পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

৶•

সেই স্রোত—মধ্যে মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রগণ উদয় হইতেছে, নিবিতেছে—আবার উঠিতেছে। আমি নিতান্ত একা-একা বলিয়া ভয় করিতে লাগিল-নিতান্ত একা-মাতৃহীন-মা! মা! করিয়া ডাকিতেছি। আমি এই কাল-সমুদ্রে মাতৃসন্ধানে আসিয়াছি। কোথা মা! কই আমার মা? কোথায় কমলাকান্ত-প্রসূতি বঙ্গভূমি। এ ঘোর কাল-সমুদ্রে কোথায় তুমি? ...চিনিলাম, এই- আমার জননী জন্মভূমি—এই মৃন্ময়ী—মৃত্তিকারূপিণী—অনন্তরত্নভূষিতা-এক্ষণে কালগর্ভে নিহিতা। রত্নমণ্ডিত দশভুজ—দশ দিক্-দশ দিকে প্রসারিত; তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত; পদতলে শত্রু বিমর্দ্দিত, পদাশ্রিত বীরজন কেশরী শত্রুনিষ্পীড়নে নিযুক্ত! এ মূর্ত্তি এখন দেখিব না-আজি দেখিব না, কাল দেখিব না— কালস্রোত পার না হইলে দেখিব না—কিন্তু এক দিন দেখিব—দিগ্‌ভুজা, নানাপ্রহরণপ্রহারিণী, শত্রুমর্দ্দিনী, বীরেন্দ্রপৃষ্ঠবিহারিণী-দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্যরূপিণী, বামে বাণী বিদ্যাবিজ্ঞানমূর্তিময়ী, সঙ্গে বলরূপী কার্ত্তিকেয়, কার্য্যসিদ্ধরূপী গণেশ, আমি সেই কালস্রোতোমধ্যে দেখিলাম এই সুবর্ণময়ী বঙ্গপ্রতিমা!

 ...তোমায় কি বলিয়া ডাকিব মা? এই ছয় কোটি মুণ্ড ঐ পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত করিব-এই ছয় কোটি কণ্ঠে ঐ নাম করিয়া হুঙ্কার করিব,—এই ছয় কোটি দেহ তোমার জন্য পতন করিব—না পারি, এই দ্বাদশ কোটি চক্ষে তোমার জন্য কাঁদিব। এসো মা, গৃহে এসো-যাঁহার ছয় কোটি সন্তান—তাঁহার ভাবনা কি?

 এস, ভাই সকল! আমরা এই অন্ধকার কালস্রোতে ঝাঁপ দিই। এস, আমরা দ্বাদশ কোটি ভুজে ঐ প্রতিমা তুলিয়া, ছয় কোটি মাথায় বহিয়া, ঘরে আনি। এস, অন্ধকারে ভয় কি?...সেই স্বর্ণপ্রতিমা মাথায় করিয়া আনি। ভয় কি? না হয় ডুবিব; মাতৃহীনের জীবনে কাজ কি?

 ‘আনন্দমঠের মূলমন্ত্র ‘বন্দে মাতরম্' সঙ্গীতের অন্তর্নিহিত তথ্য ইহাই—“মাতৃহীনের জীবনে কাজ কি?” ছয় কোটি বৃদ্ধি পাইয়া সপ্তকোটি হইয়াছে, তফাৎ এই মাত্র। আর তফাৎ, “বন্দে মাতরম্‌” আশাবাদীর সঙ্গীত।

 এই মাতৃপূজার সহিত ‘আনন্দমঠে’ অন্য যে একটি প্রবৃত্তি মাখামাখি হইয়া আছে, ১২৮১ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যা 'বঙ্গদর্শনে’র কমলাকান্তের দপ্তরের “একটি গীতে” তাহার প্রথম দর্শন পাই; ‘আনন্দমঠ’ ঠিক ইহার আট বৎসর পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। হিন্দু জাতিকে স্বাধীন দেখিবার আকাঙ্ক্ষা বঙ্কিমের মনে কখনও নির্ব্বাপিত হয় নাই; যদিচ পরিণত বুদ্ধির সহায়তায় তিনি ভাল করিয়াই বুঝিয়াছিলেন, বর্ত্তমান অবস্থায় এই স্বাধীনতা হিন্দুর লক্ষ্য নয়। তাঁহার ‘আনন্দমঠে’র শেষ দৃশ্যে বিসর্জ্জন আসিয়া প্রতিষ্ঠাকে লইয়া গিয়াছে। তথাপি স্বাধীন হইবার এই প্রবৃত্তি তিনি কখনও পরিত্যাগ করেন নাই,