বিষয়বস্তুতে চলুন

সতী/৪

উইকিসংকলন থেকে

(পৃ. ২১-২৪)
◄  
  ►
8

দক্ষ-যজ্ঞ আরম্ভ হইল। ত্রয়োদশ ধর্ম্ম দক্ষের জামাতা। কেহ মহিষ-চালিত শকটে, কেহ রত্ন-রথে দক্ষ ভবনে যাত্রা করিলেন। অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা প্রভৃতি সাতাইশ ভগিনী দক্ষকন্যা, তাঁহারা চন্দ্রালায় হইতে আগত হইলেন। অগ্নির স্ত্রী স্বাহা দক্ষের অপর এক কন্যা, বিচিত্র যানারোহণ-পূর্ব্বক তিনি পিত্রালয়ের অভিমুখে যাত্রা করিলেন। গন্ধর্ব্বগণ ও দিক্‌পালগণের সঙ্গে দেবগণ একত্র মিলিত হইয়া যজ্ঞসম্পাদনে ব্রতী হইলেন, স্বয়ং ভৃগু এই যজ্ঞে হোতাস্বরূপ বরিত হইলেন।

 নারদ কৈলাসপুরীতে যাইয়া শিবকে বলিলেন, “ভগবন্‌! আপনাকে ছাড়া ত্রিজগতের সকলকেই নিমন্ত্রণ করার ভার আমার উপর পতিত হইয়াছিল, এই শিবহীন নিমন্ত্রণ ব্যাপারের জন্য মার্জ্জনা ভিক্ষা করিতে আসিয়াছি।”

 দেবাদিদেবের বিম্বোষ্ঠে মৃদু হাস্য প্রকাশিত হইল। ললাটের অর্দ্ধেন্দুর রশ্মিতে সেই হাস্য মনোহর হইল। তিনি বলিলেন, “যজ্ঞহীন হইয়া ধরিত্রী পীড়িত হইতেছেন। যজ্ঞ হইলেই মঙ্গল, আমাদের নিমন্ত্রণ নাই বা হইল; আমি কৈলাস পর্ব্বতে থাকিতেই ভালবাসি-নন্দিকেশ্বর এবং আমি, কতকটা নির্জ্জনতা-প্রিয় হইয়া পড়িয়াছি। নিমন্ত্রণে যাওয়া আসা আমাদের পক্ষে ক্লেশকর ভিন্ন কিছুই নহে। কিন্তু তুমি সতীকে দক্ষগৃহের যজ্ঞের সংবাদ দিও না। তাঁহার পিতা আমার প্রতি বিরূপ হইয়াছেন। আমি তাঁহাকে তাহা জানাই নাই। তিনি এই সকল ব্যাপার শুনিলে মনে কষ্ট পাইবেন।”

 নারদ ঘুরিয়া ঘুরিয়া কৈলাস পর্ব্বত দেখিতে লাগিলেন। উচ্চ দেবদারু-দ্রুমের নিম্নের কোথাও বেদী প্রস্তুত, সেখানে শিব যোগাসনে আসীন হন। কোথাও সতীর বাহন সিংহ মহাদেবের বৃষের অঙ্গলেহন করিয়া সখ্য জানাইতেছে। অপূর্ব্ব ধূস্তূর-পুষ্পরাজি চারিদিকে ফুটিয়া তীব্রমধুর গন্ধে দিক্‌ প্রফুল্ল করিতেছে। কোথায়ও হরীতকীর বন ও নিম্নবৃক্ষের শ্রেণী। যেখানে হর ও সতী একত্রে কথোপকথন করেন, সেই মনোহর স্থানটি যেন চিত্রে লিখিত। সেখানে রজতখণ্ড-পতনের শব্দের ন্যায় ঝঙ্কার করিয়া রজতের ন্যায় শুভ্রধার বিশিষ্ট অলকনন্দা বহিয়া যাইতেছে। নদীর প্রক্ষালিত শিলার বিভূতিস্পর্শে তাহার শুভ্রতা স্থানে স্থানে ম্লান হইয়া গিয়াছে।

 দেবর্ষি দেখিলেন, কর্ণিকার পুষ্পতরুমূলে সতী দাঁড়াইয়া আছেন। তাপসীর বেশ, অঙ্গযষ্টিকে অপূর্ব্ব কোমলতা প্রদান করিয়া একখানি বল্কল শোভা পাইতেছে। তাহা দেহে বিলম্বিত, এবং সীমান্তপ্রদেশ ঈষৎ স্পর্শ করিয়া রহিয়াছে। হস্তে ও কণ্ঠে রুদ্রাক্ষবলয়, আলুলায়িত কেশরাশিতে একটি অতসীকুসুমের মাল্য গ্রথিত। তিনি একটি কর্ণিকার তরু সন্নিহিত বিল্ববৃক্ষ হইতে একটি বৃহৎ বিল্বফল পাড়িতেছেন। বিল্বের কণ্টকরাশি দেবীর স্পর্শে পল্লবে পরিণত হইয়া যাইতেছে, এবং দেবী ছুঁইতে না ছুঁইতেই শাখা আনম্র হইয়া পড়িতেছে। তৎসমৃদ্ধ ফলগুলি দেবীর স্পর্শ-প্রত্যাশায় আপনি আপনি করতলে আসিতেছে। নারদকে দেখিয়া দেবী বলিলেন, “নারদ ভূপর্য্যটনই তোমার কর্ম্ম। আমার পিতা দক্ষের গৃহের কোন সংবাদ জান? আমার মাতাকে অনেক দিন দেখি নাই, আমার দুঃখিনী মাতাকে দেখিতে বড় সাধ যাইতেছে।” সতীর চক্ষে একবিন্দু অশ্রু দেখা দিল।

 নারদ এ প্রকার প্রশ্নের প্রত্যাশা করেন নাই। তিনি কি উত্তর দিবেন! দেবর্ষি মিথ্যা কথা বলিবেন না; শিবের আদেশ অমান্য করাও তাহার পক্ষে শোভন নহে। তিনি দ্বিধা-কুণ্ঠিত চিত্তে বলিলেন, “দেবি, দক্ষ এবং প্রসূতি ভাল আছেন, আমি কল্য তাঁহাদিগকে দেখিয়া আসিয়াছি।” দেবী বলিলেন, “নারদ তুমি তাঁহাদিগকে দেখিয়া আসিলে, তাঁহারা কি আমার কথা কিছুই বলিলেন না?” নারদ নিরুত্তর রছিলেন।

 দেবীর সন্দেহ ক্রমেই বৃদ্ধি পাইল। তিনি উৎকণ্ঠিত স্বরে বলিলেন, “তুমি এরূপ করিতেছ কেন? তবে কি তাঁহারা কুশলে নাই?” নারদ বলিলেন। “তাঁহারা ভাল আছেন, কিন্তু মা, আমায় ক্ষমা করিবেন, পিতৃকুলের কোন প্রশ্ন আমায় করিবেন না।”

 এই বলিয়া নারদ বীণা বাজাইয়া প্রস্থানপর হইলেন। তত্ত্বপূর্ণ বিচিত্র সংগীতালাপনে বীণা-তন্ত্রীর স্বরলহরী সেই পুণ্য নিকেতনকে মুখরিত করিল। পিণাকী সেই সঙ্গীতে যোগাম্বুধিতে নিমগ্ন হইলেন। সমস্ত কৈলাসপুরী সেই বীণাবাদনে একখানি ভাবের চিত্রের ন্যায় স্থির নিস্পন্দ হইয়া রহিল। কেবল জবাতরুর শ্যাম শাখাপ্রশাখা হইতে অজস্র জবাপুষ্প নিম্নে পতিত হইয়া সেই স্থানে ঈষৎ চাঞ্চল্যের লক্ষণ প্রকটিত করিল, আর দেবীর হৃদয়ে মাতার জন্য আকুলতা প্রবল উচ্ছ্বাসে পরিণত হইয়া তাঁহাকে মূর্ত্তিমতী উৎকণ্ঠা কিম্বা বায়ুকম্পিত লতার ন্যায় বিচলিত করিয়া সেই সেই সৌম্য নিকেতনকে কথঞ্চিৎ অশান্ত করিয়া তুলিল।