জেবুন্নিসা বেগম/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

জেবুন্নিসা বেগমকে বিবাহ করিবার জন্য পারস্যাধিপতির পুত্ত্র শাহ্‌জাদা ফরুখের দিল্লীতে আগমন

 জেবুন্নিসা বেগমের রূপ এবং বিদ্যা ও বুদ্ধির কথা পূর্ব্বাবধি সর্ব্বত্র খ্যাত ছিল। হেন সর্ব্বগুণসমন্বিতা বাদশাহজাদীর বিবাহ হইবে—একথা পারস্য দেশ পর্য্যন্ত প্রচার হইলে সেই দেশের অধিপতির পুত্ত্র শাহজাদা “ফরুখ্‌” উক্ত বেগমকে বিবাহ করিবার উদ্দেশ্যে দিল্লীতে আগত হন। তিনি সুপুরুষ ও কাব্যরসে রসিক ছিলেন। সকলেরই একান্ত বাসনা ছিল এইরূপ এক রাজপুত্ত্রের সহিত মুগল সম্রাটের দুহিতা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন, কিন্তু নিম্নলিখিত ঘটনায় তাহা হইল না।

 ইরানের রাজপুত্ত্র শাহজাদা ফরুখ্‌ দিল্লীতে আসিয়া জেবুন্নিসা বেগমের বিবাহপ্রার্থী হইলে উক্ত বেগম শাহজাদা ফরুখ্‌কে একবার স্বচক্ষে দেখিবার অভিলাষে নিজ ভবনে আহার করিবার জন্য তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করেন। শাহজাদা ফরুখ জেবুন্নিসা বেগমের দ্বারা নিমন্ত্রিত হওয়াতে অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। তিনি উক্ত বেগমকে ধন্যবাদ প্রদান পূর্ব্বক সাদরে তাঁহার আমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া আহার করিবার জন্য যথাসময়ে জেবুন্নিসা বেগমের মহলে উপস্থিত হন এবং ভোজনের জন্য নির্দ্দিষ্ট স্থানে উপবেশন পূর্ব্বক খাদ্যসামগ্রীর প্রশংসা করিতে করিতে আহারে প্রবৃত্ত হন।

 জেবুন্নিসা বেগম চিকের অন্তরাল হইতে তাহাকে দেখিতেছিলেন। শাহজাদা ফরুখ্‌ ইহা টের পাইয়া বলিয়া উঠিলেন—

“سنبوسهُ بیسن بـدہ”
সম্বুসা-এ-বেসন বিদা
“বেসনের সম্বুসা দেও”

 এই কথা দুই প্রকার ভাব প্রকাশ করে। সরলভাবে দেখিতে গেলে বেসনের “সম্বুসা” (সিঙ্গারার মত খাদ্যদ্রব্য) দেও, এই অর্থ হয়। অক্ষর বিন্যাসের ব্যতিক্রম করিয়া অর্থ করিতে গেলে বে, সন অর্থাৎ “স” ও “ন” এই দুই অক্ষর ব্যতীত “সম্বুসা” দেও, এই ভাব ব্যক্ত করে। সম্বুসা হইতে “স” ও “ন” বাদ দিলে কেবল “বুসা” শব্দ থাকে। “বুসা” শব্দের অর্থ চুম্বন। তাহা হইলে বুঝ যায় যে শাহজাদা ফরুখ্‌ জেবুন্নিসা বেগমকে বলিতেছেন “চুম্বন দেও”।

 উক্ত বেগম সরল ভাবের অর্থ ধরিয়া না লইয়া, শেষের কুটিল অর্থই ধরিয়া লইলেন। কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির অন্তঃপুর-মহিলাকে লক্ষ্য করিয়া একজন অপরিচিত পুরুষ এপ্রকার কথা বলিয়া ধৃষ্টতা প্রকাশ করাতে জেবুন্নিসা বেগম অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন। তিনিও তৎক্ষণাৎ দ্ব্যর্থযুক্ত কথায় ঐ উক্তির নিম্নলিখিত উত্তর প্রদান পূর্ব্বক সেই স্থান হইতে চলিয়া গেলেন।

“از مطبخ مادر طلب”

অজ মতবখ্‌-এ-মা দর তলব

 এ কথার সরল অর্থ করিতে গেলে—“আমাদের রান্নাঘর হইতে চেয়ে নেও”—এইরূপ বুঝায়। “মা” ও “দর” এই দুই শব্দ একত্র করিলে “মাদর” শব্দ হয়, ইহার অর্থ মাতা। এই প্রকারে বলিলে—“(তোর) রান্নাঘরের মার নিকট হইতে চেয়ে নেও” অর্থ প্রকাশ করে। শাহজাদা ফরুখ্‌ও শেষের অর্থই গ্রহণ করিয়া লজ্জিতমনে আহার-স্থান হইতে নতশিরে চলিয়া গেলেন।

 জেবুন্নিসা বেগম পূর্ব্বেই এক প্রকার স্থির করিয়াছিলেন—তিনি আর বিবাহ করিবেন না। কেবল তাঁহার পিতার বিশেষ অনুরোধ রক্ষা না করা ধৃষ্টতা ভাবিয়া শাহজাদা ফরুখ্‌কে বিবাহ করিতে সম্মত হন। তাহাও সন্তুষ্টচিত্তে বা স্বেচ্ছায় নহে। এই ঘটনার পর তিনি উক্ত শাহজাদাকে বিবাহ করিতে কোনমতেই স্বীকার করিলেন না। তিনি বলিলেন—“যে ব্যক্তি মহিলার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কর্ত্তব্যজ্ঞানহীন, হেন ব্যক্তিকে বিবাহ করা ধিক্‌।”

 শাহজাদা ফরুখ জেবুন্নিসা বেগমকে বিবাহ করিবার জন্য বড় আশা করিয়া আসিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার বাসনায় ছাই পড়াতে তিনি ক্ষুণ্ণমনে স্বদেশে ফিরিয়া গেলেন।

 উক্ত ইরান রাজপুত্ত্র ইতিপূর্ব্বে যে একটী কবিতার মুখপাত রচনা করিয়া জেবুন্নিসা বেগমের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন তাহ নিম্নে প্রদত্ত হইল।

ترا ای مه جبین بی پرده دیدن آرزو دارم
جمالت هائی حسنت را رسیدن آرزو دارم

তর অয়্‌ মাজবীন্‌ বেপরদা দীদন্‌ আজু দারম্ জমালত্‌ হা-এ-হুসনত্‌ রা রসীদন্‌ আর্জুদারম্‌।

হে চন্দ্রাননে—তোমাকে অবগুণ্ঠন হইতে বিমুক্ত দেখিতে বাসনা পোষণ করি।
তোমার রূপ লাবণ্যের সমীপে পৌঁছিবার ইচ্ছা করি।

 এই কবিতা জেবুন্নিসা বেগমের নিকট পৌছিলে তিনি নিম্নলিখিত উত্তয় লিখিয়া পাঠান।

بلبل از گل بگدرو گرد چمن بیند مرا
بت پرستی کے کند گر برھمن بیند مرا
در سخن پنہا شدم چو بوئی گل در برگ گل
ھر که دیدن میل دارد در سخن بیند مرا

বুল্‌বুল্‌ অজ্‌ গুল্‌ বগুজর—
র্গিদ্‌ চমন্‌ বীনদ মরা।
বুত পরস্তী কে কুনিদ—
গর ব্রহমন বীনদ মরা।
দর্‌ সুখন্‌ পিনিহা শুদম্‌—
চৌ বু-এ-গুলদর্‌ বর্গ-এ-গুল,
হর কি দীদন মৈল্‌ দারদ—
দর্‌ শুখন্‌ বীনদ মরা।

আমাকে বাগানে দেখিলে বুলবুল ফুল ত্যাগ করে।
ব্রাহ্মণ যদি আমাকে দেখে তবে সে আর কেন
মূর্ত্তি পূজা করিবে।

ফুলের স্থবাস যেমন ফুলের পাপ্‌ড়ীর ভিতর
লুকাইয়া থাকে, আমিও তেমন আমার কবিতার
ভিতর লুকাইয়া আছি।

যে আমাকে দেখিতে ইচ্ছা করে সে আমার
কবিতার ভিতর আমাকে দেখিতে পাইবে।

 এইরূপ লেখালেখির পরিণাম যে পূর্ব্ববর্ণিত ঘটনায় পরিণত হইবে, বোধ করি শাহজাদা ফরুখ ইহা স্বপ্নেও ভাবেন নাই।

 উক্ত ইরান রাজপুত্ত্রের সহিত জেবুন্নিসা বেগমের পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা হইয়াও অবশেষে তাহা ভাঙ্গিয়া গেলে তাঁহার আর বিবাহ হয় নাই। সারা জীবন তিনি অবিবাহিত অবস্থায় অতিবাহিত করেন। ইহা দেখিয়া জেবুন্নিসা বেগমের নিয়তিতে বিধাতা যে বিবাহ লিখিয়া দেন নাই একথা ব্যতীত আর কি বলা যায়।