সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবনী/ফ্লরেন্স নাইটিঙ্গেল

উইকিসংকলন থেকে
ফ্লরেন্স নাইটিঙ্গেল

 এক চাষার এক কুকুর ছিল, তার নাম ক্যাপ। একদিন এক দুষ্ট লোকে পাথর ছুড়িয়া ক্যাপের একটি পা খোঁড়া করিয়া দিল। চাষা ভাবিল, ‘এই খোঁড়া কুকুর লইয়া আমি কি করিব? এ আর আমার কোনো কাজে লাগিবে না। শেষটায় কুকুর বেচারাকে মারিয়া ফেলাই ঠিক হইল। একটি ছোটো মেয়ে, তার নাম ফুরেন্স, সে এই কথা শুনিতে পাইয়া বলিল, “আহা মারবে কেন? আমায় দেও, আমি ওকে সারিয়ে দেব।” তার পর সে ক্যাপকে বাড়িতে লইয়া তার পায়ে পট্টি বাঁধিয়া, তাহাতে ঔষধ দিয়া, সেঁক দিয়া রীতিমতো শুশ্রষা করিয়া কয়েক দিনের মধ্যেই তাহার খোঁড়া পা সারাইয়া দিল। তখন' সেই চাষা বলিল, “ভাগ্যিস আপনি ছিলেন, তা নইলে আমার এমন কুকুরকে আমি মিছামিছি মেরে ফেলতাম।”

 কেবল এই একটি ঘটনা নয়, প্রায়ই এমন দেখা যাইত যে, মেয়েটি হয়তো বাগানে বেড়াইতেছে, আর কাঠবিড়ালিগুলা তাহার কাছ হইতে খাবার লইবার জন্য চারিদিক হইতে ছুটিয়া আসিতেছে। বাড়ির ঘোড়াটা পর্যন্ত তাঁহার গলার আওয়াজ শুনিলে, বেড়ার উপর দিয়া গলা বাড়াইয়া দেখিত। ফুরেন্স নাইটিঙ্গেল বড়োলোকের মেয়ে, তাঁহার পয়সাকড়ির ভাবনা ছিল না, কোনো অভাব ছিল না। তাহার বাবারও বড়ো ইচ্ছা, ছেলেমেয়েরা সকলে - খুব ভালো লেখাপড়া শেখে। সুতরাং অল্প বয়স হইতেই যে ফুরেন্সের মনে লেখাপড়ার ঝোক ছিল সেটা কিছু আশ্চর্য নয়। কিন্তু লোকে যে ঐ বয়স হইতেই তাঁহাকে ভালোবাসিত এবং শ্রদ্ধা করিত, সেটা তাঁহার লেখাপড়ার বাহাদুরির জন্য নয়—তার কারণ এই যে, তিনি যেমন মনপ্রাণ দিয়া সকলকে ভালোবাসিতেন, লোকের সেবা করিতে পারিতেন এবং লোকের সুখে সুখী, দুঃখে দুঃখী হইতে পাল্পিতেন, এমন আর কেহ পারিত না। আশেপাশে যেখানে যত গরিবের স্কুল আর হাসপাতাল ছিল, ফুরেন্স তাহার সবগুলির মধ্যেই থাকিতেন। সেই সময়ে ইংলণ্ডে কয়েদীদের অবস্থা বড়ো ভয়ানক ছিল। জেলখানাগুলি অত্যন্ত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর এবং তাহাদের বন্দোবস্ত এমন বিশ্রী যে, একবার যে জেলে ঢুকিয়াছে তাহার পক্ষে ভবিষ্যতে আবার ভালো হওয়া একরূপ অসম্ভব। মিসেস ফ্রাই নামে একজন ইংরাজ মহিলা এই কয়েদীদের উন্নতির জন্য নানারূপ চেষ্টা করিতেছিলেন—কিসে তাহারা আবার চাকরি পায়, কিসে তাহারা সমাজের কাছে ভালো ব্যবহার পায়, কিসে তাহাদের মধ্যে আবার সাধুভাব ফিরিয়া আসে, তিনি এই চিন্তাতেই সমস্ত সময় কাটাইতেন। ইহার সঙ্গে ফুরেন্সের আলাপ হওয়ায়, দুজনেরই উৎসাহ খুব বাড়িয়া গেল।

 ফুরেন্স বুঝিলেন যে ইংলণ্ডের হাসপাতালগুলির উন্নতি করিতে হইলে রোগীর সেবার জন্য বিশেষভাবে শিক্ষিত লোক চাই। সেবার কাজ মেয়েদের দ্বারাই খুব ভালোরকম হইবার কথা, সুতরাং তাহার মনে এই চিন্তা আসিল যে, একদল মেয়েকে রোগীর শুশ্রষা বিষয়ে ভালোরকম শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।

 সে সময়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে এ-বিষয়ে কিছু কিছু বন্দোবস্ত ছিল। সেখানে এমন সব শুশ্রষাকারিণীর দল ছিল, যাঁহারা আবশ্যকমতো রোগীর শুশ্রুষ ও যুদ্ধক্ষেত্রে আহতের সেবার জন্য সকল সময়ে প্রস্তুত থাকিতেন। ফ্রান্স দেশে Sisters of mercy নামে একদল সন্ন্যাসিনী বহুকাল হইতে অতি আশ্চর্যরূপে এই কাজ করিয়া আসিতে- ছিলেন। জার্মানিতেও শুশ্রষা-শিক্ষার ভালো বন্দোবস্ত ছিল। মিসেস ফ্রাইয়ের সঙ্গে ফুরেন্স পরামর্শ করিলেন, একবার ঐ-সকল দেশ ঘুরিয়া এই বিষয়ে কিছু শিক্ষা করিয়া আসি। যেমন কথা তেমনি কাজ। ফুরেন্স পরম উৎসাহে বিদেশে গিয়া এই শিক্ষায় লাগিয়া রহিলেন। সেখানে তাঁহার বুদ্ধি উৎসাহ ও সেবার আগ্রহ দেখিয়া, সকলেই অবাক হইয়া গেল। তিনি ছয় মাসের মধ্যে রীতিমত পরীক্ষা পাশ করিয়া এবং সকল বিষয়ে আশ্চর্য সফলতা দেখাইয়া দেশে ফিরিলেন; কিন্তু এত পরিশ্রমের ফলে তাঁহার শরীর এমন ভাঙিয়া পড়িল যে, তাহার কাজ আরম্ভ করিতে আরো বছরখানেক দেরি হইয়া গেল। সুস্থ হইয়াই তিনি চারিদিকে হাসপাতাল আতুরাশ্রম প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করিয়া দেশের মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন আনিয়া ফেলিলেন। তখন তাঁহার বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর।

 ইহার কিছুদিন পরেই ১৮৫৪ খৃস্টাব্দে রুশিয়ার সঙ্গে ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের লড়াই বাধিয়া গেল। ইংরাজের সে সময়ে যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত ছিল না। তাড়াতাড়ি কিছু সৈন্য সংগ্রহ করিয়া তাহাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হইল। তাহাদের চিকিৎসার জন্য বা আহতের সেবার জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করিবার সময় হইল না। ইহার ফল এই হইল যে, চারিদিকে অসম্ভবরকম বে-বন্দোবস্ত দেখা দিল। এমন-কি, রুগ্ন ও আহত সৈন্যগণ হাসপাতালে গিয়া, ঔষধপথ্য ও চিকিৎসার অভাবে দলে দলে মরিতে লাগিল। সময়ের অবস্থা এমন ভয়ানক হইয়াছিল যে, যুদ্ধে যত লোক মারা পড়ে তাহার সাতগুণ লোকে হাসপাতালে প্রাণ হারায়।

 এই-সকল কথা ইংলণ্ডে পৌছিলে পর লোকে শিহরিয়া উঠিল। “কি করা যায়, কিরূপে এ অবস্থা দূর হয় এই ভাবনায় সকলে অস্থির হইয়া পড়িল। তখন ইংলণ্ডের যুদ্ধমন্ত্রী নিজে ফুরেন্স নাইটিঙ্গেলকে লিখিলেন, “আপনি এই কাজের ভার লইতে পারেন কি?” এমন ডাক শুনিয়াও কি ফুরেন্স নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন? তিনি কিছুমাত্র সময় নষ্ট না করিয়া, চৌত্রিশ জন শুশ্রষাকারিণী (nurse) সঙ্গে যুদ্ধস্থানে চলিলেন। গুনিয়া দেশসুদ্ধ লোকে আশ্বস্ত হইয়া বলিল, “আর ভয় নাই।”

 ‘মিস নাইটিঙ্গেলের দল’ যুদ্ধক্ষেত্রে পৌছিয়া দেখিলেন কাজ বড়ো সহজ নয়। ছোট্টো একটি হাসপাতাল, তাহার মধ্যে চারহাজার লোক ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া শুইয়া আছে। অধিকাংশই জ্বর ও আমাশয়ে ভুগিতেছে—আহতের সংখ্যা খুবই কম। ঔষধের কোনো ব্যবস্থা নাই-পথ্যাপথ্যের বিচার নাই-যাহার ভাগ্যে যাহা জুটিতেছে সে তাহাই খাইতেছে। তার উপর হাসপাতালের বিছানাপত্র সমস্ত এমন ময়লা ও দুর্গন্ধ যে, সুস্থ লোকেও সেখানে অসুস্থ হইয়া পড়ে। শুশ্রষাকারিণীর দল প্রথমে নিজেরা হাসপাতাল ধুইয়া সাফ করিলেন। তার পর প্রত্যেকটি বিছানা মাদুর চাদর পরিষ্কার করিয়া কাচিলেন। কে কি খাইবে, কাহার কি ঔষধ চাই, এ-সমস্তের ব্যবস্থা করিলেন। মিস নাইটিঙ্গেল নিজে রান্নাঘরের সমস্ত গুছাইয়া পথ্যের বন্দোবস্ত করিলেন। দেখিতে দেখিতে হাসপাতালের চেহারা ফিরিয়া গেল। চারিদিক ঝরঝরে পরিষ্কার। ক্রমে হতাশ রোগীদের মুখে প্রফুল্লতা দেখা দিল—চারিদিকে সকলের উৎসাহ জাগিয়া উঠিল—সকলে বলিল, “মিস নাইটিঙ্গেল নিজে সব ভার লইয়াছেন, আর ভয় নাই।” যেখানে অর্ধেকের বেশি লোক বিনা চিকিৎসায় মরিতেছিল, সেখানে এখন শতকরা আটানব্বই জন প্রাণে বাঁচিয়া মিস নাইটিঙ্গেলের জয়জয়কার করিতে লাগিল। তাঁহার আর বিশ্রাম নাই, সকলের খবর লইতেছেন, সকলের কাছে কত কথা বলিতেছেন-কতজনকে প্রফুল্ল রাখিবার জন্য কত গল্প করিতেছেন-কতজন লিখিতে পারে না, তিনি তাহাদের চিঠি লিখিয়া দিতেছেন। সাধে কি তাহারা বলিত, “ফুরেন্স নাইটিঙ্গেল স্বর্গের দেবী, তাহার ছায়া লাগিলে মানুষ পবিত্র হয়।”

 তার পর যখন যুদ্ধ শেষ হইল, সকলে দেশে ফিরিল—তখন ফুরেন্স নাইটিঙ্গেলের সম্মানের জন্য বিপুল আয়োজন চলিতে লাগিল। তিনি সে-সমস্ত এড়াইয়া ভগ্ন শরীরে চুপচাপ লুকাইয়া দেশে ফিরিলেন। কিন্তু লোকে তাহা শুনিবে কেন? তাহারা তাহার জন্য মনুমেণ্ট তুলিয়া, লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা উঠাইয়া, তাঁহার নামে শুশ্রুষ-শিক্ষার আয়োজন করিয়া, তাহার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখাইয়াছে। রাজা প্রজা সকলে মিলিয়া তাহার কাছে মাথা নত করিয়াছে; দেশ-বিদেশ হইতে কতরকমের সম্মনি তাহার উপর ঢালিয়া দেওয়া হইয়াছে। স্বয়ং মহারানী ভিক্টোরিয়া বার বার তাহার প্রশংসা করিয়া বলিয়াছিলেন, “তুমি যে কাজ করিলে তাহার আর তুলনা হয় না।” ইহার পরেও মিস নাইটিঙ্গেল প্রায় পঞ্চাশ বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন এবং জীবনের শেষপর্যন্ত সর্বদাই অসংখ্য প্রকার সেবার কাজে আপনাকে নিযুক্ত রাখিয়াছিলেন। এখন এই যে ইউরোপের যুদ্ধে এত ‘রেডক্রস’ ‘এম্বুলেন্স' প্রভৃতির নাম শোন, আহতের সেবার জন্য এত চেষ্টা, এত আয়োজন দেখ, বলিতে গেলে এ-সমন্তেরই মূলে ফুরেন্স নাইটিঙ্গেল।

সন্দেশ-ভাদ্র, ১৩২৩