সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/নানা গল্প/হিংসুটি

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৮৪-১৮৬)

হিংসুটি

 এক ছিল দুষ্টু মেয়ে—বেজায় হিংসুটে, আর বেজায় ঝগড়াটে। তার নাম বলতে গেলেই তো মুশকিল, কারণ ঐ নামে সন্দেশের শান্ত লক্ষ্মী পাঠিকা যদি কেউ থাকেন, তাঁরা তো আমার উপর চটে যাবেন।

 হিংসুটির দিদি বড় লক্ষ্মী মেয়ে—যেমন কাজে কর্মে তেমনি লেখা পড়ায়। হিংসুটির বয়স সাত বছর হয়ে গেল, এখনো তার প্রথম ভাগই শেষ হল না—আর তার দিদি তার চাইতে মোটে এক বছরের বড়—সে এখনই ‘বোধোদয়’ আর ‘ছেলেদের রামায়ণ’ প’ড়ে ফেলেছে। ইংরিজি ফার্স্টবুক তার কবে শেষ হয়ে গেছে। হিংসুটি কিনা সবাইকে হিংসে করে, সে তার দিদিকেও হিংসে করতো। দিদি স্কুলে যায়, প্রাইজ পায়—হিংসুটি খালি বকুনি খায় আর শাস্তি পায়।

 দিদি সেবার ছবির বই প্রাইজ পেলে, আর হিংসুটি কিচ্ছু পেলে না, তখন যদি তার অভিমান দেখতে! সে সারাটি দিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে গাল ফুলিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বসে রইল—কারো সঙ্গে কথাই বলল না। তারপর রাত্রি বেলায় দিদির অমন সুন্দর বইখানাকে কালি ঢেলে মলাট ছিঁড়ে কাদায় ফেলে নষ্ট করে দিল। এমন দুষ্টু হিংসুটে মেয়ে!

 হিংসুটির মামা এসেছেন, তিনি মিঠাই এনে দু বোনকেই আদর করে খেতে দিয়েছেন। হিংসুটি খানিকক্ষণ তার দিদির খাবারের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। মামা ব্যস্ত হয়ে বললেন, “কিরে, কি হল? জিভে কামড় লাগল নাকি?” হিংসুটির মুখে আর কথা নেই, সে কেবলই কাঁদছে। তখন তার মা এক ধমক দিয়ে বললেন, “কি হয়েছে বল না!” তখন হিংসুটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “দিদির ঐ রসমুণ্ডিটা আমারটার চাইতেও বড়।” তাই শুনে দিদি তাড়াতাড়ি নিজের রসমুণ্ডিটা তাকে দিয়ে দিল। অথচ হিংসুটি নিজে যা খাবার পেয়েছিল তার অর্ধেক সে খেতে পারল না—নষ্ট করে ফেলে দিল। দিদির জন্মদিনে দিদির জন্য নতুন জামা নতুন কাপড় আসলে হিংসুটি তাই নিয়ে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে তোলে।

 একদিন হিংসুটি তার মায়ের আলমারি খুলে দেখে কি, লাল জামা গায়ে, লাল জুতা পায়ে, টুকটুকে রাঙা পুতুল বাক্সের মধ্যে শুয়ে আছে। হিংসুটি বলল, “দেখেছ! দিদি কি দুষ্টু! নিশ্চয় মামার কাছ থেকে পুতুল আদায় করেছে—আবার আমায় না দেখিয়ে মায়ের কাছে লুকিয়ে বাখা হয়েছে!” তখন তার ভয়ানক রাগ হ’ল। সে ভাবল, ‘আমি তো ছোট বোন, আমারই তো পুতুল পাওয়া উচিত। দিদি কেন মিছিমিছি পুতুল পাবে?’ এই ভেবে সে পুতুলটাকে উঠিয়ে নিল।

 কি সুন্দর পুতুল! কেমন মিট্‌মিটে চোখ, আর ফুটফুটে মুখ, কেমন কচি কচি হাত পা, আর টুক্‌টকে জামা কাপড়। যত সব ভালো ভালো জিনিস সব কিনা দিদি পাবে! হিংসুটির চোখ ফেটে জল এল। সে রেগে পুতুলটাকে আছড়িয়ে মাটিতে

ফেলে দিল। তাতেও তার রাগ গেল না; সে একটা ডাণ্ডা নিয়ে ধাঁই ধাঁই করে পুতুলটাকে মারতে লাগল। মারতে মারতে তার নাক মুখ হাত পা ভেঙে তার জামা কাপড় ছিঁড়ে—আবার তাকে বাক্সের মধ্যে ঠেসে সে রাগে গরগর করতে করতে চলে গেল।

 বিকেলবেলা মামা এসে তাকে ডাকতে লাগলেন আর বললেন, “তোর জন্য কি এনেছি দেখিস নি” শুনে হিংসুটি দৌড়ে এল, “কই মামা? কি এনেছ? দাও না।”

 মামা বললেন, “মার কাছে দেখ গিয়ে কেমন সুন্দর পুতুল এনেছি।” হিংসুটি উৎসাহে নাচতে লাগল, মাকে বলল, “কোথায় রেখেছ মা?” মা বললেন, “আলমারিতে আছে।” শুনে ভয়ে হিংসুটির বুকের মধ্যে ধড়াস্ ধড়াস্ করে উঠ্‌ল। সে কাঁদ-কাঁদ গলায় বলল, “সেটার কি লাল জামা আর লাল জুতো পরানো—মাথায় কালো কালো কোঁকড়ান চুল ছিল?” মা বললেন, “হ্যাঁ—তুই দেখেছিস্ নাকি?”

 হিংসুটির মুখে আর কথা নেই! সে খানিকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে তারপর একেবারে ভ্যাঁ করে কেঁদে এক দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেল।

 এর পরে যদি তার হিংসে আর দুষ্টুমি না কমে, তবে আর কি করে কমবে?

সন্দেশ—১৩২৪