বিষয়বস্তুতে চলুন

সতী/৭

উইকিসংকলন থেকে

(পৃ. ৩০-৪২)
◄  
  ►

 সতী দক্ষালয়ে আসিতেছেন। আসিবার সময় উৎসাহে মহাদেবকে প্রণাম করিতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু কৈলাসের অভ্রংলেহী চুড়া যখন নেত্রপথ উত্তীর্ণ হইয়া গেল, তখন সতীর ধ্যানস্থ-শিবমূর্ত্তি কেবলই মনে পড়িতে লাগিল এবং কেন যে তাঁহার এমন ভ্রান্তি হইল, তজ্জন্য অত্যন্ত অনুতাপ হইতে লাগিল।

 সিংহ উল্কার মত আকাশ হইতে অবতরণ করিতেছে। পিণাকপাণির বিরাট শূলহস্তে ভ্রকুটি-কুটিল ক্রূরকটাক্ষ নন্দী পশ্চাতে আসিতেছেন। দেবীর কপালে সিন্দুরবিন্দু, কেশরাজি নিবিড় আগুল্‌ফলম্বিত, তাহা সিংহের পৃষ্ঠ বাহিয়া পড়িয়াছে। যেন নিবিড় মেঘপংক্তি ভেদ করিয়া উল্কা ছুটিতেছে। রুদ্রাক্ষের মাল্য ত্রিগুণিত হইয়া দেবীর বক্ষে বিলম্বিত। কর্ণে কুণ্ডল। দেবী বল্কলবসনা, অক্ষবলয়া, ললাটের ঊর্দ্ধে কেশকলাপে বিল্বদল ও জবাকুসুম আবদ্ধ। শ্বেতচন্দনে ললাট দীপ্ত। কপোলে অলকাতিলকার পরিবর্ত্তে বিভূতি! একি অপরূপ বেশ। নন্দিকেশ্বর কুবেরকে আহ্বান করিয়া দেবীর রাজরাজেশ্বরী-যোগ্য মণিখচিত পরিচ্ছদ আনয়ন করিতে বলিয়াছিলেন। দেবী তাহা নিষেধ করিয়া দিয়াছেন। তিনি যোগীর স্ত্রী যোগিণী; তপস্বিনীর বেশেই তিনি পরিতৃপ্ত, অন্য-বেশ তাহার প্রীতিকর নহে।

 এই বেশে দেবী আসিতেছেন। হীরামণি-খচিত পট্টাম্বরধারিণী যে সতীকে প্রসূতি সাজাইয়া হরকে প্রদান করিয়াছিলেন, এ ত সে সতী নহে। এ সতী বিচিত্র বর্ণোজ্জ্বল সৌরকরদীপ্ত কুসুমকোরক নহে। এ যেন সন্ধ্যামালতী—স্নিগ্ধ অনাড়ম্বর, কিন্তু চক্ষুর পরমতৃপ্তি-সাধক। সিংহ ধীরে ধীরে দক্ষালয়ের নিকটে আসিল, অমনই কলরব পড়িয়া গেল, সতী আসিয়াছে। সেই কলরব অন্তঃপুরের প্রাচীর উত্তীর্ণ হইয়া যজ্ঞবেদীর পার্শ্বস্থিত দক্ষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল, তাহাতে কঠিন হৃদয়ে অমৃতনিষিক্ত হইল। কিন্তু দক্ষ ঘৃণার দ্বারা প্রীতিকে পরাস্ত করিয়া বিমুখ হইয়া বসিলেন।

 কিন্তু যখন সেই কলরব প্রসূতির কর্ণে প্রবেশ করিল, তখন তিনি জাগ্রতা কি স্বপ্নাবিষ্টা তাহা বুঝিতে পারিলেন না। এ কি মৃগতৃষ্ণিকা, না—উন্মাদ চিত্তক্ষোভ! রাণী অন্তঃপুর-দ্বারে আসিলেন, “আমার সতী বক্ষে আয়” বলিয়া সিংহবাহিনীকে হস্তদ্বয় অগ্রসর করিয়া দিলেন। সেই মুহূর্ত্তে মাতা-কন্যা আলিঙ্গন-বদ্ধ হইয়া রহিলেন। উভয়ের গণ্ড প্লাবিত করিয়া নয়নাশ্রু পতিত হইতেছিল। কন্যা অভিমানিনী, মাতা লজ্জিতা। এই উৎসবেও মেয়ে বলিয়া মনে হইল না, মা, তোমার পাগল জামাতাকে ছাড়িয়া আসিতে বুক ফাটিয়া গিয়াছে, বিনা নিমন্ত্রণে তাঁহাকে আনিতে পারি নাই।

 দেখিতে দেখিতে কৃত্তিকা ও রোহিণী উপনীতা হইলেন। স্বাহাও তাঁহাদের পার্শ্ববর্ত্তিনী; কৃত্তিকা স্বর্ণ-খচিত “নীলাম্বর” পরিয়াছিলেন, তাঁহার হস্তের শঙ্খবলয়ে চন্দ্রকান্তমণি নিবদ্ধ ছিল। চন্দ্রের প্রিয়-মহিষীর কণ্ঠে নীলমণির কণ্ঠী, তাঁহার কাঁচলীতে বিশ্বকর্ম্মা সপ্তবিংশ ভার্য্যা সহ চন্দ্রদেবের উজ্জ্বল চিত্র আঁকিয়া দিয়াছিলেন। রোহিণীর বাম অঙ্গে দক্ষিণ বাহু স্থাপন করিয়া কৃত্তিকা। তাঁহার রক্তপট্টবাসের প্রান্তভাগে শুভ্র মণিময় চিত্র অঙ্কিত; মস্তকে চন্দ্রকিরণের মুকুট। পদে মণির মঞ্জীর, কিন্তু স্বাহার বস্ত্রখানি হুতাশনের জ্যোতির ন্যায়। তিনি খর্ব্বাকৃতি বিপুলনিতম্বা। তাঁহার কেশরাজি একটি জ্যোতিস্মান্‌ পদ্মরাগ-মণির গ্রন্থিতে আবদ্ধ। রোহিণী আসিয়া সতীর মুর্ত্তি দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। “ভগিনী এক সিন্দুরই তোমার আয়ৎ-চিহ্ন, হস্তে রুদ্রাক্ষবলয়।” কৃত্তিকা বলিল, “ছি! বল্কল পরাইয়া এই উৎসবে পাঠাইতে শিবের লজ্জা হইল না?” স্বাহা বলিল, “ভগিণী, তোমার এমন রূপ, আহা এত বড় চুলের গোছা তৈল ও মার্জ্জনার অভাবে জটা-বদ্ধ হইয়া গিয়াছে। জঙ্গলে মুক্তা ফেলার মত শিবের ঘরে তোমায় ফেলা হইয়াছে। আহা একখানি পদ্মরাগমণিও কি তোমার হারে গাঁথিয়া দিতে পারিল না? ইহার মধ্যে রবির দুই স্ত্রী—ছায়া ও সংজ্ঞা তথায় উপনীত হইলেন। একজন গঙ্গাজলী রেশমীশাড়ী পরিয়া ছিলেন। কষ্টি পাথরে বাঁধা-ঘাটের ন্যায় সেই শাড়ীর উজ্জ্বল কৃষ্ণ পাড় ঝলমল করিতেছিল। তাঁহার উত্তরীয়াঞ্চলে স্বর্ণবিন্দু দীপ্তি পাইতেছিল। সংজ্ঞার মূর্ত্তি দীর্ঘ ও গৌরবদীপ্ত। একখানি অয়স্কান্ত মণির চূর্ণে রচিত নীলাভ্র বর্ণের বস্ত্র পরিয়া তিনি রূপের হিল্লোল তুলিয়াছিলেন। শচীর বাগান হইতে সংগৃহীত একটি মন্দারকুসুমের মালা তিনি কণ্ঠে পরিয়াছিলেন। ছায়া আসিয়া বলিল, “এই নাকি সতী! শিব আমার নিকট বলিয়া পাঠাইলে ত আমি একখানি রক্তমাণিক্যের অঙ্গদ ও দুইখানি হীরার বলয় পাঠাইতে পারিতাম!—এরূপ উৎসবেও কি এমন বেশে স্ত্রীকে পাঠাইতে হয়?” ছায়া ঘৃণার হাসি হাসিয়া বলিল, “দুইটা জবাফুল ও বিল্বদল চুলে আটকাইয়া আসিয়াছে। দেবরাজের কাছে বলিয়া পাঠাইলেও ত একগাছি পারিজাতের হার পাঠাইয়া দিতেন—আমাদের কর্ত্তার সঙ্গে ইন্দ্রের বড় ভাব, আমরা জানিলেও অনুরোধ করিতে পারিতাম।”

 সতী এই সকল মন্তব্য শুনিয়া অস্থির হইয়া উঠিলেন। তাঁহার একমুহূর্ত্তও তথায় তিষ্ঠিতে ইচ্ছা রহিল না, গণ্ড আরক্তিম হইল। তিনি যাহাদিগকে শৈশবসঙ্গিনী, প্রিয়-ভগিনী বলিয়া জানিতেন, যাহারা একটি বনফুল পাইলে তৃপ্ত হইত, একটুকু মুখের হাসিতে উল্লসিত হইত, এ ত তাহারা নহে। সেই সরল স্বচ্ছন্দ প্রাণ যজ্ঞের কবলিত হইয়াছে। সতীর হৃদয় সেই স্থান হইতে বহির্গত হইবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিল। এমন সময়ে অত্রির স্ত্রী অনসূয়া সেই স্থানে আসিয়া সতীকে দেখিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইলেন। তিনি উৎসাহের স্বরে বলিয়া উঠিলেন, “এ কি দেখিতেছি, সাক্ষাৎ শক্তিরূপিণী এই মেয়ে নাকি সতী! মরি, বিনা ভূষণে, বল্কলবসনে, জবাকুসুম ও রুদ্রাক্ষে শ্রীমূর্ত্তির কি শোভা হইয়াছে! যোগিনীর মত কুণ্ডল মা তোমাকে বড় সাজিয়াছে, মা তোমার পদের অলক্তকরাগ ধরিত্রী শিরোধার্য্য করিয়া লইতেছে, বিভূতিতে কপোল বড় সাজিয়াছে। মা, কুবের তোমার ভাণ্ডারী, তথাপি তুমি সামান্য জবাফুল পরিয়া আসিয়াছ—তুমি এই ধনরত্নগর্ব্বিতা সুন্দরীগণের পার্শ্ব হইতে আমার নিকট এস।” আনন্দে প্রসূতির মুখ প্রসন্ন হইয়া উঠিল। তিনি সতীর প্রতি মন্তব্য শুনিয়া অধীয়া হইয় পড়িতেছিলেন। সতীকে অনসূয়ার সঙ্গিনী করিয়া দিয়া মনে মনে শান্তিলাভ করিলেন। রোহিণী বলিল, “দেখ্‌লি, অনসূয়া মাসীর কথা, উহারা ঐ এক রকমের। স্বয়ং ভগবান দত্তাত্রেয় নাম ধারণ করিয়া উহার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, এই গর্ব্বে উহার পা মাটিতে পড়িতে পায় না। উনি কর্দ্দমঋষির কন্যা, ভাঙ্গা কুঁড়েতে জন্ম, আধপেটা খাইয়া থাকেন, বাকল ভিন্ন একখানি খুঞাকাপড় কিনিবার কড়ি নাই, যা হোক, সতীর সঙ্গে মিশ্‌বে ভাল। বাবা কি সাধে ভাঙ্গড়ের যজ্ঞভাগ মানা করিয়া দিয়াছেন!” মুক্তবেণী দোলাইয়া আর্দ্রা রোহিণীর মুখ চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “দিদি ও কথা বোল না, শিবের যজ্ঞভাগ মানা, এ কথা যেন সতীর কানে না উঠে; মা যে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করিয়াছেন, তাহা কি মনে নাই।” রোহিণী বলিল, “সতী এখানে নাই, তাহার কানে এ কথা উঠাবে কে?”

 আম্রমুকুলের গন্ধে বাপীতীর ভরপুর। দক্ষভবনের পরে এক বিশাল শ্যামপট বিস্তারিত রহিয়াছে। দ্বিপ্রহরে সৌরকিরণে সুদূর পল্লীনিচয়ের তরুরাজি সমুজ্জ্বল। মনে হইল যেন হরিৎ শস্যে বসুন্ধরার শাড়ীর জমি প্রস্তুত হইয়াছে এবং সেই উজ্জ্বল, সুদূরে অবস্থিত বৃক্ষ পংক্তি সেই শাড়ীর পাড়। সতী সেই স্থানে অনসূয়ার সঙ্গে দাঁড়াইয়া মুক্তির আনন্দ অনুভব করিলেন। দক্ষালয় হইতে যে কৈলাসপুরীর গগনালম্বী চুড়া তিনি প্রত্যক্ষ করেন নাই, সেই মুক্তস্থানে দাঁড়াইয়া তাহা দৃষ্টি গোচর হইল। অনসূয়ার পুত্র দত্তাত্রেয়কে দেখিয়া সতী হস্ত বাড়াইয়া তাহাকে ধরিলেন। শিশু অষ্টমবর্ষীয়। সে একটি পূজার ফুলের ন্যায় পবিত্র। সতী বলিলেন, “এই শিশুর মুখে ভগবানের রূপ আঁকা রহিয়াছে, দেবমানুষ-সমাজে এমন অপূর্ব্ব শিশু আমি দেখি নাই।” অত্রিপত্নী বলিলেন, “তুমি কি জান না যে, ভগবান্‌ আমার উদরে অবস্থান করিতে সম্মত হইয়া এই শিশুরূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন? দত্তের পিতা একশত বৎসর একপদে দণ্ডায়মান হইয়া ভগবানের তপস্যা করিয়াছিলেন, তিনি এই একশত বৎসর শুধু বায়ু সেবন করিয়াছিলেন। তাঁহারই প্রার্থনায় ভগবান আমাদিগকে কৃপা করিয়াছেন।” এই বলিয়া অনসূয়া একখানি প্রস্তরের উপর উপবেশন করিলেন। দত্তাত্রেয় তাঁহার অঞ্চল ধরিয়া জানুর সম্মুখে বসিয়া রহিলেন। সেই দ্বি-প্রহরের সৌরকিরণ মন্দীভূত তেজে শিশুর কুঞ্চিত জটাকলাপ স্পর্শ করিতে লাগিল। সতী তাহার রূপ দেখিয়া বিমল আনন্দলাভ করিলেন। অনসূয়া বলিলেন, “এই বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা বলাবলি করিতেছিলেন—শিবালয়ে তুমি বড় কষ্টে থাক।” সতী উত্তর করিলেন, “আপনার কি মনে হয়? কৈলাসপুরীর সুখের কথা কি বলিব। সেখানে জগতের সমস্ত সাধ যোগিবরকে দর্শনমাত্র পূর্ণ হইয়া যায়। কত দিন নিম্ব বৃক্ষমূলে দাঁড়াইয়া আমি তাঁহার ধ্যানস্থ মুর্ত্তি দেখিয়াছি। আমি ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলিয়া গিয়াছি। স্ত্রীজাতির ঈপ্সিত বসন, ভূষণ, আড়ম্বর আমার নিকট তুচ্ছ বোধ হইয়াছে। তাঁহার শ্রীমুখের বাণীই আমার কর্ণের ভূষণ, তাঁহার পদসেবাই আমার হস্তের অলঙ্কার, তাঁহার মূর্ত্তিচিন্তাই আমার হৃদয়ের হার হইয়াছে। বলিব কি, তাঁহাকে দেখামাত্র চিতাভস্ম পরম পবিত্র মনে করিয়াছি, সেই বিভূতিতে যে তত্ত্ব অঙ্কিত দেখিয়াছি, জগতের কোথাও তাহা নাই। এইজন্য বিভূতি লেপিয়া যোগিনী সাজিয়াছি। তাঁহার জন্য সিদ্ধি ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে হাতে কড়া পড়িয়াছে বলিয়া ছায়াদিদি আক্ষেপ করিলেন। এ নন্দীর কাজ হইলেও সবই আমার কাজ। তাঁহার সেবায় যে কষ্ট, তাহা যেন আমার জন্মে জন্মে পাইতে হয়, এই কড়াই আমার আয়ৎ-চিহ্ন।”

 দেবী এই বলিয়া নীরব হইলেন। অনসূয়া দেবীকে দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন। একদিকে দত্তাত্রেয়, অপরদিকে সতী, দুইই তাঁহার মনে অপত্যস্নেহের উচ্ছ্বাস জাগাইয়া তুলিল। ভাই-ভগিনীর মত দুইটিকে দেখা যাইতে লাগিল। শিবকে যাত্রাকালে প্রণাম করিয়া আসেন নাই, এত বড় ভুল তাঁহার কেন হইল এই চিন্তা সতীর মনে একটা কাঁটার মত বিঁধিতে লাগিল। চারিদিকে বিচিত্র বর্ণের রঙ্গিন ফুল ফুটিয়াছিল; শুভ্র বক-ফুলের অর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি প্রসূন, কোমল-পত্রের মধ্যে পুষ্পতরু বদ্ধাঞ্জলীর মধ্যে শিবোপহারের মত দেখাইতে লাগিল; অজস্র মালতী ফুল শিবের পায়ের অজস্র অর্ঘ্যের ন্যায় পবিত্র বোধ হইল; পশ্চিমাকাশের ডুবন্ত সূর্য্যের আলো-রঞ্জিত মেঘখণ্ড শিবপূজার একটী বৃহৎ তাম্রকুণ্ডের মত দেখাইতে লাগিল। পলক-হীন চক্ষে সতী এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দিকে চহিয়া কহিলেন, “আজ সমস্ত জগত তাহার শোভাসৌন্দর্য্য লইয়া, দেবাদিদেব তোমারই পূজা করিতেছে! আমিই এই পূজারীদল হইতে বাদ পড়িয়াছি। বিচিত্র ফুলের উপকরণ লইয়া পূজারিণী প্রকৃতি তোমার উদ্দেশ্যে ভক্তিপ্রেম নিবেদন করিয়া দিতেছে। আজ আমি তোমার পদে একটি জবা-ফুলের অর্ঘ দিতে পারিলাম না, তোমার কর্ণে দুইটি ধুস্তুর পুষ্প পরাইতে পারিলাম ন—বিল্বদল পাদ-পদ্মে ঠেকাইয়া প্রণাম করিতে পারিলাম না—আজ আমার দিন বৃথা, শুধু তাহাই নহে, আজ আমার জীবন নিন্দিত, আমি তোমার নিন্দা কানে শুনিয়াছি; হে দেব! কবে আমি তোমার শত শত বীণার ন্যায় মধুর ও মহান কণ্ঠস্বর শুনিয়া কান জুড়াইব।”

 এই কল্পনার মধ্যে আত্মহারা সতী ডুবিয়া পড়িলেন। তখন অনসূয়ার কণ্ঠ-স্বরে তাঁহার চিন্তার সূত্র ছিন্ন হইল; অনসূয়া বলিতেছিলেন, “এই সকল সাংসারিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুখ-বিলাসে নিমজ্জিত মেয়েরা শিবের গৌরব কি করিয়া বুঝিবে? সমুদ্র মন্থনের সময় কত বহুমূল্য রত্ন উত্থিত হইয়াছিল—সমস্ত দেবতারা তাহা লুটিয়া লইলেন। কৌস্তুভ-মণি লক্ষ্মী বিষ্ণুর ভাগে পড়িল, পারিজাত-তরু, উচ্চৈঃস্রবা ও ঐরাবত ইন্দ্র গ্রহণ করিলেন; অপরাপর দেবতারা অমৃতের ভাগ পাইয়া অমর হইলেন। শিব একবারে নিশ্চেষ্ট ও উদাসীন, কিন্তু যখন দ্বিতীয়বারের মন্থনে ক্লিষ্টকর্ম্ম দেবাসুরের অত্যধিক শ্রম জনিত নিঃশ্বাসে বিষ-প্রবাহ উত্থিত হইয়া সমস্ত জগৎ ধ্বংস করিতে উদ্যত হইল, তখন হতাশ উপায়হীন ও আর্ত্ত দেবমণ্ডলী সৃষ্টি রক্ষার জন্য শিবের শরণ লইলেন। জগতের এই আসন্ন ধ্বংসকালে শিব সেই বিষতরঙ্গ গণ্ডুষ করিয়া গ্রাস করিয়া ফেলিলেন, মুহূর্ত্ত কাল তাঁহার ত্রিনেত্র স্পন্দিত হইল, মুহূর্ত্ত কাল তাঁহার কর্ণস্থিত অতি শুভ্র ধুস্তূর পুষ্পদ্বয় কথঞ্চিৎ ম্লান হইল, তার পর আবার যে ধ্যানের মূর্ত্তি, তাহাই,—শুভ্র রজত-গিরিনিভ প্রসন্নবদন শিব। কিন্তু এই মহাসহিষ্ণুতা ও ত্যাগের চিহ্ন-স্বরূপ নীলকণ্ঠের কণ্ঠ নীলিমারঞ্জিত হইয়া রহিল। দেবাদিদেব একদিন আমার স্বামী অত্রিকে বলিয়াছিলেন—“যাহা অন্যের উপেক্ষিত, তাহাই আমার প্রার্থিত; সুরঞ্জিত বহুমূল্য পট্টবস্ত্র দেবতারা পরিধান করেন, কিন্তু বাঘের ছাল কেহ ঘৃণায় গ্রহণ করেন না; আমি তাহাই কুড়াইয়া লইয়াছি। অপরাপরের জন্য অগুরু চন্দন ও কস্তুরী; কিন্তু এই চিতাভস্ম—যাহা জগতের শেষ পরিণতি—তাহা কে লইবে? আমি এই চিতাভষ্ম আদর করিয়া অঙ্গে মাখাইয়া লইয়াছি। কৌস্তভ এবং অপরাপর মণিমুক্তা লইয়া দেবতার কাড়াকড়ি করেন, কিন্তু এই জটাজুটই আমার মাথার শোভা, ইহার মধ্যে গঙ্গার তরঙ্গ-ভঙ্গের মধুর রব আমার মনে ব্রহ্মানন্দ জাগাইয়া দেয়। দেবতারা জগতের শ্রেষ্ঠ অশ্ব ও হস্তী আরোহণ করুন; এই বৃদ্ধ বৃষভ সকলের পরিত্যক্ত, ইহাই আমার যান-বাহন। এই আড়ম্বর, এই ঐশ্বর্য্য—এ সকলে আমার মন ভুলে না, আমি আত্মার পরম সম্পদ ব্রহ্মধ্যান ও ব্রহ্মানন্দ চাই, আর কিছুর প্রার্থী আমি নই।’ বলিতে বলিতে তাঁহার চক্ষু ধ্যান-মগ্ন হইল এবং তিনি সমাধি-সিন্ধুতে ডুবিয়া পড়িলেন; তখন তাঁহার মস্তক বেড়িয়া এক অপূর্ব্ব আলোচ্ছটা আসিতে লাগিল, এবং তিনি যে কোন নিগূঢ় তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিয়া জগৎ ভুলিয়া গিয়াছেন, তাহার আভাস দিতে লাগিল! এই আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি অপরের বোধগম্য নহে। সুতরাং যদি শিবকে কেহ ভুল বুঝে, তবে দুঃখিত হইবে না। একদা বিষ্ণু বলিয়াছিলেন, “আমি সকল দেবতার পূজ্য, কিন্তু আমি শিবের পূজক। দেবতারা অমর কিন্তু তাঁহারাও মানুষের মত ঐশ্বর্য্য ও প্রতিষ্ঠার উপাসক। শিব নিস্পৃহ, নির্ধন, পাশমুক্ত, বন্ধনহীন। আমি কুবেরকে তাঁহার ভাণ্ডারী করিয়া দিয়াছিলাম, স্বর্ণময় কৈলাসপুরী তাঁহার নিবাস স্থির করিয়া দিয়াছিলাম, কিন্তু তিনি শ্মশান-বাসী, যুগে যুগে একদিনও কুবেরের খোঁজ লন নাই।’

 এই সময়ে প্রসূতি আসিয়া বলিলেন, “সতি! একবার কিছু খাইয়া যাও।” অনসূয়া সতীর হাত ধরিয়া ভোজনস্থানে উপস্থিত হইলেন। দক্ষের অপরাপর কন্যাগণ ভোজনে বসিয়াছেন, সতীকে সকলে আদর করিয়া তাঁহাদের মধ্যে বসাইলেন। কৃত্তিকা যত্নের সহিত সতীর কেশপাশ গুছাইতে গুছাইতে বলিলেন, “ভগিনি, তুমি কি বিরক্ত হইয়াছ? তা’ আর শিবপুরীর প্রসঙ্গে প্রয়োজন নাই। সকলেরই কিছু আঢ্য ঘরে বিবাহ হয় না; যাহার যা, তাহাই ভাল। মা তোমাকে আমাদের সকলের অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বস্ত্র ও ভূষণে অলঙ্কত করিয়া স্বামিগৃহে পাঠাইবেন, তা’ যেরূপ ঘর, সে সব রাখিতে পারিলে হয়! তিনি প্রতি বৎসরের উপযোগী ভূষণ ও বস্ত্র তোমাকে পাঠাইয়া দিবেন, তাহা হইলে তোমার আর কোন দুঃখের কারণ থাকিবে না।”

 দেবী কোন উত্তর করিলেন না। এমন সময় চিত্রা সংজ্ঞাকে বলিলেন, “দিদি, শচীর সঙ্গে নাকি তোমার বড় ভাব? শচীর হারে যে পদ্মরাগমণিখানি, তাহা দেবরাজ কোথায় পাইয়াছিলেন, তাহা কি শুনিয়াছ? উহা ঠিক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায়, বিশ্বকর্ম্মা জহুরী তাহার পলগুলি কাটিয়া দিয়াছেন, এমন মণি অমরাবতীতে নাই।” সংজ্ঞা বলিলেন, “ঐ মণি সুন্দ-উপসুন্দরের ঘরে ছিল, ইন্দ্র তাঁহাদের কোষাগারে প্রাপ্ত হন। উহা একবার মন্দাকিনীতে পড়িয়া গিয়াছিল, শুনিয়াছি নাকি মন্দাকিনীর যে স্থানে উহা নিপতিত হইয়াছিল, সেই স্থান হইতে অপূর্ব্ব প্রভা বিকীর্ণ করিয়া জলের উপর ঠিক একটি উজ্জ্বল আলোর ফুলের মত দেখাইতেছিল, সুতরাং তাহা উদ্ধার করিতে কোনই অসুবিধা হয় নাই।” চিত্রা বলিল, “সংজ্ঞা-দিদি! তোমার শাড়ীখানা ভাই বড় চমৎকার, অয়স্কান্তমণির গুঁড়ার দ্বারা ইহা রাঙ্গান হইয়াছে, তোমায় উহা বেশ মানাইয়াছে।” ইহার মধ্যে রোহিণী বলিলেন, “ভাই, এখানে কি বেশী দিন থাকা চলে? মা আমার একটি মাস থাকিতে বলিয়াছিলেন, ঊনকোটি তারা আমাদের বাড়ীতে আলো দেয়, এখানে যেন সব আঁধার আঁধার ঠেক্‌ছে, আর এখানে চলাফেরার বড় কষ্ট, সেখানকার বিস্তৃত ছায়াপথে বিমানে চড়িয়া যাই, আর এ পাড়াগাঁয়ের পথে কাঁকর কেবলই পায়ে বাজে।” রোহিণীর কথা শেষ না হইতে আর্দ্র বলিয়া উঠিলেন, “আমাদের সোমরস এখানে পাওয়ার বড় কষ্ট, দূত পাঠাইয়া আনিতে হয়; এখানে থাকা কি আমাদের সাজে? আর আমাদের কর্ত্তাটির যদিও আমরা সাতাশ ভার্য্যা, তথাপি সব ক’টির সঙ্গে সঙ্গে থাকা চাই, তিনি বলেন, ‘ঠাট বজায় না রাখিলে মান-সন্ত্রম থাকে না’।” ইহার মধ্যে স্বাহার এক পুত্র সতীর গা ঘেঁষিয়া বলিল, “সতি মাসি! শিব মেসো কি ক’রে বাঘছাল প’রে থাকেন? মা বলছিলেন, তোমার ভাল ভাল শাড়ী ও অলঙ্কার বেচে নাকি তিনি ভাঙ্গ খেয়েছেন!” সংজ্ঞা বলিল, “দুষ্ট ছেলে, মাসীমাকে কি এ কথা বলিতে হয়?” পুনর্ব্বসু বলিল, “তা বেচারি করবে কি, স্ত্রীলোকের কপালে যা’, তা ঘুচাবে কে? সতি! তুমি মনে দুঃখ ভেব না।”

 মুক্ত ব্যোমবিহারী পক্ষীকে সহসা পিঞ্জরাবদ্ধ করিলে তাহার যেরূপ শ্বাসরোধ হইবার উপক্রম ঘটে, এই পার্থিব বৈভবের আলোচনা—তাঁহার প্রতি কটাক্ষ ও অযাচিত সহানুভূতি—এ সমস্তই সতীকে সেইরূপ তীব্রভাবে পীড়ন করিতে লাগিল। সতীর মনে হইল, দক্ষপুরী আর তাঁহার যোগ্য নাই, তাঁহার একমাত্র স্থান কৈলাস। দেবাদিদেবের আনন্দময় বদন তাঁহার কেবলই মনে পড়িতে লাগিল; সেই বদনের ধ্যান-প্রশান্তভাবে বিশ্বের হিত সঙ্কল্পিত, সেইভাবে তিনি মাতৃস্নেহ, ভগিনীর স্নিগ্ধতা, স্বামীর আদর, সমস্তই অঙ্কিত দেখিতে পাইলেন। কৈলাসপুরীর প্রতি তরুপল্লবে তিনি জন্মভূমি, নিবাসভূমি ও স্বর্গের গৌরব একাধারে অনুভব করিতে লাগিলেন। তিনি কি দেখিতে আসিয়াছিলেন, আর কি দেখিতে লাগিলেন! যতই তাঁহারা বেশভূষার সমালোচনা করিতে লাগিলেন, ততই তাঁহার বল্কল প্রিয়তর ও শ্রেষ্ঠতর বোধ হইতে লাগিল। তাঁহার প্রাণ কৈলাসের জন্য অস্থির হইয়া উঠিল। আজ শিবের চরণপদ্মে তিনি জবা ও বিল্বদল প্রদান করেন নাই, তাঁহার দিনটা বৃথা ও শূন্য বলিয়া বোধ হইল। আকাশপানে তাকাইয়া দেখেন, মুক্ত অম্বর যেন দিগম্বরের দিক্‌বাসের ন্যায় প্রসারিত, উৎসবের নানা বাদ্যরব অতিক্রম করিয়া তিনি পিনাকপাণির ডমরু-নিনাদ শুনিতে পাইলেন। তাঁহাদের কৃপা তাঁহার অসহ্য হইল, তিনি অতি সামান্যরূপে আহার করিয়া প্রসূতির নিকট আসিয়া কাঁদিয়া বলিলেন, “মা, আমি তোমাকে দেখিবার জন্য আসিয়াছিলাম, একবার পিতাকে ডাকাইয়া আন, তাঁহাকে প্রণাম করিয়া কৈলাসপুরীতে চলিয়া যাই। আমার মন বড় ব্যাকুল হইয়াছে।”

 প্রসূতি বলিলেন, “সে কি! যজ্ঞ দেখিতে আসিলে, যজ্ঞ শেষ না হইতেই চলিয়া যাইবে? একি পাগলের কথা!”

 সতী বলেলেন, “কেন বলিতে পারি না—যজ্ঞের ধূম আমাকে ব্যথিত করিতেছে, যজ্ঞের মন্ত্রের শব্দ অসিদ্ধ ও অপূর্ণ বলিয়া মনে হইতেছে। বেদী-পার্শ্বস্থ ব্রাহ্মণগণের কোলাহল অপবিত্র বোধ হইতেছে; আমি বলিতে পারি না, কেন এই যজ্ঞ আমার প্রীতি আকর্ষণ করিতেছে না। যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণু ত এই যজ্ঞ অনুমোদন করিয়াছেন?”

 প্রসূতি বুঝিলেন, শিবানীকে না বলিলেও, এ যজ্ঞ যে শিবহীন, তাহা সাধ্বী মনে মনে বুঝিতে পারিয়াছেন। প্রকাশ্যে বলিলেন, “সিংহটা চলিতে বড় দোলে, তাহার পৃষ্ঠে এতটা পথ আসিয়া তোমার মাথাটা ঘুরিতেছে, এজন্য কিছু ভাল লাগিতেছে না, তুমি খাইতে পার নাই, দুই এক দিন আরামে থাকিলে সুস্থ হইবে। যজ্ঞেশ্বর অনুমোদন না করিলে কি কোন যজ্ঞের আরম্ভ হইতে পারে?” দক্ষ কোমলহৃদয়া সতীকে পাছে কোন প্রকার অপমানসূচক কথা বলেন, এজন্য তিনি তনয়ার আগমনসংবাদ তখনও নিজে স্বামীকে বলিয়া পাঠান নাই।

 এদিকে অন্তঃপুর-দ্বারে নন্দী দাঁড়াইয়া ছিল, তাহার ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া রহিয়াছিল। যজ্ঞের সমস্ত সম্ভারের যে দিকেই সে দৃষ্টিপাত করিয়াছে, তাহাতেই সে ক্রুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে। যজ্ঞের ধূমে তাহার শ্বাসরোধ হইতেছিল। বেদী-সন্নিহিত হোমাগ্নি তাহার নিকট চিতাগ্নির মত বোধ হইতেছিল; কেন তাহার হৃদয় বিচলিত হইতেছিল, সে নিজেই বুঝিতে পারে নাই। যজ্ঞভাগ যে শিবকে নিবেদিত হইবে না, এ কথা সে জানিত না, কিন্তু সমস্ত দক্ষপুরীর বায়ুস্তর তাহার শরীরে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ন্যায় প্রদাহ উপস্থিত করিতেছিল; ভাবী কোন অমঙ্গল আশঙ্কায় তাহার বিশাল বক্ষ ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত হইতেছিল।