বিষয়বস্তুতে চলুন

সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/চাঁদমারি

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২৬৩-২৬৪)
চাঁদমারি

 সৈন্যেরা যেখানে বন্দুক ছুঁড়তে শেখে, সেখানে একটা তক্তার উপরে মন্ত চাঁদের মতো একটা গোল চক্র আঁকা থাকে, তার উপর নিশান করে সৈন্যের গুলি চালায়। লোকেরা তাকে ‘চাঁদমারি’ বলে। কেন বলে তা ঠিক জানি না, বোধ হয় ওখানে ‘চাঁদ'কে মারে বলে তার নাম চাঁদমারি।

 আমেরিকার এক মাতাল গোলন্দাজের গল্প শুনেছিলাম, সে বনের মধ্যে গাছের আড়ালে আলো জ্বলতে দেখে সেই অলোর উপর তাক করে কামানের গোলা চালাচ্ছিল। এমন সময় তার কাপ্তান এসে বললেন “ব্যাপার কি? কামান দাগছ কিসের জন্য?” গোলন্দাজ বললে, “ঐ যে সামনে বনের মধ্যে কারা আলো জ্বালিয়েছে, ওদের আলো ফুটো করে দিচ্ছি।” কাপ্তান বললেন, “ওরে হতভাগা! ওটা যে চাঁদ উঠছে, দেখতে পাস নে?” তখন গোলন্দাজের হুঁস হল, সে তাকিয়ে দেখল যে এতক্ষণ সে চাঁদকে ফুটো করবার আশায় গুলি চালাচ্ছিল!

 পৃথিবীর বাইরে আকাশের গায়ে যে-সমস্ত আলো আমরা দেখতে পাই, যাদের চন্দ্রসুর্য গ্রহনক্ষত্র বলি তাদের মধ্যে চাঁদটাই আমাদের সবচেয়ে কাছে। কিন্তু হিসাব করলে দেখি, সেও বড়ো কম নয়-প্রায় আড়াই লক্ষ মাইল। মানুষের সবচাইতে ভয়ানক যে কামান, তার গোলা গিয়ে পড়ে ষাট মাইল দূরে। বড়ো-বড় কামানের মুখ থেকে অসম্ভব বেগে গোলা ছুটে বেড়ায়, কিন্তু তবুও সে পৃথিবীর টান ছাড়িয়ে যেতে পারে না। প্রথমে তার যতই তেজ থাকুক, শেষটায় ক্রমে নিস্তেজ হয়ে সেই পথিবীতেই ফিরে আসে। কিন্তু পণ্ডিতেরা বলেন, একটা সাধারণ বড়ো কামানের গোলাকে যদি আর পাচ-দশ গুণ বেগে খাড়া আকাশের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া যায়, তা হলে সে আর কোনোদিন ফিরে আসবে না—একেবারে পুথিবীর এলাকার বাইরে শূন্যের মধ্যে ছুটে বেরিয়ে যাবে। গোলাটাকে যদি হিসাবমতো চাঁদের দিকে তাক করে ছেড়ে দেওয়া যায়, তা হলে সে একেবারে চাঁদের গায়ে গিয়ে ঢুঁ মেরে পড়বে। কতখানি জোরে, কিরকমভাবে গোলা ছুঁড়লে সে ঠিক চাদে গিয়ে পড়বে, তাও হিসাব করে বলে দেওয়া যায়।

 এক ফরাসী লেখক চাঁদে যাওয়ার সম্বন্ধে একটা চমৎকার গল্প লিখেছিলেন। তাতে কয়েকজন লোককে একটা প্রকাণ্ড গোলার মধ্যে পুরে চাঁদের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল। একটা পাহাড়ের মধ্যে প্রকাণ্ড কামান গেঁথে গোলা ছুড়বার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গল্পের আর সব মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু গোলা যখন ছুটে বেরোল তখনো যে ভিতরের মানুষগুলো বেঁচে রইল, এটা কিছুতেই সম্ভব হয় না।

 আজকাল শুনতে পাচ্ছি, কামানের গোলার চাইতে চাঁদে হাউই ছুড়ে মারা নাকি অনেক বেশি সহজ। আমেরিকার একজন বৈজ্ঞানিক পণ্ডিত অধ্যাপক গডার্ড সাহেব একরকম আশ্চর্য নুতন ধরনের হাউই বানিয়েছেন! তার ভিতরে এমন অদ্ভুত নূতন কৌশলে বারুদমসলা পোরা থাকে যে, সে বারুদ একবারে সমস্তটা ফাটে না—থেকে থেকে এক-একবার বারুদ ফুটে ওঠে আর তার ধাক্কায় হাউই ক্রমাগত এগিয়ে চলে। প্রথম ধাক্কাতেই হাউই অনেক দূর পর্যন্ত যায়, তার পর যেই তেজ থেমে আসতে থাকে, অমনি আবার দ্বিতীয় ধাক্কা এসে লাগে। সেটার বেগ কমতে না কমতেই আবার তৃতীয় ধাক্কা। এমনি করে নিজের ভিতরকার বারুদের কাছে বার বার ধাক্কা খেয়ে খেয়ে সে হাউই অসম্ভব উঁচুতে উঠে যায়।

 গডার্ড সাহেবের তৈরি চার সের ওজনের একটা হাউই অনায়াসে দুশো মাইল উঁচুতে উঠতে পারে। আর বারুদসুদ্ধ ষোলো মণ ওজনের ঐরকম একটা হাউই বানিয়ে যদি আকাশের দিকে ছেড়ে দেওয়া যায়, তাহলে সে হাউই আর ফিরে আসবে না। বারুদ ফুরাবার আগেই সে এতদূর গিয়ে পড়বে যে পৃথিবী তাকে আর কিছুতেই ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তখন তার বেগ আর কমবে না; সে নিজের বেগে সোজা নিজের পথে যুগের পর যুগ ছুটে চলতে থাকবে-যদি পথের মধ্যে চাঁদ কিম্বা অন্য কোনো গ্রহ কিম্বা আর কিছুতে তাকে টেনে না নেয়। গডার্ড সাহেব বলেন, এইরকমের একটা হাউইকে চাঁদের দিকে ছেড়ে দিলে সে নিশ্চয়ই চাঁদে গিয়ে পৌঁছাবে। হাজার পাঁচেক টাকা হলেই নাকি এইরকম একটা হাউই বানানো যেতে পারে। চাঁদের অন্ধকার দিকটায় যদি হিসেব করে হাউই ফেলা যায়, আর হাউয়ের মধ্যে যদি এমন মসলা দেওয়া থাকে যে চাঁদের গায়ে ঠেকবামাত্র তাতে বিদ্যুতের আলোর মতো চোখ-ঝলসান আগুন জ্বলে ওঠে, তা হলে পৃথিবীতে বসে দুরবীন দিয়ে সেই আলোর ঝিলিক দেখে পণ্ডিতেরা বলতে পারবেন-‘ঐ হাউই গিয়ে চাঁদের গায়ে পড়ল।'

 আরো অনেকখানি বড়ো করে যদি চাঁদমারি হাউই বানানো যায়, আর তার মধ্যে দু-চারজন মানুষ থাকবার মতো ঘরের ব্যবস্থা করা যায় আর বড়ো-বড়ো চোঙায় ভরা বাতাস আর কিছু দিনের মতো খাবার খোরাক যদি সঙ্গে দেওয়া যায়, তা হলে মানুষও চাঁদে বেড়াতে যেতে পারবে না কেন? চাঁদে লেগে হাউই যাতে চুরমার হয়ে না যায়, তার জন্য নানারকম বন্দোবস্ত করা যেতে পারে। ফিরে আসবার সময় পৃথিবীমুখো করে হাউই ছাড়বার মতন ব্যবস্থাও সহজেই করা যায়। এর মধ্যেই নাকি কোনো কোনো উৎসাহী লোকে খুব সাহস করে গডার্ড সাহেবকে লিখেছেন যে, চাঁদে যাওয়ার জন্য যদি লোকের দরকার হয়, তা হলে তাঁরা যেতে রাজি আছেন। কেউ কেউ নাকি তার জন্য টাকাও দিতে চেয়েছেন। কিন্তু গডার্ড সাহেবের সেরকম কোনো মতলবই নেই।

 যাহোক মানুষের খেয়াল চাপলে মানুষ সবই করতে পারে। হয়তো তোমরা সব বুড়ো হবার আগেই শুনতে পাবে যে চাঁদের দেশের প্রথম যাত্রীরা চাঁদে যাবার জন্য রওনা হয়েছে। তারা যদি গিয়ে ফিরে আসতে পারে, তা হলে কত যে আশ্চর্য অদ্ভুত কাহিনী তাদের কাছে শুনতে পাবে, তা এখন কল্পনা করাও কঠিন।

সন্দেশ-আষাঢ়, ১৩২৭