সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/গাছের ডাকাতি

উইকিসংকলন থেকে
গাছের ডাকাতি

 ধীর শান্ত ক্ষমাশীল লোকের কথা বলতে হলে আমাদের দেশে গাছের সঙ্গে তার তুলনা দেওয়া হয়—'তরোরিব সহিষ্ণুণা'। গাছের মহত্ত্বের কথা ছেলেবেলায় কত যে পড়েছি এখনো তার কিছু কিছু মনে পড়ে! 'ছেত্তুঃ পার্শ্ব গতাচ্ছায়াং নেপসংহরতি দ্রুমঃ - যে লোক পাশে বসে গাছের ডাল কাটছে তার কাছ থেকেও গাছ তার ছায়াটুকু সরিয়ে নেয় না। আরো শুনেছি, ‘কঠিন অপ্রিয় বাক্য করিলে শ্রবণ, রক্তজবা রাগ ধরে মনুজ লোচন। ইহাদের শিরোপরে লোষ্ট্র নিক্ষেপণে, সুফল প্রদান করে বিনম্র বদনে।' এমন যে শান্ত নিরীহ গাছ সেও নাকি আবার অত্যাচার করে। নানারকম কৌশল কয়ে, বিষ ঢেলে, ফাঁদ পেতে, হুল্ ফুটিয়ে, সঙ্গিন চালিয়ে, গেলা মেরে, সাঁড়াশি বিঁধিয়ে কত উপায়ে যে তারা দৌরাত্মি করে তা শুনলে পরে তোমরা বলবে ‘গাছের পেটে এত বিদ্যে'।

 এর আগে শিকারী গাছের কথা বলেছি। তাতে গাছের কেমন করে অশ্চর্যরকম ফাঁদ পেতে পোকামাকড় ধরে খায়, তার গল্প দেওয়া হয়েছিল। তারা নানারকম লোভ দেখিয়ে, রঙের ছটায় মন ভুলিয়ে পোকাদের সব ডেকে আনে। কিন্ত যারা আসে তারা আর ফিরে যায় না। মধু খেতে খেতে কখন যে তারা ফাঁদের মধ্যে গিয়ে পড়ে সেটা তাদের খেয়ালই থাকে না। কখন হঠাৎ টপ্ করে ফাঁদের মুখ বুজে যায়, কিংবা গাছের আঠালো রসে তাদের পা আটকিয়ে যায়, কিংবা ফাঁদের মধ্যে পিছল পথে উঠতে গিয়ে আর উঠতে পারে না তখন বেচারাদের ছটফটানি সার। এরা মাংসাশী গাছ, পোকামাকড় খেয়ে এরা বেঁচে থাকে, তাই প্রাণের দায়ে একটু-আধটু হিংসাবৃত্তি না করলে এদের চলবে কেন?

 খোঁজ করলে দেখা যায়, অনেক সময় গাছে গাছেও লড়াই চলে। অল্পে অল্পে দিনের পর দিন নিঃশব্দে সে লড়াই চলতে থাকে। এক জায়গায় দশ-বিশটা গাছ থাকলেই তাদের মধ্যে কিছু না কিছু রেষারেষি বেধে যায়। সকলেই চায় প্রাণ ভরে আলো আর বাতাস পেতে–সুতরাং যারা প্রবল তারা গায়ের জোরে সকলকে ঠেলেঠুলে বেড়ে ওঠে আর দুর্বল বেচারিরা আড়ালে অন্ধকারে শুকিয়ে মরে।

 এক-একরকম গাছ থাকে তাদের কেমন অভ্যাস, তারা অন্য গাছের গায়ে পড়ে পাক দিয়ে উঠে তার পর তাদের চিপ্‌সে মারে। এক-এক সময় দেখা যায়, একটা গাছ সিন্ধবাদের বুড়োর মতো আর-একটা গাছের ঘাড়ে চেপে রয়েছে। গাছের অন্য বিদ্যা যেমনই থাক, সে তো হনুমানের মতো লাফাতে পারে না, তা হলে সে অন্যের ঘাড়ে চড়ল কি করে? চড়তে হয় নি, ঐ ঘাড়ের উপরেই তার জন্ম হয়েছে। ঐখানে কবে কোন পাখি এসে ফলের বীজ ফেলে গেছে, সুবিধা পেয়ে সেই বীজ এখন ডালপালা মেলে, মাটি পর্যন্ত শিকড় ঝুলিয়ে প্রকাণ্ড গাছ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে নীচের গাছটার খুবই আপত্তি থাকবার কথা, কিন্তু আপত্তি থাকলেই-বা শোনে কে? যেখানে সেখানে জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠায় এক-একটি গাছের বেশ একটু বাহাদুরি দেখা যায়। আমাদের দেশের অশ্বথগাছ এ বিষয়ে একেবারে পাকা ওস্তাদ। ছাতে দালানে পোড়ো মন্দিরে অন্য গাছের ঘাড়ে কারখানায় চিমনির চূড়ায়, যেখানে তাকে সুযোগ দেবে সেখানেই সে মাথা উঁচিয়ে বেড়ে উঠবে। বটগাছের জন্মও অনেক সময়ে অন্য গাছের ঘাড়ের উপর হয়—সেইখানে বাড়তে বাড়তে সে যখন বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয় তখন নীচের গাছটিকে সে অল্পে-অল্পে ফাঁস দিয়ে চেপে মারে। এইরকম করে সে বড়ো-বড়ো তালগাছকেও কাবু করে ফেলতে পারে।

 আর একদল গাছ আছে তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সব সময় তৈরি থাকে, পাছে কেউ তাদের অনিষ্ট করে। শুকনা বালির দেশে মনসাগাছের বাড়তি খুব বেশি। মনসা গাছের পুরু ছাল, তার মধ্যে জলভরা নরমশাঁস, তাতে ক্ষুধাও মেটে তৃষ্ণাও দূর হয়। কিন্তু মনসাগাছের গা-ভরা কাঁটা, জানোয়রের সাধ্য কি তার কাছে ঘেঁষে। গোরু ছাগলে কত সময়ে ক্ষুধার তাড়ায় কাঁটার কথা ভুলে গিয়ে মনসাগাছে মুখ দিতে গিয়ে নাকে মুখে কাঁটার খোঁচা খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে পালিয়ে আসে। মনসা জাতীয় গাছ নানারকমের হয়, কোনটা ছোটোখাটো, তার পুরু পুরু চ্যাটাল পাতা, কোনোটার পাতা নেই একেবারে থামের মতো খাড়া, কোনোটার চেহারা ঝোপের মতো, কোনোটার ভুট্টার মতো, কোনোটা চল্লিশ হাত লম্বা, কোনোটা বড়ো জোর এক হাত কি দেড় হাত। কিন্তু এক বিষয়ে সবাই সমান, সকলের গায়ে শজারুর মতো কাটা। কোনোটার কদমফুলের মতো সুন্দর চেহারা, দেখে হাত দিতে ইচ্ছে হয়—কিন্তু একটিবার হাত দিলেই বুঝবে কেমন মজা।

 এই গাছগুলার কাঁটা এক-এক সময়ে এমন সরু হয় যে, হঠাৎ দেখলে বোঝা যায় না-কিন্তু ধরতে গেলে একেবারে ঝাঁকে ঝাঁকে কাঁটা চামড়ার মধ্যে ফুটে যায়। কাঁটাওয়ালা গাছ নানারকমের আছে, তার মধ্যে কোনো কোনোটি শুধু কাঁটাতেই সন্তুষ্ট নয়, তারা কাঁটার মধ্যে বিষ ভরে রাখে। তাতে কাঁটার খোঁচা অরি বিষের জ্বালা দুটোই বেশ একসঙ্গে টের পাওয়া যায়। আবার দু-একটার কাঁটা নিতান্তই সামান্য—সরু শুঁয়ার মতো কিন্তু তাদের বিষ বড়ো তেজালো। বিছুটির পাতা অণুবীক্ষণ দিয়ে দেখলে মনে হয় যেন অসংখ্য হূল উঁচিয়ে আছে-তাতে হাত দিবামায় তার আগাটুকু ভেঙে গিয়ে ভিতর থেকে বিষাক্ত রস বেরিয়ে আসে। এক-এক জাতীয় বিছুটি আছে তাদের বিষে অসহ্যরকম যন্ত্রণা হয় এবং সপ্তাহ ভরে তার জের চলে। এক সাহেব একবার এইরকম এক বিছুটি ঘাঁটতে গিয়ে তার পর নয় দিন শয্যাগত ছিলেন। তিনি বলেছেন যে বিহুটি লাগবার পর সারাদিন তাঁর মনে হত যেন তপ্ত লোহা দিয়ে কে তাঁর হাতের মধ্যে ঘা মারছে।

 ‘ওল খেয়ো না ধরবে গলা’–এ কথা আমিও জানি তোমরাও জান; কিন্তু জঙ্গলের ধারে যখন বুনো ওলের নধর সবুজ পাতাগুলো ছড়িয়ে থাকে, তা খেলে যে গলা ধরবে এ কথা গোরু ছাগলে কি করে জানবে? এই-সব পাতার মধ্যে ছুঁচের চাইতেও সরু অতি সুক্ষ দানা থাকে, সেইগুলি গলায় জিভে ফুটে মুখের অবস্থা সাংঘাতিক করে তোলে। ওয়েস্ট ইণ্ডিজ দ্বীপে একরকম বেত পাওয়া যায়। তার পাতা খেলে গলা ফুলে কথা তো বন্ধ হয়ই, অনেক সময় দম বন্ধ হয়ে যেতে চায়। শুনা যায়, সেখানকার নিষ্ঠুর দাস-ব্যবসায়ীরা এই পাতা খাইয়ে ক্রীতদাসদের শাসন করত। এই বেতের নাম Dumb Cane বা ‘বোবা বেত'।

 আত্মরক্ষার জন্যেই অধিকাংশ গাছ নানারকমের ফন্দি-ফিকিরের আশ্রয় নেয়। কিন্তু কেবল নিজেকে বাঁচিয়েই সকলে সন্তুষ্ট নয়, বংশরক্ষার জন্যে তাদের যে-সব উপায় খাটাতে হয় সেগুলিও এক-এক সময় কম সাংঘাতিক নয়। অনেক গাছের ফল বা বীজ দেখা যায় যেন কাঁটায় ভরা। এইরকম কাঁটাওয়ালা নখওয়ালা ফল সহজেই নানা জানোয়ারের গায়ের চামড়ায় লেগে এক জায়গার ফল আর-এক জায়গায় গিয়ে পড়ে। তাতে জানোয়ারের অসুবিধা খুবই হতে পারে কিন্তু গাছের বংশ বিস্তারের খুব সুবিধা হয়। এক-একটা ফলের কাঁটার সাজ অনাবশ্যকরকমের সাংঘাতিক বলে মনে হয়। দক্ষিণ আমেরিকায় একরকম ফল হয় সে ফল মানুষে খায় না, তার গুণের মধ্যে তার প্রকাণ্ড দুইটি বঁড়শির মতো শিং আছে, তার একটি কোনো জন্তুর গায়ে বিঁধলে তার সাধ্য কি যে ছাড়িয়ে ফেলে। অনেক সময় দেখা গিয়েছে, এই ফলের কামড় ছাড়াতে গিয়ে গোরু ছাগল বা হরিণের মুখের মধ্যে বঁড়শি আটকে গিয়েছে। পোষা জন্তু হলে মানুষের সাহায্যে সে উদ্ধার পেয়ে যায়, কিন্তু বনের জন্তু নিরুপায়। তারা কেবল অস্থির হয়ে পাগলের মতো ছুটে বেড়ায়-তাতে আধ-খোলা ফলের ভিতরকার বীচিগুলা চারিদিকে ছিটিয়ে পড়বার সুযোগ পায়, কিন্তু নিরীহ জতুর প্রাণটি যায়। এই ফলকে সে দেশের লোকে ‘শয়তানের শিং' বলে।

 এর চাইতেও ভয়ানক হচ্ছে আফ্রিকার সিংহ মারা ফল। আঁকশির মতো চেহারা, তার চারিদিকে ‘বাঘনখ’ ফলের মতো বড়ো-বড়ো নখ। নখের গায়ে ভীষণরকম কাটা তাদের এক-এক মুখ এক-এক দিকে-একটাকে ছাড়াতে গেলে আর-একটা বেশি করে বিঁধে যায়। প্রতি বছর সে দেশে হাজার হাজার হরিণ, ভেড়া আর ছাগল এইভাবে জখম হয়। যেখানে নখ বসে সেখানে ঘা হয়ে পচে ওঠে, তাতে ফল যদি খসে যায় তা হলে কতক রক্ষা; না হলে শেষটায় প্রাণ নিয়ে টানাটানি। স্বয়ং পশুরাজ সিংহও যে এর হাত থেকে সকল সময়ে নিস্তার পেয়ে থাকেন তা নয়। এর জন্যে সিংহের প্রাণ দিতে হয়েছে এমনও দেখা গিয়েছে।

 আর-এক রকম গাছ আছে, তাদের ফল পাকলে ফেটে যায় আর ভিতরের বীচিগুলা সব ছিটিয়ে পড়ে। কোনো কোনো গাছে এই বীজ ছড়ানো কাজটি বেশ একটু জোরের সঙ্গে হয়। এক বাঁদরের গল্প শুনেছি, সে খুব বাহাদুরি করে গিলার গাছে বসে বসে মুখ ভ্যাংচাচ্ছিল। গিলার ফল হয় বড়ো-বড়ো সিমের মতো—সেগুলো পেকে পটকার মতো আওয়াজ করে ফেটে যায় আর চারিদিকে গিলা ছিটায়, বাঁদর তো সে খবর রাখে না, সে আরাম করে ল্যাজ ঝুলিয়ে বসে খুব একটা উৎকটরকম দুষ্টুমির ফন্দি আঁটছে, এমন সময় ফট করে গিলা ফেটে তার কানের কাছে চাঁটি মেরে গেল। বাঁদরটা হঠাৎ হাত-পা ছেড়ে পড়তে পড়তে সামলে গেল—তার পর দাঁত মুখ খিচিয়ে ফিরে দেখে কেউ নেই। এরকম অদ্ভুত কাণ্ড দেখে তার ভয় হল, না কি হল, তা জানি না কিন্তু সে এক লাফে সেই যে পালাল, একেবারে বিশ-ত্রিশটা গাছ না ডিঙিয়ে আর থামল না। দক্ষিণ আমেরিকায় একরকম ফল আছে, সে এই বিদ্যাতে গিলার চাইতেও ওস্তাদ। তার ফলগুলো ফাইবার সময় বন্দুকের মতো আওয়াজ করে আর তার ভিতরকার বীচিগুলো এমন জোরে ছুটে যায় যে ভালো করে তার চোট লাগলে মানুষ পর্যন্ত জখম হতে পারে।

 ছেলেবেলায় একরকম গাছের গল্প পড়েছিলাম, তারা নাকি মানুষ ধরে টেনে খায়। কিন্তু আজকাল পণ্ডিতেরা এ কথা বিশ্বাস করেন না—কারণ, অনেক খোঁজ করেও সে গাছের কোনোরকম প্রমাণ পাওয়া যায় নি। যে গাছ পোকামাকড় খায়, সে সুযোগ পেলে পাখিটা বা ইঁদুরটা পর্যন্ত হজম করতে পারে। কিন্তু যে যদি মানুষ পর্যন্ত খেতে আরম্ভ করে তা হলে তো আর রক্ষা নেই।

সন্দেশ—পৌষ, ১৩২৪