সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/তিন-চূড়ো পাহাড়ের দেশে

উইকিসংকলন থেকে

তিন-চূড়ো পাহাড়ের দেশে

গোধূলিতে ডুলি ক’রে আমি চলি দূর গাঁয়ে তিন-চূড়ো পাহাড়ের শেষে,
পার হয়ে অবিরাম কত গ্রাম, মাঠ, ঘাট, চলি চলি বুনোদের দেশে।
দুই কুলি বয় ডুলি, আমি চলি দুলি দুলি সঁওতাল-পরগনা দিয়ে
শীতের অলস বেলা ক্ষীণ হয়ে আসে ক্রমে, আয়ু তার আসে যে ফুরিয়ে।
আকাশের ভাঙা-চোরা অগণিত মেঘে মেঘে সিঁদুরের ছোঁয়া যেন লাগে;
যেন কোন্ অতীতের মায়াময় স্মৃতিগুলি রাঙা হয়ে ওঠে অনুরাগে।
তখন ভেঙেছে হাট দূর কোন্ দেহাতের, বুনো পথ ভেঙে তাড়াতাড়ি
চলেছে গরুর গাড়ি, লোকজন সারি সারি, কেনা-বেচা সেরে ফেরে বাড়ি।
চলেছে মেয়ের দল, গানে ক’রে কোলাহল,
নাহি বুঝি সে গীতের বাণী,—
তবু সে গানের ভাষা, যাহা শুনি ভাসা-ভাসা, আকুল করিছে প্রাণখানি।
মুড়ি আর খোয়া-ভরা উচু-নীচু মেঠো পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে ঘুরে,
ডুলির ঝোলার মাঝে আমি চলি একটান,
দুরে—কোন্ সীমাহীন পুরে।
পার হয়ে চলি মাঠ, আসে ঘন শালবন, তালবন হিনে ও বামে,
গাছের মাথার পরে মিলালো দিনের আলো, ধূসর সঁঝের মায়া নামে।

শাখে শাখে পাখীদের কলহের কোলাহল, ঘরে ফেরে বেলেহাঁসগুলি,
নিঝুম শীতের সাঁঝে ধূসর বনের মাঝে হেলে দুলে চলে মোর ডুলি।
সহসা বনের ধারে আগুনের ছোপ লাগে, পূরবের গগনের কোণে,
আবছায়া ধরা যেন আলোর স্বপন দেখে হেসে ওঠে আপনার মনে।
আঁধার সাগরকূলে আলোকের ঢেউ এলো,
কে শোনালো সোনালী এ ভাষা?
নিরাশা-আঁধার মনে জাগে যেন ক্ষণে ক্ষণে প্রাণভরা আলোময় আশা।
আমি শুধু চেয়ে দেখি কৃষ্ণা-তিথির সাঁঝে অপরূপ রূপের মাধুরী,
ওঠে চাঁদ প্রতিপদী, উজল সোনার দ্যুতি আছে তার সারাদেহ জুড়ি।
বনে বনে সাড়া জাগে, পাখীদের কোলাহল
থেমে যায়, ধরে তারা গীতি,
আলোর অতিথি আসে,অভয়ের হাসি হাসে,দূর হয় আঁধারের ভীতি।
ঝিরি ঝিরি হাওয়া বয়, গাছে গাছে ঢেউ ওঠে,
শাখে শাখে মৃদু আলো দোলে,
ঝিলিমিলি জ্যোছনা সে ঝিমঝিমে সাঁঝে আজ
কুয়াসার আবরণ তোলে।
ছোট নদী ‘উশ্‌ঝোর’ পড়ে আছে নিরালায় বালুর চাদরখানা মেলে,
তারি সাদা বালুচরে খাড়া ঢালু পথ বেয়ে
চলে ডুলি কালো ছায়া ফেলে।
তীরে মেহেদির বন, ঘন ঘন ঝোপে-ঝাড়ে ঝিঁঝিদের চলে কানাকানি;
শীতের প্রখর সাঁঝে, শিবা ডাকে মাঝে মাঝে,
আশে-পাশে নাহি জন-প্রাণী।
আলোর পরশে ফের জাগে দূর সীমানায় ছায়াময় পাহাড়ের রেখা,
হাতছানি দিয়ে ডাকে ‘খৈড়ডি’ বুনো গ্রাম, পাহাড়ের শেষে যায় দেখা।
পাহাড়ের তলে তলে বুনোদের গান চলে, মাদলের ধ্বনি আসে ভেসে;
চলে চলে ডুলি চলে ওই পাহাড়ের গাঁয়ে, তিন-চূড়ো পাহাড়ের দেশে।৷