বিষয়বস্তুতে চলুন

সে/৯

উইকিসংকলন থেকে
(পৃ. ৮১-৮৯)
◄  
১০  ►

 সকালবেলায় পুপেদিদি উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলে, দাদামশায়, সে-কে নিয়ে সব গল্প কি ফুরিয়ে গেল।

 দাদামশায় খবরের কাগজ ফেলে রেখে চষমা কপালে তুলে বললে, গল্প ফুরোয় না, গল্প-বলিয়ের দিন ফুরোয়।

 আচ্ছা ও তো গা ফিরিয়ে পেলে তারপরে কী হোলো বলো না।

 আবার ওকে গা খাটিয়ে মরতে হবে, গায়ে পড়ে নিতে হবে নানা দায়। কখনো গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াবে, কখনো গালমন্দ গা পেতে নেবে, কখনো নেবে না, কখনো কাজে গা লাগবে কখনো লাগবে না। ওর গা থাকা সত্ত্বেও কুঁড়েমি দেখে লোকে বলবে কিছুতে ওর গা নেই। কখনো গা ঘুরবে, কখনো গা কেমন করবে, গা ঘুলিয়ে যাবে, কখনো গা ভার হবে, কখনো গা মাটি-মাটি করবে, গা ম্যাজম্যাজ করবে, গা সির্‌সির্‌ করবে, গা ঘিন্‌ঘিন্ করতে থাকবে। সংসারটা কখনো হবে গা-সওয়া কখনো হবে উণ্টো, কারো কথায় গা জ্ব’লে যাবে কারো কথায় গা যাবে জুড়িয়ে। বন্ধু বান্ধবের কথা শুনে গায়ে জ্বর আসবে। এত মুস্কিল একখানা গা নিয়ে।

 আচ্ছা দাদামশায়, ও যখন আর-একজনের গা নিয়ে বেড়াত তখন মুস্কিল হোত কার। গা-কেমন করলে ওর করত, কি তার করত।

 শক্ত কথা। আমি তো বলতে পারব না, ওকে জিগেস করলে ওরও মাথা ঘুরে যাবে।

 দাদামশায়, গা নিয়ে এত হাঙ্গাম আমি কখনো ভাবিনি।
-পৃঃ ৮৩
 ঐ হাঙ্গামগুলো জোড়া দিয়েই তো যত গল্প। গায়ের উপর সওয়ার হয়ে গল্প ছুটেছে চারদিকে। কোনো গা গল্পের গাধা, কোনো গা গল্পের রাজহস্তী।

 তোমার গা কী দাদামশায়।

 বলব না। অহঙ্কার করতে বারণ করে শাস্ত্রে।

 দাদামশায়, সে-র গল্প তুমি থামিয়ে দিলে কেন।

 বলি তাহোলে। কুঁড়েমির স্বর্গ সকল স্বর্গের উপরে। সেখানে যে ইন্দ্র ব’সে অমৃত খাচ্চেন হাজারচক্ষু আধখানা বুজে, তিনি হোলেন গল্পের দেবতা। আমি তাঁর ভক্ত; কিন্তু তাঁর সভায় আজকাল ঢুকতেই পারিনে। আমার ভাগে গল্পের প্রসাদ অনেকদিন থেকে বন্ধ।

 কেন।

 পথ ভুল হয়ে গিয়েছিল।

 কী করে।

 অমরাবতীর যে সুরধুনী নদীর একপারে ইন্দ্রলোক, তারি ভাঁটিতে আছে আরেক স্বর্গ। কার্‌খানাঘরের কালো ধোঁয়ার পতাকা উড়ছে সেখানকার আকাশে। সেটা হোলো কাজের স্বর্গ। সেখানে হাফ্‌পেণ্ট্‌পরা দেবতা বিশ্বকর্ম্মা। একদিন শরৎকালের সকালে পূজোর থালায় শিউলি ফুল সাজিয়ে রাস্তায় চলেছি; ঘাড়ের উপর এসে পড়ল বাইক-চড়া এক পাণ্ডা। তার ঝুলিতে একতাড়া খাতা, বুকের পকেটে একটা লাল কালীর, একটা কালো কালীর ফাউণ্টেনপেন, খবরের কাগজের কাটা টুকরোর বাণ্ডিল চায়না-কোটের দুই পকেট ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছে, ডানহাতের কব্‌জি ঘড়িতে ষ্ট্যাণ্ডার্ড টাইম, বাঁ হাতে কলকাতা টাইম, ব্যাগে ই আই আর, ই, বি, আর, এ, বি, আর, এন, ডর, আর, বি, এন, আর, বি, বি, অরি, এস, আই, আর-এর টাইমটেবিল। বুকের পকেটে নোটবই ডায়রি সুদ্ধ। ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়িয়ে পড়ি আর কী। সে বললে, আকাশের দিকে তাকিয়ে চলেছ কোন চুলোয়।  আমি বললুম, রাগ কোরো না পাণ্ডাজি। মন্দিরে পুজো দিতে যাব, রাস্তা খুঁজে পাচ্চিনে।

 সে বললে, তোমরা বুঝি মেঘের দিকে হাঁ-ক'রে-তাকানো রাস্তা-খোঁজার দল। চলো পথ দেখিয়ে দিচ্চি।

 আমাকে হিড়্ হিড়্ ক'রে টেনে নিয়ে এল বিশকর্ম্মা ঠাকুরের মন্দিরে। হাঁ না করবার সময় দিলে না। কিছু জিগেস করবার আগেই বললে, রাখো এইখানে থালা, পকেট থেকে বের করো পাঁচসিকে দক্ষিণে।

 বোকার মতো পুজো দিলেম। তখনি হিসেব সে টুকে নিলে তার নোট বইয়ে। কব্‌জিঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে, হয়েছে কাজ, এখন বেরোও। সময় নেই।

 পরদিন থেকেই দেখি ফল ফলেছে। ভোর তখন সাড়ে চারটে। ডাকাত পড়েছে ভেবে ধড়ফড় ক'রে ঘুম ভেঙে শুনি, অনাথ-তারিণী সভার সভ্যেরা বারো তেরো বছরের পঁচিশটা ছেলে জুটিয়ে দরজায় এসে চীৎকারস্বরে গান জুড়ে দিয়েছে,—

   যত পেটে ধরে, তার চেয়ে ভরো পেটে,

   টাকাপয়সায় পকেট পড়ছে ফেটে,

  হিসেব খতিয়ে দেখলে বুঝতে পারো,

  অনাথজনের কত ধার তুমি ধারো।

    তারো, গরীবেরে তারো,

    তারো, তারো, তারো।

 তারো তারো-করতে করতে ভীষণ চাঁটি পড়তে লাগল খোলে। মনে মনে যত খতিয়ে দেখছি তহবিলে কত টাকা বাকি, চাঁটি ততই কানে তালা ধরিয়ে দিলে। সঙ্গে সঙ্গে বাজল কাঁসর, তারো তারো তারো-ক'রে নাচ জুড়ে দিলে ছেলেগুলো। অসহ্য হয়ে এল। দেরাজ খুলে থলিটা বের করলেম। সাতদিনের না-কামানো দাড়িওয়ালা ওদের সর্দ্দার উৎসাহিত হয়ে চাদর পেতে ধরলে। থলি ঝাড়তে বেরোল একটাকা ন আনা তিন পয়সা। মাসের দুদিন বাকি, দরজির দেনার জন্যে টানাটানি করে ঐটুকু রেখেছিলেম।

 গান ছেড়ে গাল সুরু করলে। বললে, অগাধ টাকা, চিরটা দিন পায়ের উপর পা দিয়ে গদিয়ান হয়ে বসে আছি, ভুলেছ যেদিন মরবে, সেদিন তোমার মতো লক্ষপতির যে দর আর আমাদের ছেঁড়া ট্যানাপরা ভিখিরিরও সেই দর।

 এ কথাগুলো পুরোনো ঠেকল, কিন্তু ঐ লক্ষপতি বিশেষণটাতে শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।

 এই হোলো শুরু। তারপরে ইতিমধ্যে পঁচিশটা সভার সভ্য হয়েছি। বাংলাদেশে সরকারী সভাপতি হয়ে দাঁড়ালেম। আদি ভারতীয় সঙ্গীতসভা, কচুরিপানাধ্বংসন সভা, মৃত-সৎকার সভা, সাহিত্যশোধন সভা, তিন চণ্ডীদাসের সমন্বয় সভা, ইক্ষু-ছিবড়ের পণ্যপরিণতি সভা, খন্যানে খনার লুপ্তভিটা সংস্কার সভা, পিঁজরাপোলের উন্নতি-সাধিনী সভা, ক্ষৌরব্যয়নিবারিণী-দাড়ি-গোঁফরক্ষণী সভা—ইত্যাদি সভার বিশিষ্ট সভ্য হয়েছি। অনুরোধ আসছে, ধনুষ্টঙ্কারতত্ত্ব বইখানির ভূমিকা লিখতে, নব্যগণিত পাঠের অভিমত দিতে, ভুবনডাঙায় ভবভূতির জন্মস্থান নির্ণয় পুস্তিকার গ্রন্থকারকে আশীর্ব্বাদ পাঠাতে, রাওলপিণ্ডির ফরেষ্ট অফিসারের কন্যার নামকরণ করতে, দাড়িকামাননা সাবানের প্রশংসা জানাতে, পাগলামির ওষুধ সম্বন্ধে নিজের অভিজ্ঞতা প্রচার করতে।

 দাদামশায়, মিছিমিছি তুমি এত বেশি বকো যে তোমার সময় নেই বললে কেউ বিশ্বাস করে না। আজ তোমাকে বলতেই হবে গা ফিরে পেয়ে কী করলে সে।

 বিষম খুসি হয়ে চলে গেল দমদমে।

 দমদমে কেন।

 অনেকদিন পরে নিজের কান দুটো ফিরে পেয়ে স্বকর্ণে আওয়াজ শোনবার সখ ওর কিছুতে মিটতে চায় না। শ্যামবাজারের মোড়ে কান পেতে থাকে ট্রামের বাসের ঘড়ঘড়ানিতে, টিটেগড়ের চটকলের দারোয়ানের সঙ্গে ভাব করে নিয়েছে তার ঘরে বসে কলের গর্জ্জন শুনে ওর চোখ বুজে আসে। ঠোঙায় করে রসগোল্লা আর আলুর দম নিয়ে বার্ণ কোম্পানির কামারের দোকানে বসে খেতে যায়। বন্দুকের তাক অভ্যেস করতে গোরা ফৌজ গেছে দমদমে, ও তারি ধুম্‌ ধুম্‌ শব্দ শুনছিল আরামে, টার্গেটের ওপারে ব’সে। আনন্দে আর থাকতে পারলে না, টার্গেটের এধারে মুখ বাড়িয়ে দেখতে এসেছে, লাগল একটা গুলি ওর মাথায়। -বাস্।

 বাস্ কী দাদামশায়।

 বাস্ মানে সব গল্প গেল একদম্‌ ফুরিয়ে।

না, না, সে হোতেই পারে না। আমাকে ফাঁকি দিচ্চ। এমন ক’রে তো সব গল্পই ফুরোতে পারে।

 ফুরোয় তো বটেই।

 না সে হবে না কিছুতেই। তারপরে কী হোলো বলে।

 বলো কী—মরার পরেও।

 হাঁ মরার পরে।

 তুমি গল্পের সাবিত্রী হয়ে উঠলে দেখছি।

 না, অমন ক’রে আমাকে ভোলাতে পারবে না, বলো কী হোলো।

 আচ্ছা বেশ।—

 লোকে বলে মরার বাড়া গাল নেই। মরার বাড়াও গাল আছে সেই কথাটা বলি তবে।—ফৌজের ডাক্তার ছিল তাঁবুতে, মস্ত ডাক্তার সে। সে যখন খবর পেলে মানুষটা মগজে গুলি লেগে মরেছে, বিষম খুসি হয়ে লাফ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল—হুর্‌রা।

 খুসি হেলো কেন।  ও বললে, এইবার মগজ বদল করার পরীক্ষা হবে।

 মগজ বদল হবে কী ক’রে।

 বিজ্ঞানের বাহাদুরি। জু থেকে চেয়ে নিলে একটা বনমানুষ। বের করলে তার মগজ। আর সে-র মাথার খুলি খুলে ফেললে। তার মধ্যে বাঁদরের মগজ পুরে দিয়ে খড়ির পলেস্তারা দিয়ে মাথাটা বেঁধে রাখলে পনেরো দিন। খুলি জুড়ে গেল। বিছানা ছেড়ে সে যখন উঠল, তখন সে এক বিষম কাণ্ড। যাকে দেখে তার দিকে দাঁত খিচিয়ে কচীমিচি করে ওঠে। নর্স দিলে দৌড়। ডাক্তার সাহেব বজ্রমুঠিতে ওর দুই হাত চেপে ধরে জোর গলায় বললেন, স্থির হয়ে বোসো এইখানে। ও হুঙ্কারটা বুঝলে কিন্তু ভাষাটা বুঝলে না। ও চৌকিতে বসতে চায় না, ও লাফ দিয়ে উঠে বসতে চায় টেবিলের উপরে। কিন্তু লাফ দিতে পারে না, ধপ্ ক’রে পড়ে যায় মেজের উপর। দরজাটা খোলা ছিল, বাইরে ছিল একটা অশথ গাছ। সবার হাত এড়িয়ে ছুটল সেই গাছের দিকে। ভাবলে এক লাফে চড়তে পারবে ডালে। বারবার লাফ দিতে থাকে অথচ ডালে পৌঁছতে পারে না, ধপ্ ক’রে পড়ে যায়। বুঝতেই পারে না কেন পারছে না। রেগে রেগে ওঠে। ওর লক্ষ দেখে চারদিকে মেডিকেল কলেজের ছেলেরা হো হো ক’রে হাসতে থাকে। ও দাঁত খিচিয়ে তেড়ে তেড়ে যায়। একজন ফিরিঙ্গি ছেলে গাছতলায় পা ছড়িয়ে বসে কোলে রুমাল পেতে রুটি মাখন দিয়ে কলা দিয়ে আরামে খাচ্ছিল, ও হঠাৎ গিয়ে তার কলা ছিনিয়ে নিয়ে দিলে মুখে পুরে; ছেলেটা রেগে ওকে মারতে যায়, বন্ধুদের হাসি কিছুতে থামতে চায় না।

 মহা ভাবনা পড়ে গেল ওর জিন্মে নেবে কে। কেউ বললে, পাঠাও জু-তে, কেউ বললে, অনাথ-আশ্রমে। জু-র কর্ত্তা বললে এখানে মানুষ পোষা আমাদের বরাদ্দে নেই, অনাথ-আশ্রমের অধ্যক্ষ বললে এখানে বাঁদর পোষা আমাদের নিয়মে কুলোবে না।  দাদামশায়, থামলে কেন।

 দিদিমণি, জগতের সব কিছুর সব শেষে আছে থামা।

 না, এ কিন্তু এখনো থামেনি। কলা ছিনিয়ে খাওয়া ও-তো যে-সে পারে।

 আচ্ছা, কাল হবে, আজ কাজ আছে।

 কাল কী হবে বলো না অল্প একটুখানি।

 জানো তে ওর বিয়ের সম্বন্ধ আগেই হয়েছে। ওর যে মগজ বদল হয়ে গেছে সে খবরটা কনের বাড়িতে পৌঁছয় নি। দিন স্থির, লগ্ন স্থির। বরের পিসে ওকে মস্ত দু’ছড়া কলা খাইয়ে ঠাণ্ডা করে বিয়ের জায়গায় নিয়ে গেছেন। তার পরে বিয়ে বাড়িতে যে কাণ্ডটা হোলো তা ভালো করে ফলিয়ে বললে তখন তুমিই বলবে গল্পের মতো গল্প হয়েছে। এর পরে আর ওকে মেরে ফেলবার দরকার হবে না। সে মরার বাড় হবে।

 * * * * 

 সন্ধ্যেবেলায় বসেছি ছাদে। দিব্যি দক্ষিণের হাওয়া দিচ্ছে। শুক্লা চতুর্থীর চাঁদ উঠেছে আকাশে। পুপুদিদি একটি আকন্দের মালা গেঁথে এনেছে কঁচপাত্রে—গল্প বলা শেষ হলে বকশিষ মিলবে।

 হেনকালে হাঁপাতে হাঁপাতে সে উপস্থিত। বললে, আজ থেকে আমার গল্প জোগানের কাজে আমি ইস্তফা দিলুম। আমাকে পাতু গেঁজেলের গা পরিয়েছিলে, সেও সহ্য করেছি, শেষকালে বাঁদরের মগজ পূরেছ আমার খুলির মধ্যে, এ সইবে না। এর পরে হয়তো আমাকে চামচিকে কি টিকটিকি কি গুবরে পোকা বানিয়ে দেবে। তোমাদের অসাধ্য কিছুই নেই। আজ আপিসে গিয়ে কেদারা টেনে বসেছি দেখি ডেস্কের উপরে এক ছড়া মর্ত্তমান কলা। সহজ অবস্থায় কলা আমি ভালোই বাসি—কিন্তু এখন থেকে আমাকে কলা খাওয়া ছেড়েই দিতে হবে। পুপুদিদি, এর পরে তোমার ঐ দাদামশায় আমাকে নিয়ে যদি ব্রহ্মদত্যি কিম্বা কন্ধকাটা বানান, তা হোলে কাগজে না ছাপান যেন। ইতিমধ্যে কন্যাকর্ত্তা এসেছিলেন আমার ঘরে। বিয়েতে আশি ভরি সোনা দেবার কথা পাকা ছিল,—একদম নেমে গেছে তেরো ভরিতে, ওরা বুঝেছে আমার ভাগ্যে এর পরে কনে জোটা দায় হবে। এই তবে বিদায় নিলেম।