সাহিত্যে প্রগতি/সাহিত্যে প্রগতি
সাহিত্যে প্রগতি
আজকাল দেশে প্রগতি-সাহিত্য বলিয়া রব উঠিয়াছে। ইহার মানে অনেকেই ধরিতে পারেন না। সাধারণ লোক বলিতেছেন, ইহা আবার কি? আর সনাতনী সাহিত্যিকরা বলিতেছেন, রস ও রূপ নিয়া সাহিত্য; সাহিত্যে পশ্চাদগমনশীলতাই বা কি আর প্রগতিই বা কি? সাহিত্যে একটা সনাতন ধারাই চলে, তাহা অখণ্ড এবং তাহা রস ও রূপের বিকাশই ব্যক্ত করে। অতএব সাহিত্যে এই কথার কোন মূল্য নাই।
এখন কথা এই, যাঁহার যা ধারণা তাহা তিনি নিজের হৃদয়ে পোষণ করিতে পারেন এবং লোক সমাজে প্রচার করিতে পারেন, কিন্তু তাহা বলিয়া সত্যের অপলাপ হয় না। এই স্থাণুবৎ নড়ন-চড়নশীলতা-বিহীন দেশে সকলেই জীবনের সব দিকেই সনাতন ও অখণ্ড ধারার প্রভাব দেখেন। যে দেশে সমাজ ক্ষেত্রে, অর্থনীতিক্ষেত্রে, রাজনীতিক্ষেত্রে, ভাষার ক্ষেত্রে, ধর্ম্মক্ষেত্রে ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সনাতন ধারার আবিষ্কার করাই বাহাদুরী বলিয়া গণ্য হয়, সে দেশে সাহিত্যক্ষেত্রে সনাতন ও অখণ্ডভাব আবিষ্কার করা বিচিত্র নয়। এই চলমান শ্মশানরূপ ভারতীয় সমাজে সনাতন ধারার এবং আধ্যাত্মিকতার ও মাহাত্ম্যের যতই বাহাদুরী থাকুক না কেন তাহা বাস্তব নহে। সত্য এই যে, মানব সমাজ গতিশীল, স্থাণুবৎ স্থিতিশীল নহে। যে সমাজ স্থাণুবৎ জড়তাপ্রাপ্ত তাহার মৃত্যু অনিবার্য্য এবং তাহা শ্মশানে পরিণত হয়। এই শ্মশানে সনাতন ধারার আবিষ্কার কিছু অদ্ভুত ব্যাপার নয় এবং তাহার অতীন্দ্রিয় (mystic) মাহাত্ম্যও কিছু নাই। বাস্তব কথা এই যে একটা জীবন্ত জাতির জীবনের সর্ব্ব বিষয়ে পরিবর্ত্তনের যে অভিব্যক্তি দেখিতে পাওয়া যায় সাহিত্যে তাহা প্রতিফলিত হয়। এই জন্যই সাহিত্যের মধ্যে দিয়া একটা জাতির ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া যায়। সাহিত্যের এই অভিব্যক্তির অনুসন্ধান করিলে দেখিতে পাওয়া যায় সাহিত্যকে যেমন বীর রসাত্মক, ধর্ম্মাত্মক প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত করা যায় আবার তেমনি অন্যান্য প্রকারেও বিভক্ত করা হয়।
ইহার মধ্যে একটী শ্রেণী বিভাগ হইতেছে নিম্নপ্রকারের:
প্রাচীন সাহিত্যগুলিতে আমরা নানা জনশ্রুতির মধ্যে কতকগুলি বীরের অমানুষিক বীরত্ব গাথার সংবাদ পাই, ইহাকে Heroic age বলা হয়। যথা Homer-এর Achilles, পারস্যের রোস্তম, ভারতের ভীষ্ম প্রভৃতির বীর গাথাকে Heroic age-এর অন্তর্গত বলা যায়। আবার Homer-এর Iliad, Virgil-এর Aenid, ফেরদৌসীর “শাহানামা” আর ভারতের রামায়ণ, মহাভারত classical age-এর পরিচয় প্রদান করে। তৎপরে আসে সামন্ততান্ত্রিক যুগের সাহিত্য। ইউরোপের এই যুগের সাহিত্যের যথেষ্ট নিদর্শন আছে। ফরাসী চারণ রোঁলার Chansons (গীতি) এবং অন্যান্য চারণদের Geste-তে এই যুগের সমাজের চিত্র প্রকাশ করে। তৎপরে আসে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় সমাজ। এই যুগে ইউরোপের সমাজতন্ত্র ধ্বংস করিয়া বুর্জ্জোয়া এবং ধনীতন্ত্রীয় সমাজের প্রতিষ্ঠা হয়। ইহাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমাজ বলা হয়। ইউরোপের এই যুগের সাহিত্যে আমরা তাহার নিদর্শন পাই। ফ্রান্সের “ডুমা”, “বালজাক” “ভিক্টর হুগো”, “রোঁমা রোঁলা” প্রভৃতি সেই দেশের বুর্জ্জোয়া সমাজের চিত্র ও মনস্তত্ত্ব সাহিত্যে প্রকট করিয়াছেন। ইংলণ্ডে সেক্সপিয়রও সমাজের চিত্র তাঁহার নাটকসমূহে প্রকাশ করিয়াছেন। আর Dickens থেকে Galsworthy পর্য্যন্ত আধুনিক ইংরেজ লেখকেরা বুর্জ্জোয়া সমাজেরই প্রতিচ্ছবি তাঁহাদের লেখার মধ্যে পরিস্ফুট করিয়াছেন। রুশের সাহিত্যিকেরা সমাজের প্রত্যেক চিত্র লোকচক্ষুর সম্মুখে ধরিয়াছেন। রুশের গোগল থেকে টলষ্টয় পর্য্যন্ত সাহিত্যিকেরা নিজ নিজ যুগের প্রতিচ্ছবি দেখাইয়াছেন। রুশের বুর্জ্জোয়া সমাজ প্রতিষ্ঠিত হইবার আগেই বিপ্লবের দ্বারা প্রলেটারিয়েট সমাজ সংগঠিত হয়। এই জন্য তথায় আমরা একটা যথার্থ বুর্জ্জোয়া সমাজের সন্ধান পাই না। আবার ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত রুশ-বৈপ্লবিক সাহিত্যিকদের লেখার মধ্যে রুশীয় বৈপ্লবিক আন্দোলনের স্তরের সংবাদ আমরা পাই। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে December বিপ্লবের সাহিত্য ডষ্টয়েভস্কি হইতে আরম্ভ করিয়া আধুনিক রুশের প্রলেটারিয়ান সাহিত্যিকদের লেখার মধ্যে সমাজের এই স্তরের কার্য্যের সংবাদ আমরা পাই।
ভারতীয় সাহিত্যকে এই চাবিকাটীর দ্বারা উদ্ঘাটন করিলে আমরা তদ্রূপ ফলই প্রাপ্ত হই। ভারতীয় সাহিত্যে ইহার কোন ব্যতিক্রম হয় না। এ বিষয়ে বিশদভাবে অন্যত্র আলোচিত হইয়াছে। সংস্কৃত সাহিত্যে Heroic যুগ থেকে সামন্ততন্ত্রীয় সমাজের নিদর্শন পাওয়া যায়। অবশ্য ভারতবর্ষে আজ পর্য্যন্ত একটা যথার্থ বুর্জ্জোয়া সমাজ এখনও অভিব্যক্ত হয় নাই। এই জন্য সংস্কৃত সাহিত্যে তাহার নিদর্শন নাই। তবে কথা আসে বাংলা সাহিত্যে কি পাই? বাংলার সমাজ যে ভাবে অভিব্যক্ত হইতেছে সাহিত্যেও তাহার প্রতিচ্ছবি পড়িতেছে। বাংলা সাহিত্য কিছু আগে পর্যন্তও সংস্কৃত সাহিত্যের পোঁ ধরিয়া চলিয়াছিল; এই জন্যেই আমরা রবীবাবু পর্য্যন্ত সাহিত্যের মধ্যে রাজারাণী, জমিদার, বরকন্দাজ প্রভৃতির সংবাদ পাই। যদিচ খাস বাংলা সমাজে রাজারাণীর দরবার, সেপাই শাস্ত্রী প্রভৃতির পাট অনেকদিন আগেই উঠিয়া গিয়াছে। বাংলার সমাজ আজ পর্যন্ত সামন্ততান্ত্রিক ভিত্তির উপর দণ্ডায়মান আছে, এই জন্যেই পুরাতনের মোহ সম্পূর্ণ কাটাইয়া উঠিতে পারে নি। কিন্তু উপস্থিত যুগের আলেখ্য হালের কোন কোন সাহিত্যিকের মধ্যে দিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে। আজ একটা মধ্যবিত্তীয় সমাজ ভারতের সর্ব্বত্র গড়িয়া উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং এই জন্যে তাহার আভাসও কোন কোন সাহিত্যিকের লেখার মধ্যে পাওয়া যাইতেছে। অন্যপক্ষে ভারতীয় সমাজশরীর মধ্যে একটী শ্রমিক শ্রেণী গড়িয়া উঠিয়াছে। সেই জন্য তাহারও কিঞ্চিৎ সংবাদ আমরা বাংলা ও হিন্দী সাহিত্যে পাইতেছি।
সাহিত্যের এই যৎকিঞ্চিৎ সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করিয়া আমরা আমাদের প্রশ্নে আসি। আমাদের জ্ঞাতব্য এই যে, সাহিত্যে প্রগতি কাহাকে বলে অর্থাৎ প্রগতিশীল সাহিত্য কথার মানে কি? আমরা উপরোক্ত সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দ্বারা এই তথ্যে উপনীত হই যে, রাষ্ট্রে যে সামাজিক শ্রেণীর প্রভাব থাকে জাতীয় জীবনের সংস্কৃতির সর্ব্ব বিষয়ে যেমন সেই শ্রেণীর ছাপ অঙ্কিত হয়, সাহিত্যেও তেমন তাহা পরিলক্ষিত হয়, অর্থাৎ যে শ্রেণী সমাজে স্বীয় প্রভাব বিস্তার করে সাহিত্যে সেই শ্রেণীরই দৃষ্টি ভঙ্গীর (World view) পরিচয় পাওয়া যায়। যে শ্রেণী রাষ্ট্রশক্তি পরিচালিত করে সেই শ্রেণী নিজের দৃষ্টি ভঙ্গী অনুযায়ী সমাজকে পরিচালিত করে। সেই জন্য তাহারই পরিচয় সেই শ্রেণীর সাহিত্যিকদের মধ্যে দিয়া পরিস্ফুট হইয়া ওঠে। সামন্ততান্ত্রিক যুগের সাহিত্যের মধ্যে যেমন আমরা রাজারাণীর ব্যাপার, ব্যারণদের বীরত্বের খবর ও তাহাদের প্রেমের সংবাদ পাই, বুর্জ্জোয়া সমাজের সাহিত্যিকদের মধ্যে তদ্রূপ সেই শ্রেণীর মনস্তত্ত্ব ও জীবনের কার্য্যের প্রতিচ্ছবি দেখিতে পাই। যেমন ফ্রান্সের চারণ রোঁলা তৎকালীন রাজনৈতিক আদর্শের বিষয় বলিয়াছেন প্রজার কর্ত্তব্য হইতেছে তার ভূস্বামীর জন্যে লড়াই করা। আর এই কথার প্রতিধ্বনি আমরা গীতা থেকে আরম্ভ করিয়া রাজপুতনার চারণদের মুখ থেকে “স্বামিধর্ম্ম” আদর্শের কথায় পাই। কিন্তু আবার ইউরোপীয় আধুনিক বুর্জ্জোয়া সমাজে democracy আদর্শের কথা শুনি এবং ভারতে যে বুর্জোয়া সমাজ উদ্ভূত হইতেছে তাহার মুখে সেই democracy প্রতিধ্বনিত হইতে শুনিতে পাইতেছি।
আজ ভারতীয় সমাজে, গীতা, দ্বিতীয় অধ্যায়ের আদর্শ বা হলদিঘাটের “ঝালা স্বামিধর্ম্ম ভোলে না” এই উক্তির প্রতিধ্বনি শুনিতে পাওয়া যায় না। অপরপক্ষে আজ ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজ বলিতেছে “ডেমোক্রেসি চাই, কনষ্টিটুয়েণ্ট এসেম্বলী চাই।” আবার পাশ্চাত্য দেশীয় proletariat শ্রেণী যেমন সাম্যের উপর সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্যে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে ভারতের প্রলেটারীয় শ্রেণী তেমনি গণতন্ত্র চাই, সাম্য চাই বলিয়া ধ্বনি তুলিয়াছে। ইহার অর্থ প্রত্যেক শ্রেণী নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে জগতকে দেখে এবং জগতকে তদনুযাদী গঠিত করিতে চায়। এই কারণ বশতঃ এই সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণকারীগণ বলিল যেমন সমাজ ধাপে ধাপে অগ্রসর হইতেছে তেমনি তাহার সাহিত্যও ধাপে ধাপে প্রগতিশীল হইতেছে। যেমন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে বুর্জ্জোয়া সমাজ অধিকতর সভ্যতাসম্পন্ন তজ্জন্য অগ্রগমনশীল, তদ্রূপ সামন্ততান্ত্রিক সাহিত্য থেকে বুর্জ্জোয়া সাহিত্য অধিকতর প্রগতিশীল। আবার ধনতান্ত্রিক বুর্জ্জোয়া সমাজ থেকে গণতান্ত্রিক সাম্যবাদীয় সমাজকে অধিকতর অগ্রগমনশীল বলা হয়, তদ্রূপ শেষোক্ত সমাজের সাহিত্যকে অধিকতর প্রগতিশীল বলা হয়। প্রগতি একটী আপেক্ষিক জিনিস। যেমন বর্ব্বর অপেক্ষা সামন্ততান্ত্রিক যুগ অধিকতর সভ্যতাসম্পন্ন তদ্রূপ তাহার সাহিত্যকেও অধিকতর প্রগতিশীল বলা যায়। আবার যে সাহিত্যের মধ্যে সভ্যতার পূর্ব্বাবস্থা থেকে অধিকতর অগ্রগমনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়, তুলনা দ্বারা তাহাকে আপেক্ষিক প্রগতিশীল মনোভাবের বলা হয়; এই জন্যই যে সাহিত্যে সভ্যতার ও প্রগতির নিদর্শন পাওয়া যায় তাহাকেই আপেক্ষিক ভাবে “প্রগতিশীল” বলা যায়। এই কারণ বশতঃ যে সাহিত্যমধ্যে সমাজের অগ্রগমনশীলতার দ্যোতনা অর্থাৎ অধিকতর উন্নত অবস্থার দিকে গমনের আকাঙ্খা বা স্পৃহার পরিচয় পাওয়া যায় তাহাকেই প্রগতিশীল সাহিত্য বলিয়া ধার্য্য করা হয়। যে সাহিত্য সমাজের অচলায়তন ভাঙ্গিয়া উন্নত অবস্থার দিকে পথ নির্দ্দেশ করিয়া দেয় সেই চেষ্টাকেই প্রগতি সাহিত্য বলা হয়।
এক্ষণে শেষকথা এই, সনাতনীরা যে বলেন রস ও রূপ নিয়াই সাহিত্য এই জন্যে তাহা একটি অখণ্ড বস্তু, কিন্তু উপরে আমরা বিশ্লেষণ করিয়া দেখিয়াছি যে সমাজে যেমন যেমন বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শ্রেণীর আধিপত্যের ছাপ অঙ্কিত হইতে দেখা যায়, সংস্কৃতিতেও সেই ছাপ সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। তজ্জন্য রস ও রূপ বিভিন্ন যুগে আপেক্ষিকভাবে প্রকাশ পায়। ইহার অর্থ, প্রত্যেক যুগের সাহিত্যই রস ও রূপ নিয়া সংগঠিত হয় বটে, কিন্তু সেই রস ও রূপ বিভিন্ন শ্রেণীর ছাপ বহন করে। যাঁহারা Art for Art’s sake বলেন তাঁহারা একটা অসঙ্গত ও অবৈজ্ঞানিক কথার উল্লেখ করেন। এমন কি প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জ্জোয়া সমাজতাত্ত্বিক সোরোকিন বিশদভাবে দেখাইয়াছেন যে ইহা একটা অর্থশূন্য উক্তিমাত্র। রস ও রূপ অর্থাৎ Art প্রত্যেক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গির সহিত বিজড়িত। যেমন মধ্যযুগীয় বা সামন্ততান্ত্রিক সাহিত্যের মধ্যে যে রস ও রূপ পাওয়া যায় তাহা বুর্জ্জোয়া সাহিত্যের রস ও রূপ হইতে পৃথক। যেমন ফ্রান্সের সামন্ততান্ত্রীয় ক্রবাদুরদের সাহিত্যের রস ও রূপ থেকে আনাতোল ফ্রান্সের লিখিত সাহিত্যের রস ও রূপ সম্পূর্ণ পৃথক, যেমন বৈদিক যুগের সাহিত্যের, তৎপরে ক্লাসিকাল যুগের এবং বর্ত্তমানের ভারতীয়দের মধ্যে রূপ ও রসের ধারণাও সম্পূর্ণ বিভিন্ন। পুনঃ, শ্রেণীসমূহেরও রূপ এবং রস বোধ বিভিন্ন প্রকারের!