বিষয়বস্তুতে চলুন

হাস্যকৌতুক (১৯৪৬)/আর্য ও অনার্য

উইকিসংকলন থেকে

আর্য ও অনার্য

অদ্বৈতচরণ চট্টোপাধ্যায় ও চিন্তামণি কুণ্ডু

 অদ্বৈত। তুমি কে?

 চিন্তামণি। আমি আর্য, আমি হিন্দু।

 অদ্বৈত। নাম কী?

 চিন্তামণি। শ্রীচিন্তামণি কুণ্ডু।

 অদ্বৈত। কী অভিপ্রায়?

 চিন্তামণি। মহাশয়ের কাগজে আমি লিখব।

 অদ্বৈত। কী লিখবেন?

 চিন্তামণি। আমি আর্য― আর্যধর্ম সম্বন্ধে লিখব।

 অদ্বৈত। আর্য জিনিসটা কী মশায়?

 চিন্তামণি। (বিস্মিত হইয়া) আজ্ঞে, আর্য কাকে বলে জানেন না? আমি আর্য, আমার বাবা শ্রীনকুড় কুণ্ডু আর্য, তাঁর বাবা ৺নফর কুণ্ডু আর্য, তাঁর বাবা―

 অদ্বৈত। বুঝেছি। আপনাদের ধর্মটা কি?

 চিন্তামণি। বলা ভারি শক্ত। সংক্ষেপে এই পর্যন্ত বলা যায় যে, যা অনার্যদের ধর্ম তা আর্যদের ধর্ম নয়।

 অদ্বৈত। অনার্য আবার কারা।

 চিন্তামণি। যারা আর্য নয় তারাই অনার্য। আমি অনার্য নই, আমার বাবা শ্রীনকুড় কুণ্ডু অনার্য নয়, তাঁর বাবা ৺নফর কুণ্ডু অনার্য নয়, তাঁর বাবা―

 অদ্বৈত। আর বলতে হবে না। অতএব যে-হেতুক শ্রীনকুড় কুণ্ডু আমার বাবা নন এবং ৺নফর কুণ্ডুর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, আমিই হচ্ছি অনার্য।

 চিন্তামণি। তা স্থির বলতে পারি নে।

 অদ্বৈত। (ক্রুদ্ধ হইয়া) এ তোমার কি-রকম কথা। ‘স্থির বলতে পারি নে’ কী? নকুড় আমার বাবা নয় তুমি স্থির বলতে পার না? তুমি কোথাকার কী জাত, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিসের!

 চিন্তামণি। জাতের কথা হচ্ছে না, বংশের কথা হচ্ছে। আপনিও তো ভুবনবিদিত আর্যবংশে জন্মগ্রহণ—

 অদ্বৈত। তোমার বাবা নকুড় কুণ্ডু যে বংশে জন্মেছে আমিও সেই বংশে জন্মেছি! চাষার ঘরে জন্মে তোমার এতবড়ো আস্পর্ধা।

 চিন্তামণি। যে আজ্ঞে, আপনি না হয় আর্য না হলেন, আমি এবং আমার শ্রীবাবা আর্য! হায়! কোথায় আমাদের সেই পূর্বপুরুষগণ, কোথায় কশ্যপ ভরদ্বাজ ভৃগু—  অদ্বৈত। এ-ব্যক্তি বলে কী? কশ্যপ তো আমাদের পূর্বপুরুষ আমাদের কাশ্যপ গোত্রে জন্ম—তোমার পূর্বপুরুষ কশ্যপ ভরদ্বাজ ভৃগু এ কী রকম কথা।

 চিন্তামণি। আপনি এ-সকল বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, আপনার সঙ্গে এ-সম্বন্ধে কোনো আলোচনা হতেই পারে না। হায়! এ-সকল ইংরেজি শিক্ষার শোচনীয় ফল।

 অদ্বৈত। ইংরেজি শিক্ষা আপনাতে কি ফলে নি?

 চিন্তামণি। আজ্ঞে, সে-দোষ আমাকে দিতে পারবেন না, স্বাভাবিক আর্যরক্তের তেজে আমি অতি বাল্যকালেই ইস্কুল পালিয়েছিলুম।

হরিহববাবু এবং অন্যান্য অনেকানেক লেখকের প্রবেশ

 অদ্বৈত। আসতে আজ্ঞে হোক। লেখা সমস্ত প্রস্তুত?

 হরিহর। এই দেখুন না।

 চিন্তামণি। কী বিষয়ে লিখেছেন মশায়?

 হরিহর। নানা বিষয়ে।

 চিন্তামণি। আর্যদের সম্বন্ধে কিছু লিখেছেন?

 হরিহর। না

 চিন্তামণি। আর্যদের বিজ্ঞান সম্বন্ধে―

 হরিহর। য়ুরোপীয়েরা আর্যজাতি এবং তাঁদের বিজ্ঞান―

 চিন্তামণি। য়ুরোপীয়েরা অতি নিকৃষ্ট জাতি, এবং বিজ্ঞান সম্বন্ধে আমাদের পূর্বপুরুষ আর্যদের তুলনায় তারা নিতান্ত মূর্খ, আমি প্রমাণ করে দেব। এখনো আর্য-বংশীয়েরা তেল মাখবার পূর্বে অশ্বত্থামাকে স্মরণ করে ভূমিতে তিনবার তৈল নিক্ষেপ করেন। কেন করেন আপনি জানেন?

 হরিহর। না।

 চিন্তামণি। আপনি?

 অদ্বৈত। না।

 চিন্তামণি। আপনি জানেন?

 প্রথম লেখক। না।

 চিন্তামণি। না যদি জানেন তবে আপনারা বিজ্ঞান সম্বন্ধে কথা কইতে যান কেন? হাই তোলবার সময় আর্যরা তুড়ি দেন কেন আপনারা কেউ জানেন?

 সকলে। (সমস্বরে) আজ্ঞে, আমরা কেউ জানি নে।

 চিন্তামণি। তবে? এই যে আমাদের আর্য মেয়েরা বাতাস করতে করতে পাখা গায়ে লাগলে ভূমিতে একবার ঠেকায় তার কারণ আপনারা কিছু জানেন?

সকলে। কিছু না!

 চিন্তামণি। এই দেখুন দেখি! এই সকল বিষয় কিছুমাত্র আলোচনা না করেই, অনুসন্ধান না করেই আপনারা বলেন য়ুয়োপীয় বিজ্ঞান শ্রেষ্ঠ। অথচ আর্যরা হাঁচে কেন, হাই তোলে কেন, তেল মাখে কেন, এ আপনারা কিছু জানেন না!

 হরিহর। আচ্ছা মশায়, আপনিই বলুন। তেল মাখবার পূর্বে ভূমিতে তৈল নিক্ষেপ করবার কারণ কী?

 চিন্তামণি। ম্যাগ্‌নেটিজ্‌ম্! আর কিছু নয়। ইংরেজিতে যাকে বলে ম্যাগনেটিজ্‌ম।

 হরিহর। (সবিস্ময়ে) আপনি ম্যাগনেটিজ্‌ম সম্বন্ধে ইংরেজি বিজ্ঞানশাস্ত্র কিছু পড়েছেন?

 চিন্তামণি। কিছু না! দরকার নেই। বিজ্ঞান শিক্ষা কিম্বা কোনো শিক্ষার জন্য ইংরেজি পড়বার কিছু প্রয়োজন নেই। আমাদের আর্যেরা আরো কী বলেন? প্রাণশক্তি, কারণশক্তি এবং ধারণশক্তি এই তিন শক্তি আছে, তার উপরে তৈলের সাধারণশক্তি যোগ হয়ে ঠিক স্নানের অব্যবহিত পূর্বেই আমাদের শরীরের মধ্যে ভৌতিক কারণশক্তির উত্তেজনা হয়— এই তো ম্যাগনেটিজ্‌ম। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজেরা স্নানের পরে যে গায়ে তোয়ালে ঘষে, তার কত হাজার বৎসর আগে আমাদের আর্যদের মধ্যে গামছা দিয়ে গাত্রমার্জনপ্রথা প্রচলিত ছিল ভেবে দেখুন দেখি।

 লেখকগণ। (সবিস্ময়ে) আশ্চর্য, ধন্য। আর্যদের কী বিজ্ঞানপারদর্শিতা! আর্য কুণ্ডুমশায়ের কী গবেষণা!

 হরিহর। ভালো মূর্খের হাতেই আজ পড়া গিয়েছে। কিন্তু একে চটিয়ে কাজ নেই। নানা কাগজে লিখে থাকে। শুনেছি নাকি এই আর্য কুণ্ডু ভদ্রলোকদের বড্ড গাল দিতে পারে। সেই জন্যেই বিখ্যাত।

 চিন্তামণি। ওই দেখুন― ওই আর্য ব্রাহ্মণ প্রাতঃকালে যে ফুল তুলছে—কেন তুলছে বলুন দেখি।

 অদ্বৈত। পূজার সময় দেবতাকে দেবে বলে।

 চিন্তামণি। ছি ছি, আপনারা কিছুই গভীর তলিয়ে দেখেন না। সকালে ফুল তুলতে যখন ঋষিরা অনুমতি করেছেন তখন স্পষ্টই প্রমাণ হচ্ছে যে, বাতাসে অক্সিজেন বাষ্প যে আছে এ তাঁরা জানতেন। তা যখন জানা ছিল, তখন অবশ্য অন্যান্য বাষ্পের কথাও তাঁরা জানতেন সন্দেহ নেই। এই রকম একে একে অতি স্পষ্ট করে প্রমাণ করে দেওয়া যায় যে, আধুনিক য়ুরোপীয় রসায়নশাস্ত্রের কিছুই তাঁদের অগোচর ছিল। হাই তোলবার সময় তুড়ি দেওয়া কেন? সেও ম্যাগনেটিজ্‌ম। উত্তানবায়ুর সঙ্গে আধানশক্তির যোগ হয়ে যখন ভৌতিক বলে পরিচালিত নিধানশক্তি স্বশক্তির প্রভাবে প্রাণ, কারণ এবং ধারণ এই তিনটেকে অতিক্রম করতে থাকে তখন সত্ত্ব, রজ এবং তম এই তিনেরই ব্যতিক্রমদশা ঘটে। এমন সময়ে মধ্যমা এবং বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ঘর্ষণজনিত বায়ব তাপের কারণভূত স্নায়ব তাপ সৌর তাপের সঙ্গে মিলিত হয়ে জীবদেহের ভৌতিক তাপের আত্যন্তিক প্রলয়দশা ঘটতে দেয় না। একে বিজ্ঞান বলে না তো কাকে বিজ্ঞান বলে? অথচ আমাদের আর্য ঋষিগণ ডারুয়িনের কোনো গ্রন্থই পড়েন নি।

 লেখকগণ। আশ্চর্য! ধন্য! ধন্য আর্য-মহিমা! আমরা এতদিন এ-সকল কথার কিছুই বুঝতুম না!

 হরিহর। (স্বগত) এবং আজও কিছু বুঝতে পারছি নে।

 চিন্তামণি। মাটিতে পাখা ঠোকার বিষয়ে যদি জিজ্ঞাসা করেন তো সেও ম্যাগনেটিজ্‌ম! সম্প্রসারণ এবং নিঃসারণ, বিপ্রকর্ষণ এবং নিকর্ষণ এই কটা ভৌতিক ক্রিয়ার যোগে―

 অদ্বৈত। রক্ষা করুন মশায়, আমার মাথা ঘুরছে। পাখা ঠোকার বিষয়ে আপনি আমার কাগজে লিখবেন এখন! আপনি অনেক বকেছেন আপনাকে একটা পান আনিয়ে দিই।

 চিন্তামণি। আজ্ঞে না, আপনার এখেনে আমি পান খেতে পারি নে। আপনি আর্যক্রিয়াকলাপ অনুসরণ করেন না— যে আধ্যাত্মিক শক্তি আমাদের আর্যনাড়ীতে কুলক্রমাগত প্রবাহিত হয়ে আসছে, সেই শক্তি—

 অদ্বৈত। মশায়, থাক মশায়, আপনাকে পান দেব না, আপনি পান নেই খেলেন। অনুমতি করেন তো বরঞ্চ তামাক আনিয়ে দিচ্ছি।

 চিন্তামণি। তামাক! কী সর্বনাশ! সে আরও খারাপ! উৎকৃষ্ট জাতি নিকৃষ্ট জাতির হুঁকোয় তামাক খায় না কেন? এক জাতি আরএক জাতির স্পৃষ্ট অন্ন খায় না কেন? আগে আর্য অনার্যের ছায়া মাড়াতেন না কেন? তার মধ্যে কি বিজ্ঞান নেই? অবশ্য আছে। আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সেও ম্যাগনেটিজ্‌ম। উত্তম, মধ্যম এবং অধম এই তিন প্রকার দেহজ বিকিরণশক্তি—

 অদ্বৈত। থামুন থামুন—তামাক দেব না মশায়, কাজ নেই আপনার তামাক খেয়ে। পানও থাক্, তামাকও থাক্— যাতে আপনার সুবিধে হয়, যাতে আপনার দেহজ বিকিরণশক্তি রক্ষা হয় তাই করুন।

 লেখকগণ। ধিক্ অদ্বৈতবাবু, আপনি আর্যশ্রেষ্ঠ কুণ্ডুমশায়ের জ্ঞানগর্ভ কথা শুনতে দিলেন না!

 প্রথম লেখক। (দ্বিতীয়ের প্রতি) কুণ্ডুমশায়ের কী অসাধারণ যুক্তিশক্তি ও জ্ঞান। কিন্তু কিছু কি বুঝতে পারলে ভাই?

 দ্বিতীয় লেখক। ভাই, বোঝা গেল না। ভালো করে জিজ্ঞাসা করা যাক্ না। আচ্ছা মশায়, আপনি ধারণ কারণ প্রভৃতি যে-সকল শক্তির উল্লেখ করলেন, সেগুলো কী?

 চিন্তামণি। সেগুলো আর কিছু নয়— ইংরেজিতে যাকে বলে ফোর্স, যাকে বলে ম্যাগনেটিজ্‌ম।

 লেখকগণ। (সমস্বরে) ওঃ বুঝেছি।

 হরিহর। আজ্ঞে, আমি এখনো কিছু বুঝতে পারছি নে।

 লেখকগণ। (বিরক্ত হইয়া) বুঝতে পারছেন না। ম্যাগনেটিজ্‌ম― ফোর্স— সোজা কথা। ম্যাগনেটিজ্‌ম তো জানেন? ফোর্স তো জানেন? এও তাই আর কি। আর্যদের অসাধারণ বিজ্ঞানচর্চা।

 প্রথম লেখক। এ সকল স্পষ্ট বুঝতে গেলে নানা শাস্ত্র জানা আবশ্যক। মশায়ের বোধ করি, নানা শাস্ত্র অধ্যয়ন করা হয়েছে।

 চিন্তামণি। না, শাস্ত্রটা এখনো পড়া হয় নি। আমি, আমার বাবা এবং ৺নফর কুণ্ডু আর্য— এই জন্য শাস্ত্র অধ্যয়ন আমি বাহুল্য বিবেচনা করেছি।

 দ্বিতীয় লেখক। তা বটে কিন্তু বিজ্ঞানটা আপনি অবিশ্যি ভালো করেই পড়েছেন।

 চিন্তামণি। আজ্ঞে না, আমি চিন্তাশক্তির প্রভাবে আমাদের আর্যজাতির হাঁচি কাশি তুড়ি আঙুল-মটকানো প্রভৃতি আচারব্যবহারের নানাবিধ সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসকল আয়ত্ত করেছি। আমার বিজ্ঞান পড়া আবশ্যক হয় নি। আপনার শুনে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু আর্যশাস্ত্রের দিব্যি নিয়ে আমি শপথ করতে পারি আমি আর্যশাস্ত্র কিম্বা বিজ্ঞান কিছুই পড়ি নি। আমার সমস্ত বিদ্যা স্বাধীনচিন্তাপ্রসূত।

 হরিহর। আজ্ঞে, শপথ করবার আবশ্যক নেই— পড়াশুনো আছে এরূপ অপবাদ আপনাকে কেউ দেবে না।

১২৯২