সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/মরুর দেশে

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৮৭-১৮৯)
মরুর দেশে

 ‘মরু' নামটিতেই বলিয়া দেয় যে দেশটি মরা। গাছপালা জীবজন্তু সেখানে বাড়িতে পায় না। মানুষ সেখানে বাস করিতে গেলে দুদিনের বেশি টিকিতে পারে না; এমনি ভয়ানক সে দেশ।

 পৃথিবীর ‘ম্যাপ' যদি দেখ, দেখিবে আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিমে সাহারার প্রান্ত হইতে চীন সাম্রাজ্যের মাঝামাঝি পর্যন্ত বড়ো-বড়ো দেশ জুড়িয়া Desert (পরিত্যক্ত দেশ) বা মরুভূমি পড়িয়া আছে। তা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই মানুষের আবাসের আশেপাশেই ছোটো বড়ো ফাঁকা দেশ-সেখানে ঘর নাই বাড়ি নাই, আছে খালি বালির মাঠ অরি বালির ঢিপি। মেরুর কাছে সাইবিরিয়া বা গ্রীনল্যাণ্ড প্রভৃতি শীতপ্রধান দেশেও এমন সব ফাঁকা জায়গা আছে যেখানে বছরের মধ্যে আট মাস ধরিয়া সারাটি দেশ শ্মশানের মতো পড়িয়া থাকে—কেবল বসন্তের কাছাকাছি একটু-আধটু গাছপালার চেহারা দেখা যায়।

 কিন্তু বাস্তবিক ‘মরুভূমি’ বলিতে কেবল সেই-সব দেশকেই বুঝায় যেখানে বারো মাস কেবল বালির স্তুুপ ছাড়া আর কিছু দেখিবার জো নাই-যেখানে শুকনা বালি রৌদ্রে তাতিয়া সমস্ত দেশটাকে একেবারে শুকাইয়া রাখে। সারা বছর সেখানে বৃষ্টি নাই—গাছপালার মধ্যে ক্বচিৎ কোথাও একটু সুবিধা পাইয়া হয়তো দু-দশটি মনসা গাছ মাথা তুলিয়াছে। মরুভূমির ধারে কিনারায় হয়তো দু-চারিটা সাপ বিছা বা গিরগিটি মাঝে মাঝে দেখা যায় কিন্তু যতই ভিতরে যাও ততই দেখিবে জনপ্রাণীর কোনো সাড়া নাই। মাছিটা পর্যন্ত সেখানে শুকাইয়া মরে। চারিদিকে কেবল বালি, তার মধ্যে জম্ভই-বা বাঁচে কি খাইয়া, আর গাছই-বা রস পায় কোথায়? মনসা জাতীয় গাছগুলার পাতা মোটা, তাহাতে রস থাকে অনেক বেশি—আর তাদের ছাল পুরু, তাহাতে রসটাকে তাড়াতাড়ি শুকাইতে দেয় না। তাহারা বালির নীচে সরস মাটিতে প্রাণপণে শিকড় বসাইয়া কোনোরকমে বাঁচিয়া থাকে।

 মরুভূমির মধ্যে আগাগোড়াই কেবল যদি বালি থাকিত, তবে তাহার ভিতরকার সংবাদ লওয়া মানুষের পক্ষে অসম্ভব হইত। কিন্তু বালির নীচেও তো জমি আছে—সেই জমির মধ্যে কত ঝরনা কত জলাশয় বালির চাপে চাপা পড়িয়া থাকে, মাঝে মাঝে যেখানে বালির চাপ কম অথবা জলের বেগ খুব বেশি সেখানে সমস্ত চাপ ঠেলিয়া জল একেবারে উপরে উঠিয়া আসে। জলের পরশ পাইয়া তাহার চারিদিকে খেজুরগাছ আর নানারকম লতাপাতা গজাইয়া উঠে, গাছের ছায়ায় ছায়ায় সমস্ত জায়গাটিকে ঠাণ্ডা করিয়া রাখে। দেখিলে মনে হয় যেন এক-একটি তীর্থস্থান। এক-একটি মরুতীর্থের ধারে ধারে ছোটোছোটো গ্রাম বসিয়া যায়—মরুপথের যাত্রীরা পথ চলিতে চলিতে এই-সকল জায়গায় আসিয়া বিশ্রাম করে।

 বাতাস যেখানে শুকনা, সেখানকার জমি অল্পেই তাতিয়া উঠে আর তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয়। সেইজন্য মরুভূমিতে যেমন গরম খুব বেশি, শীতও তেমনি প্রচণ্ড। এক সময়ে যেমন মাটিতে পা ফেলিবামাত্র ফোস্কা উঠিয়া যায়-আরেক সময় হয়তো জল জমিয়া বরফ হইয়া থাকে। দিনেরবেলা যেখানে গরমে শরীর ঝলসিয়া যায় রাত্রে সেইখানেই কম্বলের উপর কম্বল চাপাইয়া তবু শীত মানিতে চায় না। এইরূপ শীত গ্রীষ্মের লড়াইয়ের মধ্যে বাতাস বড়ো-একটা স্থির থাকিতে পারে না। যেখানেই গরম বেশি, বাতাস সেখান হইতে চিমনির ধোঁয়ার মতো উপরে উঠিতে থাকে। তখন চারিদিক হইতে ঠাণ্ডা বাতাস ঝড়ের মতো ছুটিয়া আসিয়া এক তুমুল কাণ্ড বাধাইয়া তোলে। মরুপথের বিপদ অনেক —চলিতে চলিতে পথ হারাইলে তৃষ্ণায় মরিতে হয়—চোরাবালির পাহাড় ধ্বসিয়া কত মানুষ প্রাণ হারায়-শীতে জমিয়া গরমে পুড়িয়া কত সময়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। কিন্তু, যতরকম বিপদ আছে তাহার মধ্যে মানুষ সবচাইতে ভয় করে মরুভূমির ঝড়কে। সে ঝড় যে কত বড়ো সাংঘাতিক ব্যাপার হইতে পারে তাহা চোখে না দেখিলে কল্পনা করা যায় না। দমকা বাতাসের ঝাপটায় মরুভূমির তপ্ত বালি হু হু করিয়া ছুটিতে থাকে, বাতাসের আঁচে আর বালির ঘষায় সর্বাঙ্গে ফোস্কা পড়িয়া যায়, ধুলায় অন্ধ হইয়া দম আটকাইয়া মানুষগুলা পাগলের মতো ছুটিতে থাকে। তার উপর বাতাসের ঘুর্ণীটানে মরুভূমির বালি যখন পাক দিয়া উঠিতে থাকে তখন সেই বালুস্তম্ভের মুখে যে পড়ে তাহার আর রক্ষা নাই। বালির স্তম্ভে চাপা পড়িয়া কত বড়ো-বড়ো যাত্রীদল যে মারা গিয়াছে তাহার আর হিসাব নাই।

 এত বালি আসিল কোথা হইতে? সাহারা মরুভূমিতে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মণ বালি ক্রমাগত উড়িয়া উড়িয়া পশ্চিমে সমুদ্রের মধ্যে গিয়া পড়িতেছে-তবু মনে হয় বালির আর শেষ নাই। সাহারার মধ্যে এবং পুবে উতরে আশেপাশে বেলেপাথরের পাহাড়। কোনো কালে সে স্থানে সমুদ্র ছিল—তাহার নরম বালি জমাট বাঁধিয়া এখনো পাহাড় হইয়া সঞ্চিত আছে। বাতাসে সেই পাহাড়কে রেণু রেণু করিয়া উড়াইয়া মরুভূমির মধ্যে ঢলিয়া দিতেছে-আবার মরুভূমির বালিকে সেই কোথাকার সমুদ্রের মধ্যে নিয়া ফেলিতেছে। মোটের উপর দেখা যায় যে, বালি ক্ষয় হইতে হইতে ক্রমে সমস্ত মরুভূমিটাই নিচু হইয়া আসিতেছে। এখন যেখানে মরুভূমি দেখা যায় শেষে তাহারই কত জায়গায় মানুষের থাকিবার মতো চমৎকার জমি দেখা দিবে।  মরুভূমির কথা বলিতে গেলেই উটের কথা আসিয়া পড়ে। উটের শরীরটিকে মরুভূমির উপযোগী করিয়াই গড়া হইয়াছে। চ্যাটাল চ্যাটাল পা, তার আষ্টেপৃষ্টে কড়ায় ঢাকা-ঝামা দিয়া ঘসিলেও তাহাতে ফোস্কা পড়ে না। ক্ষুধা নাই, তৃষ্ণা নাই—এক পেট ঘাস খাইয়া তিন দিন উপোস থাকে—এক ঢোক জল লইয়া সারাদিন পথ চলে। সবদিকে তার সবই ভালো-মন্দের মধ্যে কেবল তার মেজাজটি। আরবদের বিশ্বাস যে উট যদি একবার রাগ করে তবে একদিন হউক, এক বৎসর হউক, সে প্রতিহিংসা না লইয়া ছাড়িবে না। সেইজন্য কোনো উটের মেজাজ বিগড়াইতে দেখিলেই তাহার মাটির উপর নানারকম পোশাক ছড়াইয়া উটকে তাহার মধ্যে ছাড়িয়া দেয়। উট তখন ঐগুলার উপর মনের সুখে লাথি চাঁটি মারিয়া মেজাজ ঠাণ্ডা করে।

 মরুর দেশের কথা বলিলাম। এখন মরু সাগরের (Dead Sea) কথা বলিয়া শেষ করি। মরু সাগরটি একটা মাঝারি গোছের হ্রদ-পঞ্চাশ মাইল লম্বা, আট-দশ মাইল চওড়া। কিন্তু তার মধ্যে কোথাও একটি মাছ বা কোনোরকম জলের প্রাণী নাই। সমুদ্রের জলকে শুকাইয়া ঘন করিলে যেরূপ হয়, মরু সাগরের অবস্থা ঠিক সেইরূপ। জল এমন ভারি যে তাহার মধ্যে ডুবিয়া মরিবার ভয় নাই আর এমন লবণাক্ত যে জলে স্নান করিলে সর্বাঙ্গে চাপ বাঁধিয়া নুন জমিতে থাকে।

সন্দেশ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৪