বিষয়বস্তুতে চলুন

হারানো খাতা/পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ

প্রভু! এলেম কোথায়!
বরষ গত হ’ল জীবন বহে গেল,
কখন কি যে হ’ল জানিনে হায়!
আসিনু কোথা হ’তে, যেতেছি কোন্ পথে,
ভেসেছি কালস্রোতে তৃণের প্রায়।
মৃত্যুসিন্ধুপানে চলেছি প্রতিক্ষণ,
তবুও দিবানিশি মোহেতে অচেতন,
জীবন অবহেলে, আঁধারে দিনু ফেলে,
কত কি গেল চলে, কত কি যায়।

—অজ্ঞাত

 কালীপদর বাড়ী যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যার বড় দেরি নেই। ওযে অত গরীব ছিল তা আমি কোন দিন জানতে পারিনি। সামনের দরজাব একটা পাল্লা ভেঙ্গে বোধ করি কোথায় চলে গেছে, আর একখানা বাতাসে ঢক্ ঢক্‌ শব্দ করছে। বাড়ীখানা এক সময়ে যে গাঁয়ের মধ্যে সব চাইতে বড় লোকেরই বাড়ী ছিল, সে আজও তার বিরাট বপু দেখেই বেশ বোঝা যায়। হলে হবে কি, আজ যে তার এ গাঁয়ে সবার চাইতেই দশা মন্দ, সেও তো আমি একটু ক্ষণের মধ্যেই দেখতে পেলেম।

 “উঠানে তুলসীমঞ্চে প্রদীপ দিয়ে একটী কিশোরী মেয়ে তার ময়লা কাপড়ের আঁচলটুকু গলায় জড়িয়ে প্রণাম করছিল, আমায় দেখতে পেয়েই সেই আঁচল সে গায়ে টেনে দিলে, মুখের চেহারা থেকেই জান্‌তে পারলুম যে সে আমার কালীপদর বোন সুখদা।

 “সুখদার মা যত পারলেন কাঁদলেন, জন্মের মতন দ্বীপান্তরিত ছেলের এসে রেখে দিয়েই চলে গেলে, আমি বল্লুম, ‘সুখদাকে দেখতে অনেকটাই কথা উল্লেখ করে তার আচরণের নিন্দা করলেন এবং যারা তাকে লঘু পাপে গুরুদণ্ড দিয়ে তার চেয়েও অধিকতর পাপে পাপী হয়েছে, তাদের উদ্দেশ্যেও তিনি খুবই আশীর্ব্বাদ করতে পেরে উঠলেন না। তার পর অনেক বিলম্বে আর সব কথা চুকিয়ে দিয়ে তখন নিশ্চিত হয়ে নিজেদের কথা তুল্লেন!”

 ‘সংসার তো’ আর চলে না বাবা, যা কিছু ছিল পদ’র মোকদ্দমায় ধরে দিলাম, আইবুড় মেয়ে ঘাড়ে, কি করি এখন?”

 “আমি আগে হতেই ভাবছিলাম যে কেমন করে ওকথাটা আমি বলবো? অবশ্য পদ’র বোনকে চোখে দেখে বলবার ভাবনাটা আমার একটুখানি পরেই কমে গেছলো। কারণ কুৎসিত না হলেও সুখদাকে দেখতে এতই সাধারণ যে, সে দেখেই যে আমি ঘুরে পড়িনি, এটা অন্ততঃ তার মা বিশ্বাস করতে পারবেন। এখন আরও একটু সুযোগ পেয়ে নিঃসঙ্কোচেই বলে ফেল্লুম, “তার জন্যে ভাববেন না, কালীপদ যাবার আগে তার ভার আমার হাতে দিয়ে গেছে, আমিও তার কাছ থেকে নিয়েছি।”

 “পদ’র মা কেমন একটু সন্দেহের সঙ্গেই আমার মাথা হতে পা অবধি চোখ বুলিয়ে নিয়ে কথা কইলেন। একটু কুণ্ঠিত ভাবে বলেন, “তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে? এতগুলো পাশ করেছ, অত সুন্দর তুমি, পদ’র মুখে শুনেছিলাম, তোমার বাপ ছিলেন জেলার হাকিম। তুমি কি আমার মতন দুঃখীর মেয়েকে—”

 “আমি হাসি চেপে রেখে জবাব দিলুম—‘পদ আমায় তার ভার দিয়েছে, বিয়ে যার সঙ্গে হয় হবে, সেতো এক্ষুণিই হচ্ছে না ভাল পাত্র আর কোথাও না পান তো আমাকেই তখন দেবেন, আমারও তাতে কোন আপত্তি নেই।

 “তার পর সুখদা মায়ের হুকুম মতন আমার জন্যে জলখাবার নিয়ে কালীপদর মতন, তাই আমার আরও আপত্তি নেই।’

 “সুখদার মা এবার যে কান্নাটা কাঁদলেন তারমধ্যে আধখানা দুঃখের এবং আধখানা সুখের। সেই ছেলেই তো তাঁকে মহাদেবের মতন জামাই দিয়ে গিয়েছে।—এই কথাটা এ ক্রন্দনের মধ্যে প্রধান হয়ে রৈলো।

 “মাস পাঁচেক পরে পড়াশোনা সাঙ্গ করে ঘরে এসে বসলুম।”

 “ওইখানকারই সবজজের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা বছর পার হয় চলে আসছিল। মেয়ে আমি দেখেছি, চারুমতীকে দেখতে বোধ করি ভালই হবে, যা একটু বেশী মোটা। তা ধনীর দুলালীরা ওরকম হবেন বই কি! গণে পণে, অলঙ্কার, বস্ত্রে, এবং আসবাবপত্রে জজবাবু হাজার সাতেক টাকা মেয়ের প্রতি খরচ করবেন একথাও নাকি ধার্য্য হয়ে গিয়েছিল। আমি বাড়ী এসে বস্‌তেই তিনি লোক নিয়ে পাকা দেখার দিন ঠিক করে বলে পাঠালেন।

 “মা খুব খুসী, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর হরিষে বিষাদ হলো। মাকে সুখদার কথা ভেঙ্গে বলে জানালুম যে এ বিয়ে করা চলে না। আমি কথা দিয়েছি। মার মনে যে আঘাত লাগলো সে আমি বুঝেছিলেম। মা আমার এক সন্তানের জননী, কুটুম্বিতার সাধ একটা নারীজন্মের নাকি ঈপ্সিত। যাই হোক তবু আমার কথা বজায় রাখবার জন্যে তাঁর ধনী কুটুম্বের সাধ তিনি ছেড়েই দিলেন।

 জজবাবু নিজে এসে আমায় ডেকে বল্লেন, ‘জানো তুমি, তোমার মার নামে আমি ‘ব্রিচ অফ্ কণ্টাক্টের কেস’ করতে পারি।’

 “তা’ অবশ্য আমি জানতাম না। আর যতই কিছু পড়িনা কেন, আইনতো আর পড়িনি, জান্‌বো কেমন করে? একটু ভেকা হয়ে রইলুম। তিনি তখন আমায় কাবু দেখে অনেক কথাই বল্লেন এবং তক্ষুণি গালি ফিরিয়ে নিয়ে আমার ‘আশীর্ব্বাদ’ করে যেতেও রাজী আছেন, তাও জানিয়ে দিতে দেরী করলেন না। ততক্ষণে আমার জড়তা কাটলো আমি বল্লেম, ‘আমি আর একজনকে কথা দিয়েছি; তারা গরীব অনন্যোপায়, তাদের বঞ্চনা করলে ঈশ্বরের দরবারে আমি দোষী বেশী হবো। আপনার ভাবনা কিসের?’

 “কথাটা খোসামোদেরই ছাঁচে ঢালা। তাতেই বাবুটীর রাগ বাড়িলেও মাত্রাটা কিছু যে কম থাকলে সে বোধ করি উহারই জন্য। তিনি রুষ্ট পরিহাসে রূঢ় প্রশ্ন করলেন, ‘তিনি কাঁর মেয়ে শুনি’?

 “আমি বিনীতবচনে জবাব দিলাম, ‘তার বাপ ছিলেন কালেক্টরির সেরেস্তাদার, একমাত্র ভাইএর রাজদ্রোহের অপরাধে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়েছে, বুড় মা ছাড়া অপর কেউ নেই।’

 “জজবাবু যেন আঁৎকে উঠেই উঠে দাঁড়ালেন। রাজদ্রোহের নামেই বোধ করি তাঁর হৃৎকম্প উপস্থিত হয়ে থাকবে! এবার স্পষ্ট পরিহাসেই বল্লেন, ‘তাহলে কুটুম্ব নির্ব্বাচনটা করেছ ভাল! যাহোক সময় থাকতে খবরটা পেয়ে ভালই হলো, এনার্কিষ্টের দলে মেয়ে দিয়ে কি শেষে ধনে প্রাণে মারা যেতাম।’

 “মার অনুমতি নিয়ে কালীপদর মা বোনকে মার আশ্রয়ে এনে দিলাম। ভাবী পুত্রবধুর মুখ দেখে মা যে আমার খুব উল্লসিত হয়ে উঠেননি, সেতো আমি বুঝতে পেরেছিলুম, কিন্তু এ নিয়ে আমাদের মাতাপুত্রে কোন আলোচনাই আমরা হ’তে দিইনি। মন তার কল্পনার স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে চাইবে বইকি! নিজের ছেলের মস্ত নামওলা শ্বশুর, আর সুন্দরী বউ কোন মা কবে চায়নি? অথচ কর্ত্তব্যের খাতিরে কতকিই না করতে হয়। ক’জনের মাই বা ভরাবুকে বউ ঘরে তুলতে পেরেছেন। সয়ে যাওয়া দরকার,—চুপ করে সবই সয়ে যাওয়া,যা পাই তাকেই যথাসাধ্য ভাল মনে করা—এই টুকুই যে মস্ত বড় দরকার। ঐটুকু না পারলেই যে মানুষ একেবারে গেল।”

 “সুখদারা রয়ে গেল, আমি চাকরীর জন্য খোঁজ খবর করে বেড়াচ্চি আরও দুটো একটা পাশ টাস দেবারও ইচ্ছে আছে, বিয়ের জন্য সুখদার মা ছাড়া আর কারু যে বিশেষ কোন ত্বরা আছে তারতো কোন লক্ষণই দেখিনে। আমার হ্যাঁ, তা আমার যে একেবারেই ছিলনা, তাও বলতে পারিনে, আবার ছিলই যে তাও বলবার ভরসা আমার নেই। বিয়ে জিনিষটা সম্বন্ধে খুব বেশী তলিয়ে আমি কোন দিনই ভাবিনি। গোটা কয়েক পাশ করার সঙ্গে ও’ও যেন একটা দায় চোকান। কিন্তু সুখদাকে আমার ভালই লাগছিল। ভালবাসা একে বলতে হয় বলো, আরতো কখনও ভালবাসিনি, কাজেই ও নিয়ে তর্ক আমি কতে পারবে না, তবে ভালবাসার বর্ণনা যেখানে যত পড়েছি, তাদের সঙ্গে এ ভালবাসার সম্পর্কটা বড় বেশীই অল্প। সুখদা থাকে মার অন্তঃপুরে আমি থাকি হয় সদর বাড়ীতে না হয়ত কলকাতায়। বাড়ীর মধ্যে গেলে কখন কখন সুখদাকে এক আধবার দেখতে পাই। একটু গম্ভীর গম্ভীর চালে সে হয়ত মায়েদের দুজনের পূজোর যোগাড় করছে, না হয়ত পান সাজবার সরঞ্জাম নিয়ে বসে গেছে, মধ্যে মধ্যে পড়তে বসে মা তাকে ‘বোকামেয়ে’ বলে অনুরাগ করছেন, তা’ শুনতে পেয়ে হাসি চেপে আমি বাইরে পালিয়ে এসে হেসে ফেলেছি। আহা, মা আমার ওপর যা খুসী হচ্চেন, ‘গাধা পিটে ঘোড়া বানানো’ মুখের কথাটীতো নয়! সুখদার মেধা জিনিষটা বড্ডই নাকি কম! অন্ততঃ মার ত সেই রকমই বিশ্বাস!

 “বেশী দিন গেল না। বাবার চাকরী, তাঁর অসময়ে মৃত্যুর সুপারিসে আমি নাকি পেতে পারতুম, কিন্তু ইচ্ছা হলোনা সেটাকে কাজে লাগাতে। তা’ভিন্ন সেই সবজজবাবু নাকি আমার সম্বন্ধে সরকারের কান ভারী করে রেখেছেন এম্‌নি একটা, গুজবও শোনা গেল। আমি নিজের টাকা দিয়ে একটা আয়ুর্ব্বেদিক ঔষধের দোকান খুলে বস্‌লেম। দেশে এক বিচক্ষণ বৃদ্ধ কবিরাজ ছিলেন—মকরধ্বজ সুরকির গুঁড়ো মেশাতে না জানায়, তাঁর কিছুমাত্র পশার ছিল না। তাঁকে দিয়ে খাঁটি মকরধ্বজ তৈরিটা শিখে নেবার চেষ্টা করতে লেগে পড়া গেল। তাঁকে আমার সহায় করে কস্তুরী ভৈরব বা মহামৃত্যুঞ্জয় রসে কস্তুরীর বদলে আদা বাটা বন্ধ করে দেশের লোক যাতে খাঁটি জিনিষটা পায় আর বিলিতি ওষুধের মতন নিঃসঙ্কোচে মারাত্মক রোগীকে খাওয়াতে পারে, তারই জন্যে উঠে পড়ে লাগবো মনে করেছিলেম। তা কপালে তো দেশের সেবা করবার পুণ্য সঞ্চিত করা ছিলনা হবে কি করে?

“আমার কবিরাজখানায় সত্যকার মুক্তাভস্ম, স্বর্ণভস্ম—করাতের গুঁড়ো নয়,—নিখুত নেপালী কস্তুরী এবং যত রকম গাছ গাছড়া পাওয়া সম্ভব ছিল, ক্রমে ক্রমে যোগাড় করে তুল্‌ছি, এমন সময় এমন মারাত্মক হয়ে আমাদের দেশে বসন্ত মড়ক দেখা দিলে যে তার কাছে আসল নকল সব রকমের কস্তুরী ভৈরব বা মৃত্যুঞ্জয় রস ভয় পেয়ে পালিয়ে রইলো। হরিনাম সহজে তো কেউ নেয় না। তা একদিনের মধ্যে অমনি পঁচিশবারই হয়ত ঐ নাম গানটা কানে শোনা তো যেতই, মুখেও বলতে হয়েছে বই কি পাড়া পড়শীর খাতিরে। মা আমার জন্যে ভয় করলেও নিজে নির্ভয়ে পড়সীর সেবায় ছুটে যেতেন; আমায় এঁটে উঠতে না পেরে কপাল চাপড়ে খুন হতেন, কিন্তু তবু জোর ক’রে বারণ করতেন না, কেঁদে বলতেন ‘ও নিজের কাজ করে রাখচে, বারণ আমি করবো কি করে? বিপদতারণ তো আছেন, তাঁকেই প্রাণপণে ডাকচি।’

“প্রথমে এ বাড়ীতে বসন্তের ছোঁয়া লাগলে সুখদার মাকে। তাঁর সেবা আমরা তিন জনেই কর্‌ছিলুম, কিন্তু দুজনেই আমরা একদিনের আড়া আড়িতে দুজনকারই মাকে হারিয়ে ফেল্লেম। সুখদা মেয়ে মানুষ সে লুটোপুটি করে তার হারানো জিনিষের জন্য চেঁচিয়ে কেঁদে শোক প্রকাশ করলে, কিন্তু বেটাছেলে হয়ে জন্মেছি বলে আমার কত বড় ক্ষতি আমায় শুধু নিঃশব্দ চোখের জল দিয়েই সাঙ্গ করে নিতে হলো। তার উপর যে মুখের চেয়ে জগতে আমার আর কিছুই সুন্দর ও প্রিয় ছিল না, সেই সবচেয়ে আদরের মুখই আমার নিজের হাতে—ভাবতে গেলে সমস্ত মন যেন ভয়ে ও বিস্ময়ে শিউরে ওঠে। পেরেছিলুমও তো!

 “সুখদার জন্যেই ভাব্‌ছিলুম যে বাড়ী ছেড়ে দুজনে কোথাও পালাব নাকি? এমন সময় আমার পালাবার শক্তি হরণ করে আমার সর্ব্বশরীর ব্যেপে বসন্তর গুটি দেখা দিল। সে কি যন্ত্রণা! উঃ সে কি যন্ত্রণা। বোধ করি শর শয্যা পেতে শুলেও তেমন করে সর্ব্বশরীরে তার ফলাগুলো বেঁধে না। হাজার হাজার ছুঁচ দিয়ে যদি সর্ব্বশরীরের মাংসের মধ্যে ফোঁড় তোলা যায় তাতেও কি অত বেশী যন্ত্রণা দিতে পারে? উপকথার রাজার যেমন চোখে শুদ্ধ ছুচ বেঁধা ছিল আমার চোখেও যেন তাই হলো। বিশেষ করে ডান চোখটায়। রোগের খেয়ালে যন্ত্রণার আর্ত্তনাদে কেবলই মরা মাকে আকুল হয়ে ডেকেছি আর সঙ্গে সঙ্গেই কার অশ্রুজলে ভেজা কাতর স্বর কানে গেছে, মা, মা, মা শেতলা! ভাল করে দাও মা! মা, মা, মা, মা, ভাল করে দাও মা!

 “যতক্ষণ জ্ঞান ছিল সুখদাকেই অনুভব করেছিলুম, দেখবার তো চোখ ছিল না। মধ্যে মধ্যে তাকে মিনতি করে বলেও ছিলুম ‘পালিয়ে যাও সুখদা! কেন অনর্থক প্রাণ দেবে, আমি তো গিয়েইছি।’

 সে কেঁদে উঠে বলেছিল ‘এক সঙ্গেই যাই চলো, একলা আমি দাঁড়াবো কোথায়?

 “এই প্রথম আর শেষ কথা আমাকে সে বলেছিল। এর পরের কোন কথাই আমার আর মনে নেই। আমার যখন জ্ঞান হলো তখন আমার সকল স্মৃতি লুপ্ত হয়ে গেছে, তাই মনে নেই কত দিনে কত অল্পে অল্পে আমি আমার সেই মরণ শয্যা থেকে বেঁচে উঠেছিলুম?

 “হাসপাতালের কম্পাউণ্ডারদের কাছে পরে শুনেছি, ডাক্তার যে দিন বজরা করে আস্‌তে আস্‌তে জ্বলন্ত চিতা থেকে আমায় মাটিতে আছড়ে পড়তে দেখে ছুটে গিয়ে আমায় জীয়ন্ত দগ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করেন, তার পর থেকে প্রায় ছয় মাস পরে আমার গায়ের ঘা শুকিয়ে আমার বাঁচবার আশা দেখা দেয়। এতকাল ধরে হাঁসপাতালের বাহিরে একটা স্বতন্ত্র ঘরে পড়ে আমি মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছি। প্রাণ, জিনিসটা তো কঠিন বড় কম নয়! আচ্ছা এই যে আমি মরে গিয়েও বেঁচে উঠলুম, এর পর থেকে কি আমার পুনর্জ্জন্ম হলো না? আমি কি আর সেই আগের আমিই আছি? মরে যে গিয়েছিলুম, তা ত বুঝতেই পারা যাচ্ছে। পোড়াতে যারা এনেছিল’ তারা আমার নিকট বন্ধু কেউ যে নয়, তা চিতায় তুলে দিয়ে প্রস্থান করার প্রমাণও হচ্ছে। কিন্তু কি ভয়ানক আয়ুর জোর আমার! আর অমন নির্জ্জন ‘শ্মশান’ ঘাটেও কিনা অত বড় ‘বান্ধব’ জুটে গেল! সেই গলা পচা বসন্তের রোগী তুলে এনে, একবেলার পথ বয়ে এনে এই যে ছ মাস ধরে প্রাণপণ চেষ্টায় বাঁচালেন এ কি বড় সহজ কথা। আমার প্রাণটাকে যদি একটুও মায়া করবার দরকার থাক্‌তো, তা’হলে তাঁকে আমার রোজ সকালে উঠে ফুল চন্দনে পূজা করাই উচিৎ ছিল, কিন্তু তা না থাক্‌লেও তাঁর দয়ার যে শেষ হয় না তা আমায় স্বীকার তো করতেই হবে। তাঁর পায়ের তলায় পড়েই এই নূতন জন্মটাকে আমার ক্ষয় করে যাওয়াই উচিত ছিল বই কি! কিন্তু তখন কি আর মাথার কোন ঠিক আছে? কে আমি কি করচি, কোথায় যাব—সবই যে ভুল হয়ে গেছলো। ছ মাসের পর প্রাণের আশা! তার পর পাঁচ ছয় মাস প্রায় পাগলামীর বিকারে কেটে যাবে। ভাল কবে উঠতে বসতেও পেরেছি নাকি ন’মাস দশমাস পরে। সবশুদ্ধ বৎসর দেড়েক আপনা ভোলা হয়ে ছিলুম, অর্থাৎ জীবধর্ম্ম ছাড়া মানুষের ধর্ম্ম বড় কিছুই আমার মধ্যে ছিল না। তবে নিরুপদ্রব বলে পাগলা গারদে না পাঠিয়ে আমায় ভগবান আমার নিজের হাঁসপাতালেরই একপ্রান্তে ঠাঁই দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু কপালে যে বিষয় বিড়ম্বনা লেখা আছে হবে কি—মনুষ্যত্ব ফিরে আসতে না আসতে এই মুখের ছবি আমায় পাগল করে এবার পথেই ঠেলে বার করে দিলে।

 “তার পরের কথা আরও যেন খেইহারা, খাপছাড়া। আসল কথা এই যে, তখন তো আর আমার কথা বলবার জন্য ডাক্তার সাহেবের কম্পাউণ্ডার বা চাকর বাকর কেউ সাক্ষী হয়ে বসেছিল না। কোথায় কোথায় গেলুম, কবে যেন একবার ভাল হয়ে কোনখানে চাকরী করি! শীতকালটা থাকি ভাল, আবার নাকি পাগলামী ঘাড়ে চাপে, তারা তাইতে তাড়িয়ে দেয়। এমনি কি কি ঘটেছিল, ঠিক ঠিক মনে না থাকলেও একটু একটু স্মরণে আসে। শেষে যেখানে চাকরী করি তারাই আমার পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেয় বুঝি। তা সেখান থেকে বেরিয়ে অবধি আর পাগল হইনি, তবে নূতন ক’রে জ্বরে পড়ে এমন দশা হলো যে আর খেটে খাবার শক্তিটুকুও ছিল না। দু’চার দিন ভিক্ষে করে কিছু কিছু পেটে দিই, দু’চার দিন না খেয়েই কাটে, তার পর থেকে সকল কথাই বেশ স্পষ্ট মনে আছে। এই যে রাজা আমায় আমার আগের জন্মের মতনই মান দিচ্ছেন, এর কি আমি একটুখানিও যোগ্য?

 “আচ্ছা তা’হলে মানুষের সব চেয়ে বেশী দুর্ভাগ্যটা কিসে? সব হারানো, না জ্ঞান হারানো? বোধ করি জ্ঞান হারানোর মতন পাপের ভোগ আর কিছুতেই নয়। সবই তো আমার এই প্রানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। সেই জ্ঞানই যদি না রইলো তা’হলে আমার “সব”কে যে আমি হারিয়েছি, তাই আমি জানতে পারলুম কই? দুঃখ জিনিষটা যে সর্ব্বথাই পরিত্যজ্য তাও তো নয়। দুঃখকেও ভোগ কর্‌তে একটা সুখ আছে। আমার যে মা আমার ইহজম্মের আরাধ্যা দেবী ছিলেন, তাঁর বিয়োগ দুঃখকে যদি আমার মন নিশ্চিহ্ণ করে মুছে ফেলে দেয়, তা’হলে আমার পুত্র জন্ম সার্থক হবে কোথা দিয়ে? না না থাক্,—হে ভগবান! আমার এই অসীম দুঃখের পর্ব্বত তুমি ভেঙ্গে দিও না। যদি কেউ দুঃখের মধ্যে বিস্মৃতির কামনা করে, জেনো সে ভুক্তভোগী নয় বলেই তা করতে পেরেচে। আমার দুঃখ? আমার ব্যথা! আমার মনে তুমি পদ্মের মৃণাল হয়ে ওঠো, গোলাপের কাঁটা হয়ে থাকো,—তোমায় যেন আর ভুলি না। কিন্তু এই দুঃখকে বরণ করে নিতে আমি শিখলুম কোথা থেকে বলো দেখি? সেও একটি দুঃখী মেয়েরই কাছে। সে আমার মেয়ে হয়েছে। কিন্তু তাকে আমি মোটে চিনিনে। নাইবা চিনলুম? এ ভবের হাটে কেইবা কা’কে চিনচে? যার সঙ্গে যখন মেলা যায়। গঙ্গার ধারে গাছ তলায় ভোরের পাখীর মতন সে একটি আনন্দের গান গাইছিল। দুঃখ থেকেও যে আনন্দের রস ছড়িয়ে পড়ে, আর তা আঁজলা ভরে পান করা যায়, তা সেই দিনেই বুঝে নিয়েছি। নাঃ আর যা’ হই পাগল আর হবো না। এইটেই দেখছি বিধাতার সব চেয়ে বড় অভিশাপ।

 “একটা জায়গায় বড্ডই আমার খটকা লাগে। সুখদার মুখ যেন এ বাড়ীর রাণীর মুখে কে এনে বসিয়ে দিয়েছে। তার গলার শব্দও তারই চুরি করা এ’ কেমন করে হলো? আচ্ছা সুখদা মরে গিয়েছে বলে যে আমার ধারণা হয়েছিল, সেটাই কি ঠিক? কিসে জানলুম? কেউ কি আমায় বলেছিল? কিন্তু বলবেই বা আমায় কে? আমার পুরণো জগৎ থেকে কেউ তো আমার এই নুতন জগতে দেখা দিতে আসেনি। তা’হলে সে কি শুধু আমার মনেরই কল্পনা? তাহলে কি আমার সব চেয়ে বড় কর্ত্তব্যে আমি এমন করেই অবহেলা করলুম? সুখদার তাহলে কি হলো? সে তো কম দিনও নয়। চার বৎসর। এই চার বৎসর ধরে নিঃসহায়া সুখদাকে কে দেখলে? খবর নেবো,—কিন্তু কেমন করে? আমি যে মরে গেছি। মরা মানুষের চিঠি পেলে জাল বলেই লোকে উড়িয়ে দেবে। নিজে যাব? বিশ্বাস করবে কেউ? আবার হয়তো পাগলা গারদে ভর্ত্তি হব। বাড়ী ঘর টাকাকড়ি ছিল তো সবই,—তা কি তার থাকতে পেয়েছে, না আমার জ্ঞাতিরাই দখল করলে? যদি জান‍্তে পারতুম আমার সুখদা এই রাণী পরিমলের মতনই কোন দয়ালু স্বামীর হাতে পড়ে সুখে আছে, আমি বাঁচতুম যে তা’হলে। আমি যে তার ভার নিইছিলুম।

 “—কাল সংবাদ পত্রে দেখলুম, যুদ্ধ জয়ের জন্য রাজনৈতিক অনেক অপরাধীকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে! আহা আমার কালীপদ যদি আবার ফিরে আসে।—কিন্তু তাকেই বা সুখদার কথা আমি কি বলবো?”