবদত্ত ধনুঃ ধন্বী টঙ্কারিলা রোষে।
“এতক্ষণে, রে লক্ষ্মণ,”—কহিলা সরোষে
রাবণ, “এ রণক্ষেত্রে পাইনু কি তোরে,
নরাধম? কোথা এবে দেব বজ্রপাণি?
শিখিধ্বজ শক্তিধর? রঘুকুলপতি,
ভ্রাতা তোর? কোথা রাজা সুগ্রীব? কে তোরে
রক্ষিবে পামর, আজি? এ আসন্ন-কালে
সুমিত্রা-জননী তোর, কলত্র ঊর্ম্মিলা,
ভাব দোঁহে। মাংস তোর মাংসাহারী জীবে
দিব এবে; রক্তস্রোত শুষিবে ধরণী!
কু-ক্ষণে সাগর পার হইলি, দুর্ম্মতি!
পশিলি রাক্ষসালয়ে চোরবেশ ধরি,
হরিলি রাক্ষস-রত্ন—অমূল্য জগতে।”
গর্জ্জিলা ভৈরবে রাজা বসাইয়া চাপে
অগ্নিশিখাসম শর; ভীম সিংহনাদে
উত্তরিলা ভীমনাদী সৌমিত্রি-কেশরী;—
“ক্ষত্ত্রকুলে জন্ম মম, রক্ষঃকুলপতি!
নাহি ডরি যমে আমি; কেন ডরাইব
তোমায়? আকুল তুমি পুত্ত্রশোকে আজি,
যথাসাধ্য কর, রথি! আশু নিবারিব
শোক তব, প্রেরি তোমা পুত্ত্রবর যথা।”
বাজিল তুমুল রণ; চাহিলা বিস্ময়ে
দেব নর দোঁহা-পানে, কাটিলা সৌমিত্রি
শরজাল মুহুর্মুহুঃ হুহুঙ্কার-রবে!
সবিস্ময়ে রক্ষোরাজ কহিলা;—“বাখানি
বীরপণা তোর আমি, সৌমিত্রি-কেশরী!
শক্তিধরাধিক শক্তি ধরিস্ সুরথি!
তুই; কিন্তু নাহি রক্ষা আজি মোর হাতে।”
স্মরি পুত্ত্রবরে শূর, হানিলা সরোষে
মহাশক্তি। বজ্রনাদে উঠিলা গর্জ্জিয়া,
উজলি অম্বরদেশ সৌদামিনীরূপে
ভীষণরিপুনাশিনী! কাঁপিলা সভয়ে
দেব, নর। ভীমাঘাতে পড়িল ভূতলে
লক্ষ্মণ, নক্ষত্র যথা; বাজিল ঝন্ঝনি
দেব-অস্ত্র; রক্তস্রোতে আভাহীন এবে।
সপন্নগ গিরিসম গড়িলা সুমতি।
গহন কাননে যথা বিঁধি মৃগবরে
কিরাত অব্যর্থ শরে, ধায় দ্রুতগতি
তার পানে; রথ ত্যজি রক্ষোরাজ বলী
ধাইলা ধরিতে শবে! উঠিল চৌদিকে
আর্ত্তনাদ! হাহাকারে দেবনররথী
বেড়িলা সৌমিত্রি-শূরে। কৈলাসসদনে
শঙ্করের পদতলে কহিলা শঙ্করী;—
“মারিল লক্ষ্মণে, প্রভু! রক্ষঃকুলপতি
সংগ্রামে। ধূলায় পড়ি যায় গড়াগড়ি
সুমিত্রানন্দন এবে! তুষিলা রাক্ষসে,
ভকত-বৎসল তুমি; লাঘবিলা রণে
বাসবের বীর-গর্ব্ব; কিন্তু ভিক্ষা করি,
বিরূপাক্ষ! রক্ষ, নাথ! লক্ষ্মণের দেহ।”
হাসিয়া কহিলা শূলী বীরভদ্র-শূরে;—
“নিবার লঙ্কেশে, বীর!” মনোরথ-গতি,
রাবণের কর্ণমূলে কহিলা গম্ভীরে
বীরভদ্র;—“যাও ফিরি স্বর্ণলঙ্কাধামে,
রক্ষোরাজ! হত রিপু, কি কাজ সমরে!”
স্বপ্নসম দেবদূত অদৃশ্য হইলা।
সিংহনাদে শূরসিংহ আরোহিলা রথে;
বাজিল রাক্ষস-বাদ্য, নাদিল গম্ভীরে
রাক্ষস; পশিলা পুরে রক্ষ-অনীকিনী—
রণবিজয়িনী ভীমা, চামুণ্ডা যেমতি
রক্তবীজে নাশি দেবী, তাণ্ডবি উল্লাসে,
অট্টহাসি রক্তাধরে, ফিরিলা নিনাদি,
রক্তস্রোতে আর্দ্রদেহ! দেবদল মিলি
স্তুতিলা সতীরে যথা, আনন্দে বন্দিলা
বন্দীবৃন্দে রক্ষঃ-সেনা বিজয়-সঙ্গীতে!
হেথা পরাভূত যুদ্ধে, মহা অভিমানে,
সুরদলে সুরপতি গেলা সুরপুরে।
ইতি শ্রীমেঘনাদবধকাব্যে শক্তিনির্ভেদো নাম সপ্তমঃ সর্গঃ
সপ্তম সর্গ।
সমপ্রেমাকাঙ্ক্ষী—seeking for the same love. Both the lotus and the Suryamukhi bloom at sunrise. They are therefore poetically said to be the wives of the sun.
লঙ্কাধামে সাজিলা ভৈরবী ইত্যাদি—the Rakshasa army is compared to the dreadful goddess Chandi. The strength of the elephants in the army is the strength in the fearful arms of Chandi. The speed of the horses in the army is the speed of her fearful march. The golden chariots represent the crown on her head. The flags represent the skirts of her cloth. The sounds of the various musical instruments represent her war-cry. The various weapons of the Rakshasas represent her teeth. The splendour of the armours of the Rakshasas represents the fire in her eyes.
উপকারী জনে, মহৎ......বিপদে—the person who saves his benefactor from danger is great.
জ্বলিছে অক্ষর যথা বন দাবানলে ইত্যাদি—the sky shone with the splendour of the army of gods as the forest fire shines in the forest. The elephants in the army represent the masses of smoke issing out of the forest fire. The weapons of the gods represent the flames of the forest fire.
চপলা যেন অচলা, শোভিছে পতাকা—the banners looked like restless flashes of lightning.
গগনরতন-শশী চিররাহুগ্রাসে—The Moon, the gem of heaven is once for all in the jaws of Rahu; i.e. Meghanada is now in the jaws of Death.
সপন্নগ—with the snakes. Lakshmana is the mountain, and his weapons are the snakes.