সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/চতুর্থ অঙ্ক/প্রথম গর্ভাঙ্ক

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ অঙ্ক

প্রথম গর্ভাঙ্ক

পলাশী—ইংরাজ-শিবিরের পার্শ্ব

ক্লাইব, কিল্‌প্যাট্রিক ও কুট

কিলপ্যাট্রিক। The enemy arrayed in overwhelming number; we have taken a daring step Colonel.
ক্লাইব। We will beat them.
কুট। Atleast we will die like Englishmen.
ক্লাইব। Go,—lead the boys under cover of the mangoegrove. The Frenchmen are deadly shots.
ক্লাইব ব্যতীত সকলের প্রস্থান

আমির বেগের প্রবেশ

ক্লাইব। তোম লোক হামাদিগের সহিত এরূপ দুশ্‌মনি করিবে, হামি জানি না। হামি এখনি নবাবের তাঁবুতে যাইয়া, সব হাল বলিব, মীরজাফরের letter দেখাইব। হামরা যুদ্ধ করিব না, নবাবের সহিত peace করিব! যদি নবাব হামাদিগকে মারে, তোমাদিগেও বধ করিবে।
আমির। কেন সাহেব, এরূপ কথা বল্‌ছেন কেন?
ক্লাইব। কেন? জঙ্গলকা মাপিক ফৌজ লইয়া নবাব আসিয়াছে মীরজাফর আপনি ফৌজ চালাইতেছে,—Semicircle করিয়া ফৌজ দাঁড়াইয়াছে। হামার ফৌজ এক একজন বিশজনকে মারিয়া মরিলে, হামার ফৌজ সব নষ্ট হইবে, তবু নবাবী ফৌজ আধা কমিবে না।
আমির। সাহেব, কোন চিন্তা করবেন না। কয়জন মাত্র ফরাসী সৈন্য ল’য়ে, ফরাসী সেনাপতি সিনফ্রেঁ আপনাদের সহিত যুদ্ধ কর্‌বে, আর যুদ্ধ ক’র্‌বে মোহনলাল—মীরমদন,—আর কোন সৈন্য আপনাদের বিরুদ্ধে একটা গুলিও ছুড়বে না, আপনি নিশ্চিন্ত হ’য়ে আক্রমণ করুন। আপনাকে তো মীরজাফর খাঁ পত্র লিখেছিলেন, যে পলাশীর ক্ষেত্রে সৈন্য সামন্তের বামে বা দক্ষিণে, তিনি অবস্থান কর্‌বেন।
ক্লাইব। হামি শুনিল, নবাব কাঁদাকাটি করিয়াছিল, মীরজাফর কোরাণ ছুঁইয়া oath নিয়াছে, যে সে নবাবের পক্ষ হইয়া লড়িবে;—কাজও সেইরূপ দেখিতেছি।
আমির। আপনি যা শুনেছেন, তা সত্য। কিন্তু তিনি নবাবের সহিত মৌখিক সদ্ভাব করেছেন সেরূপ না ক’র্‌লে নবাবের হাতে নিস্তার পেতেন না। আপনাদের সহিত সন্ধিমত তিনি কার্য্য করিবেন।
ক্লাইব। হামি বুঝিতে পারিতেছি না, কোন কথাটী সত্য! কোরাণ ছুঁইয়া শপথ করিয়াছে, আমাদের পক্ষ হইয়া যুদ্ধ করিবে, ফের নবাবের সামনে কোরাণ ছুইঁল! হামি কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।

জহরার প্রবেশ

জহরা। কি সাহেব, তুমি কি বুঝতে পাচ্ছ না? তোমার কি বোধ হয়, মীরজাফর রাজ্যলোভ পরিত্যাগ করবে? বাঙ্গলা-বিহার-উড়িষ্যার গদী পায়ে ঠেলে, নবাবের পক্ষে যুদ্ধ কর্‌বে? তোমাদের ধর্ম্মপুস্তকে কি বলে? যদি রাজ্যলোভ দিয়ে, সয়তান মানুষকে নরকস্থ না ক’রতে পারে, তবে সে সয়তান সয়তান নয়! তুমি কি বুঝতে পাচ্ছ না, যে সয়তান মীরজাফরের হৃদয় সম্পূর্ণ অধিকার করেছে? উন্নতির আশা, প্রভুত্বের আশা, রাজ্য আশা,—কিরূপ বলবান, তা কি তুমি জান না? তবে কেন তুমি জন্মভূমি পরিত্যাগ ক’রে, আত্মীয় বন্ধু পরিত্যাগ ক’রে, বিশাল সমুদ্র পার হ’য়ে ভারতবর্ষে উপস্থিত হয়েছ? কি সাহসে, তুমি রাত্রে নবাবের বিপুল সৈন্য, ছ’শো জাহাজী সৈন্য ল’য়ে আক্রমণ করেছিলে?
ক্লাইব। বিবি, তোমার কথায় হামার বিস্‌ওয়াস্ আছে;—তুমি কি ঠিক বুঝিয়াছ, মীরজাফর নবাবের পক্ষ হইয়া হামাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবে না? নবাব মুসলমান, মীরজাফর মুসলমান, নবাবের কাঁদাকাটিতে মন নরম হইতে পারে। রায়দুর্লভ, ইয়ারলতিফ, এরা সবভি এক দেশের আদমী, নবাব সকলের কাছে কাঁদাকাটি করিয়াছে, সবাই দেখিতেছি—যেমন লড়াই করিতে খাড়া হয়, তেমনি খাড়া হইয়াছে। তুমি কি ঠিক বুঝিয়াছ নবাবী পক্ষ লড়াই করিবে না? দেখ—হামি ভয় পাইয়া এ সব কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি না, লড়াই করিতে আসিয়াছি, লড়াই করিব। তোমায় পুছ করিতেছি; কি নিমিত্ত শোনো,—যদি উহারা আমাদের দুশ্‌মন হয়, আগে আমি উহাদের আক্রমণ করিব। হামরা মরিব, উহাদিগেরও মারিব। দেখাইব আমাদের সহিত দুশমনি করিয়া কেহ বাঁচিবে না। তুমি কি বুঝিয়াছ, যে উহারা আপনার দেশোয়ালি লোক ছাড়িয়া আমাদের পক্ষ হইয়াছে?
জহরা। সাহেব, তুমি এতদিন বাঙ্গলায় আছো, আজও কি বাঙ্গালীর চরিত্র অবগত হও নাই? তোমার কি মনে হয়, কারো হৃদয়ে স্বদেশ-অনুরাগ আছে, তোমার কি মনে হয় কারো হৃদয়ে জাতীয়তা আছে, তোমার কি মনে হয় মাতৃভূমির ভালমন্দ কেউ চিন্তা করে? না! যদি বাঙ্গলার হিন্দু-মুসলমানের কিছুমাত্র হৃদয় থাক্‌তো স্বদেশের উপর যদি তাদের কিছুমাত্র স্নেহ থাক্‌তো, যদি স্বদেশের উন্নতির প্রতি কিছুমাত্র দৃষ্টি থাকতো, তা’হলে কি পরস্পর পরস্পরের প্রতি দ্বেষাদ্বেষ করে? তুমি কি এখনো বোঝো নি, যে যারা যারা তোমাদের সহায় হয়েছে, তাদের সকলের এক স্বার্থ নয়,—বিশ্বাসঘাতক, ষড়যন্ত্রকারীরা এক স্বার্থে চালিত নয়, তা কি বুঝতে পারো নি? সেনানায়ক বিশ্বাসঘাতক ইয়ারলতিফও পত্র লিখেছিল,—“নবাবী আমায় দাও,” মীরজাফরও পত্র লিখেছে,—“নবাবী আমায় দাও;” রাজবল্লভ স্বয়ং রাজা হ’তে চায়, ঘসেটী বেগমের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে তা সম্পূর্ণ প্রকাশ পেয়েছে;—রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ, মাণিকচাঁদ,—সকলেরই মনোগত কিসে রাজ্য করগত হবে! রাজ্য করগত করা, রাজ্যের মঙ্গলার্থে নয়, দুর্দ্দান্ত নবাবকে দমন কর্‌বার জন্য নয়, প্রজার শান্তির জন্য নয়, স্বর্গের জন্য! যদি না স্বার্থপর হ’তো, তুমি সকলের চক্ষে ধূলি দিয়ে, প্রতারিত ক’র্‌তে পার্‌তে না। সাহেব, তোমাদের স্বার্থ একরূপ,—পরস্পর স্বার্থের জন্য বিবাদ করে,—কিন্তু ইংরাজ-শত্রুর বিরুদ্ধে সকলে মিলে ভ্রাতৃভাবে অস্ত্র ধারণ করো। সে স্বার্থ বাঙ্গলার হিন্দু-মুসলমানের নয়; অতি হীন স্বার্থ, সেই হীন স্বার্থের আবরণে সকলে অন্ধ হয়েছে,—তোমার কৌশলে নয়। যদি নিজ নিজ স্বার্থে এরূপ অন্ধ না হতো, তাহ’লে বুঝতো, সে দূরদেশ হ’তে ছ’মাস সমুদ্রে ভেসে, নিজ স্বার্থ নিমিত্ত এসেছ, তাদের স্বার্থের জন্য নয়। যুদ্ধে প্রাণ দিয়ে তাদের গদী দিতে এসো নাই, আপনার প্রভুত্বের জন্যে এসেছ। সকলেই বুদ্ধিমান, কিন্তু স্বার্থ এরূপ বলবান্, যে তোমাদের স্বরূপ মনোভাব কেউ বুঝতে সক্ষম হয় নি।
ক্লাইব। তবে তুমি কিরূপে বুঝিলে?
জহরা। আমার দিব্য চক্ষু প্রস্ফুটিত; পতিপ্রেম আমার স্বার্থ, আত্মসুখ স্বার্থ নয়! আমি পতি-পুত্রহীনা, আমার দেশের মায়া কি,—জাতীয়তা কি? আমার একমাত্র হোসেন কুলীর স্মৃতি! সেই স্মৃতি আমায় সহস্র দানবীয় বল দিয়েছে। যে দিন নবাব-শোণিতে হোসেন কুলির প্রেতাত্মার তৃপ্তি করবো, সেই দিন থেকে—আমি যে রমণী সেই রমণী,—পতিশোকাতুরা রমণী, পতির কবরের পার্শ্বে অনন্ত শয্যায় শয়ন কর্‌বো!
ক্লাইব। তোমার কি মনে হয়—হামরা যুদ্ধ জিতিব? মীরমদন, মোহনলাল, সিনফ্রেঁ,—উহাদিগের সৈন্য একত্রিত করিলে, হামাদিগের যুদ্ধ সঙ্গিণ।
জহরা। সাহেব, যদি সকল সৈন্য একত্র হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তথাপি জেনো তোমাদের জয়। (আকাশে বজ্রধ্বনি) ঐ শোনো, গগনমার্গে বজ্রনাদে বিধাতা বল্‌চে তোমাদের জয়! সাহেব, আমার দিব্যচক্ষু প্রস্ফুটিত, বিধি-লিপি আমার সম্পূর্ণ গোচর। ঈশ্বর দীননাথ, তিনি দীনের দুঃখ সহ্য করেন না। ভারতবর্ষে, দীন প্রজা দিবারাত্র হাহাকার করছে, ভারতবর্ষ শান্তিহীন। হিন্দুর দৌরাত্ম্যে যখন প্রজা পীড়িত হয়, ভগবান ভারতবর্ষ আফগানদের প্রদান করলেন; আফগানদের দৌরাত্ম্যে, প্রজা পীড়িত হওয়ায়, মোগলেরা শান্তিস্থাপন করলে। এখন মোগলেরা অত্যাচারী, মারহাট্টা অত্যাচারী,—দিন দিন যুদ্ধ বিগ্রহ, প্রজার শান্তি নাই, সেই শান্তি স্থাপনের ভার, ঈশ্বর তোমাদের উপর প্রদান কচ্ছেন; আবার তোম্‌রাও যদি অত্যাচারী হও, তোম্‌রাও রাজ্যচ্যুত হবে। তোমার অল্প সৈন্য, এই তোমার সন্দেহ? যুদ্ধক্ষেত্রে দেখবে,—প্রত্যেক সেনা, কোটী সৈন্যের বল ধারণ করবে! ঐ তোপধ্বনি হচ্ছে, বোধ হয় ফরাসীরা তোমাদের আক্রমণ কচ্ছে। আমি যাই, নবার-শিবিরে আমায় যেতে হবে। সেখানে আমার অনেক কাজ, নবাব-দূত হ’য়ে, নবাব-সৈন্য বিশৃঙ্খল কর্‌বো।
ক্লাইব। বিবি, তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে বেড়াইবে? তুমি গোলাগুলি ভয় ক'রো না!
জহরা। দেখেছো তো, নিশা-যুদ্ধে তোমাদের পথ দেখিয়ে ল’য়ে গিয়েছিলেম। কোয়াশার আবরণে দিক্ নির্ণয় কর্‌তে পারো নাই, তাই নবাব হস্তগত হয় নাই। গোলাগুলি! এমন গোলাগুলি তোমাদের সৈন্যের নিকট নাই, নবাব সৈন্যের নিকট নাই, যে আমাকে আঘাত করবে। ঐ যে—ঐ যে হোসেন শোণিত-পানের জন্য হা-হা কচ্ছে,—আমার মৃত্যুর অবকাশ কোথায়?
জহরার প্রস্থান
ক্লাইব। (স্বগত) The Bellona herself! Oh the battle rages hot.
ক্লাইবের প্রস্থান
আমির। এ কি, ভীষণ দেওয়ানা! হোসেনের প্রতি এর এত ভালবাসা! হোসেন তো ঘসেটী আর আমিনাবেগমকে নিয়েই ছিলো, এর প্রতি তো ফিরেও চাইতো না। যাই, নদীর ধার দিয়ে ঘুরে মীরজাফরকে সংবাদ দিইগে।
প্রস্থান