সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/শেষ সুখ পরম সুখ

উইকিসংকলন থেকে
R. D. SORNOKAR, ENGR
১৭৩

শেষ সুখ পরম সুখ।

সেক্‌সপিয়র।


শেষ সুখ পরম সুখ।


 রোসিলন্ দেশে বর্ত্রাম্ নামে এক নরপতি ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পরে রাজ্যাভিষিক্ত হইলে ফ্রান্সের সম্রাট স্বীয় রাজধানী পেরিস্ নগরস্থ রাজসভায় তাঁহাকে আহ্বান করিলেন। বর্ত্রামের পিতার সহিত মহারাজের সাতিশয় সৌহৃদ্য ছিল অতএব বন্ধুর নিধন সংবাদ প্রাপ্তির পর সদয় হইয়া মিত্রতনয়ের আনুকূল্য করিতে মানস করিয়াছিলেন।

 বর্ত্রাম্ রাজকার্য্য পর্য্যালোচনের পর আপনার জননী বিধবা রাজমহিষী সন্নিধানে বসিয়া আছেন ইত্যবসরে ফ্রান্সের রাজসভাসদ্ লাফু নামক এক জন প্রাচীন পুরুষ রোসিলনে উপস্থিত হইয়া নবীন রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন এবং সম্রাটের আদেশ বিজ্ঞাপন পূর্ব্বক তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত যত্ন করিতে লাগিলেন। ফ্রান্সাধিপতি রাজাধিরাজ ছিলেন, সুতরাং তাঁহার রাজসভা হইতে অধীন ভূপতিদিগের প্রতি নিমন্ত্রণ প্রেরিত হইলেও আজ্ঞাপত্রের ন্যায় লিখিত হইত। বশম্বদ নৃপগণ ধনসম্পত্তি ও সাতিশয় সম্ভ্রম সত্ত্বেও তাহাতে অবজ্ঞা করিতে পারিতেন না, অতএব বর্ত্রামের জননী বিধবা রাণী যদিও প্রিয় তনয়কে নয়নের বহিস্থ করিতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং তদ্বিয়োগে অচির মৃত স্বামির শোক পুনর্ব্বার উথিত হইবার সম্ভাবনা ছিল তথাপি সম্রাটের আজ্ঞা হেলন বিষম বোধ করিয়া ফ্রান্সাধিপের সন্নিধানে পুত্র প্রেরণে কাল বিলম্ব করিলেন না, ত্বরায় দূত সমভিব্যাহারে গমনের নিমিত্ত নন্দনকে অনুমতি করিলেন। রাজ্ঞী তনয়কে বিদায় দিয়া স্নেহবশতঃ শোকাকুল হইলে সম্রাটের সুবিজ্ঞ দূত লাফু বিবিধ প্রবোধ বচনে তাঁহাকে শান্ত্বনা করত কহিলেন আপনার পতি রোসিলনাধিপতি সংপ্রতি পরলোক প্রাপ্ত হইয়াছেন, অবিলম্বে প্রাণাধিক প্রিয়তম সন্তান বিদেশ যাত্রা করিবেন ইহাতে অন্তঃকরণ বিষণ্ণ হইতে পারে বটে কিন্তু এক্ষণে বিষাদ বিসর্জ্জন করুন সম্রাট্‌ অতিশয় দয়ালু বিশেষতঃ আপনার স্বামির সহিত তাঁহার মহতী প্রীতি ছিল অতএব আপনার তনয়কে দেখিবার অভিলাষ করিয়াছেন অতঃপর ইঁহার সহিত মিত্রবৎ সদ্ব্যবহার এবং পিতার তুল্য সর্ব্বদা তত্ত্বাবধারণ করিবেন। অনন্তর রাণীকে সংবাদ প্রদান করিলেন ফ্রান্সাধিপতি কিয়ৎকালাবধি সাতিশয় পীড়িত হইয়াছেন চিকিৎসকেরা নানা প্রকার চিকিৎসা করিয়া প্রতীকার করিতে পারে নাই। যুবরাজ বর্ত্রামের মাতা মহারাজের শারীরিক অসুস্থতার কথা শুনিয়া অনেক ক্ষণ সন্তাপ করিয়া কহিলেন, আহা আমার সমাশ্রিতা হেলেনার পিতা যদি জীবিত থাকিতেন সম্রাট্‌কে অনায়াসে সুস্থ করিতে পারিতেন। পরে আপনার নিকটস্থ এক যুবতীকে দেখাইয়া বলিতে লাগিলেন এই হেলেনা, ইহার পিতা জেরার্দো-দি-নারবণ বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। উক্ত চিকিৎসক আপনার চরম সময়ে লালন পালন নিমিত্ত এই কন্যাটী আমার হস্তে সমর্পণ করিয়া যান্, তদবধি ইনি আমার সমীপে রহিয়াছেন। অনন্তর হেলেনার সদ্গুণ ও সুশীলতার যথেষ্ট প্রশংসা করিয়া কহিলেন পিতৃগুণেই এই রমণী গুণবতী হইয়াছেন। রাজ্ঞী যাবৎ সম্রাট প্রেরিত দূতের সহিত এই সকল কথা কহিতেছিলেন তাবৎ পর্য্যন্ত হেলেনা শোকাকুল হইয়া ক্রন্দন করিতে ছিলেন। নৃপাঙ্গনা কুমারীর জনক শোক উদ্ভূত হইল বুঝিয়া তাঁহাকে শান্ত্বনা করিলেন।

 অনন্তর বর্ত্রাম জননীকে অভিবাদন পূর্ব্বক মহারাজের বার্ত্তাবহ সমভিব্যাহারে ফ্রান্স যাত্রা করিলেন। রাজ্ঞী পুত্রের প্রস্থান কালে অশ্রুপাত করিতে২ আশীর্ব্বিধান করিয়া সম্রাটের সদস্য লাফুকে সবিনয় বচনে কহিলেন হে মহাশয় আমি এই সন্তানটী আপনকার হস্তে সমর্পণ করিলাম আপনি ইহাকে সদুপদেশ ও সৎ শিক্ষা প্রদান করিবেন কুমার সম্রাট্ সভার রীতি বর্ত্ম কিছুই জানেন না।

 বর্ত্রাম মাতার নিকট বিদায় হইয়া জননীর অনুচরী হেলেনার সহিত সম্ভাষণ করিলেন এবং তাহার নিকট বিদায় গ্রহণ পূর্ব্বক সুমধুর বচনে কহিলেন পরমেশ্বর তোমাকে সুখে রাখুন তুমি আমার মাতার শান্ত্বনা কারিণী এবং আনন্দ বর্দ্ধিনী হইয়া স্বচ্ছন্দে কাল যাপন কর।

 হেলেনা বর্ত্রামের অঙ্গসৌষ্ঠব এবং সদ্‌গুণ নিরীক্ষণাবধি মনে২ তাঁহার সহিত প্রণয়াভিলাষ করিয়াছিলেন, যদিও পিতার প্রতি সাতিশয় স্নেহবতী থাকাতে জনকের বিয়োগে শোকাকুল হন্ তথাপি নবীন নরপতির প্রতি অনুরাগ অন্তঃকরণ মধ্যে লব্ধাস্পদ হইলে পর পিতার আকার বিস্মরণ পূর্ব্বক নিরন্তর নায়কের রূপ লাবণ্য ধ্যান করিতেন। অতএব তাঁহার বিদেশ যাত্রায় অতিশয় ব্যাকুলা হইলেন। ইতি পূর্ব্বে প্রাচীন রাজমহিষীর সন্নিধানে দণ্ডায়মান হইয়া মৌনাবলম্বন পূর্ব্বক যে অশ্রুপাত করিতেছিলেন তাহাতে রাজ্ঞী মনে করেন যুবতী পিতার নাম স্মরণে রোদন করিলেন কিন্তু তখনও বর্ত্রামের নিমিত্ত রমণীর নয়ন হইতে বারিধারা নিঃসৃতা হয়।

 যুবতীর মনোমধ্যে রোসিলনাধিপতির প্রণয় বাসনা যদিও উত্তরোত্তর প্রবলা হয় তথাপি তাহা ব্যক্ত করিতে পারেন নাই, কেননা আপনি অতি দীন ব্যক্তির নন্দিনী, আপনার জনক জননী রাজার তুল্য সম্ভ্রান্ত অথবা মহা কুলীন ছিলেন না অতএব বর্ত্রামের প্রতি নায়কের ন্যায় ব্যবহার করিয়া অধিপকে যে ভাবে দর্শন করিতে হয় সেই প্রকারে তাঁহাকে অবলোকন করিতেন তথাপি অনুরাগের আতিশয্য বশতঃ তাঁহার নিকটে থাকিয়া মানসিক প্রণয় সুখানুভব পূর্ব্বক জীবন কাল যাপনের সংকল্প করিয়াছিলেন। ফলতঃ যুবতী নরনাথের পরিণীতা হইয়া স্বীয় অভিলাষ সম্পূর্ত্তি করণ এবম্প্রকার দুর্ঘট বোধ করিতেন যে কখন২ আপন মনে পরিতাপ করিতে২ কহিতেন নভোমণ্ডলস্থ উজ্জ্বল নক্ষত্রের শোভা দেখিয়া তাহার সহিত প্রেমাকাঙ্ক্ষা পূর্ব্বক পরিণয়ের প্রার্থনা যাদৃশ হাস্যাস্পদ, আমার পক্ষেও নৃপতি গগণ বিহারী জ্যোতিঃস্বরূপ হওয়াতে তাঁহার অনুরাগে আত্মবিস্মরণ পুরঃসর তদীয় সহধর্ম্মিণী হইবার আশয় তদ্রূপ উপহাস্যতার আলয়।

 যাহা হউক, বর্ত্রাম্ প্রস্থান করিলে হেলেনা তাহার অদর্শনে সাতিশয় কাতর হইলেন এবং অজস্র অস্রপাত পূর্ব্বক মহা বিষাদে সময় যাপন করিতে লাগিলেন। যদিও যুবতী স্বীয় বংশের নিকৃষ্টতা বিবেচনা করিয়া আপন মনে স্থির করিয়াছিলেন বরমাল্য প্রদান পূর্ব্বক নরপতিকে পরিণয় করিয়া প্রণয় সুখ সম্ভোগ করিতে পারিবেন না তথাপি নিরঙ্কুশ অভিলাষ দমনে অক্ষমা হওয়াতে নিরন্তর তদীয় রূপ দর্শন পূর্ব্বক নয়নদ্বয়ের তৃপ্তি সম্পাদন এবং নির্জ্জনে উপবেশন পূর্ব্বক তদীয় শ্যামল লোচনের শোভা, ধনুর তুল্য সুন্দর ভ্রূভঙ্গি, মনোহর কুন্তল এবং অমল বদন সুধাকর স্মরণ করত মনে২ মহৎ সুখানুভব করিতেন ফলতঃ আপনার নির্ম্মল মনোরূপ দর্পণে প্রতিবিম্ব রূপ তদীয় প্রতিকৃতি কল্পিত করিয়া চিত্ত চকোর চরিতার্থ করিতেন অতএব তাহার গমনে সুন্দরী আপনার প্রেমের মানসিক ফলভোগেও বঞ্চিত হওয়াতে যৎপরোনাস্তি খিন্না হইলেন।

 হেলেনার পিতা জেরার্দো-দি-নারবণ চিকিৎসা বিদ্যায় অদ্বিতীয় ছিলেন, নিরন্তর বৈদ্যক শাস্ত্রাধ্যয়ন ও বিবিধ ওষধির গুণ পরীক্ষণ করিয়া কতকগুলি মহৌষধের প্রকরণ সঙ্কলন করেন। তাহার কন্যাকে প্রদান নিমিত্ত ধনসম্পত্তি কিছুই ছিল না এ কারণ লীলা সম্বরণ সময়ে তনয়াকে সেই ভেষজ প্রয়োগের প্রকরণ উপদেশ করিয়া যান্। ফ্রান্সস্থ সম্রাটের দূত মহারাজের যে রোগের কথা কহেন ঐ প্রকরণ মধ্যে তাহারও এক ঔষধ ছিল। অতএব বর্ত্রামের গমনে যুবতী যদিও সকল বিষয়ে নিরাশা ও সাতিশয় খিন্না হইলেন তথাপি পীড়ার কথায় হঠাৎ পিতৃপ্রাপ্ত ভেষজের বিষয় স্মরণ হওয়াতে আশ্বাস করিতে লাগিলেন এবং স্বয়ং পেরিস্ নগরে গমন পূর্ব্বক সম্রাটের চিকিৎসা করিতে সংকল্প করিলেন। তাঁহার অন্তঃকরণে এক২বার ঈদৃশ সংশয়ের উদয় হইল বটে যে রাজবৈদ্যগণ মহারাজের রোগ অচিকিৎস্য বলিয়া গিয়াছেন ইহাতে দীন হীন অবোধ বালার চিকিৎসায় কাহার্‌ বিশ্বাস হইবে? কিন্তু পিতার খ্যাতি প্রতিপত্তি এবং ঔষধের গুণে দৃঢ় প্রত্যয় থাকাতে মনোমধ্যে সম্পূর্ণ আশা করিলেন চিকিৎসা করিতে পাইলে মহারাজকে নীরোগ করিবেন এবং সেই সুযোগে স্বীয় সৌভাগ্য সঞ্চয় পুরঃসর অভিলষিত নায়ক রোসিলনাধিপের পরিণীতা হইয়া কামনা পূর্ণ করিতে পারিবেন।

 রোসিলনের নবীন নৃপতি সম্রাটের আদেশে পেরিস্ যাত্রা করিলে কিয়ৎকালানন্তর এক দিন এক জন কর্ম্মকর প্রাচীন রাজমহিষীর সন্নিধানে আগমন পূর্ব্বক যথাবিধি বন্দনান্তে নিবেদন করিল আপনার প্রিয়তমা হেলেনা যুবরাজ বর্ত্রামের প্রেমাভিলাষিণী, যুবতী আপনা আপনি যে সকল কথা কহিতে ছিলেন তাহাতে এ বিষয় স্পষ্ট প্রকাশ পাইল এবং এই কারণে নায়কের অনুগামিনী হইয়া পেরিস্ রাজধানী গমনের সুযোগ দেখিতেছেন। বৃদ্ধা রাণী কিঙ্করের প্রমুখাৎ এই বৃত্তান্ত শুনিয়া প্রফুল্লমনা হইলেন এবং সেই দাসকে আদেশ করিলেন হেলেনাকে আমার নিকট পাঠাইয়া দাও তাঁহার সহিত আমার কথা আছে। অনন্তর প্রেষ্য বিদায় হইলে মনে২ ভাবিতে লাগিলেন বর্ত্রামের পিতার প্রতি আমি যখন প্রেমাসক্তা হই তখন আমারও ঈদৃশী দশা হইয়াছিল প্রেম স্বভাবতঃ যৌবন কালের অনুগামী এবং সকলেই স্বভাবের বশতাপন্ন সুতরাং তরুণ সময়ে যৌবন কুসুমে প্রেম স্বভাবতঃ কণ্টক স্বরূপে জন্মিয়া থাকে, অতএব স্বভাব বশতঃ উৎপন্ন প্রণয়ের দোষে সংস্পৃষ্ট হওয়া কাহার পক্ষে বিচিত্র নহে। আমার বিলক্ষণ স্মরণ হয় যৌবন দশায় আমারও এ বিষয়ে দোষ বোধ হয় নাই। বৃদ্ধা রাজ্ঞী আপনার মনে এই প্রকার চিন্তা করিতেছেন ইতিমধ্যে হেলেনা আসিয়া উপস্থিতা হইলেন তাহাতে রাণী স্নেহান্বিত বচনে কোমল সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন হেলেনা আমি তোমার জননী, জান কি না? হেলেনা সবিস্ময় চিত্তে উত্তর দিলেন আপনি আমার মহামান্যা ঠাকুরাণী। রাজ্ঞী তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক কহিলেন বৎসে আমি তোমার মাতা, তুমি আমার কন্যা, কেন আমার কথায় চমৎকৃতা হইয়া ম্লানা হইতেছ? হেলেনা রাজমহিষীর হঠাৎ এবম্বিধ সম্বোধনে চমৎকৃত হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন রাণী বুঝি আমার প্রণয়ের বিষয় জানিতে পারিয়াছেন অতএব সভয় হইয়া কহিলেন মহারাণী ক্ষমা করুন, আপনি আমার মাতা নহেন, কেননা রোসিলনের অভিনব ভূপতি আমার ভ্রাতা হইতে পারেন না, আমি আপনার নন্দিনী হইব এতাদৃশ সুকৃত কি করিয়াছি? অনন্তর রাজ্ঞী কৌতুক করত কহিতে লাগিলেন হেলেনা তবে কি তুমি আমার পুত্রবধূ হইবে? কেননা মাতা ও দুহিতা শব্দে বিরক্তা হইলে। বৎসে আমার তনয়ের প্রতি কি তোমার প্রণয়ানুরাগ জন্মিয়াছে? হেলেনা সাতিশয় ভীতি প্রকাশ পুরঃসর কহিলেন ঠাকুরাণি ক্ষমা করুন, এ কি আজ্ঞা করিতেছেন? নৃপবনিতা পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসিলেন হে কুমারি বল না, আমার পুত্রের প্রতি কি তোমার চিত্ত প্রণয়াসক্ত হইয়াছে? ইহাতে হেলেনা এতাবন্মাত্র প্রত্যুক্তি করিলেন রাজ্ঞি আপনি কি তাঁহাকে ভালবাসেন না? এতৎশ্রবণে রাণী কহিতে লাগিলেন হেলেনা আর এবম্প্রকার বক্রোক্তি করিয়া উত্তর দেও কেন? তোমার প্রণয়ের বিষয় ব্যক্ত কর, আকার ইঙ্গিতে প্রেম সংস্পর্শের চিহ্ণ প্রকাশ পাইয়াছে। অনন্তর হেলেনা জানুদ্বয় পাতন পূর্ব্বক উপবিষ্ট হইয়া করপুটে আপনার প্রেমাসক্তি স্বীকার করিলেন এবং লজ্জা নম্রমুখে তাঁহার নিকট এই অপরাধের নিমিত্ত ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। পরে অভীষ্ট নায়কের সহিত সমাগমের অসম্ভাবনা দর্শাইয়া কহিলেন আমার এই প্রেম মনোমধ্যেই বিলীন হইবে যেহেতু আমি যে রোসিলনাধিপের প্রতি অনুরাগিণী ইহা তাঁহার বিদিত হয় নাই। অবশেষে আপনার প্রণয় যে কেবল ভ্রমবিলসিত, এতদ্বিষয়ে এক দৃষ্টান্ত দেখাইয়া কহিলেন হে মহারাণি ভারতবর্ষীয় লোকেরা স্বভাবতঃ রশ্মি বিতরণ কারি রবির আরাধনা করিয়া মনে করে ভানুমান অর্চ্চনায় প্রসন্ন হইয়া প্রসাদস্বরূপে প্রভা বিস্তার করিতেছেন কিন্তু সূর্য্য কিছুই জানেন না কেহ পূজা করে কি না তদীয় দ্যুতি প্রকৃতির নিয়মে অবনীর উপর বিস্তীর্ণ হয়। আমার প্রেমেরও অবিকল এই ভাব। রাজ্ঞী এ সমস্ত বাক্য আকর্ণনানন্তর তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি কি সম্প্রতি পেরিস্ নগরে যাত্রা করিবার মানস করিয়াছ? হেলেনা কহিলেন হাঁ ঈদৃশ সংকল্প আছে, যৎকালে আপনার অদূরে দণ্ডায়মানা হইয়া রাজদূত লাফুর প্রমুখাৎ সম্রাটের শারীরিক অসুস্থতার বার্তা শ্রবণ করি সেই সময়ে আমার তথায় যাইবার বাসনা হয়। রাণী জিজ্ঞাসা করিলেন রাজনন্দনের প্রণয়ানুরোধে সেখানে গমনের মানস করিয়াছিলে কি না? হেলেনা কাপট্য পরিহার পূর্ব্বক সরল বচনে উত্তর দিলেন হাঁ রাজকুমারের প্রতি অনুরাগই আমার ঐ রূপ মানস উৎপাদন করে নচেৎ কোথায় পেরিস্ নগর কোথায় ঔষধ কোথায় সম্রাট এ সকল বিষয়ের চিন্তা আমার চিত্তে উদিত হইবার সম্ভাবনা কি? রাজ্ঞী এতাবৎ কাল পর্য্যন্ত সদসৎ কিছুই না কহিয়া ক্রমাগত কেবল যুবতীর প্রীতির বৃত্তান্ত শ্রবণ করিতেছিলেন এক্ষণে সটীক জানিতে চাহিলেন হেলেনার সন্নিধানে যে ঔষধ আছে তাহাতে সম্রাটের পীড়া শান্তির সম্ভাবনা কি না। অনন্তর অন্তঃকরণ নিবিষ্ট করিয়া চিন্তা করাতে স্মরণ হইল তরুণীর জনক জেরার্দো-দি-নারবণ যে সকল ঔষধ প্রস্তুত করেন তন্মধ্যে ঐ ভেষজ সর্ব্বাপেক্ষা মহৎ, উক্ত ভিষক্ মৃত্যুকালে কন্যাকে প্রদান করেন। পরে হেলেনার জনকের মুমুর্ষু কালে তাঁহার নিকট কন্যা গ্রহণ করত যে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন রাণীর স্মৃতিপথে তাহা উদিত হইল এবং বিবেচনা করিতে লাগিলেন বিধাতা বুঝি তরুণীর সৌভাগ্য এবং ফ্রান্সাধিপতির জীবন এই ভেষজের অধীন করিয়া দিয়াছেন নচেৎ ইতিপূর্ব্বে এই কুমারীর মনে তাদৃক ভাবের উদয় কেন হইবেক। অতএব সযত্ন হইয়া অবিলম্বে যুবতীকে পেরিস নগরে গমন করিতে অনুমতি দিলেন এবং সমভিব্যাহারে উপযুক্ত লোকজন প্রেরণ করত সর্ব্ব প্রকারে আনুকূল্য করিলেন। হেলেনাও সানন্দ মনে রাজ্ঞীকে প্রণাম করিয়া বিদায় হইলেন।

 যুবতী পেরিস্ নগরে উপস্থিত হইয়া লাফু দূতের সাহায্যে সম্রাট্ সমীপে গমনের অনুমতি প্রাপ্ত হইলেন কিন্তু কৃতকার্য্য হইবার নিমিত্ত তাহাকে সাতিশয় যত্ন করিতে হইল। ফ্রান্সাধিরাজ প্রথমতঃ স্ত্রীলোকের ভেষজ সেবন করিতে সম্মত হইলেন না অতএব তরুণী নরনাথকে আত্ম পরিচয় জ্ঞাপন করিলেন আমি জেরার্দো-দি-নারবণ ভিষকের নন্দিনী। ঐ বিখ্যাত বৈদ্যের নাম ও খ্যাতি প্রতিপত্তি মহারাজের বিদিত ছিল এবং কামিনী যখন কহিতে লাগিলেন আমি মহারাজকে যে ঔষধ প্রদান করিব আমার পিতা বহু দর্শন ও দূর বিবেচনা পূর্ব্বক এই ভেষজ প্রস্তুত করিয়া মৃত্যুকালে আমাকে দিয়া গিয়াছেন যদিস্যাৎ দুই দিবসের মধ্যে আরোগ্য করিতে না পারি মহারাজ আমার প্রাণ নষ্ট করিবেন তখন সম্রাট্ ঔষধ সেবনে সম্মত হইলেন। হেলেনা সম্রাটের নিকট পীড়া শান্তি করিতে পারিলে পারিতোষিক স্বরূপে অভীষ্ট স্বামি লাভ প্রার্থনা করিলেন। মহারাজ অচিকিৎস্য রোগের অল্পকাল মধ্যে প্রতীকার করিবার প্রতিজ্ঞা দর্শনে তৎক্ষণাৎ অঙ্গীকার করিলেন কুমারি তুমি আমার পীড়া শান্তি করিয়া কৃতকার্য্য হইতে পারিলে আমার তনয় ব্যতীত ফ্রান্সের মধ্যে যে কোন পুরুষকে বরণ করিতে বাসনা করিবে তাহারই সহিত তোমার বিবাহ দেওয়াইয়া দিব।

 হেলেনা পিতৃদত্ত ঔষধের প্রভাবে আপনার সৌভাগ্য সঞ্চয়ের যে আশা করিয়াছিলেন তহিাতে বঞ্চিত হইলেন না। সম্রাট্ ভেষজ সেবন করিয়া দুই দিন অতীত না হইতে২ সম্পূর্ণ রূপে আরোগ্য ও স্বাস্থ্য লাভ করিলেন। মহারাজ স্বস্থ হইয়া অবিলম্বে অঙ্গীকৃত সম্পাদন নিমিত্ত রাজসভা সংক্রান্ত সমস্ত যুবা ব্যক্তিদিগকে আহ্বান করিয়া তরুণীকে কহিলেন এই সকল তরুণ পুরুষদিগের মধ্যে কাহার গলে বরমাল্য প্রদান করিতে তোমার বাসনা হয়? হেলেনা সেই যুবক বৃন্দমধ্যে আপনার চিরাভিলষিত রোসিলনাধিপতি বর্ত্রামের দর্শন পাইয়া মনস্কামনা সিদ্ধ হইল বোধ করিলেন এবং হর্ষে পুলকিত হইয়া তৎক্ষণাৎ কহিলেন মহারাজ এই রাজনন্দন পাণিপীড়ন পুরঃসর নিরন্তর আমার লোচনানন্দ প্রদান করেন এই আমার প্রার্থনা। পরে বর্ত্রামের প্রতি সপ্রণয় নয়ন নিক্ষেপ পূর্ব্বক কহিলেন নাথ আমি এতাদৃক্ প্রার্থনা করিতে পারি না যে আপনি আমার প্রতি প্রণয়ী হয়েন কিন্তু আমি আত্মা কে চিরকালের নিমিত্ত আপনকার দাস্যকরণে নিযুক্ত করিলাম। সম্রাট্ দেখিলেন কামিনীর মনোভীষ্ট বর অভিনব রোসিলনাধিরাজ অতএব তাঁহাকে আদেশ করিলেন বর্ত্রাম এ যুবতী অতিশয় রূপবতী, গুণবত্তার পরিচয়ও পাওয়া গেল অতএব ত্বরায় ইহার পাণি গ্রহণ কর ইনি তোমার ভার্য্যা হইবেন। বর্ত্রাম্ সম্রাটের আদেশেও সহসা তরুণীকে গ্রহণ করিতে উৎসুক হইলেন না, সন্দিগ্ধচিত্ত হইয়া যুবতীকে কহিলেন তুমি অতি দীন চিকিৎসকের কন্যা, আমার পিত্রালয়ে পালিত হইয়া এক্ষণেও আমার জননীর দানের উপর নির্ভর করত জীবন ধারণ করিতেছ, আপনার কুলের মান সম্ভ্রম বিবেচনা করিলে তোমাকে পরিণয় করিতে পারি না। হেলেনা বর্ত্রামের উপেক্ষায় সাতিশয় ক্ষুন্না হইলেন কিন্তু তাঁহার প্রতি আপনার মন নিতান্ত অনুরক্ত থাকাতে ক্ষোভেও প্রণয়াশা ত্যাগ করিতে পারিলেন না। অতএব সম্রাট্ সমীপে গমন পূর্ব্বক নিবেদন করিলেন মহারাজ আমার ভেষজে আরোগ্য লাভ করিলেন পরমাহ্লাদের বিষয় কিন্তু আমি অভীষ্ট প্রাপ্ত হইলাম না যেহেতু রোসিলনাধিপতি মহারাজের আজ্ঞা লঙ্ঘন পূর্ব্বক আমাকে অবজ্ঞা করিলেন। ফান্সাধিরাজের স্বাধিকারস্থ কুলীনগণের পরিণয় বিষয়ে বিশেষ ক্ষমতা ছিল যুবতীর প্রমুখাৎ বর্ত্রামের আজ্ঞা হেলন সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া ক্রুদ্ধ হইলেন এবং বর্ত্রাম্‌কে আনয়ন পুরঃসর বল দ্বারা সেই দিবস পাণিগ্রহণ ব্যাপার সম্পাদন করিয়া দিলেন। রোসিলনাধিপকে অগত্যা দারপরিগ্রহ করিতে হইল। কিন্তু চিরদুঃখিনী হেলেনা যদিও আপন জীবনকে সঙ্কটে নিক্ষেপ পূর্ব্বক মহারাজের আনুকূল্যে বহুকালের আশার বস্তু লাভ করিয়া মহামান্য সম্ভ্রান্ত পতির পরিণীতা ভার্য্যা হইলেন তথাপি সহসা কোন প্রকার সুখের মুখ সন্দর্শন করিতে পারিলেন না কেননা স্বামী পাণি গ্রহণ করিয়াও উপেক্ষা করিতে লাগিলেন, দম্পতীর প্রীতি পরস্পরের অনুরাগ সাপেক্ষ, সম্রাটের সাধ্য কি যে রাজশাসনে তাহা জন্মাইয়া দিবেন।

 যাহা হউক যথাবিধি বিবাহ ক্রিয়া নির্ব্বাহ হইলে রোসিলন্‌রাজ বর্ত্রাম্ ভার্য্যাকে বলিলেন সম্রাটের সভা হইতে আমাদের বিদায় গ্রহণ কর। হেলেনা প্রিয়তমের আদেশে মহারাজের নিকট প্রার্থনা করিবামাত্র স্বদেশে প্রত্যাগমনের অনুমতি হইল। অনন্তর যুবরাজ জায়াকে বলিলেন তোমার সহিত অকস্মাৎ পরিণয় হওয়াতে মনোমধ্যে যৎপরোনাস্তি উদ্বিগ্ন হইয়াছি অতএব যে কোন ব্যবহার করিব তাহাতে বিস্ময় বা চমৎকার বোধ করিও না। যদিও হেলেনা জীবনাধীশের এই বাক্যের ভাব তদানীং অনুভব করিতে পারিলেন না কিন্তু অনতিবিলম্বে প্রকাশ পাইল স্বামী তাঁহাকে পরিত্যাগ করিবার মানস করিয়াছেন, কেননা তৎপরেই জননীর সন্নিধানে গমনের আদেশ হইল। যুবতী পতির নির্দয় নিদেশে সাতিশয় খিন্না হইলেন এবং কাতরতা পূর্ব্বক সবিনয় বচনে নিবেদন করিলেন মহাশয় এ বিষয়ে আমার বাঙ্নিষ্পত্তি করণের ক্ষমতা নাই, আমি আপনার নিতান্ত অধীনা কিঙ্করী, দৈবযোগে আমার সৌভাগ্যের উদয় হইয়াছিল কিন্তু গ্রহবিগুণ প্রযুক্ত অনুরূপ গুণ না থাকাতে তাহার ফল ভোগে বঞ্চিত হইলাম। যাহা হউক এই অভাবের দূরীভাব নিমিত্ত এখন অনুদিন যত্ন করিব। তরুণীর এবম্প্রকার কাতর্য্য অবলোকনে ও রোসিলনাধিপ বর্ত্রামের সাহঙ্কার হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হইল না। বনিতাকে একটাও সৎ কথা না কহিয়া সঙ্কল্প সাধনে কৃতনিশ্চয় হইলেন এবং অবিলম্বে পরিত্যাগ পুরঃসর প্রস্থান করিলেন।

 অতএব হেলেনা যদিও অসম সাহসিতা পূর্ব্বক ফ্রান্সে যাত্রা করিয়া মহারাজের জীবন রক্ষা এবং রোসিলনাধিপতিকে পরিণয় করিয়া কৃতকার্য্যা হইলেন তথাপি অনুতাপ করিতে২ পেরিস্ হইতে প্রাচীন রাজমহিষীর নিকট প্রত্যাগমন করিতে হইল। অপর গৃহে প্রবেশ করিয়া স্বামির আন্তরিক নির্দয়তা প্রকাশক এক লিপি প্রাপ্ত হইলেন তাহাতে তাঁহার আশা লতা একেবারে ভগ্না হইয়া গেল সুতরাং পূর্ব্বাপেক্ষা মহাবিষাদে কাল ক্ষেপ করণে প্রবৃত্ত হইলেন।

 বৃদ্ধা রাজ্ঞী পুত্র ইচ্ছা পূর্ব্বক পাণি গ্রহণ করিলে স্নুষাকে যে রূপে গ্রহণ করিতে হয় তদ্রূপ সমাদর পুরঃসর হেলেনার অভ্যর্থনা করিলেন এবং রাজকুমার পরিণয়ের দুই দিবস পরে অসৌজন্য প্রকাশ পূর্ব্বক যুবতীকে বাটী প্রেরণ করাতে তাঁহার যে মনঃ ক্ষোভ হয় নানা প্রকার প্রবোধ বচনে শান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। কিন্তু রাণীর এবম্প্রকার সদয় ব্যবহারেও বধূর বিক্ষিপ্ত চিত্তে স্থৈর্য্য হইল না। কামিনী শোকাবেগে বিবশী হইয়া শ্বশ্রূকে নিবেদন করিলেন ঠাকুরাণি আমার হৃদয়েশ চিরকালের নিমিত্ত পরিত্যাগ করিয়াছেন যুবরাজের প্রেরিত পত্রী বাচন করিয়া দেখুন। পরে অধীরতা প্রযুক্ত স্বয়ং সেই লিপি গ্রহণ পূর্ব্বক পাঠ করিলেন যথা—হেলেনা যখন তুমি আমার অঙ্গুলিভূষণ প্রাপ্ত হইবে তখন আমাকে স্বামি বলিয়া সম্বোধন করিও। কিন্তু আমি অঙ্গুরী প্রদান করিব না ও ঐ তখন কখনই হইবেক না। পত্রী পাঠ করিয়া যুবতী মোহবশতঃ সংজ্ঞা শূন্য হইলে বৃদ্ধা রাণী শান্ত্বনা করিয়া বলিলেন বৎসে ধৈর্য্যাবলম্বন কর বর্ত্রাম এক্ষণে স্থানান্তরে আছেন তুমি আমার নিকট যে ভাবে ছিলে সেই ভাবে কন্যার ন্যায় অবস্থিতি কর। তোমার যে সমস্ত অনুপম গুণের নিদর্শন প্রাপ্ত হইয়াছি তাহাতে মূঢ় বর্ত্রাম কি, তদপেক্ষা বিংশতি গুণ গুণান্বিত স্বামী তোমাকে লাভ করিয়া চরিতার্থতা স্বীকার পূর্ব্বক অনুক্ষণ ভার্য্যা বলিয়া সম্বোধন করিতে বাসনা করিবে। কিন্তু দয়াশীলা শ্বশ্রূ স্নুষার শান্ত্বনা নিমিত্ত বৃথা চেষ্টা পাইলেন যুবতী অনিমিষ নয়নে স্বামির পত্রী নিরীক্ষণ করাতে পুনর্বার শোকে ব্যাকুলা হইলেন এবং তদবস্থায় উচ্চ স্বরে পাণিগ্রাহির সেই লিপির এক প্রান্তস্থ এই লিখন পাঠ করিলেন যথা যখন আমার কলত্র নাই তখন ফ্রান্সদেশ মধ্যে আমার কিছুই নাই। বর্ষীয়সী মহিষী বধূর প্রমুখাৎ ঐ কএকটী শব্দ শুনিয়া জিজ্ঞাসিলেন বৎসে এ সকল কথা কি বর্ত্রামের লিপিমধ্যে লিখিত আছে? শোক বিকলা হেলেনা কিঞ্চিং ধৈর্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক পত্রীর প্রতি পুনর্বার নেত্রপাত করিয়া নিরীক্ষণ করত কহিলেন হাঁ অম্ব, এই কএক পদ এক পার্শ্বে লেখা রহিয়াছে।

 পর দিবস উষা সময়ে শোকসন্তপ্তা যুবতী রাজসদন হইতে নির্গত হইয়া এক দিকে গমন পূর্ব্বক অদৃশ্যা হইলেন এবং প্রস্থান সময়ে শ্বশ্রূর সুগোচর নিমিত্ত স্বীয় অভিপ্রায় জ্ঞাপন পুরঃসর এই লিপি লিখিয়া গেলেন আমার নিমিত্ত আপনকার নন্দন রাজ্য ও রাজসদন পরিত্যাগ করিয়া দূরদেশে আছেন এই অপরাধে আমি সাতিশয় লজ্জিত হইয়াছিলাম অতএব এক্ষণে পাপের প্রায়শ্চিত্ত নিমিত্ত সেন্ত জেক্‌স-লি-গ্রান্দ তীর্থ পর্য্যটনে যাত্রা করিলাম আপনি নিজ সন্তানের সমীপে এতৎ সংবাদ প্রেরণ পূর্ব্বক লিপিতে লিখিবেন স্নুষা তোমার অবজ্ঞায় চিরকালের নিমিত্ত আলয় পরিত্যাগ করিয়াছে।

 বর্ত্রাম্ পেরিস্ নগর পরিত্যাগ পূর্ব্বক ফ্লোরেন্সে গমন করিয়া সম্রাটের সেনানীপদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন এবং শৌর্য্য বীর্য্য প্রকাশ পুরঃসর কএকটা সমর বিজয় করেন। সে স্থানে মাতার প্রেষিত পত্রী প্রাপ্ত হইয়া তদ্‌যোগে এই আনন্দ বর্দ্ধক সংবাদ অবগত হইলেন যে হেলেনা আর তাঁহাকে উত্যক্ত করিবে না বিবেকিনী হইয়া দেশান্তরে প্রস্থান করিয়াছে। রোসিলনের নবীন অধিপ এই সমাচারে মহা হর্ষিত হইলেন এবং অবিলম্বে স্বদেশ প্রত্যাগমনের মানস করিয়া আয়োজন করিতে লাগিলেন। এই সময় পতিবিরহে বিষন্না হেলেনা তীর্থযাত্রির বেশে ফ্লোরেন্স দেশে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 সেন্ত জেকস-লি-গ্রান্দ তীর্থে গমন করিতে হইলে যাত্রিদিগকে ফ্লোরেন্স নগর দিয়া যাইতে হইত অতএব হেলেনার ঐ নগরে আগমন পথ ঘটিত হইল। যুবতী নগরী মধ্যে প্রবেশ করিয়া শুনিতে পাইলেন তথাকার ধর্ম্ম পরায়ণা এক বিধবা অবলা তীর্থ যাত্রি দিগকে আপন ভবনে স্থান দান পুরঃসর যথোচিত আতিথ্য করিয়া থাকেন। অতএব সেই পুণ্যশীলা ললনার আলয় অনুসন্ধান পুর্ব্বক তথায় গিয়া উপনীত হইলেন। আতিথেয় যোষা অভ্যাগত রমণীর যথোচিত অভ্যর্থনা করিলেন এবং তাহাকে সেই নগরীস্থ আশ্চর্য বিষয় সকল প্রদর্শনের আশ্বাস দিয়া কহিলেন বৎসে যদিস্যাৎ অত্রত্য নরপতির সেনা দেখিতে অভিলাষ থাকে আমার সঙ্গে চল উত্তমরূপে দেখাইয়া আনিব। যদি অবনীপতির অনীকিনী দর্শন করিতে যাও তন্মধ্যে তোমার স্বদেশীয় এক জন যুবার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পাইবে। ঐ ব্যক্তি রোসিলন্ দেশের রাজা, এখানে সম্রাটের সেনানায়ক হইয়া শোর্য্য বীর্য প্রকাশ পূর্ব্বক ভূরি২ রণ জয় করিয়া মহাবীর পরাক্রম বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছেন। হেলেনা যখন শুনিলেন ঐ নগরে রাজকীয় সেনামধ্যে আপনার পরম প্রণয় ভাজন বর্ত্রামের দর্শন পাইবেন তখন সাতিশয় ব্যগ্রতা সহকারে সেই মহিলার নিকট সৈন্যাবলোকনের বাসনা ব্যক্ত করিলেন এবং তৎক্ষণাৎ তাঁহার সমভিব্যাহারে পুনর্ব্বার প্রিয়তমের বদন সুধাকর নিরীক্ষণ দ্বারা শোকাকুল হৃদয়ের যৎকিঞ্চিৎ শান্ত্বনা করণাশয়ে গমন করিলেন। সেই প্রবীণ ললনা সেনা স্থানের অদূরে উপস্থিত হইয়া বর্ত্রামকে দেখাইয়া সমভিব্যাহারিণী যুবতীকে জিজ্ঞাসা করিলেন কেমন এ যুবা কি রূপবান্ নহেন? হেলেনা অকপটে উত্তর দিলেন হাঁ। ইনি পরম সুন্দর, নিরীক্ষণে নয়নের সার্থক হইল। পথিমধ্যে গমন কালে সেই অবলা হেলেনাকে কেবল বর্ত্রামের কথা কহিয়াছিলেন অপর যুবরাজ যে প্রকারে দারি পরিগ্রহ করেন এবং দুর্ভগা পত্নীর দুরদৃষ্ট বশতঃ অবিলম্বে তাহাকে পরিত্যাগ পুর্ব্বক যে রূপে মহারাজের সৈন্যাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন এ সমস্ত বিষয় বিশেষরূপে বর্ণনা করিয়াছিলেন। হেলেনা সাতিশয় স্থিরতা সহকারে মনোযোগ পূর্ব্বক ঐ সকল কথা শ্রবণ করেন কিন্তু প্রাচীনা উল্লেখিত বিষয়ের বিবরণ সমাপন করিয়া যখন অন্য একটা গল্প আরম্ভ করিলেন তখন হেলেনার হৃদয় শল্য বিদ্ধ প্রায় হইয়া অত্যন্ত ব্যথিত হইল সেই গল্পের সংক্ষিপ্তার্থ এই যে বর্ত্রাম সেই বিধবার দুহিতার প্রতি আসক্ত হইয়াছেন।

 ফ্রান্সাধিরাজ যে যুবতীর সহিত বর্ত্রামের বিবাহ দেন যদিও তাহাতে যুবার প্রীতি জন্মে নাই তথাপি অবলার প্রণয় রসাস্বাদনে তাঁহার চিত্ত বিরক্ত ছিল না কেননা সৈন্যসামন্ত সমভিব্যাহারে যখন ফোরেন্স নগরে অবস্থিতি করিতেছিলেন তখন হেলেনা যে বিধবা যোষার সদনে অতিথ্য স্বীকার করিলেন সেই নারীর দাএনা নামী কন্যার সহিত প্রণয়োৎপাদন নিমিত্ত যৎপরোনাস্তি যত্ন করিয়াছিলেন। দাএনার রূপ লাবণ্যে মোহিত হইয়া প্রতিদিন নিশাভাগে তদীয় শয়নাগারের গবাক্ষ তলে গিয়া দণ্ডায়মান হইতেন এবং সুন্দরীর শারীরিক সৌন্দর্য্যের বর্ণন পূর্ব্বক প্রেম ভিক্ষা করিতেন। অপর বিবিধ প্ররোচন বচন প্রয়োগ পুরঃসর প্রার্থনা করিতেন নিশীথ সময়ে পুরস্থ সমস্ত প্রাণি সুষুপ্তি প্রাপ্ত হইয়াছে সুন্দরি এক্ষণে আলয়ে প্রবেশের অনুমতি কর না কেন? কিন্তু দাএনা যুবাকে কৃতদার জানিতেন সুতরাং তাহার ঐ রূপ, অনুপযুক্ত প্রার্থনা গ্রাহ্য অথবা আপন প্রেমের কোন লক্ষণ প্রকাশ করিতেন না। উক্ত যুবতীর জননী ধর্ম্মশীলা এবং সচ্চরিত্রা ছিলেন যদিও তাঁহার ধন সম্পত্তি সে সময় কিঞ্চিৎ খর্ব্ব হইয়াছিল তথাপি মহা সম্ভ্রান্ত কেপিউলেট্ বংশোদ্ভবা তনয়াকে সদুপদেশ দ্বারা সুনীতি সম্পন্না ও ধর্ম্মনিষ্ঠা করিতে ত্রুটি করেন নাই সুতরাং অসৎ প্রবৃত্তিতে যুবতীর মনঃ প্রবৃত্ত হয় নাই।

 অতিথি বৎসলা মহিলা এতদ্বিষয়ের বিবরণ হেলেনার নিকট ব্যক্ত করিয়া আপনার নন্দিনীর সদ্গুণের প্রশংসা করত কহিলেন আমার নিরন্তর সদুপদেশ ও সুশিক্ষা প্রভাবেই আমার কন্যা ধর্মভীরু ও সুশীলা হইয়াছেন। অবশেষে জ্ঞাপন করিলেন বর্ত্রাম্ বোধ হয় আগামি দিবসে ফ্লোরেন্স পরিত্যাগ করিয়া যাইবে কেননা গত রাত্রিতে আমার তনয়ার আলয় সন্নিধানে আসিয়া সাক্ষাৎ করণার্থ বিস্তর বিনয় করিতেছিল।

 প্রেমাভিলাষিণী হেলেনা আপন নায়কের নায়িকান্তরের প্রতি আসক্তির কথা শুনিয়া যদিও উৎকলিকাকুলা এবং মনোনীত কান্তের পরিগ্রহ নিমিত্ত সমস্ত যত্ন বিফল বোধে খিদ্যমানা হইলেন তথাপি প্রণয়োৎপাদনের আশা পরিত্যাগ না করিয়া নির্দয় বল্লভকে পুনর্বার প্রাপ্ত হইবার নিমিত্ত উপায়ান্বেষণ করিতে লাগিলেন। উক্ত ধর্ম্মপরায়ণ যোষার সন্নিধানে আত্ম পরিচয় প্রদান পুরঃসর ব্যক্ত করিলেন মা এ অভাগিনীই বর্ত্রামের পরিত্যক্তা বনিতা। অনন্তর সেই বৃদ্ধা ও তদীয় তনয়ার নিকট কাতরতা পূর্ব্বক সবিনয় বচনে নিবেদন করিলেন আপনারা যদিস্যাৎ এক্ষণে আমার প্রতি কৃপা প্রকাশ করেন তবে আপন দুর্ভাগ্য মোচনে যত্ন করিতে পারি। আপনারা অদ্য রাজনন্দনকে সদনে আগমনের অনুমতি করুন আমি দাএনার বেশ ধারণ পূর্ব্বক তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি। হে জননি এ প্রকারে স্বামির সহিত সাক্ষাৎ করণের তাৎপর্য এই যে তাহার নিকট হইতে একটা অঙ্গুরী দাএনার বেশে অনায়াসে গ্রহণ করিতে পারিব, স্বামী আমাকে পরিত্যাগ করিয়া বলিয়াছেন যদি কখন তাঁহার হস্ত হইতে অঙ্গুলি ভূষণ আসাদন করিতে পারি আমাকে ভার্য্যা বলিয়া পুনর্ব্বার গ্রহণ করিবেন।

 বর্ষীয়সী এবং তাঁহার বুদ্ধিমতী তনয়া হেলেনার পরিচয় পাইয়া বিবেচনা করিলেন এই দুর্ভগা ভামিনীর প্রতি অধুনা যৎকিঞ্চিৎ করুণা বিতরণ পুরঃসর আনুকূল্য করিলে উত্তর কাল বিলক্ষণ প্রত্যুপকার লাভের সম্ভাবনা অধিকন্তু ইহার সমভিব্যাহারে যে অর্থ আছে তাহা হইতে আপাততঃ কিয়ৎ সংখ্যক মুদ্রা লভ্য হইতে পারে অতএব সাহায্য প্রদানে সম্মত হইয়া সস্নেহ বচনে কহিলেন যদি এ প্রকার করিলে তোমার উপকার হয় করিব। অনন্তর হেলেনা দিবাভাগে কৌশলক্রমে প্রিয়তমের নিকট আপনার মৃত্যু সমাচার প্রেরণ করিলেন, ইহার তাৎপর্য্য এই যে বর্ত্রাম্ কলত্রের নিধন সংবাদ প্রাপ্ত হইলে দাএনাকে দাররূপে পরিগ্রহ করিবার নিমিত্ত আগ্রহান্বিত হইবেন তাহাতে আপনি দাএনার আকৃতি ধারণ পুরঃসর যুবরাজের সেই আগ্রহ সময়ে কৌশলক্রমে অঙ্গুরী প্রাপ্ত হইতে পারিবেন তাহা হইলেই ভবিষ্যতে নিঃসন্দেহ সৌভাগ্যোদয় হইবে।

 অনন্তর দিবাকর চরমাচল চূড়া অবলম্বন করিলে নিশার অন্ধকারে অবনি মণ্ডল ক্রমে সমাবৃত হইতে লাগিল। বর্ত্রাম্ দাএনার অনুরাগে উৎকলিকাকুল থাকাতে সন্ধ্যার কিয়ৎ পরেই মহিলার আলয়ে যাত্রা করিলেন। এ দিকে হেলেনাও দানার বেশ ধারণ পূর্ব্বক যুবতীর আবাসে বসিয়া নায়কের আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। অনতিবিলম্বে যুবরাজ দাএনার ভবন সন্নিধানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং অন্যান্য দিনের মত কামিনীর প্রণয় সঞ্চারাভিলাষে প্রেমালাপ আরম্ভ করিলেন। হেলেনা যদিও অন্য অঙ্গনা হইয়া প্রিয়তমের সহিত আলাপ করিলেন এবং নবানুরাগী নৃপতনয় যদিও নবীন নায়িকাকে দাএনা বোধে সাতিশয় ঔৎসুক্য সহকারে তাঁহার প্রতি প্রীতি মিশ্রিত উক্তি করিতে লাগিলেন তথাপি হেলেনা পতির প্রণয় আলাপ বলিয়া তাহাতে সাতিশয় প্রীতা হইলেন। দাএনা এপর্য্যন্ত যুবরাজের সহিত প্রেমের কথা কহেন নাই সে দিবস দাএনা রূপিণী হেলেনা কথায়২ আপনার অনুরাগ ব্যক্ত করাতে নৃপতনয়ও মহা সন্তুষ্ট হইলেন এবং ব্যগ্রতা পূর্ব্বক তাঁহার প্রতি চিরানুরক্ত থাকিবার অঙ্গীকার করিলেন। হেলেনা আপনার চিরাভিলষিত প্রিয়তমের সহিত উক্ত প্রকারে কথোপকথন করিয়া এক্ষণে সানন্দ চিত্তে অশ্বাস করিলেন নায়কের অবজ্ঞাত নায়িকা হইলেও কালক্রমে ঈদৃশ প্রণয় ভাজন হইতে পারিব।

 হেলেনার রূপ গুণ ইতিপূর্ব্বে যুবরাজ বর্ত্রামের বিশেষ বিদিত ছিল না, এ কারণ ভাবিনীকে অবজ্ঞা করেন। গুণগ্রাহী যুবা যদি কামিনীর কমনীয় রূপ লাবণ্য ও অনুপম গুণের পরিচয় পাইতেন তাহা হইলে কখন অবিজ্ঞতা পূর্ব্বক তাদৃশ স্ত্রীরত্ন পরিত্যাগ করিতেন না। যদিও নৃপতনয় আপনার আলয়ে প্রতিদিন যুবতীকে অবলোকন করিতেন তথাপি তাঁহার রূপ লাবণ্যের দিকে বিশেষ মনোযোগ না থাকাতে তদ্বিষয়ের চিন্তা চিত্ত মধ্যে কদাপি উদিতা হয় নাই। অপর যে আকৃতি সর্ব্বদা দৃষ্টি গোচর হয় তাহার সৌন্দর্য্য মাধুর্য্য প্রথমতঃ যাদৃশ মনের আকর্ষক হয় নিরন্তর দেখিতে থাকিলে তাদৃক্ থাকে না ইহাতে যদিও আদৌ হেলেনার রূপ লাবণ্য রাজকুমারের চিত্ত চমৎকৃত করিয়া থাকে তথাপি অনিশ অন্যভাবে নিরীক্ষণ করাতে প্রণয়োৎপাদন করিতে পারে নাই। অপিচ তরুণীর গুণচয়ে পূর্ব্বে রাজনন্দনের পরিচয় হইবার সম্ভাবনা ছিল না কেননা কখন কামিনীকে সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া মুক্তকণ্ঠে কথোপকথন করিতে দেখেন নাই। সে যাহা হউক। হেলেনা আপনার সৌভাগ্য ও পতির সহিত সম্প্রীতি সম্পাদনের যে উপায় অবলম্বন করেন তাহা সফল এবং পরিণামে মঙ্গল দায়ক করিবার আশয়ে স্থির করিলেন এই নিশার প্রণয়ব্যবহারে প্রিয়তমের অন্তঃকরণ সম্পূর্ণ রূপে মুগ্ধ করিতে যত্ন করি। অতএব বিবিধ সরস বচনে নায়ককে আনন্দিত করিতে লাগিলেন। বর্ত্রাম্ প্রিয়তমার অকৃত্রিম আকৃতি সৌন্দর্য্য, সুমধুর বচন, এবং সরল সদ্ব্যবহারে এরূপ মুগ্ধ হইলেন যে একেবারে তাঁহাকে বিবাহ করিতে প্রতিজ্ঞা করিলেন। হেলেনা এই সময়ে আপনার সংকল্প সিদ্ধির নিমিত্ত সমুৎসুকা হইয়া চতুরতা পূর্ব্বক রাজকুমারের নিকট প্রণয়ের নিদর্শন অঙ্গুরী প্রার্থনা করিলেন। বর্ত্রাম নবীন নায়িকার ভাবে মগ্ন হইয়াছিলেন, তৎক্ষণাৎ অঙ্গুলি হইতে উন্মোচন করিয়া কমিনীর করে অঙ্গুরীয়ক সমর্পণ করিলেন। হেলেনা মনোভীষ্ট নায়কের অঙ্গুলীভূষণ প্রাপ্ত হইয়া মহা হর্ষিত হইলেন এবং আপনি ফ্রান্সাধিরাজ সকাশাৎ পুরস্কার স্বরূপে যে অঙ্গুরী লাভ করিয়াছিলেন নায়কের প্রতি গাঢ়ানুরাগের লক্ষণ ব্যক্ত করণার্থ তাহার হস্তে তাহা প্রদান করিলেন। এই রূপে পরম কৌতুকে যামিনী যাপন হইলে প্রত্যুষে রাজনন্দন প্রণয়িনীর নিকট বিদায় হইলেন এবং সেই দিন স্বদেশ গমনের নিমিত্ত অবধারিত হওযাতে অবিলম্বে রোসিলন্ নগরে জননীর সন্নিধানে যাত্রা করিলেন।


 হেলেনা অচিরে চিরপ্রণয় ভাজন প্রিয়তমের পরিগৃহীতা হইয়া চরিতার্থতা লাভ নিমিত্ত ব্যগ্রচিত্ত হইলেন অতএব আতিথেয় গৃহিণী এবং তদীয় নন্দিনীর নিকট আপনার প্রতি আনুকূল্য করণের নিমিত্ত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিয়া তাহাদের দয়ার যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা করিতে লাগিলেন শেষে সবিনয় বচনে নিবেদন করিলেন তোমাদের অনুগ্রহে বল্লভের সহিত এক দিন বিশ্রম্ভালাপ করিয়া চির তৃষিত চিত্ত চকোর চরিতার্থ করিলাম এবং অভিলষিত লাভের সোপানও হইয়ছে কেননা নায়কের অঙ্গুরী হস্তগত করিয়াছি এক্ষণে যদিস্যাৎ আর কিঞ্চিৎ করুণা প্রকাশ পুরঃসর একবার আমার সমভিব্যাহারে পেরিস্ যাত্রা কর, তাহা হইলে মনোবাঞ্ছা সম্পূর্ণ রূপে পরিপূর্ণ হয়। দয়াশীলা বিধবা মহিলা যুবতীর প্রার্থনায় সম্মত হইলেন এবং কিয়দ্দিন মধ্যে তিন জনে পেরিস্ নগরে যাত্রা করিলেন। কিন্তু সেস্থানে উপস্থিত হইবামাত্র শুনিতে পাইলেন মহারাজ প্রিয় সুহৃৎ রোসিলনাধিপের মহিষী সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত রোসিলনে প্রস্থান করিয়াছেন অতএব হেলেনা সমভিব্যাহারিণী সেই দুই নারী সঙ্গে করিয়া সম্রাটের পশ্চাৎ গমন করিলেন এবং কতিপয় দিবসের মধ্যে রোসিলনে গিয়া উত্তীর্ণ হইলেন।

 ফ্রান্সাধিরাজ হেলেনার ঔষধে নীরোগ হইয়া অনুদিন অধিক স্বাস্থ্য অনুভব করিতেছিলেন ইহাতে চিকিৎসিকার নাম নিরন্তর স্মরণ হইত। রোসিলনে উপনীত হইয়া তত্রত্য মহীপতির মহিলার সহিত সাক্ষাৎ করত মঙ্গল প্রশ্নান্তে তাঁহার কথা উথাপন করিলেন। তদ্বিষয়ে কথোপকথন হইলে পরিতাপ পূর্ব্বক বিধবা রাজ্ঞীকে কহিতে লাগিলেন তোমার সন্তান আপনার দোষে সেই বহুমূল্য কন্যারত্ন নষ্ট করিয়াছেন। প্রাচীন রাজমহিষী সদ্গুণালঙ্কৃতা স্নুষার প্রসঙ্গাবধি অধীরা হইয়া বারম্বার দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক পরিতাপ করিতে লাগিলেন। সম্রাট রাণীর শান্ত্বনা করত কহিলেন হে সুশীলে ধৈর্য্যাবলম্বন পুরসর শোকাবেগ নিবারণ কর, আমিও মনের উদ্বেগ শান্তি নিমিত্ত এ সকল বিস্মরণ করি। এতদবসরে সম্রাটের সর্ব্বাধিকারী সুশীল লাফু নিকটে আসিয়া উপস্থিত হওয়াতে তিনি রাজধিরাজকে হেলেনার কথা সহজে পরিত্যাগ করিতে দিলেন না, সম্রাটের সমীপে করপুটে দণ্ডায়মান হইয়া নিবেদন করিলেন মহারাজ যুবরাজ বর্ত্রাম্ আপনকার এবং তাঁহার মাতা ও বনিতার প্রতি অতিশয় অসদ্ব্যবহার করিয়াছেন তাহাতে তাঁহার নিজেরও যথেষ্ট অনিষ্ট হইয়াছে। আহা তাদৃশ স্ত্রীরত্ন হারাইলেন, সেই অবলার রূপলাবণ্য নিরীক্ষণে কাহার লোচন চরিতার্থ, এবং মধুর বচন শ্রবণে কাহার শ্রবণেন্দ্রিয় পরিতৃপ্ত, ও অনুপম গুণে মানস সমকৃষ্ট না হইত। ফ্রান্সাধিরাজ মন্ত্রির পরিতাপে যদিও সন্তাপিত হইলেন তথাপি প্রকৃতির গাম্ভীর্য্য প্রযুক্ত কাতর না হইয়া বরং সুবিজ্ঞ অমাত্যকে শান্ত্বনা করত কহিতে লাগিলেন এক্ষণে নষ্ট নিধির গুণকীর্ত্তন বিফল, স্মরণে কেবল দুঃখোদয় হয়, যাহা ভবিতব্য ছিল হইয়াছে, এখন রোসিলনাধিপ বর্ত্রাম্‌কে ডাকাইয়া আন দেখি। তদনন্তর নৃপতনয় বর্ত্রাম্ লজ্জা নম্রমুখে সম্রাট সমীপে আগমন করিলেন এবং আপনার অবিহিতাচরণ নিমিত্ত অনুতাপ করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। মহারাজ মৃত রোসিলনাধিপতির চির সৌহৃদ্য এবং তদীয় মহিষীর সবিনয় সৌজন্যের অনুরোধে যুবরাজের প্রতি সদয় হইয়া অপরাধ মার্জ্জন করিলেন। পরন্তু অনতি বিলম্বে রাজকুমারের অঙ্গুলি পর্ব্বে আপনার অঙ্গুলি ভূষণ অবলোকন করাতে তাঁহার করুণাপূর্ণ মুখমণ্ডল পুনর্ব্বার বিবর্ণ হইয়া উঠিল। রাজাধিরাজের স্মরণ হইল হেলেনার চিকিৎসায় সন্তুষ্ট হইয়া এই অঙ্গুরী তাহাকে পারিতোষিক দিয়াছিলাম। সেই গুণবতী যুবতী পরিষদ্‌মধ্যে এই পুরস্কার গ্রহণ কালে ধর্ম্ম সাক্ষি করিয়া অঙ্গীকার করিয়াছিল যদিস্যাৎ কদাচিৎ আপদ্ আপতিত হয় তাহা হইলে ইহা সমাট সমীপে প্রেরণ করিব নচেৎ অন্য সময়ে কদাপি হস্তান্তর করিব না। যুবরাজ বর্ত্রাম্ তাহার পাণিগ্রাহ বটে কিন্তু এ তাহাকে পরিত্যাগ করিয়াছে, কিরূপে এই অঙ্গুরী প্রাপ্ত হইল? অনন্তর রাজনন্দনকে জিজ্ঞাসা করিলেন বর্ত্রাম্ তুমি এই অঙ্গুলি ভূষণ কোথায় পাইয়াছ? বর্ত্রাম্ রাজাধিরাজের বিস্ময় উৎপাদন পুরঃসর উত্তর দিলেন মহারাজ আমার প্রণয়াভিলাষিণী এক কামিনী আপনার অনুরাগ ব্যক্ত করণাশয়ে স্বীয় আলয়ের গবাক্ষ দ্বার দিয়া আমার হস্তে এই অঙ্গুরী প্রদান করিয়াছিলেন। সম্রাট বর্ত্রামের এই অসঙ্গত উত্তর শ্রবণে বিবেচনা করিতে লাগিলেন এ ব্যক্তি আপনার বনিতাকে ঘৃণা করিত বোধ হয় তাহার প্রাণ সংহার করিয়াছে নচেৎ পরিত্যক্তা ভার্য্যার অঙ্গরী ইহার হস্তে আসিবার সম্ভাবনা কি? অতএব হত্যাপরাধের আশঙ্কায় যুবরাজকে ধৃত করিবার নিমিত্ত রক্ষক দিগকে আদেশ করিলেন এবং সকলের সমক্ষে মুক্তকণ্ঠে কহিতে লাগিলেন আমার অন্তঃকরণ ঘোর চিন্তায় আচ্ছন্ন হইল। মনে হইতেছে যেন বর্ত্রাম্ অত্যাচার করিয়া হেলেনার জীবন বিনষ্ট করিয়াছে। এই সময় দাএনার জননী তনয়া সমভিব্যাহারে সম্রাটের সমীপে আগমন পুরঃসর আবেদন করিল মহারাজ রোসিলনাধিরাজ কুমার বর্ত্রাম্ আমার দুহিতাকে বিবাহ করিতে অঙ্গীকার করিয়া আসিয়াছেন যথাবিধি পাণিগ্রহণ নিমিত্ত তাঁহার প্রতি আদেশ হয়। বর্ত্রাম্ রাজাধিরাজ ফ্রান্সাধিপতির কোপ দর্শনে সাতিশয় ভীত হইয়া সমুদায় অস্বীকার করিলেন। দাএনা হেলেনার নিকট হইতে বর্ত্রামের অঙ্গুরী লইয়া আসিয়াছিল অতএব জননীর কথায় নৃপতনয় অস্বীকার করিলে সত্যতা সপ্রমাণ নিমিত্ত সেই অঙ্গুরী নৃপতি সমক্ষে বহির্গত করিয়া নিবেদন করিল মহারাজ বর্ত্রাম্ আমার পানি গ্রহণার্থ অঙ্গীকার করিয়া এই অঙ্গুলি ভূষণ সমপর্ণ করেন আমিও তাঁহাকে আপনার অঙ্গুলি মুদ্রা প্রদান করিয়াছি। সম্রাট সেই যুবতীর প্রমুখাৎ অঙ্গুরীয়কের কথা শ্রবণ করাতে তাহাকেও তৎক্ষণাৎ অবরোধ করিতে আজ্ঞা দিলেন এবং দাএনা অঙ্গুরীর যে আগম বৃত্তান্ত বর্ণনা করিল বর্ত্রামের কথার সহিত তাহার অনৈক্য দেখিয়া অতিশয় সংশয়ান্বিত হইলেন। অবশেষে সকলের সাক্ষাতে কহিলেন হেলেনার এ অঙ্গুরী, এই যুবতী এবং যুবরাজ কি প্রকারে ইহা প্রাপ্ত হইয়াছে যদিস্যাৎ যথার্থ না বলে উভয়ের প্রাণ দণ্ড করিব। দাএনা সম্রাটের কথায় বিনয় পুরঃসর নিবেদন করিল আমার জননী এক জন রত্ন বণিকের সন্নিধানে এই অঙ্গুরী ক্রয় করিয়াছেন আজ্ঞা হউক আমরা বণিককে আপনার সমীপে আনিয়া উপস্থিত করি। দাএনার এই প্রার্থনা গ্রাহ্য হইলে তাহার জননী বাহিরে গেল এবং অবিলম্বে হেলেনাকে সমভিব্যাহারে লইয়া প্রত্যাগমন করিল।

 রোসিলনের প্রাচীন রাজমহিষী অঙ্গুরীর প্রসঙ্গবধি স্নুষার শোকে ও তনয়ের বিপদাশঙ্কায় কাতর হইয়া মনে করিতেছিলেন যুবরাজ বুঝি যথার্থই স্ত্রী হত্যা করিয়াছে। দাএনার জননী গমন করিলে কিঞ্চিৎ পরে দূর হইতে দেখিতে পাইলেন সেই বর্ষীয়সীর সমভিব্যাহারে প্রিয়া হেলেনা আগমন করিতেছেন অতএব মনের সমস্ত বিষাদ বিস্মরণ পূর্ব্বক হর্ষে পুলকিত হইলেন। অনন্তর হেলেনা আসিয়া উপস্থিত হইলে নৃপতি যদিও তাহাতে আপনার জীবন প্রদা প্রমদা হেলেনার অবয়ব সাদৃশ্য দর্শনে আহ্লাদিত হইলেন তথাপি তিনি হেলেনা কি না, এতৎ সংশয় আশু নিবৃত্তি করিতে পারিলেন না। অতএব জিজ্ঞাসা করিলেন ইনি কি বর্ত্রামের বনিতা হেলেনা? হেলেনা পতির পরিত্যক্ত বধূ, এ প্রযুক্ত অভিমান প্রকাশ পুরঃসর উত্তর করিলেন প্রভো আমি বর্ত্রামের পরিণীতা পত্নী নহি, আপনি বুঝি তাঁহার ভার্য্যার ছায়া দর্শন করিতেছেন, যদি তাহা হয় তবে নামমাত্র বর্ত্রামের কলত্র বস্তুতঃ নহে। বর্ত্রাম্ এক্ষণে ভার্য্যার নিমিত্ত কাতর ছিলেন অতএব হেলেনার দর্শন ও তাহার এই সমস্ত বাক্য শ্রবণানন্তর চিনিতে পারিয়া আনন্দিত হইলেন এবং হর্ষাবেগ বশতঃ উচ্চ স্বরে কহিলেন এই যে আমার চিত্তপ্রীণনী প্রণয়িনী, সুন্দরি অপরাধ ক্ষমা কর। হেলেনা প্রিয়তমের বচনে প্রণয়ের্ষ্যা প্রকাশ পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, নাথ আমি এই যুবতী দাএনার বেশ ধারণ করিয়া এক দিবস আপনকার প্রেম ভাজন হইয়াছিলাম বটে কিন্তু আমার স্বরূপে একটা প্রিয় কথাও প্রাপ্ত হই নাই, এই দেখুন আপনার লিপি বর্ত্তমান আছে। ইহা বলিয়া পূর্ব্বে যে পত্রী অপূর্ণ নয়নে অবলোকন করত কাতর স্বরে বাচন করিয়াছিলেন এক্ষণে হর্ষোৎফুল লোচনে আনন্দ গদ্গদ বাক্যে তাহা পাঠ করিতে লাগিলেন। তদনন্তর প্রিয়তমকে সম্বোধিয়া বলিলেন নাথ এক্ষণে অঙ্গুরী আসাদিত হইয়াছে, এখন আপনি আমাকে গ্রহণ করিবেন কি না? আমি সর্ব্ব প্রকারে জয়ী হইয়াছি। যুবরাজ কহিলেন সুন্দরি আমি কি সে রাত্রি তোমার সহিত কথোপকথন করিয়াছিলাম? সে দিন কি দাএনা আপন সদনে ছিলেন না? আমার এ বিষয়ে অতিশয় সংশয় হইল। যাহা হউক, তোমার সঙ্গে সে নিশা তাদৃশ সুখে বঞ্চন করিয়াছিলাম যদি এ বিষয় সপ্রমাণ করতে পার তোমার চিরক্রীত হইয়া থাকিব। হেলেনা ঐ বিষয়ের প্রমাণ নিমিত্তই দাএনা ও তদীয় জননীকে সমভিব্যাহারে আনিয়াছিলেন অতএব তাহা সপ্রমাণ করা তাঁহার পক্ষে দুরূহ হইল না। অনন্তর মহারাজ সুশীলা দাএনার চরিত্র বিবেচনা করিয়া মনে করিলেন রূপ লাবণ্য সম্পন্ন কামিনীরা কোন প্রকার খ্যাতাপন্ন কর্ম্ম করিলে তাহাদিগকে বিশিষ্ট বরপ্রদান করিলেই যথেষ্ট পুরস্কার বোধ করে অতএব আপনার জীবন দায়িনী রমণীর প্রতি এবম্প্রকারে আনুকূল্য কারিণী দাএনার পুরস্কার নিমিত্ত অঙ্গীকার করিলেন হে যুবতি তোমাকে অবিলম্বে কোন সম্ভ্রান্ত পুরুষের গৃহিণী করিয়া দিতেছি।

 হেলেনা স্বামি সঙ্গতা হইয়া দুঃখনন্তর পরম সুখ সম্ভোগ করত জনকের চরণ স্মরণ পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন পিতৃদত্ত সামান্য ধন হইতে শুভ গ্রহের আনুকূল্যে এই সৌভাগ্য সম্পাদিত হইল, জনকের ঔষধ ফলেই এক্ষণে চিরাভিলষিত প্রিয় বর্ত্রামের পরম প্রণয়াস্পদ মহিষী এবং রোসিলনের প্রাচীন রাজ্ঞীর স্নেহান্বিতা স্নুষা হইলাম ইতি।