সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/ইস্কুলের গল্প/দাশুর খ্যাপামি

উইকিসংকলন থেকে
দাশুর খ্যাপামি

 স্কুলের ছুটির দিন। স্কুলের পরেই ছাত্রসমিতির অধিবেশন হবে। তাতে ছেলেরা মিলে অভিনয় করবে। দাশুর ভারি ইচ্ছা ছিল সেও একটা কিছু অভিনয় করে। একে ওকে দিয়ে সে অনেক সুপারিশও করিয়েছিল, কিন্তু আমরা সবাই কোমর বেঁধে বললাম, ‘সে কিছুতেই হবে না।’

 সেই তো গতবার যখন আমাদের অভিনয় হয়েছিল, তাতে দাশু সেনাপতি সেজেছিল। সেবারে সে অভিনয়টা একেবারে মাটি করে দিয়েছিল। যখন ত্রিচূড়ের গুপ্তচর সেনাপতির সঙ্গে ঝগড়া করে তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে বলল, “সাহস থাকিলে তবে খোল তলোয়ার।” দাশুর তখন, “তবে আয়, সম্মুখ সমরে”—বলে তখনি তলোয়ার খুলবার কথা। কিন্তু দাশুটা অনাড়ির মতো টানাটানি করতে গিয়ে তলোয়ার তো খুলতে পারলই না, মাঝে থেকে ঘাবড়ে গিয়ে কথাগুলোও বলতে ভুলে গেল। তাই দেখে গুপ্তচর আবার, “খোলো তলোয়ার!” বলে হুংকার দিয়ে উঠল। দাশুটা এমনি বোকা, সে অমনি, “দাঁড়া, দেখছিস না বকলস আটকিয়ে গেছে” বলে চেঁচিয়ে তাকে এক ধমক দিয়ে উঠল। ভাগ্যিস আমি তাড়াতাড়ি তলোয়ারটা খুলে দিলাম, তা না হলে ঐখানেই অভিনয় বন্ধ হয়ে যেত। তার পর শেষের দিকে রাজা যখন জিজ্ঞাসা করলেন, “কিবা চাহ পুরস্কার, কহ সেনাপতি,” তখন দাশুর বলবার কথা ছিল, “নিত্যকাল থাকে যেন রাজপদে মতি”, কিন্তু দাশুটা তা না বলে, তার পরের আরেকটা লাইন আরম্ভ করেই, হঠাৎ জিভ কেটে, “ঐ যাঃ। ভুলে গেছিলাম” বলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। আমি কটমট করে তাকাতে, সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক লাইনটা আরম্ভ করল।

 তাই এবারে তার নাম হতেই আমরা জোর করে বলে উঠলাম, “না, সে কিছুতেই হবে না।” বিশু বলল, “দাশু একটিং করবে? তা হলেই চিত্তির।” ট্যাঁপা বলল, তার চাইতে ভজু মালিকে ডেকে আনলেই হয়।” দাশু বেচারা প্রথম খুব মিনতি করল, তার পর চটে উঠল, তার পর কেমন মুষড়ে গিয়ে মুখ হাঁড়ি করে বসে রইল। যে কদিন আমাদের তালিম চলছিল, দাশু রোজ এসে চুপটি করে হলের এক কোনায় বসে বসে আমাদের অভিনয় শুনত। ছুটির কয়েকদিন আগে থেকে দেখি, ফোর্থ ক্লাশের ছোটো গণ্‌শার সঙ্গে দাশুর ভারি ভাব হয়ে গেছে। গণ্‌শা ছেলেমানুষ, কিন্তু সে চমৎকার আবৃত্তি করতে পারে—তাই তাকে দেবদূতের পার্ট দেওয়া হয়েছে। দাশু রোজ তাকে নানারকম খাবার এনে খাওয়ায়, রঙিন পেনসিল আর ছবির বই এনে দেয়, আর বলে যে ছুটির দিন তাকে একটা ফুটবল কিনে দেবে। হঠাৎ গণ্‌শার উপর দাশুর এতখানি টান হবার কোনো কারণ আমরা বুঝতে পারলাম না। কেবল দেখতে পেলাম, গণ্‌শাটা খেলনা আর খাবার পেয়ে ভুলে ‘দাশুদা’র একজন পরম ভক্ত হয়ে উঠতে লাগল।

 ছুটির দিনে আমরা যখন অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, তখন আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারা গেল। আড়াইটা বাজতে না বাজতে দেখা গেল, দাশুভায়া সাজঘরে ঢুকে পোশাক পরতে আরম্ভ করেছে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, “কি রে? তুই এখানে কি করছিস?” দাশু বলল, “বাঃ, পোশাক পরব না?” আমি বললাম, “পোশাক পরবি কি রে? তুই তো আর একটিং করবি না।” দাশু বলল, “বাঃ, খুব তো খবর রাখ। আজকে দেবদূত সাজবে কে জান না?” শুনে হঠাৎ আমাদের মনে কেমন একটা খটকা লাগল, আমি বললাম, “কেন, গণ্‌শার কি হল?” দাশু বলল, “কি হয়েছে, তা গণ্‌শাকে জিজ্ঞেস করলেই পার।” তখন চেয়ে দেখি, সবাই এসেছে, কেবল গণ্‌শাই আসে নি। অমনি রামপদ, বিশু আর আমি, ছুটে বেরাম গণ্‌শার খোঁজে।

 সারাটি স্কুল খুজে, শেষটায় টিফিন ঘরের পিছনে হতভাগাকে খুঁজে পাওয়া গেল। সে আমাদের দেখেই পালাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমরা তাকে চটপট প্রেপ্তার করে টেনে নিয়ে চললাম। গণ্‌শা কাঁদতে লাগল, “না আমি কক্ষনো একটিং করব না, তা হলে দাশুদা আমায় ফুটবল দেবে না। আমরা তবু তাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় অঙ্কের মাস্টার হরিবাবু সেখানে এসে উপস্থিত। তিনি আমাদের দেখেই ভয়ংকর লাল চোখ করে ধমক দিয়ে উঠলেন, “তিন-তিনটে ধাড়ি ছেলে মিলে ঐ কচি ছেলেটার পেছনে লেগেছিস? তোদের লজ্জাও করে না?” বলেই আমাকে আর বিশুকে একেকটি চড় মেরে আর রামপদর কান মলে দিয়ে হন্‌হন্ করে চলে গেলেন। এই সুযোগে হাতছাড়া হয়ে গশচন্দ্র আবার চম্পট দিল। আমরাও অপমানটা হজম করে ফিরে এলাম। এসে দেখি, দাশুর সঙ্গে রাখালের মহা ঝগড়া লেগে গেছে। রাখাল বলছে, “তোকে আজ কিছুতেই দেবদূত সাজতে দেওয়া হবে না।” দাশু বলছে, “বেশ তো, তা হলে আর কেউ দেবদূত সাজুক, আমি রাজা কিংবা মন্ত্রী সাজি। পাঁচ-ছটা পার্ট আমার মুখস্থ হয়ে আছে। এমন সময়ে আমরা এসে খবর দিলাম যে, গণশাকে কিছুতেই রাজী করানো গেল না। তখন অনেক তর্কবিতর্ক আর ঝগড়াঝাটির পর স্থির হল যে, দাশুকে আর ঘাঠিয়ে দরকার নেই, তাকেই দেবদূত সাজতে দেওয়া হোক। শুনে দাশু খুব খুশি হল আর আমাদের শাসিয়ে রাখল যে, “আবার যদি তোরা কেউ গোলমাল করিস, তা হলে কিন্তু গতবারের মতো সব ভণ্ডুল করে দেব।”

 তার পর অভিনয় আরম্ভ হল! প্রথম দৃশ্যে দাশু বিশেষ কিছু গোলমাল করে নি, খালি স্টেজের সামনে একবার পানের পিক ফেলেছিল। কিন্তু তৃতীয় দৃশ্যে এসে সে একটু বাড়াবাড়ি আরম্ভ করল। এক জায়গায় তার খালি বাবার কথা, “দেবতা বিমুখ হলে মানুষে কি পারে?” কিন্তু সে এই কথাটুকুর আগে কোথেকে আরো চার-পাঁচ লাইন জুড়ে দিল। আমি তাই নিয়ে আপত্তি করেছিলাম, কিন্তু দাশু বলল, “তোমরা যে লম্বা-লম্বা বক্তৃতা কর সে বেলা দোষ হয় না, আমি দুটো কথা বেশি বললেই যত দোষ!” এও সহ্য করা যেত, কিন্তু শেষ দৃশ্যের সময় তার মোটেও আসবার কথা নয়, তা জেনেও সে স্টেজে আসবার জন্য জেদ ধরে বসল। আমরা অনেক কষ্টে, অনেক তোয়াজ করে, তাকে বুঝিয়ে দিলাম যে, শেষ দৃশ্যে দেবদূত আসতেই পারে না, কারণ তার আগের দৃশ্যেই আছে যে দেবদূত বিদায় নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। শেষ দৃশ্যেও আছে যে মন্ত্রী রাজাকে সংবাদ দিচ্ছেন যে দেবদূত মহারাজকে আশীর্বাদ করে স্বর্গপুরী প্রস্থান করেছেন। দাশু অগত্যা তার জেদ ছাড়ল বটে, কিন্তু বেশ বোঝা গেল সে মনে মনে একটুও খুশি হয় নি।

 শেষ দৃশ্যের অভিনয় আরম্ভ হল। প্রথম খানিকটা অভিনয়ের পর মন্ত্রী এসে সভায় হাজির হলেন। এ কথা সে কথার পর তিনি রাজাকে সংবাদ দিলেন, “বারবার মহারাজে আশিস করিয়া, দেবদূত গেল চলি স্বর্গ অভিমুখে।” বলতেই হঠাৎ কোখেকে, “আবার সে এসেছে ফিরিয়া” বলে একগাল হাসতে হাসতে দাশু একেবারে সামনে এসে উপস্থিত। হঠাৎ এরকম বাধা পেয়ে মন্ত্রী তার বক্তৃতার খেই হারিয়ে ফেলল, আমরাও সকলে কিরকম যেন ঘাবড়িয়ে গেলাম—অভিনয় হঠাৎ বন্ধ হবার জোগাড় হয়ে এল। তাই দেখে দাশু খুব সর্দারি করে মন্ত্রীকে বলল, “বলে যাও কি বলিতেছিলে।” তাতে মন্ত্রী আরো কেমন ঘাবড়িয়ে গেল। রাখাল প্রতিহারী সেজেছিল, সে দাশুকে কি যেন বলবার জন্য যেই একটু এগিয়ে গেছে, অমনি দাশু, “চেয়েছিল জোর করে ঠেকাতে আমারে এই হতভাগা”-বলে এক চাটি মেরে তার মাথার পাগড়ি ফেলে দিল। ফেলে দিয়েই সে রাজার শেষ বক্তৃতাটা “এ রাজ্যেতে নাহি রবে হিংসা, অত্যাচার, নাহি রবে দারিদ্র্য যাতনা” ইত্যাদি—নিজেই গড়গড় করে বলে গিয়ে, “যাও সবে নিজ নিজ কাজে” বলে অভিনয় শেষ করে দিল। আমরা কি করব বুঝতে না পেরে সব বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। ওদিকে ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল আর ঝুপ করে পর্দা নেমে গেল।

 আমরা সব রেগেমেগে লাল হয়ে দাশুকে তেড়ে ধরে বললাম, “হতভাগা, দেখ দেখি সব মাটি করলি, অর্ধেক কথা বলাই হল না।” দাশু বলল, “বা তোমরা কেউ কিছু বলছ না দেখেই তো আমি তাড়াতাড়ি যা মনে ছিল সেইগুলো বলে দিলাম। তা না হলে তো আরো সব মাটি হয়ে যেত।” আমি বললাম, “তুই কেন মাঝখানে এসে সব গোল বাধিয়ে দিলি? তাই তো সব ঘুলিয়ে গেল।” দাশু বলল, “রাখাল কেন বলেছিল যে আমায় জোর করে অটিকিয়ে রাখবে? তা ছাড়া তোমরা কেন আমায় গোড়া থেকে নিতে চাচ্ছিলে না আর ঠাট্টা করছিলে? আর রামপদ কেন বারবার আমার দিকে কট্‌মট্ করে তাকাচ্ছিল?” রামপদ বলল, “ওকে ধরে ঘা দু-চার লাগিয়ে দে।”

 দাশু বলল, “লাগাও না, দেখবে আমি এক্ষনি চেঁচিয়ে সকলকে হাজির করি কি না!”

সন্দেশ—আশ্বিন, ১৩২৯