সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/উঁচু বাড়ি

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৫৯-১৬০)
উঁচু বাড়ি

 লোকে বলে—'মনুমেণ্টের মতো-উঁচু!' সেরকম উঁচু বাড়ি দেখলে আমরা বলি, 'ইস্! বড্ডো উঁচু বাড়ি। কিন্তু একটিবার আমেরিকায় ঘুরে এস, তার পরে সেই বাড়িই তোমার চোখে নিতান্তই ছোটো ঠেকবে। মনুমেণ্টের মাথায় অমন আরো দু-চারটা মনুমেণ্ট চাপাও তবে আমেরিকার লোকে বলবে, ‘হ্যাঁ, কতকটা উঁচু বটে!' নিউইয়র্কের একটি বাড়ি, পঞ্চান্ন তলা—সাড়ে সাতশো ফুট! একটা সাধারণ তিনতলা বাড়ি প্রায় চল্লিশ ফুট উচু—এইরকম উনিশটা বাড়ি একটার মাথায় আরেকটা চাপালে তবে সাড়ে সাতশো ফুট উচু হয়। আমেরিকার এক-একটা শহরে বিশতলা ত্রিশতলা চল্লিশতলা বাড়ির ছড়াছড়ি| ভাবতে গেলে আমাদের মাথা ঘুলিয়ে যায়।

 এক-একটি বাড়ি যেন এক-একটি শহর! তার মধ্যে কত অফিস কত দোকান কত হোটেল, গির্জা ইস্কুল থিয়েটার বায়স্কোপ ডাকঘর সভা-সমিতি। বাড়ির এক-এক জায়গায় সারি সারি খাঁচার মতো ঘর—তাতে চড়ে লোকে উঠছে নামছে, বিশ-পঁচিশতলা সিঁড়ি ভেঙে কষ্ট করে উঠতে হয় না। বাড়ির মধ্যে ত্রিশ হাজার লোক-সকলেই ব্যস্ত, চারিদিকে ছুটাছুটি অথচ কোনো গোলমাল নেই। বন্দোবস্ত এমন সুন্দর যে কিছু একটা দরকার হলে তার জন্য হাঁ করে বসে থাকতে হয় না বা বিশ মাইল দূরে ছুটতে হয় না। বাড়িতেই সবরকম দোকান- ঘরে বসে টেলিফোন কর, যা চাও দু মিনিটের মধ্যে ঘরে এসে হাজির!

 বাড়িতে ঢুকলে দেখবে শুধু যে মাথার উপরে এতখানি দালান আছে তা নয়—মাটির নীচেও দশ বিশতলা। সেখানে সূর্যের আলো যাবার উপায় নাই—সারাদিন আলো জেলে কাজ চলে। ঐ-সব নীচের তলাগুলোতে নানারকম কলকারখানা—ইলেকট্রিক কোম্পানির বড়োবড়ো চাকাওয়ালা কল, বাড়ি গরম রাখবার জন্য বড় বড় 'বয়লার’— বড়ো-বড়ো ছাপাখানা তাতে সকাল সন্ধ্যা খবরের কাগজ ছাপা হয়।

 কোনো কোনো রাস্তার দুধারে এইরকম দশ-বিশতলা বাড়ির সার চলেছে—তার ছায়ায় রাস্তা যেন অন্ধকার—সেখানে সূর্যের মুখ দেখা যায় না—আকাশ দেখতে হলে ঘাড় বাঁকিয়ে উপরে তাকাতে হয়। কিন্তু যারা একেবারে উপরে ত্রিশতলা বা চল্লিশতলায় থাকে তাদের আলো বাতাসের কোনো অভাব হয় না রাস্তার ধুলা শহরের কুয়াশা অত উচুতে পৌছায় না-কাজেই সেখানকার হাওয়া অতি পরিষ্কার। বাড়িগুলো দেখতে যেমন আশ্চর্য, এগুলি তৈয়ার করার কায়দাও তেমনি অদ্ভুত। বাড়ি তুলবার আগে প্রায় একশো-দেড়শো হাত গর্ত কেটে ভিত খুড়তে হয়। যেখানে বাড়ি হবে, তার চারদিকে খুব মজবুত আর খুব উঁচু ‘কপিকল’ বসায়। সেই কলে বড়ো-বড়ো লোহার থাম চাপিয়ে থামগুলাকে হিসাবমতো ঠিক ঠিক জায়গায় বসানো হয়। তার পর থামের গায়ে লোহার কড়ি বরগা বসিয়ে সেগুলোকে পেরেক স্ক্রু দিয়ে এঁটে দেয়। এমনি করে সমস্ত বাড়িটার একটা কঙ্কাল আগে খাড়া করা হয়। তার পর ঢালাই করা পাথুরে মাটির দেওয়াল দিয়ে কঙ্কালটিকে ভরাট করে তাতে দরজা জানালা বসালে পর তখন সেটা বাড়ির মতো দেখতে হয়। যারা এই-সকল কাজ করে তাদের যে অনেকখানি সাহস দরকার তা বুঝতেই পার। মাটি থেকে চারশো হাত উপরে লোহার বরগার উপর দিয়ে হাঁটাহাটি করা—তার উপরে বসে কাজকর্ম করা, কখনো-বা উপর নীচ ওঠা নামা-এ-সব যেমন তেমন লোকের কাজ নয়।

সন্দেশ -মাঘ, ১৩২১