সেই সব শহীদেরা/রাসমণি থেকে অনুরাধা সংগ্রাম সতত প্রবহমান
রাসমণি থেকে অনুরাধা সংগ্রাম সতত প্রবহমান
১৯৪৬ সালের ৩১শে জানুয়ারী কিংবা ২০০৮ এর ১২ই এপ্রিল। মাঝখানে অনেকটা সময়, আপাতদৃষ্টিতে তারিখ দুটিতে কোনো মিলই নেই। প্রথম দিনটিতে শহীদ হয়েছিলেন হাজং বিদ্রোহের দুর্ধর্ষ নেত্রী আর দ্বিতীয়টিতে অন্তরীণ অবস্থায় দুরারোগ্য ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান অনুরাধা গান্ধী। সাদা চোখে দেখলে এই দুই নারীর মধ্যে মিলের চাইতে অমিলই বেশি। কৃষকনেত্রী রাসমণি মারা যান রণাঙ্গনে। শত্রুর বুলেট বিদীর্ণ করেছিল তাঁর শরীর। অনুরাধা সেই অর্থে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ না করলেও আজীবন বিপ্লবী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার দরুণ সমস্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে প্রায় চিকিৎসাহীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর মৃত্যুকে অনায়াসেই শহীদের আত্মত্যাগের সমপর্যায়ে ফেলা যায়। অনুরাধা ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারিণী, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আলোকপ্রাপ্তা বিপ্লবী নারী। অপরজন স্বল্প শিক্ষিতা গ্রাম্য রমণী হয়েও মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন বাস্তব জীবনে। মাও এর চিন্তাকে প্রতিষ্ঠা দেন গেরিলা যুদ্ধের ময়দানে। একজন লড়েছিলেন বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে তো অপরজনের নিরবিচ্ছিন্ন পথচলা দেশীয় শাসকদের বিরুদ্ধে। এত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একটা বিষয়ে তাঁদের দারুণভাবে মেলানো যায়। এরা দুজনেই মৃত্যুর আগের মুহূর্তটি পর্যন্ত ব্যয় করেছিলেন নিপীড়িত শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আর তাই বোধহয় দুটি নাম একসাথে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করা সার্থক।
এবার সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক এই দুই মহান বিপ্লবীনীর জীবনকাহিনী-
রাসমণির কথা:
ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে গারো পাহাড়ের কোলে বাস হাজং উপজাতির। অর্থনৈতিকভাবে ভয়ঙ্কর পিছিয়ে পড়া এই গোষ্ঠীর জীবনে অভিশাপের মতো ছিল মধ্যযুগীয় ভূমিদাস প্রথা যার পোশাকী নাম টঙ্ক প্রথা। তোলা আদায়, বেগার খাটানো, নানা অর্থনৈতিক কর বসিয়ে সীমাহীনভাবে তাদের শোষণ করত স্থানীয় জমিদার ও মহাজনেরা। ১৯৩৭-৩৮ এর কৃষক বিদ্রোহের ঢেউয়ে প্রবাহিত হয়েছিল বহু হাজং চাষী। সেই শুরু। তারপর ১৯৪৬ সালে তেভাগার প্রাবল্যে উৎসাহিত হাজংয়েরা টঙ্ক প্রথা সহ সমস্ত সামন্ত শোষণের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে আওয়াজ তুলেছিল এবং এই আধা ঘুমন্ত অত্যাচারীত মানুষদের একত্রিত করেছিলেন যে অতি সাধারণ নারী তিনিই রাসমণি। অষ্টাদশ শতকে ভক্তিবাদী আন্দোলনের কারণে আমরা আরেক রাসমণিকে চিনি যিনি বিখ্যাত হয়েছেন ‘লোকমাতা' নামে অথচ ততটাই বিস্মৃতির আড়ালে রয়ে গেছেন হাজং নেত্রী রাসমণি। যার বৈপ্লবিক নেতৃত্ব, সমাজসেবা, আত্মত্যাগ, স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকার কথা।
রাসমণি সম্ভবত ১৮৯৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। যেহেতু বিবাহের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিধবা হন তাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে তাঁকে ডাইনী বলে ডাকা হতো। যদিও এই ‘ডাইনীর’ ডাক পড়ত প্রসবকার্য্যে। তিনি ছিলেন অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ দাই বা ধাত্রী। রুগ্ন শিশুদের চিকিৎসার জন্যে বৃদ্ধবৃদ্ধাদের কাছ থেকে ভেষজ, গাছগাছড়া, দ্রব্যের গুণাগুণ আয়ত্ত্ব করেন। এ জাতীয় সমাজসেবামূলক কাজ তাঁকে সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলে। ১৩৫০ (বঙ্গাব্দ)-এর মন্বন্তর মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সাথে যুক্ত হয়ে লঙ্গরখানা খুলে অন্ততঃ তিনটি গ্রামের মানুষের মুখে অন্ন জোগান রাসমণি। তাঁর নির্দেশে খাদ্যসংগ্রহকারী দল, চোরাব্যবসায়ী ও মজুতদারের গুদাম দখল করে চাল, বস্ত্র, অর্থ বাজেয়াপ্ত করত। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে সমবায় প্রথায় চাষবাস, সাধারণের জন্য ধানের গোলা ও মেয়েদের জন্য কুটীরশিল্প কেন্দ্রস্থাপন করেন এই মহীয়সী নারী। প্রায় ৬৫ বছর আগে রাসমণি তৈরী করেছিলেন নৈশবিদ্যালয়, জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক পাঠচক্র, সভাসমিতি আয়োজন করা, বাঁধ বাঁধা, খাল খনন ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়িত করেন। জমিদারদের অত্যাচার ও কু-প্রভাব থেকে হাজংদের মুক্ত করার অভিপ্রায়ে গণচেতনায় উদ্বুদ্ধ বিপ্লবী দলও গড়ে তোলেন তিনি। মিছিলের পুরোভাগে থাকত নারী বাহিনী। জমিদারেরা প্রমাদ গুণেছিল এই বিশাল জন জাগরণে। কিন্তু তা আটকানোর সাধ্য ছিল না কারোর। প্রৌঢ় বয়সে রাসমণির অফুরন্ত কর্মদক্ষতা, অগ্নিবর্ষী বক্তৃতা, গ্রামে গ্রামে প্রচার জ্বালিয়ে দিল হাজং বিদ্রোহের আগুন। উত্তর ময়মনসিংহের সুসং জমিদারীর তিনটি মহকুমায় অবসান ঘটলো জমিদারী শাসনের। ব্রিটিশ পুলিশরাজের পরোয়া না করে রাসমণির নেতৃত্বে বীর হাজং সন্তান-সন্ততিরা প্রতিষ্ঠা করে ক্ষুদ্রাকার গণরাষ্ট্র। যেখানে শাসকের রক্তচক্ষু নেই, জমিদার নেই, পেয়াদা নেই, তাই শোষণও নেই। ১৯৪৬ সালের ১লা জানুয়ারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাস্টিনের পরিচালনায় E.F.R. ভয়ঙ্কর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হানা দেয় হাজংদের গ্রামগুলিতে। নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুঠতরাজ এবং নারীধর্ষণ চলতে থাকে। বর্বর সেনাদল ধ্বংস করে সংগ্রামী চাষীদের গড়ে তোলা ফসল গুদাম, স্কুল, সমিতি (যৌথবাহিনীকে মনে পড়েছে?)। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন “প্রায় একশত গ্রামব্যাপী এই ভয়ঙ্কর ধ্বংসকাণ্ড ও নরহত্যার মধ্যে হাজং চাষীরা ভয়ে পলায়ন করিল না। অমানুষিক শোষণ ও উৎপীড়নের মধ্যেই যাহারা জীবন কাটায় তাহারা ধ্বংস ও মৃত্যুকে ভয় করেনা। এই ভয়ঙ্কর ধ্বংসকারী পশুশক্তির সম্মুখে হাজং চাষী অস্ত্র হাতে লইয়া রুখিয়া দাঁড়াইল, তাহাদের পুরোভাগে দাঁড়াইলেন হাজং মাতা রাসমণি। রাসমণি চারিদিক ঘুরিয়া ঘুরিয়া হাজং চাষীদের স্বতঃস্ফূর্ত ও খণ্ড খণ্ড প্রতিরোধ সংগ্রামকে ঐক্যবদ্ধ রূপ দিতে লাগিলেন।”
এমনকি জঙ্গলে সামরিক শিক্ষাশিবির বানিয়ে কৃষকদের গেরিলাযুদ্ধের কৌশল শিখিয়ে, গ্রামের পর গ্রাম প্রচার ও দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে শত্রুসেনাকে বিভ্রান্ত করে তোলেন তিনি। ৩১শে জানুয়ারী বহেরাতলী গ্রাম আক্রমণ করে ২৫ জন রাইফেলধারী সৈন্য। পঁয়ত্রিশ জন কৃষকবীর সঙ্গে নিয়ে সোমেশ্বরী নদীতীরে তাদের সাথে প্রবল যুদ্ধে অবতীর্ণ হন রাসমণি। আধুনিক অস্ত্রধারী সুশিক্ষিত সেনার সাথে তাঁর ও সুরেন্দ্র হাজং-এর নেতৃত্বে কৃষকবাহিনীর সেই যুদ্ধ ভারতের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। দশটি বুলেটে ছিন্নভিন্ন রাসমণি ঘটনাস্থলেই প্রাণ বিসর্জন দেন। হাজং রক্তে লাল হয় সোমেশ্বরীর বালুচর। আরো অনেকসংখ্যক গ্রামবাসীর প্রতিরোধে সেনাবাহিনী পিছু হঠে যায়।
কোনো একজনের মৃত্যুতে সংগ্রাম হয়তো সাময়িক ধাক্কা খায় কিন্তু থামে না। রাসমণির মৃত্যুতেও হাজং জনতা ব্যর্থমনোরথ হয়নি। তাঁরই দেখানো পথে বিদ্রোহীরা আন্দোলনকে আরো বড় আকারে ছড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে রেবতী, শঙ্খমণি সহ বহু নারী যোদ্ধার সাথে সর্বমোট ১৫০ জন শহীদ হন। শেষাবধি অবসান হয় টঙ্ক প্রথার
অনুরাধার কথা:
মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মারা গেলেন যে অনুরাধা গান্ধী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু ১৯৭১ সালে। ওই বছরই ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের মধ্যে ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুম্বাই-এর এলফিনস্টোন কলেজের মেধাবী ছাত্রী অনুরাধা। তথাকথিত উজ্জ্বল কেরিয়ারের হাতছানির পরোয়া না করে যুক্ত হন প্রগতিশীল যুব আন্দোলন নামে নকশালপন্থী সংগঠনের সাথে। ৭০ দশক জুড়ে পশ্চিমভারতের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন অনুরাধা। ৭৪ সালে শিবসেনার মদতে ঘটা ‘ওয়রলি' দাঙ্গা প্রতিরোধে এবং অ্যাফ্রো-আমেরিকান বিপ্লবী সংগঠনের আদলে গড়ে ওঠা ‘দলিত ব্যবস্থার' মুভমেণ্টে নিজেকে নিযুক্ত করেন। জরুরী অবস্থা পরবর্তী সময়ে সিভিল লিবার্টি আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে CPDR-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন তিনি। ১৯৭৭ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সিভিল লিবার্টি কনফারেন্সে জোরালোভাবে রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির দাবিতে সওয়াল করেন। উপস্থিত ছিলেন ভি.এম. তারাকুণ্ডে, গোবিন্দ মুখোটি, ভারাভারা রাও এমনকি জর্জ ফার্নাণ্ডেজ, অরুণ শৌরীর মতো ব্যক্তিত্ব। CPI(ML)(PW)কে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় করবার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচার জরুরী হয়ে পড়ে। এই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অনুরাধা মুম্বাই শহরের শান্ত জীবনযাত্রা ছেড়ে রওনা দেন নাগপুর। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব পড়ানোর কাজ করতে করতে সংগঠনের বিস্তার ঘটান সাফল্যের সঙ্গে। তাঁর আন্তরিকতা তাঁকে শিক্ষক হিসাবেও জনপ্রিয় করে তোলে। বিপ্লবী রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন বহু ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। বিচ্ছিন্ন জঙ্গী শ্রমিক আন্দোলনকে এক ছাতার তলায় আনতে নিরলস পরিশ্রম করেছেন সে সময়। নাগপুর শুধু নয়, সংলগ্ন এলাকায় কাম্পতি, খাপারখোলা, জবলপুর, অমরাবতীতেও ঠিকা শ্রমিক, বিড়িশ্রমিক, রেল শ্রমিক এবং চন্দ্রপুরে কয়লাখনি শ্রমিকদের সংগঠিত করেছেন তিনি। কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়েছে তাঁকে, ফলে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি ভালোবাসা আরো দৃঢ় হয়েছে। পুলিশি হানাদারীর ফলে যখন প্রকাশ্য কাজকর্ম অসম্ভব হয়ে পড়ে, অনুরাধা চলে যান বস্তারে গোন্দ আদিবাসীদের মধ্যে, তিনবছর সেখানে অতিবাহিত করে তাদের সমস্যা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রাকে গভীরভাবে অধ্যায়ন করলেন। কী করে তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে হয় তা হাতে কলমে দেখালেন এই বিপ্লবী নারী। মহিলাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, রাজনৈতিক শিক্ষাশিবির গড়ে সচেতন করতে থাকেন আদিবাসীদের। শুধুমাত্র তাত্ত্বিক নেতামাত্র না হয়ে থেকে একজন প্রকৃত গেরিলা যোদ্ধার মতোই বহন করতেন রাইফেল। তা তৈরির কাজটিও শিখে নেন একসময়। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি ও সচেতনতা একবার তাঁকে পুলিশের গুলিতে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়। পশ্চিম বস্তারের ন্যাশনাল পার্ক অঞ্চলে ১৯৯৭ সাল নাগাদ তীব্র দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অসহ্য গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ায় তিনি প্রথমবার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। অসুস্থ শরীরেও তীব্র ইচ্ছাশক্তির বলে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতিরোধ কার্যে। তখন সেখানে ফসল ফলানো ও সুষম বণ্টনের কাজ চলছিল। শুরুটা করেছিলেন শূন্য থেকে। কঠোর অধ্যাবসায় ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলতো সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশেও। সাধারণ CPI(ML)(PW) কর্মী হিসাবে কাজ শুরু করে পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন বিদর্ভ রিজিওন্যাল কমিটি মেম্বার। যখন AILRC প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮৩ তে, তিনি ছিলেন অন্যতম স্থপতি। বিদ্যার্থী প্রগতি সংগঠন, স্ত্রী চেতনা, অল মহারাষ্ট্র কামগার ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠন, গড়ার প্রধান স্থপতি ছিলেন তিনি। নারীমুক্তির প্রশ্নে কাজ করে চলা অনুরাধা অসংখ্য তত্ত্বগত ও মতাদর্শগত প্রবন্ধ লিখেছেন সব ধরণের পত্রপত্রিকায়। মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অস্পৃশ্যতা, নারী স্বাধীনতার ওপর সুচিন্তিত প্রবন্ধের পাশাপাশি আক্রমণ করেছেন বুর্জোয়া নারীবাদ ও উত্তর আধুনিক চিন্তাকে। ইংরেজি, হিন্দি, মারাঠী ভাষায় স্বনামে ও ছদ্মনামে লিখেছেন, পিপলস্ মার্চ, জনসংগ্রাম, কলম ইত্যাদি পত্রিকায়। অনুবাদ করেছেন চেরাবান্দারাজুর কবিতা। ভারতে জাতপাত প্রশ্নে তাঁর তৈরি পলিসি পেপার পূর্বতন CPI(ML)(PW) পার্টি দলিল হিসাবে গৃহীত হয়। ২০০৭ সালের ঐক্য কংগ্রেসে CPI(Maoist)-এর একমাত্র মহিলা মেম্বার হিসাবে যোগদান করেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে। সাড়ে তিনদশকের সুদীর্ঘ কার্যকলাপ তাঁকে উন্নীত করেছিল দণ্ডকারণ্য-বিদর্ভের বিপ্লবী নারী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী হিসাবে। তাঁর সারা জীবনের লড়াই এটাই প্রমাণ করে যে নারীমুক্তি আন্দোলন আদতে শ্রেণীসংগ্রামেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মধ্যবিত্ত সুলভ বিপ্লবী বাগাড়ম্বর ও কেরিয়ার সর্বস্বতার মুখে লাথি মেরে বেরিয়ে এসেছিলেন অনুরাধা গান্ধী। তাঁর জীবনযাপন, শিশুসুলভ সারল্য এবং সকলের সাথে মিশে যাওয়ার দুর্লভ গুণ যেকোনো কমিউনিস্ট বিপ্লবীর সম্পদ।
একথা সত্য যে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে খুবই মর্মান্তিকভাবে, গোপন জীবনযাত্রার জন্যে উপযুক্ত চিকিৎসার সুযোগ, বা সময় কোনোটাই পাওয়া যায়নি। দুরারোগ্য ব্যাধিকে শেষ পর্যন্ত জয় করতে পারেননি শ্রীমতি অনুরাধা গান্ধী। কিন্তু মৃত্যুতেই তো সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। কোনো মৃত্যুতে মানুষ বিস্মৃত হয় আবার কোনো মৃত্যু তাকে অমর করে। সব হারা জনতার তরে যদি মরণ হয় তাহলে অমন হিমালয় পর্বতও তার ওজনের কাছে তুচ্ছ। চলমান বিপ্লবী ও নারী আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক অনুরাধা চিরকাল বেঁচে থাকবেন শ্রমজীবী জনতার হৃদয়ে। কারণ তিনি ছিলেন মৃত্যুর চেয়েও বড়ো।
সংগ্রাম প্রবহমান:
ফরাসী বিপ্লবকে নিয়ে ইউজিন দেলাক্রোয়ার আঁকা সেই অসামান্য ছবি Liberty Leading the people। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত বিপ্লবী নারী ছুটছেন। তাঁর এক হাতে পতাকা, ওপর হাতে রাইফেল। ১৭৮৯-এর ১৪ই জুলাই, চুরমার হয়ে গেল অত্যাচারের প্রধান কেন্দ্র বাস্তিল। শুধু ফ্রান্স নয়, গোটা ইউরোপের রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিল ফরাসী বিপ্লব। সেদিন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন নারীরা। আবার ১৮৭১-এর মার্চ মাস। ভোরবেলায় প্যারিসের অনভিজাত নারীরা পুরুষদের জাগিয়ে তুলে ভার্সাই সরকারের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সমাবেশিত করেছিলেন। সূচনা হয় প্যারি কমিউন। কমিউনের অন্যতম নেত্রী লুইসি মিশেল নিশ্চিন্ত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে, নিজের আদর্শে অটল থেকে বলেছিলেন, “মেয়েদের মুক্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য আসতে পারে একমাত্র বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সনাতন ধারনা ও মূল্যবোধকে দু-পায়ে মাড়িয়ে”। ১৯১৭-র ৮ই মার্চ। মহান ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের সূচনাই হলো শ্রমজীবী নারীদের হাত ধরে। হাজার হাজার রুশ মহিলা রুটি, জমি ও শান্তির দাবি নিয়ে নেমে এলেন পেট্রোগ্রাদের রাস্তায়। ৮ই মার্চ একটি মাইলস্টোন মাত্র। নকশালবাড়ির কৃষক রমণীরা যেদিন বুক পেতে দেন পুলিশের গুলির মুখে সেদিনটিও নিশ্চিত নারী দিবস। চন্দনপিঁড়ির অহল্যা, সরোজিনী, উত্তমী যেদিন শহীদ হন বা কলকাতার রাজপথে লুটিয়ে পড়েন লতিকা, অমিয়া, প্রতিভারা সেটিও কি একটি নারী দিবস নয়? প্রীতিলতার পথ ধরেই উঠে এসেছিলেন তেলেঙ্গানার শহীদ লাছাক্কা বা নির্মলা কৃষ্ণমূর্তি। ভারতের বৈপ্লবিক ঐতিহ্যই তাঁদের পথ করে দিয়েছিল। তাঁদের বারংবার আবির্ভাব প্রতিষ্ঠা করে একটি সহজ সত্যের যেটা মার্কস ১৮৬৮ সালের ১২ই ডিসেম্বর লুডাভিগ কুলেগম্যানকে এক চিঠিতে জানিয়ে গেছিলেন।
“যারাই ইতিহাসের কিছু জানেন, তারা এও জানেন যে মহিলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া বিশাল কোন সামাজিক বিপ্লব সম্ভব নয়।” তাই অনুরাধা আর রাসমণি একই বিপ্লবী সত্ত্বার অংশ বিশেষ, শুধু আবির্ভাব ঘটেছে ভিন্ন সময়ে। না, কোনো জন্মান্তরবাদের অযৌক্তিক গল্প নয়। যতদিন নারীর প্রতি কুৎসিত হিংসা, সামন্ততান্ত্রিক অনাচার বলবৎ থাকবে, থাকবে রাষ্ট্র ও শাসকের চোখরাঙানী, ঝরবে মানুষের চোখের জল ততদিন ঘাসে বারুদের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মাতৃজঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হবেন রাসমণি-অনুরাধারা। ইতিহাসের নিয়মেই।