সরীসৃপ/বন্যা

উইকিসংকলন থেকে

বন্যা

 তারপর ভৈরবকে শেষরাত্রির দিকে একেবারে ঘরের চালায় উঠিতে হইল। আজ কতকাল এই শনে-ছাওয়া চালা তাকে সপরিবারে আকাশের কৃপণ অকৃপণ বর্ষণ হইতে আড়াল করিয়াছে, আকাশ-ফাটা রোদে যোগাইয়াছে ছায়া। এই চালার নীচে কত দিনরাত্রি কাটিয়াছে, কে জানিত কেবল তলায় নয়, একদিন রাত্রিশেষে দরকার হওয়া মাত্র উপরেও তার এমন আশ্রয় মিলিবে?

 ঢালু ভিজা চালা বাহিয়া একেবারে ডগায় উঠিয়া ভৈরব পা ছড়াইয়া বসিয়া রহিল। এখন বৃষ্টি নাই। আকাশের একদিকে আল্‌গা মেঘ, অন্যদিক ফাঁকা। ফাঁকায় তারাও আছে, ছোট একটি চাঁদও আছে। মেঘ যেন ঘষামাজা করিয়াছে আকাশকে, বৃষ্টি যেন ধুইয়া মুছিয়া দিয়াছে,—কি জ্বলজ্বলে সব তারা, কি জ্যোৎস্না বিলানোর সখ অতটুকু আনমনা ক্ষয়ধরা চাঁদের!

 অথচ পৃথিবী ঝাপসা, চারিদিকে ভাল নজর চলে না। চাঁদ আর তারার আলো যেন পৃথিবীর জন্য নয়, যেটুকু পায় পৃথিবী সে শুধু উপচানো দয়া। উত্তরে আমবাগানের বন, আবছা অন্ধকারের একটা এলোমেলো স্তূপ। পশ্চিমে সেই আবছা অন্ধকারই সমতল করিয়া বিছানো,—ক’দিন আগে ছিল ফসল ভরা মাঠ, এখন প্রায় নিস্তরঙ্গ জলের সমুদ্র! পূর্ব্ব আর দক্ষিণের বাড়ীগুলি নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের মধ্যে বিশাল নিশ্চল আবছা অন্ধকারের ঢেউ।

 সবগুলি বাড়ী নয়, মাঝে মাঝে মাচা আছে, কিন্তু খুব কাছের মাচাটি ছাড়া একটিকেও মাচা বলিয়া চেনা যায় না।

 ‘আরে হোই মহিম, আছ নাকি, হেঁই?’

 নিজের হাঁক শুনিয়া ভৈরবের নিজেরই চমক লাগে। এত জোরে হাঁক না দিলেও চলিত। কাছের মাচাটি হইতে মহিমের জবাব আসিবার আগে আরও দূরের সাড়া আসিল।

 ‘ভৈরব মামা, আগো ও ভৈরব মামা, একবারটি এসাে ইদিকে—সর্ব্বনাশ হইছে মাের—শুনছ ভৈরব মামা, আগো ও ভৈরবমামা!’

 বেশ বুঝিতে পারা যায়, আলতামণির গলা। সম্পদের আলােচনায় এমন কোমল আর মনােহারী, বিপদের আর্তনাদে এমন তীক্ষ্ণ আর মর্ম্মভেদী গলা রাজনগরে আর কারো নাই।

 কিন্তু কোনদিক হইতে কেহ সাড়া দিল না। এমনি ভাবে রাত্রিশেষে ঘরের চালায় উঠিয়া আশ্রয় গ্রহণের আশঙ্কা থাকায় গ্রাম আগেই অর্দ্ধেক খালি হইয়া গিয়াছে। কিন্তু যারা গিয়াছে তাদের বেশীরভাগ স্ত্রীলােক আর শিশু, ঘরের চালায়, মাচায়, চালের বাঁশ আর গাছের ডাল হইতে দোলনার মত ঝুলানাে তক্তপােষে, অনাথদের বাড়ীর পিছনের উঁচু মাটির ঢিপিটায় আর ছোটবড় কয়েকটা নৌকায় যারা আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে তাদের অধিকাংশই পুরুষ। এ অবস্থায় কেউ যে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে তাও মনে করা চলে না। তবু আলতামণির আর্ত্তনাদে কেহ সাড়া দিল না।

 ভৈরবের হকের জবাবে মহিম বলিল, ‘চালায় বটে নাকি? কতক্ষণ?’

 ভৈরব বলিল, “এই মাত্তর উঠলাম, ভাবছিলাম চৌকীর পরে রাতটুকুন কাটাব, তা শালার জল হু হু করে বাড়তে শুরু করে দিলে। দিনে দিনে ভাগ্যি সব কটাকে রেখে এলাম বনগাঁয়ে, নয় তাে বিপদ ঘটত। চাল ক’টা নিতে এসে নিজে হলাম আটক। কানাই না’টা নিয়ে গেল বিকেলে, বলল কি, এই এলাম বলে মামা, হাটতলা যাব আর আসব। মিথ্যুক লক্ষ্মীছাড়া বাঁদরটার আর পাত্তা নেই।

 আবার আলতামণির আর্ত্তনাদ শােনা গেল, ‘মহিমমামা! ভৈরবমামা!—আগাে শুনছ?’

 ভৈরব মহিমকে বলিল, ‘ঘরে ঘরে সমান বিপদ, আলতামণির চিল্লানিটা শুনছ? সবার আগে মাচান হল তাের, আগে থেকে পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে বসে আছিস মাচানে উঠে, এত চেঁচানি কিসের রে বাবু!’

 ‘অমনি স্বভাব ছুড়ির, গাঁ শুদ্ধু লােক দেখতে পারে না সাধে?’

 মহিম বােধ হয় তামাক সাজিতে আরম্ভ করিয়াছে, আগুন দেখা গেল। একটু তামাক টানিতে পারিলে মন্দ হইত না, কিন্তু মহিমের মাচানে যাওয়ার উপায় নাই। গেলেও সুবিধা হইবে না, অতটুকু মাচানের উপর মহিমের বৌ, মহিমের ছেলের বৌ, দু’টি বয়স্কা মেয়ে, সকলে আশ্রয় নিয়াছে। তাদেরি বােধ হয় নড়িবার ঠাঁই নাই, ওর মধ্যে কোথায় বসিয়া সে তামাক টানিবে? ডিঙ্গি নৌকাটি অবশ্য আছে মহিমের, কিন্তু তাকে তামাক খাওয়ানাের জন্য মহিম যে মাচান হইতে নামিয়া ডিঙ্গিতে করিয়া এখন তার চালায় আসিয়া উঠিবে সে ভরসা নাই। কোমরে দু’টি বিড়ি আর দেশলাই গোঁজা ছিল, একটু হিসাব করিয়া ভৈরব একটা বিড়ি ধরাইল।

 তারপর আবার শােনা গেল আলতামণির আর্ত্ত চীৎকার,—এবার আওয়াজটা আরও তীক্ষ্ণ, আরও মর্ম্মভেদী।

‘ও মহিমমামা! ও ভৈরবমামা! তোমাদের ভাগ্নি-জামাই যে মরে গেল গো, একবারটি আসবে না?’

 মহিম হুঁকায় একটা টান দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘যাবে নাকি?'

 ভৈরব বলিল, ‘চল যাই। হুঁকাটা এনো দাদা, বিড়িফিড়ি একদম মুখে রুচে না।’

 বাড়ীর পিছনে সব চেয়ে মোটা আমগাছটার অনেক উঁচুতে মোটা ডাল বাছিয়া আলতামণির মাচান বাঁধা হইয়াছে। গাছটার সকলের নীচের ডালটা পর্যন্ত জল উঠিয়াছে, দেড়খানা মানুষ ডুবিয়া যাইবে। আশ্চর্যের কিছু নাই, উঁচু জমিতে উঁচু ভিটায় ভৈরবের বড় ঘর, চাল হইতে নামিবার সময় দেখিয়া আসিয়াছে সে ঘরের দরজার অর্ধেকের বেশী জলের নীচে ডুবিয়া গিয়াছে। ইট দিয়া তক্তপোষ উঁচু করিয়া কি সাহসেই সে ঘরের মধ্যে রাতটা কাটাইয়া দিবে ভাবিয়াছিল! তক্তপোষটা এখন বোধ হয় ঘরের মধ্যে ভাসিয়া বেড়াইতেছে।

 এখানে আলতামণির অবস্থা সত্যই কাহিল। কাছে আসিয়া ভৈরব ও মহিম দু’জনেই বুঝতে পারিল, অকারণে আলতামণি ওরকম আর্ত্তনাদ করে নাই। আমগাছের ডুবুডুবু ডালটা সে এক হাতে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরিয়া আছে, অন্য হাতে ধরিয়া আছে কানাইকে। কানাই জীবিত না মৃত বুঝিবার উপায় নাই, কিন্তু একেবারেই নিশ্চেষ্ট, আলতামণি ছাড়িয়া দিলেই জলে ডুবিয়া স্রোতে ভাসিয়া চলিয়া যাইতে পারে, এমনিভাবে গা এলাইয়া দিয়াছে।

 ‘ধর মামা, চট করে ধর একজন,—হাত এলিয়ে গেছে আমার। কত্‌খন এমনি করে ধরে আছি।’

 মৃদু ও মধুর গলা আলতামণির, কে বলিবে একটু আগে তারই গলা দিয়া অমন ইঞ্জিনের হুইসেলের মত আওয়াজ বাহির হইয়াছিল!

 গাছের ডালে ডিঙ্গি বাঁধিয়া দু’জনে ধরাধরি করিয়া কানাইকে ডিঙ্গিতে তুলিতেই ব্যাপারটা মােটামুটি বুঝা গেল। কানাইয়ের মুখ দিয়া দেশী মদের তীব্র গন্ধ বাহির হইতেছে।

 ভৈরব বলিল, ‘বটে। এইজন্য বাঁদরটার না’য়ের দরকার হয়েছিল! না’টা হল কি রে আলতা, এ্যাঁ?’

 আল তখন ডালটার উপর বুক দিয়া হাঁপাইতেছে, উঠিবার ক্ষমতা নাই। ক্ষীণস্বরে বলিল, ‘ভেসে গেছে।’ ভৈরব চমকাইয়া বলিল, ‘ভেসে গেছে! কোন্‌দিকে গেল? হায় সব্বোনাশ!’

 আলতা কাঁদিবার উপক্রম করিয়া বলিল, ‘কোনদিকে গেল কি করে বলব মামা? আমার ইদিকে এমন সব্বেনাশ—’

 ‘সব্বোনাশ? তাের সব্বোনাশ? আমার না’ গেল, সব্বোনাশ তাের? বজ্জাতটাকে ধরলি কেন তুই, বানের জলে গাঁয়ের কলঙ্ক ধুয়ে যেত! ও ছোঁড়া যদ্দিন বাঁচবে তদ্দিন তাের সব্বোনাশ, বেটাচ্ছেলে মর্‌লে তাের হাড় জুড়ােবে।’

 ‘শাপমণ্যি দিওনা মামা—গুরুজন বটে ন’ তুমি?’

 আলতা হাঁপাইতে ভুলিয়া গিয়াছে, ভৈরবের নৌকা জলে ভাসিয়া যাওয়ার অপরাধ ভুলিয়া গিয়াছে, নীচু গলাতেও কোমলতা নাই,—গাছের ডালে ভর দিয়া এমন ভাবে মুখ তুলিয়া চাহিয়াছে যেন সাপের মত ছােবল দিবে।

 মহিম ভৈরবকে সাহস দিয়া বলিল, ‘কোথাও ঠেকে থাক্‌বে নিশ্চয়,—কাল পাত্তা মিল্‌বে।’

 নৌকার শোকে কাতর ভৈরব জবাব দিল না। জলে ঢেউ নাই, কিন্তু স্রোত প্রবল। তিনজনের ভারে ডিঙ্গি নৌকাটির এমন অবস্থা হইয়াছে যে, ঢেউ থাকিলে হয়ত ডুবিয়াই যাইত। আলতামণি হাত বাড়াইয়া ডিঙ্গির প্রান্তটা ধরিতেই ভৈরব জোর করিয়া তার হাত ছাড়াইয়া দিল।

 ‘ডুবিয়ে মারবি নাকি সবাইকে?’

 আলতামণি আবার কাঁদ কাঁদ হইয়া বলিল, ‘অমনি করে ফেলে রাখবে নাকি? মাচানে তোল তবে ধরাধরি করে?’

 ডিঙ্গির মাঝখানে একটা নির্জ্জীব বস্তার মত কানাইকে ফেলিয়া রাখা হইয়াছে, সেখানেও জলের অভাব নাই। শরীরের হাড়গোড় থাকিলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলি এভাবে দুমড়াইয়া মুচড়াইয়া গা এলাইয়া পড়িয়া থাকা যে মানুষের পক্ষে সম্ভব কানাইকে দেখিলে বিশ্বাস হয় না। তবে কানাইয়ের পড়িয়া থাকিবার ভঙ্গির জন্য নয়, অতটুকু ডিঙ্গিতে এতগুলি লোকের থাকা নিরাপদ নয় বলিয়াই ভৈরব আর মহিম পরামর্শ করিয়া কানাইকে মাচানে তুলিবার কষ্টটা স্বীকার করাই স্থির করিয়া ফেলিল। এ বন্যা, আর কিছু নয়। নদীর বাঁধ কতটুকু ভাঙ্গিয়াছে কে জানে, কতখানি ভাঙ্গিবে তাই বা কে জানে। এমন বন্যা আর কখনও হয় নাই, এর চেয়ে ভয়ানক, এর চেয়ে সর্ব্বনাশকারী বন্যা কল্পনা করা অসম্ভব, তবু এখনও কিছু বলা যায় না। এ বন্যা, আর কিছু নয়। হয়ত হঠাৎ প্রবল গর্জন করিতে করিতে কোথাকার আটকানো জলরাশি ছুটিয়া আসিবে। তাদের চিহ্নও আর খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। তা ছাড়া, আলতামণি কানাইকে এভাবে ডিঙ্গিতে পড়িতে থাকিতেও দিবে না, সে নিজে ডিঙ্গিতে উঠিয়া আসিবেই। একজনের ডিঙ্গিতে চারজন উঠিলে চলিবে কেন?

 মাচানে উঠিবার বাঁশের মইটা কানাই মন্দ করে নাই, গাছের সঙ্গে বাঁধিয়া দিয়াছে শক্ত করিয়া। এদিক দিয়া বজ্জাতটার গুণ আছে অনেক,—যা’ করে ভাল করিয়াই করে। কত তাড়াতাড়ি মাচান বাঁধিয়াছে, হাতের কাছে যা কিছু উপাদান পাইয়াছে তাই লাগাইয়াছে কাজে, তবু মাচানটি যেন দারুণ বিপদে ক’দিনের জন্য নিরুপায়ের আশ্রয় নয়, বা উপভােগ করিবার আরামের ব্যবস্থা। উপরে ছাউনিটা পর্যন্ত এমনভাবে করিয়াছে যেন বহুকাল রােদ বৃষ্টি ঠেকাইবার জন্য ছাউনিটার দরকার হইবে।

 ক্ষীণ চাঁদের আবছা আলােয় বাঁশের মই বাহিয়া শবের মত একটা নিশ্চেষ্ট শিথিল দেহ মাচানে তোলা সহজ ব্যাপার নয়। দূর সম্পর্কের দুই মামার অকথ্য গালাগালিতে আলতামণির শ্রবণ-যন্ত্র দু’টি যে একেবারে বিকল হইয়া গেল না, সে এক রহস্যময় ধর্ম্ম বটে মানুষের ইন্দ্রিয়ের। আলতামণির আর্ত্ত্তনাদে সাধে কেউ সাড়া দেয় না। তার প্রত্যেকটি আর্তনাদ শেষ পর্যন্তু এমনিভাবে মানুষকে হাঙ্গামায় ফেলে, প্রাণান্ত করিয়া ছাড়ে। বৈশাখের প্রথমে মাঝরাত্রে সে একবার এইরকম আর্ত্তনাদ করিয়াছিল,—ঘরে তার আগুন লাগিয়াছে! কেন লাগিয়াছে? নদীর মােটে তিন মাইল দূরে এই গ্রামে বৈশাখ মাসে জলের জন্য মানুষের যেমন পিপাসা জাগে তীব্র, নারীবহুল এই দেশে আলতামণির জন্য কয়েকটা মানুষের তেমনি কামনা জাগিয়াছিল বলিয়া। আলতামণিকে না পাইলে আলতামণির ঘরে আগুন দিতে হয়, এমন হিংস্র সেই কামনা।

 মাচার একপাশে কানাইকে ফেলিয়া দিয়া মহিম ও ভৈরব ধপ করিয়া বসিয়া পড়িল। আলতামণি কানাইকে উপরে তুলিতে তাদের সাহায্য করিতে পারে নাই, সেটা সম্ভব ছিল না। এখন তাড়াতাড়ি কানাইয়ের ভিজা কাপড় বদলাইয়া নিজের একটা শাড়ী দিয়া সে তাকে ঢাকিয়া দিল। গাছের পাতা আর মাচানের ছাউনি এখানে জ্যোস্নাকে আড়াল করিয়াছে,—মাচান অন্ধকার।

 ‘কি হইছে মামা? নড়ন চড়ন নাই যে?’

 ভৈরব বলিল,—‘কি হইছে সে তো তুই জানিস—আমরা কি করে বলব?’

 মহিম বলিল—‘হবে আবার কি, ঠেসে মদ গিলেছে, এখন জ্ঞান নেই।’

 আলতামণি কাঁদ কাঁদ গলায় বলিল, ‘ফিরে এসে কি সব আবোলতাবোল বকতে বকতে মই বেয়ে উঠছিল মামা, হঠাৎ কি হ’ল পড়ে গেল নীচে। ভেসেই যেত চলে, মাচান থেকে ঝাঁপ দিয়ে ধরেছি। তখন চেতনা ছিল না মামা—অমন হঠাৎ চেতন লোপ পেল কেন মামা? বড় ডর লাগে মামা, গা কাঁপছে মোর—হা দ্যাখো—’

 গা কাঁপিতেছে কিনা না দেখিয়াই তাকে ঠেলিয়া দিয়া ভৈরব বলিল, ‘দেখেছি বাবু, দেখেছি। বক বক না করে মাথায় হাওয়া কর, আপন থেকে চেতন আসবে। বেশী গিললে অমন হয়।’

 হাওয়া করার কথাটা খেয়াল ছিল না, হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া আলতামণি পাখা খুঁজিয়া বাহির করিল, তারপর কানাইএর মাথায় জোরে জোরে বাস করিতে লাগিল।

 ভৈরব বলিল, ‘আস্তে আস্তে হাওয়া কর, অত জোরে লোকে হাওয়া করে না কি?’

 ‘না মামা, জোরে জোরে করি, শীগ্‌গির চেতন হবে।’

 ‘যেমন মুখ্যু তুই,—আস্তে হাওয়া দিলে বেশী কাজ দেয়। তিনবার আমায় মারলি পাখা দিয়ে, পাখা রাখ, আঁচল দিয়ে হাওয়া দে।’

 আলতামণি এ পরামর্শ শুনিল না, পাখা দিয়াই হাওয়া করিতে লাগিল। তবে অধীর ব্যাকুলতার সঙ্গে নয়, ধীরে ধীরে।

 খানিক পরে মহিম বলিল, ‘এবার যাই আমরা?’

 ‘না মামা না, ভোরবেলা তক্ বোসো, পায়ে ধরি তোমাদের।'

 ভৈরব অন্ধকারে হাসিয়া বলিল, ‘এত ভয়কাতুরে যদি তুই, কানাই তো ক’দ্দিন রাতে ঘরে থাকে না, একা থাকিস কি করে শুনি?’

 ‘আজ যে চেতন নেই মামা।’

 পাখাটা কানাই-এর মাথায় ঠেকিয়া যাওয়ায় মাচানের উপর পাখাটা একবার ঠুকিয়া আলতামণি আবার বাতাস করিতে লাগিল।

 তারপর অস্ত যাওয়ার আগেই চাঁদ ঢাকিয়া গেল মেঘে, ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি হইয়া যাওয়ার পর আবার আকাশ পরিষ্কার হইয়া দু’একটা তারা ফুটিয়া উঠিবার চেষ্টা করিতে করিতে ভোরের আলোয় ধীরে ধীরে ম্লান হইয়া মিলাইয়া গেল। চারিদিকে চাহিয়া দেখিতে আর কোন বাধা রহিল না। তবে দেখিবার কিছু নাই। এ বন্যা, আর কিছু নয়। বন্যা দর্শনীয় নয়, বর্ণনীয় নয়। বুক চাপড়াইবার, মাথা কপাল ঠুকিবার যা’ কারণ, উপবাসে আর রোগে মরণ ঘটিবার যা’ কারণ, আগামী বন্যায় বুক চাপড়াইয়া মাথা কপাল ঠুকিয়া উপবাস করিয়া আর রোগে ভুগিয়া মরা পর্যন্ত রাক্ষুসে জোঁকের কাছে ঋণী থাকিবার যা’ কারণ, তার মধ্যে পর্যন্ত দেখিবার মত কিছু নাই, বর্ণনা করিবার মত কিছু নাই। চারিদিক জলে ডুবিয়া আছে, বন্যার এই চরম দেখা। চারিদিক জলে ডুবিয়া গিয়াছে, বন্যার এই চরম বর্ণনা।

 ভৈরব শেষ বিড়িটা ধরাইবে কি না ভাবিতেছিল। বিড়িটা জমাইয়া রাখিবার আর বোধ হয় দরকার নাই। মহিমের ডিঙ্গিতে তার হারান নৌকার খোঁজে বাহির হইলে এখানে ওখানে তামাক কি দু’এক কল্কি জুটিবে না? আলতামণি এখনও কানাইকে সমানে বাতাস করিয়া চলিয়াছে। হঠাৎ পাখা বন্ধ করিয়া ভাঙ্গা গলায় সে বলিয়া উঠিল, ‘একবারটি দ্যাকো দিকি মামা ভাল করে তাকিয়ে?’

 মহিম ও ভৈরব তাকাইয়া দেখিল। দু’জনের মুখ পাংশু হইয়া গেল। ‘এমন ধারা মুখ হল কেন মামা? শ্বাস পড়ছে না কেন মামা?’ কানাই-এর মুখ দেখিলেই সেটা বোঝা যায়। কতক্ষণ তার শ্বাস পড়িতেছে না, তাও অনেকটা অনুমান করা যায়।

 ভৈরব ও মহিম পরস্পরের মুখের দিকে চাহিল। কাল অত হাঙ্গামা করিয়া মই বাহিয়া তারা কি তবে একটা শবকে মাচানে তুলিয়াছে? ভৈরব গুরুজন হইয়া কি শাপমণ্যি করিয়াছে একটা মৃত মানুষকে?

 তাই সম্ভব। মাচান হইতে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া কানাইকে আলতামণি বন্যার জলে ভাসিয়া যাইতে দেয় নাই, এক হাতে আমগাছের ডালটা আঁকড়াইয়া ধরিয়া অন্য হাতে কানাইকে ধরিয়া রাখিয়াছিল, আর তীব্র মর্ম্মভেদী আর্ত্তনাদ আরম্ভ করিয়াছিল। তবু বন্যার স্রোত তখন কানাইকে ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে। এ বন্যা, আর কিছু নয়। বন্যা মানুষকে রেহাই দেয় না। সাবিত্রী আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিলে পর্য্যন্ত বন্যা সাবিত্রীর স্বামীকে ছিনাইয়া লইয়া যাইতে পারে, সাবিত্রী বিধবা হইয়া যায়।