সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/দ্বিতীয় অঙ্ক/তৃতীয় গর্ভাঙ্ক

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় গর্ভাঙ্ক

মুর্শিদাবাদ—নবাব-অন্তঃপুরস্থ সজ্জিত উদ্যান

লুৎফউন্নিসা

গীত

উপবনে এসো নিশা সেজে এসো মনের মতন।
শিখ্‌বো সতি, নিশাপতির যতন তুমি করো কেমন॥
প’রে রতন কুসুম গাঁথা, সাজো বিলাসিনী লতা,
তরুবরে সোহাগ ক’রে, সোহাগ সখি শিখাও মোরে,
ভুবনে সুষমারাজি, উপবনে এসো আজি,
আস্‌বে হেতায় ভুবনমোহন রমণী-রঞ্জন,
সাধ হ’য়েছে পূজ্‌বো শ্রীচরণ॥

ঘসেটী বেগমের প্রবেশ
ঘসেটী। এ কি। আজ সমস্ত নগর রণজয়-উৎসব ক’রছে, রাজপুরে উৎসব, তুমি একপার্শ্বে এই ক্ষুদ্র উপবনে কেন?
লুৎফ। শ্রেষ্ঠিপ্রবর মহাতাবচাঁদ, নবাবের অভ্যর্থনার জন্য, উপবন সজ্জিত করেছেন। আমিও মা আজ নবাবের অভ্যর্থনার জন্য আমার স্বহস্ত-রোপিত উপবন কেমন সজ্জিত ক’রেছি দেখুন। মাসী মা, আজ আমি নবাব প্রত্যাগমন ক’রলে, বিশ্রাম-গৃহে যেতে দেব না, আমি এইখানে তাঁরে অভ্যর্থনা ক’র্‌বো। দেখুন কোথায় কি ত্রুটি আছে বলুন?
ঘসেটী। নবাবের আসন তো রেখেছ, পার্শ্বে তোমার আসন কই?
লুৎফ। আমি নবাবের প্রজা, আমি নবাবের পার্শ্বে বস্‌বো কেন? আমার উপবনে নবাব নিমন্ত্রিত, আমি নবাবকে পূজা ক’র্‌বো আমার আসন তাঁর পদতলে। আপনি আসন গ্রহণ করুন, যদি পূজার ত্রুটি হয় ব’লে দেবেন। মাসীমা দেখুন—এই উপবন রাজ্যের আদর্শ স্বরূপ। এই দেখুন, এই কণ্টকপূর্ণ বৃক্ষ, সকতজঙ্গের অনুরূপ,—তার উপর নবাবের যশোপুষ্প বিকশিত, সৌরভে দেশ আমোদিত ক’চ্ছে। এই দেখুন, পুষ্পিত বৃক্ষ সকল কুসুমভারে অবনত, বিনীত ভাবে নবাবকে রাজভক্তি প্রদান ক’রবে। এই দেখুন, শেফালিকাদ্বয় দ্বারপালের ন্যায় দণ্ডায়মান—ভক্তি-কুসুম উপহার দিয়ে রাজদর্শকবৃন্দকে শিক্ষা প্রদান ক’র্‌বে। এই দেখুন, উদ্যান-কণ্টক সকন স্বহস্তে নির্ম্মূল ক’রে লতাবন্ধন ক’রে রেখেছি। নবাবের কণ্টক, নবাবের শত্রু, এইরূপ বন্ধনদশায় উচ্ছেদ হ’য়ে রাজ্যের এক পার্শ্বে পতিত থাক্‌বে। যে সকল তরুলতা অনিয়মে শাখা প্রসারণ করেছিলো, সে সকল শাখা ছেদন করেছি;—দেখুন, বিনয়ীর ন্যায় তারা অবস্থান ক’র্‌ছে। বোধ হয়, আমার রাজ-অতিথি আগত। বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতি! আমার হৃদয়-আসনের আদর্শ স্বরূপ এই পুষ্পিত আসন গ্রহণ করুন, বাঁদীকে পদসেবার অধিকার দেন।
এ কি খোজা! নবাব কোথায়?

খোজার প্রবেশ

খোজা। বেগম সাহেব নবাববাহাদুর এই পত্র প্রেরণ করেছেন
লুৎফ
(পত্র পাঠ)
“প্রিয়ে,

ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে আলাপের অবসর হবে। বিধাতা বিমুখ, তোমার বিমল প্রেমাম্বাদ আমার অদৃষ্টে নাই। আমি কলিকাতায় ইংরাজ-বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করিলাম। শঠ আমাত্যগণ ষড়যন্ত্র ক’রে ইংরাজ-সৈন্য বাঙ্গ্‌লায় উপস্থিত করেছে, তাদের দমন নিতান্ত প্রয়োজন। যেরূপ বিপদতরঙ্গ উত্থিত, যেরূপ সংহার-মেঘ উদয়, যেরূপ বিপ্লব-পবনের আড়ম্বর,—ভগবানের বিশেষ অনুগ্রহ ব্যতীত নিস্তার লাভ করা অসম্ভব। যদি ঈশ্বরকৃপায় বিপদমুক্ত হ’তে পারি দেখা হবে, নচেৎ পত্রে বিদায় গ্রহণ করিলাম।

তোমার চিরানুরাগী সিরাজ”।

(খোজার প্রতি) তুমি যাও; তুমি চিরদিন নবাবের অগ্রগামী, হায়! আজ এই কুসংবাদ কেন নিয়ে এলে?

খোজার অভিবাদন পূর্ব্বক প্রস্থান
জগদীশ্বর! ভেবেছিলেম, আমার এই উপবন, সুন্দর নবাবরাজ্যের অনুরূপ। কিন্তু না, এ কপট অনুরূপ,—আমি স্বহস্তে নষ্ট কর্‌বো। এ কপট-পুষ্পে আসন সজ্জিত—দূর হোক! কপট গোলাপ, ছিন্ন হও! কণ্টক তরু, তোমরা তো আবদ্ধ নও, দৃশ্যে মলিন কিন্তু সম্পূর্ণ সতেজ, রবি-তাপে শীর্ণ হও!
সজ্জিত উপবন ভঙ্গ করণ
ঘসেটী। কি—কি? বৎসে, সহসা এমন উদ্বিগ্না হ’লে কেন?
লুৎফ। মাগো, এই দেখুন, ইংরাজ আবার সজ্জিত। নবাব যুদ্ধ যাত্রা করেছেন।
ঘসেটী। সে কি? তবে কি ভবিষ্যৎ গণনা সত্য?
লুৎফ। কি কি, কি গণনা মা?
ঘসেটী। বৎসে, আমি সিরাজের যুদ্ধজয়-বার্ত্তা শ্রবণ ক’রে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ প্রদান কর্‌ছি, দরিদ্রকে ধনরত্ন বিতরণ করবার নিমিত্ত বাঁদীদিগকে উপদেশ দিচ্ছে—এমন সময় জনৈক বাঁদী, এক ফকিরণীকে আমার নিকট ল’য়ে এলো। সে ফকিরণী আমায় তিরস্কার করে বললে—“কিসের উৎসব? মাদ্রাজ হ’তে ইংরাজ শত্রু আগত,—তা জান? বিনা দোষে নবাব, একজন ঈশ্বরজানিত ফকিরের কর্ণ-নাসিকা চ্ছেদ করেছে, তা কি অবগত নও? ফকিরের অভিশাপে অচিরে রাজ্য দগ্ধ হবে! যদি মঙ্গল প্রার্থনা থাকে, সেই ফকিরকে প্রসন্ন করো।’ বৎসে, এই ফকিরের কর্ণনাসিকাচ্ছেদন সংবাদ তুমি কিছু জানো?
লুৎফ। হ্যাঁ—হ্যাঁ—শুনেছিলেম, রাজাদেশে একজন ভণ্ড ফকিরের কর্ণনাসিকাচ্ছেদ হয়েছিল। সে ফকির রাজদ্রোহী।
ঘসেটী। বৎসে, ফকির ভণ্ড নয়, তিনি নবাবের মঙ্গলের জন্য এসেছিলেন। নবাব যখন যুবরাজ ছিলেন, দিল্লী হ’তে ফৈজী নাম্নী এক পরমাসুন্দরী বারবিলাসিনীকে এনে বেগম করেন। বারনারী, স্বভাব বশতঃই প্রতারণাপরায়ণা;—তার শয়ন-গৃহে অপর পুরুষকে ল’য়ে এসেছিল। সেই অপরাধে নবাব, যৌবনসুলভ ক্রোধ বশতঃ ফৈজির গৃহের বায়ু-প্রবেশের সকল দ্বার রুদ্ধ ক’রে, উৎকট যন্ত্রণায় তার প্রাণবধ করে। সেই মহা পাপের প্রায়শ্চিত্ত জন্য ফকির আগমন করেছিলেন। রাজ্যের শত্রুরা, হায়, অভাগা রাজ্য শত্রুপূর্ণ! রাজ্যের শত্রুরা, সেই সাধুর প্রতি এই রাজদ্রোহিতা অপবাদ প্রদান করে। সাধুর কোপাগ্নি যা’তে প্রজ্জ্বলিত হয়, এই তাদের ইচ্ছা দেখ্‌ছি, শত্রুর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে!
লুৎফ। মা, মা, সত্য বলেছেন; নবাব কখনো কখনো অর্দ্ধনিদ্রিত অবস্থায়, ফৈজির নাম ক’রে অনুতাপ করেন। এখন কিরূপে ফকিরকে প্রসন্ন করা যায়?
ঘসেটী। ফকিরণী আমায় বলেছে—“তাঁকে নিমন্ত্রিত ক’রে সম্মানের সহিত রাজপুরে এনে, তাঁর চরণে অনুনয়-বিনয় করা, আর উপায় নাই।” কিন্তু সিরাজ যুদ্ধে গমন করেছে, কি উপায় হবে?
লুৎফ। কেন, আমরা যদি নিমন্ত্রণ করি?
ঘসেটী। না—সিরাজের আহ্বান ব্যতীত ফকির—নগরে পদার্পণ কর্‌বেন না।
লুৎফ। তবে কি উপায় হবে?
ঘসেটী। নেই, এক উপায় বোধ হয় হ’তে পারে। যদি সিরাজের নামাঙ্কিত মোহর পাওয়া যায়, সেই মোহর-অঙ্কিত পত্র তাঁর নিকট প্রেরিত হ’লে, কিরূপ হয় বলা যায় না। কিন্তু সে মোহরই বা কিরূপে পাওয়া যাবে! সে মোহর পাওয়া গেলে, তাঁকে নিমন্ত্রিত ক’রে আন্‌তে পারা যায়। কিন্তু সে উপায় তো নাই!
লুৎফ। মা, আমার গৃহে তাঁর নামাঙ্কিত মোহর থাকে। তিনি আমার গৃহে অনেক পত্র মোহরাঙ্কিত করেন।
ঘসেটী। তবে একখানা কাগজ, আমায় মোহরাঙ্কিত ক’রে দেবে চলো। (স্বগত) কোথায় মোহর থাকে সন্ধান পেলে, আমি অপহরণ করবো। (প্রকাশ্যে) চলো।
লুৎফ। নবাব-মহিষীকে একথা বলি?
ঘসেটী। ইচ্ছা হয় বলো;—কিন্তু ফকিরণী বলেছে, দেবকার্য্য গোপনেই উচিত। আমার বিবেচনায় এখন গোপন রাখা কর্ত্তব্য। যদি কৃপা ক’রে ফকির উপস্থিত হন, তখন মা, আমিনা, তুমি, আমি—সকলেই তাঁর শরণাপন্ন হবো। সেই সময় মা জান্‌তে পার্‌বেন।
উভয়ের প্রস্থান