পাতা:আত্মকথা - সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রতিমা বসান হইল। অনেকক্ষণ রাখা হইল। কারণ নদীর অপরপারে অনেক স্ত্রীলোক মাকে দেখিবেন বলিয়া আসিয়াছেন । তাহারাও কঁদিতেছেন । তাহার পর প্রতিমা নদীর জলে নিমজিত হইল। আমরা বালক-দুই এক খানা ডাক খুলিয়া লইলাম। তাহার পর ঢাকী ঢুলী সঙ্গে লইয়া নীলকণ্ঠ পাখী দেখিতে যাওয়া হইল। ঢাক ঢোল কিন্তু বাজিতেছে না । প্রতি বৎসরই নীলকণ্ঠ পাখী দেখিয়া তবে বাড়ী ফেরা হয়। চিরকাল শুনা আছে যে, বিসর্জনের পর মহাদেব নীলকণ্ঠ পাখীর রূপ ধ"বু৭ করিয়া একবার দেখা দিতে আসেন। প্রতি বৎসরই বাগদীপাড়ায় একটা নয় আর একটা গাছে মীলকণ্ঠ পাখী দেখিয়াছি। দেখিতে পাওয়া গেলেই ঢাক ঢোল বাজিয়া ওঠে, আর পাখী উড়িয়া যায়। সকলে পাখীকে প্রণাম করিয়া বাড়ীতে ফিরি। বাড়ীতে ঢুকিয়া চণ্ডীমণ্ডপ শূন্য দেখিয়া বুক ফাটিয়া যায়। কিন্তু তখনই আবার আহলাদে বুক নাচিয়া উঠে। সে কিসের আহলাদ বলি শুন । বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা-বিসর্জনের পর সমস্ত বাঙ্গালার স্ত্রী পুরুষ বালক বৃদ্ধ শিশুকন্যা শিশুপুত্র ধনী নির্ধন সকলেই আপনি আপন অবস্থানুসারে আজিও নূতন বস্ত্র:দি পরিয়া থাকে। আমরাও তখন পরিতাম। কিন্তু সে জন্য তখন আমার এত আহলাদ হইত। কেন ? সমস্ত বৎসর ধরিয়া সেই আনন্দোপভোগের প্রতীক্ষায় থাকি,তাম, কেন, খুলিয়া না বলিলে তোমরা বুঝিতে পরিবে না। আমি এবং আমার দাদা দ্বারকানাথ আমাদের বাপের দুইটি মাত্র পুত্র ছিলাম । বাবা আমাদিগকে কখন ভাল কাপড় জুতা দিতেন না। আমরা সংবৎসর মোটা কাপড় পরিয়া, মোটা মার্কিন থানের পিরাণ এবং মুড়ি শেলাই চাদর গায়ে দিয়া এবং নাগরা জুতা পায় দিয়া স্কুলে বল, নিমন্ত্রণে বল, সর্ব্বত্রই যাইতাম। কেবল পূজার সময় বাবা আমাদের দুই ভাইকে এক খানি করিয়া ঢাকায় কাপড় ও চাদর, একটি করিয়া সাদা ফুলতোলা কাপড়ের জামা, একজোড়া করিয়া সাদা মোজা এবং এক জোড়া করিয়া জরির জুতা দিতেন। সেগুলি আমরা বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা-বিসর্জনের পর পরিয়া যাত্রী। রিয়া আসিয়া সদরবাটীতে শান্তিজল লইয়া সকলকে প্রণাম করিয়া বেড়াইতাম। সেই কাপড় জুতা পরিবার আনন্দের প্রত্যাশায় সংবৎসর থাকিস্তাম । তাই আজ বিসর্জন-জনিত অতি বিষাদের মধ্যেও অত আনন্দ। চক্ষু বুজিয়া যখন বিজয়া দশমীর কথা ভাবি, তখন সেই অতুলনীয় বিষাদ ও যেমন, সেই অপরিমিত আনন্দও তেমনই শরীর লাভ করিয়া আবার আমার কাছে আসে, আর তখনকারই মতন আমাকে উৎফুল্ল করিয়া দেয়। S C