সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/দ্বিতীয় অঙ্ক/প্রথম গর্ভাঙ্ক

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রথম গর্ভাঙ্ক

মুর্শিদাবাদ—জগৎশেঠের বাগানবাড়ী

মীরজাফর, জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ, রায়দুর্লভ প্রভৃতি

রায়দুঃ। শ্রেষ্ঠিবর, স্বর্গে নন্দনকাননের কথা পুস্তকে বর্ণনা আছে, আপনার এই উপবনের শোভা যে তদপেক্ষা কিছু কম, এ আমার ধারণা হয় না। নবাবের অভ্যর্থনার এরূপ আয়োজন, বোধ হয় এ পর্য্যন্ত কাহারও দ্বারা হয় নাই।
জগৎ। রাজা স্নেহচক্ষে আমার সকল কার্য্যই উত্তম দেখেন।
রায়দুঃ। না না, আমি স্বরূপই বলছি—এই মীরজাফর সাহেবকে জিজ্ঞাসা করুন।
মীরজাঃ। স্বরূপ শেঠজি।
জগৎ। বান্দার প্রতি আপনার অনুগ্রহও তো লোকপ্রসিদ্ধ।
স্বরূপ। সকতজঙ্গের যুদ্ধের পর নবাবের যেন সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তন হয়েছে;—বিনয়ী, নম্র, সকলকে যথাযোগ্য উচ্চ সম্মানে সম্মানিত করেছেন।
জগৎ। যেন বৃদ্ধ আলিবর্দ্দী যৌবন লাভ ক’রে, প্রত্যাবর্তন করেছেন।
রায়দুঃ। কিন্তু কুমন্ত্রীর পরামর্শে, আবার কখন কি মূর্ত্তি ধারণ করেন, কিছু বলা যায় না। বরং মীরমদন ভাল, আপনার সৈন্য পরিচালনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু মোহনলালের দৌরাত্ম্য অতি অসহ্য হ’য়ে উঠেছে।
রাজবঃ। এখন আবার সে সকতজঙ্গকে পরাজয় করেছে আর অহঙ্কারে তার পা ভূতলে পড়ে না! শুন্‌তে পাই, পুরাতন কর্ম্মচারীদিগকে বরখাস্ত ক’রে, আপনার আত্মীয়-স্বজনকে এনে তাদের কার্য্যে নিযুক্ত কচ্ছে।
রায়দুঃ। নবাবের নিকট পূর্ণিয়ার অধিকার পেয়ে, সেখানেও ঐরূপ দুর্ব্যবহার করেছে। মাননীয় গোলাম হোসেন খাঁ বাহাদুরকে বলেছে কি জানেন, দুই শত টাকা বেতনে যদি কার্য্য করো, থাকো, নচেৎ চ’লে যাও।
রাজবঃ। তাইতো ভাবছি, তার কুমন্ত্রণায় পাছে নবাব আবার পূর্ব্ববৎ হন।
জগৎ। আজকের দিন ও সব কথা থাক্। নবাব আস্‌ছেন।
নবাবকে অভিবাদন করিয়া আনিবার নিমিত্ত সকলের প্রস্থান
নেপথ্যে নকিব ফুকরান। নবাব মন্‌সুরোল্ মোলক সিরাজদ্দৌলা সাহকুলিখাঁ মীরজা মোহম্মদ হায়বৎজঙ্গ বাহাদুর—

বন্দীগণের প্রবেশ ও গীত

গগনে শশধর তারকা মাঝে।
ভূপতি সমাজে সিরাজ রাজে—
ধু ধু ধু জয়ভেরী বাজে॥
অরিবল চুর্ণ, দুর্জ্জন ক্ষুণ্ন,
স্থল-জল-গগন আমোদপূর্ণ,
মোদিনী উপবন মোহিনা সাজে॥
গৌরব সৌরভ, উথলে বিজয় রব,
মহানন্দ মেলা, মহান্ উৎসব,
বীরবৃন্দ পূজে বীরেন্দ্র রাজে॥

মীরজাফর, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, মহাতাবচাঁদ ও স্বরপচাঁদ, রাজবল্লভ প্রভৃতির সহিত সিরাজেদ্দৌলার প্রবেশ

সকলে। জগদীশ্বর নবাব বাহাদুরের মঙ্গল করুন।
জগৎ। জনাব, বান্দা যে এই উচ্চ সম্মান লাভ কর্‌বে, বাঙ্গলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব যে আজ বান্দার অতিথি হবেন, বান্দা এ কখন স্বপ্নেও চিন্তা করে নাই। এ সম্মান কল্পনাতীত।
সিরাজ। শ্রেষ্ঠিবর, আজ আর আমি নবাব নই! মাতামহের হস্ত ধারণ ক’রে যে বালক আপনাদের নিকট উপস্থিত হতো, যে আপনাদের পুত্রের ন্যায় স্নেহের পাত্র ছিল, আজ আমি আপনাদের সেই বালক।
মীরজাঃ। জনাব, তখনো জনাব নবাব ছিলেন, এখনো নবাব। তখনো যে হৃদয়ের রাজভক্তি জনাবকে অর্পণ কর্‌তেম, সেই রাজভক্তিতে এখনো হৃদয় পরিপূর্ণ।
সিরাজ। হ্যাঁ, এই বিষম সঙ্কটে তা সম্পূর্ণ প্রদর্শিত হয়েছে। সকতজঙ্গের বিদ্রোহ আমরা সামান্য ব’লে উপেক্ষা কর্‌তেম, কিন্তু যুদ্ধস্থলে উপস্থিত হ’য়ে সম্পূর্ণ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, যে সকতজঙ্গের কর্ম্মচারীরা সকলেই সুদক্ষ ছিল। সেনানায়কেরা—বিশেষতঃ শ্যামসুন্দর, লালুহাজরা প্রভৃতি—অতিশয় রণবিশারদ ছিল। বঙ্গীয় অমাত্যগণ, যদ্যপি না সম্পূর্ণ উৎসাহ সহকারে তাদের আক্রমণ কর্‌তেন, যদি অদ্ভুত বীরবীর্য্য না প্রকাশ কর্‌তেন, যদি সিংহাসন রক্ষার্থে না প্রাণপণ কর্‌তেন, সকতজঙ্গ নিশ্চয় মুর্শিদাবাদের আসন বিচলিত কর্‌তো।
রায়দুঃ। ন্যায়বান ঈশ্বর, ওরূপ অকর্ম্মণ্য মদ্যপায়ীকে কখন রাজাসন প্রদান করেন না। আমাদের যুদ্ধ-কৌশল অপেক্ষা সকতজঙ্গের দুর্ব্বুদ্ধিই তার পতনের প্রধান কারণ। শোনা যায়, যুদ্ধের সময় বারাঙ্গনা-বেষ্টিত হ’য়ে মদ্যপানে নিযুক্ত ছিলো।
সিরাজ। হে অমাত্যগণ, আমরা কিরূপে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর্‌বো; আপনাদের কার্য্যের যোগ্য পুরস্কার আমাদের নিকট নাই। কিন্তু আমরা আপনাদের স্নেহের উপর নির্ভর ক’রে শত অনুরোধ করবো, যেরূপ স্নেহ-চক্ষে দেখ্‌ছেন সেইরূপ স্নেহ-চক্ষেই দেখ্‌বেন—শত অপরাধ গ্রহণ কর্‌বেন না। বাল্যাবধি আপনাদেরই আদরে, আমাদের চিত্ত দমন করা শিক্ষা হয়নি, তার দায়িত্ব আপনাদেরই। যদি কখনো কখনো আমরা উগ্রতা প্রকাশ করি, সে আপনাদের মার্জ্জনীয় নিশ্চয়।
জগৎ। জনাব, বান্দার হৃদয় আজ আনন্দে পরিপ্লুত। অমাত্যবর্গ পরিবেষ্টিত হ’য়ে নবাব আজ আমাদের অতিথি। এ উচ্চ সম্মানে আজ আমি সম্মানিত।
মীরজাঃ। যুদ্ধজয় উৎসবে যে নবাব স্বয়ং উপস্থিত হ’য়ে আমাদের আনন্দ বর্দ্ধন করবেন, এ আমাদের সামান্য সম্মান নয়। আমি অমাত্যবর্গের মুখপাত্র হ’য়ে নবাবের নিকট সকলের হৃদয় ভাব প্রকাশ কচ্ছি।

মীরমদনের প্রবেশ

মীরমঃ। জনাব, সংবাদ অতি জরুরি, এই নিমিত্ত বান্দা এই আনন্দ-উৎসবের ব্যাঘাত ক’রে, হুজুরে উপস্থিত হ’তে বাধ্য হয়েছে, মার্জ্জনা আজ্ঞা হয়।
সিরাজ। কি সংবাদ? তোমার মুখভাবে অতি উৎকট সংবাদ ব্যক্ত হচ্ছে।
মীরমঃ। নচেৎ ক্রীতদাস আনন্দের বিঘ্ন কর্‌তে সাহসী হতো না। কলিকাতা হ’তে ইংরাজের এই পত্র উপস্থিত হয়েছে। অনুমতি হয় পাঠ করি।
সিরাজ। পাঠ করো—
মীরমঃ। নিজামৎ মন্‌সুরোল মোলক—
সিরাজ। ইংরাজের কি বক্তব্য পাঠ করো।
মীরমঃ।
(পত্র পাঠ)
“ইতিপূর্ব্বে আমরা নবাব-দরবারে পত্র প্রেরণ করি। মীরজাফর খাঁ বাহাদুরের নিকট, নবাব সরকারে পেশ করিবার নিমিত্ত সেই পত্র প্রেরিত হয়। পত্রের মর্ম্ম,—যে গভর্নর ড্রেকের অপরাধ মার্জ্জনা হয় ও আমরা কলিকাতায় কুঠি পুনঃস্থাপিত কর্‌বার আজ্ঞা প্রাপ্ত হই। আমরা দুই লক্ষ মুদ্রা দিতে প্রস্তুত। সে পত্রের উত্তর নবাব-দরবার হতে না পাওয়ায়, আমরা বাদসাহের নিকট যে অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছি, সেই অধিকার স্থাপনের নিমিত্ত অগ্রসর হইলাম। ইহাতে নবাব বাধা প্রদান করেন, দুঃখের বিষয় বটে—রাজ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ বড় অমঙ্গলের কারণ, কিন্তু আমরা নিরস্ত থাকিব না। ভরসা করি—”
সিরাজ। থাক্, মর্ম্মতো এই।
মীরমঃ। হ্যাঁ জনাব!
সিরাজ। পত্র কার স্বাক্ষরিত?
মীরমঃ। সাবৎজঙ্গ। ইনি কর্ণেল ক্লাইব, দাক্ষিণাত্যে নিজাম সেলাবৎজঙ্গের নিকট এই উপাধি প্রাপ্ত হন।
সিরাজ। (মীরজাফরের প্রতি) খাঁ বাহাদুর, এরূপ পত্রের তো কোন সংবাদ আমাদের নিকট নাই?
মীরজাঃ। জনাব, এ পত্রের বিষয় বান্দাও কিছু অবগত নয়।
সিরাজ। শেঠজি, রাজা রায়দুর্লভ, রাজা রাজবল্লভ, আপনারা কিছু অবগত আছেন?
সকলে। না জনাব!
সিরাজ। এই পত্রের মর্ম্মে প্রতীত হচ্ছে, যে বিতাড়িত ইংরাজ, কলিকাতা পুনরধিকার করবার নিমিত্ত প্রস্তুত। এখন ইংরাজ কোথায় তা কি কেউ অবগত আছেন? সকলেই নীরব! বুঝ্‌লেম না!—আমরা অযোগ্য কর্ম্মচারীবেষ্টিত নই। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই, যে রাজ্যের পরম শত্রু ইংরাজ, কোথায় কি অবস্থায় অবস্থিত, এ সংবাদ কোন অমাত্যেরই গোচর নয়! কলিকাতা হ’তে বিতাড়িত হ’য়ে ইংরাজ যখন সাতিশয় দুরবস্থায় বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত, তাহাদের প্রতি নবাবের অনুকম্পা হয়—এ সকল আবেদন, আমাদের নিকট অমাত্যবর্গ করেন; আমরাও তাঁদের আবেদন সম্পূর্ণ গ্রাহ্য করেছিলাম। ইংরাজের দুঃখের অবস্থা সকলে অবগত ছিলেন, কিন্তু এক্ষণে যে তারা যুদ্ধার্থে প্রস্তুত, এ কথা কারো গোচর হয় নাই! মোহনলাল নির্ব্বাচিত কতকগুলি নূতন কর্ম্মচারীর নিকট এ আভাস আমরা কতক প্রাপ্ত হই বটে, কিন্তু যখন প্রধান কর্ম্মচারীগণ এ সকলের কোন উল্লেখ করেন নাই, আমরা সেই নূতন কর্ম্মচারীদের ভ্রম বিবেচনায় সে সংবাদ উপেক্ষা করেছি। কিন্তু এখন প্রকাশ পাচ্ছে যে আমাদেরই ভ্রম! পূর্ণিয়ার বন্দোবস্তের নিমিত্ত যদি মোহনলাল নিযুক্ত না থাক্‌তো, বোধ হয় আনুপূর্ব্বিক সমস্ত সংবাদ আমাদের অগোচর থাকতো না!

দূতের প্রবেশ

দূত। রাজা মাণিকচাঁদ, নবাব-দর্শন আশায় অপেক্ষা কচ্ছেন।
সিরাজ। তাঁরে সত্বর আস্তে বল।
সেলাম করিয়া দূতের প্রস্থান
ইনি বোধ হয় আরও অদ্ভুত সংবাদ ল’য়ে উপস্থিত হয়েছেন।

মানিকচাঁদের প্রবেশ

কি সংবাদ বিনা আড়ম্বরে প্রকাশ করুন।
মাণিক। জনাব, কর্ণেল ক্লাইব কলিকাতা অধিকার করেছেন।
সিরাজ। তিন সহস্র শিক্ষিত সেনা রাজা মাণিকচাঁদের আজ্ঞাবর্ত্তী ছিল, কত সৈন্য ল’য়ে ইংরাজ তাদের বিমুখ করেছে? আর ইংরাজ যখন বাঙ্গলায় পদার্পণ করেছিল, সে সংবাদ রাজা মাণিকচাঁদের পাওয়া উচিত ছিল। যদি বহু সৈন্যে সজ্জিত হ’য়ে ইংরাজ উপস্থিত হ’য়ে থাকে, এ সংবাদ প্রেরিত হ’লে, নবাব-সৈন্যের অভাব নাই, সে সৈন্য রাজা মাণিকচাঁদের সাহায্যে প্রেরিত হতো। এখন ইংরাজ মুর্শিদাবাদ অভিমুখে আগমন করতে প্রস্তুত কিনা, যদি আপনি অবগত হ’য়ে থাকেন, অনুগ্রহ পূর্ব্বক প্রকাশ করুন।
মাণিক। জনাব, কলিকাতা-যুদ্ধে বিমুখ হবার পরই, নবাব-সমীপে সত্বর উপস্থিত হয়েছি। ইংরাজ মুর্শিদাবাদ আস্‌বার কল্পনা করবে এ কখনো সম্ভব নয়।
সিরাজ। সম্ভব অসম্ভব বিচার-ভার আপনার উপর অর্পিত নয়, স্বরূপ অবস্থা কি জ্ঞাপন করুন।
মাণিক। জনাব, হুগলি বন্দর আক্রমিত হবে, কোন দূতের নিকট সংবাদ পেলেম। সত্য-মিথ্যা নিরূপণ কর্‌বার নিমিত্ত অপেক্ষা করি নাই।
সিরাজ। ইতিপূর্ব্বে আপনারা অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিলেন যে সকতজঙ্গের ন্যায় অর্ব্বাচীনকে ভগবান কখনো সিংহাসন প্রদান করেন না। এক্ষণে আমাদের ধারণা হচ্ছে, যে আমাদের ন্যায় অকর্ম্মণ্য সিংহাসনে বহুদিন স্থান পায় না। মীরমদন, এসো।
সিরাজদ্দৌলা ও মীরমদনের প্রস্থান, মীরজাফর ব্যতীত অন্যান্য সকলের অনুগমন
মীরজাঃ। সর্ব্বনাশ উপস্থিত; নবাব নিশ্চয় আমার বিশেষ অনিষ্টের নিমিত্ত কৃতসঙ্কল্প হবে! মীরমদন প্রভৃতির কুমন্ত্রণায় বুঝিবা প্রাণবধের আদেশ দেবে! আমি এই রাত্রেই মুর্শিদাবাদ পরিত্যাগ ক’রে ইংরাজের শরণাপন্ন হই, নচেৎ আর নিস্তারের উপায় নাই।

জহরার প্রবেশ

জহরা। বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতি, চিন্তার কারণ কি? আপনার সুদিন আগত, এ সময় বিমর্ষ কেন?
মীরজাঃ। তুমি কে? কি বলছ? বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতি ব’লে কাকে অভিবাদন কচ্ছ?
জহরা। মীরজাফর খাঁ, আমার নিকট মনোভাব গোপন ক’রো না, আমায় শত্রু জ্ঞান ক’রো না, তোমার রাজ্য-লিপ্সা অচিরে পূর্ণ হবে। তোমার বলবান সহায় উপস্থিত,—তোমার কার্য্যে রাজকোষ অপেক্ষা ধনপূর্ণ ভাণ্ডার উদ্ঘাটিত হবে।
মীরজাঃ। তুমি কি বল্‌চ? তুমি কে?
জহরা। আমি সয়তানি,—আমার সয়তানি-দৃষ্টিতে ভূত-ভবিষ্যৎ অবগত। তোমার হৃদয়ের সয়তানের প্রতিমূর্তি, তোমার সম্মুখে প্রদর্শন কর্‌বার নিমিত্ত উপস্থিত হয়েছি, তুমি আমায় শত্রু জ্ঞান ক’রো না। তোমার যত অর্থ প্রয়োজন, আমি তোমায় দেব। অর্থলোভী ইংরাজের সহিত মিলিত হও। কার্য্যোদ্ধার করো। আমার কথা মিথ্যা নয়;—তার প্রমাণ স্বরূপ এই হীরকখণ্ড গ্রহণ করো। বাজা রাজবল্লভের সহিত পরামর্শ কর্‌লে জান্‌তে পারবে—এই হীরকখণ্ড কার। এ বহুমূল্য বুঝ্‌তে পেরেছ কি? স্বকার্য্য সাধনে যত্নবান হও।
জহরার প্রস্থান
মীরজাঃ। কে এ? একি ঘসেটি বেগমের সহচরী! সয়তানি বলে পরিচয় দিলে,—যথার্থই সয়তানি। আমার হৃদয়ের সুপ্ত সয়তান জাগরিত করেছে। আলিবর্দ্দীর সময়ে আমার বিদ্রোহ সফল হ’লে, এ বাঙ্গলার গদী আমারই হতো। বাঁদীর কথায় রাজ্য লিপ্সা আবার উত্তেজিত। অমাত্যেরা সকলেই সিরাজের বিরূপ; কিন্তু আমার আশা কি পোষণ কর্‌বে? সকলেরই রাজ্যলিপ্সা, কিন্তু তাদের রাজ্যে অধিকার কি? আমারই প্রকৃত অধিকার হওয়া উচিত। কৌশলে সকলের মনোভাব বুঝে দেখি, সিরাজের প্রতি সকলই বিরূপ। ওঃ—এ রাজ্য-আশা কি সফল হবে!
রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ, রাজবল্লভ, মাণিকচাঁদ প্রভৃতির প্রবেশ
নবাব কি বল্লেন?
জগৎ। কিছু না,—নিঃশব্দে হস্তী-পৃষ্ঠে আরোহণ ক’রে রাজপুরী অভিমুখে গমন করলেন!
মীরজাঃ। আমরা সে পত্র গোপন ক’রে ভাল করি নাই। এখন নবাবের কিরূপ আজ্ঞা হবে কে জানে! একে তো আমাদের সকলের উপর সন্দেহ, পত্র গোপন করায় সে সন্দেহ দৃঢ়ীভূত হয়েছে। অপর দণ্ড না হোক, বিশেষ অপমানিত হতে হবে নিশ্চয়।
জগৎ। আমাদের তো পত্র গোপন কর্‌বার ইচ্ছা ছিল না। ইংরাজের পত্র যদি নবাবকে দেওয়া হতো, তাহলেও নবাব ক্রুদ্ধ হ’তেন, ভাব্‌তেন আমাদের ষড়যন্ত্রে এরূপ পত্র লিখেছে। বিশেষ ইংরাজ এত শীঘ্র কলিকাতা আক্রমণ কর্‌তে সাহস কর্‌বে, এরূপ আমাদের দ্বারা অনুমিত হয় নাই।
মাণিক। ইংরাজ অতি উদ্যমশীল,—বোধ হয় পত্রের উত্তর আস্‌বার অপেক্ষাও করে নাই। এরূপ গোপনে কার্য্য করেছিল, যে যখন সসৈন্যে ক্লাইব বজ্‌বজের নিকট উপস্থিত হলো, তখন সংবাদ পেলেম। গণনায় তিন সহস্র সৈন্য আমার নিকট ছিল বটে, কিন্তু সকলেই অকর্ম্মণ্য; ইংরাজের সম্মুখীন হয়, এমন সৈন্য আমার ছিল না। ইংরাজের রণতরী অতি অদ্ভুত—চলৎ দুর্গ!—এই রণতরী বলেই ইংরাজ এত প্রতাপশালী।
রায়দুঃ। আমাদের ইংরাজের প্রশংসার সময় নয়। কি কর্ত্তব্য নির্দ্ধারিত করুন;—ক্রুদ্ধ নবাবকে কিরূপে শান্ত করা যায়!
মীরজাঃ। এই অর্ব্বাচীন সিরাজের পরিবর্ত্তে যদি রাজা রায়দুর্লভ বা আপনাদের মধ্যে অপর কেউ গদী প্রাপ্ত হ’তেন, রাজ্য নিরাপদ হ’তো। মহাভয়ে দিন যামিনী অতিবাহিত করতে হ’তো না।
জগৎ। সত্য।
রায়দুঃ। মহারাজ স্বরূপ আজ্ঞা করেছেন। খাঁ সাহেবের অপেক্ষা গদীর উপযুক্ত আর কে আছে?
মীরজাঃ। কি বলেন—কি বলেন!—
জগৎ। এ মন্ত্রণার উপযুক্ত স্থান নয়। মহারাজ রায়দুর্লভ, সময় নির্দ্ধারিত করুন। আপনার আবাসে, কি কর্ত্তব্য গোপনে, আমরা পরামর্শ কর্‌বো। আজ আমাদের আর একত্রে থাকবার প্রয়োজন নাই। স্বরূপ বলেছেন—স্বরূপ বলেছেন—খাঁ সাহেবের গদী হ’লে রাজ্য সুখের হয়।
সকলের প্রস্থান