পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
২৬৫

শঙ্খের শব্দ মিলিয়া আকাশ পাতাল কাঁপাইয়া কৌরবদিগের আতঙ্ক জন্মাইয়া দিল।

 তখন অর্জুন গাণ্ডীব হাতে করিয়া কৃষ্ণকে বলিলেন, “একবার দুই দলের মাঝখানে রথ লইয়া চলুন, কে কে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছে—দেখিয়া লই।”

 এ কথায় কৃষ্ণ দুই দলের মাঝখানে রথ লইয়া গেলে, অর্জুন দেখিলেন যে, খুড়া, জ্যাঠা, মামা, ভাই, পুত্র, ভ্রাতুস্পুত্র, বন্ধু, প্রভৃতি যত ভক্তি মান্য, স্নেহ এবং ভালোবাসার পাত্র, সকলেই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত;রাজ্যের জন্য সকলেই কাটাকাটি করিয়া প্রাণ দিতে আসিয়াছে। ইহা দেখিয়া দুঃখে তাহার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। তিনি কাদিতে কঁদিতে কৃষ্ণকে বলিলেন, “হায়! আমি কাহাকে মারিয়া রাজ্য লইতে আসিয়াছি! এমন রাজ্য পাইয়া ফল কি? এইরূপ ভয়ানক পাপ করার চেয়ে, শত্রুর হাতে মারা যাওয়াই তো ভালো৷”

 এই বলিয়া তিনি গাণ্ডীব ফেলিয়া কাঁদিতে লাগিলেন।

 সেদিন কৃষ্ণ সঙ্গে না থাকিলে, আর কি অর্জুনের যুদ্ধ করা হইত? তাহার মনের দুঃখ দূর করিয়া, তাহা দ্বারা যুদ্ধ করাইতে, কৃষ্ণকে অনেক পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল। তখন কৃষ্ণ তাহাকে যে সকল উপদেশ দেন, তাহাতে ‘ভগবদগীতা’ নামক অমূল্য পুস্তকই হইয়া গিয়াছে বড় হইয়া তোমরা তাহা পড়িবে। যাহা হউক, কৃষ্ণের উপদেশে অর্জনের মন শান্ত হওয়াতে, আবার তাহার যুদ্ধের উৎসাহ আসিল।

 এমন সময় মহারাজ যুধিষ্ঠির, বর্ম আর অস্ত্র পরিত্যাগপূর্বক রথ হইতে নামিয়া কিসের জন্য ভীষ্মের রথের দিকে হাঁটিয়া চলিয়াছে। তাহাকে ঐরূপ করিতে দেখিয়া কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীম, নকুল, সহদেব আর অন্যান্য বীরেরাও তাহার সঙ্গে চলিয়াছেন; কিন্তু ইহাদের কেহই যুধিষ্ঠিরের কার্যের অর্থ বুঝিতে পারিতেছেন না। ভীম, অর্জুন, নকুল আর সহদেব বলিলেন, “দাদা! যুদ্ধ আরম্ভ হয় হয়, এমন সময় আপনি আমাদিগকে ফেলিয়া কোথায় চলিয়াছেন?”

 যুধিষ্ঠির তাহাদের দিকে ফিরিয়া চাহিলেন, কিন্তু কথা বলিলেন না। তখন কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া, তাহাদিগকে বলিলেন, “উনি যুদ্ধাবম্ভের পূর্বে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, শল্য প্রভৃতি গুরুজনকে প্রণাম করিতে চলিয়াছে, ইহাতে উহার জয়লাভ হইবে।”

 এদিকে কৌরবপক্ষের লোকেরাও যুধিষ্ঠিরকে ঐরূপ করিতে দেখিয়া, নানা কথা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে। কেহ বলিল, ‘কাপুরুষ! ভয় পাইয়াছে!’ কেহ বলিল, ‘তাই ভীষ্মের পায়ে ধরিতে চলিয়াছে৷’ কেহ বলিল, ‘এমন ভাই থাকিতে এত ভয়, ছিঃ!’

 যাহা হউক, যুধিষ্ঠির ততক্ষণে ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হইয়া, তাহার পায়ে ধরিয়া বলিলেন, “দাদামহাশয়! আপনার সহিত যুদ্ধ করিব, অনুমতি দিন আর আশীর্বাদ করুন৷”

 ভীষ্ম বলিলেন, “আশীর্বাদ করি ভাই, তোমার জয় হউক! তুমি না আসিলে হয়তো আমার রাগ থাকিত, কিন্তু তুমি আসাতে বড়ই সুখী হইলাম। বল, তোমার আর কি চাই। ভাই, মানুষ টাকার দাস। দুর্যোধনের টাকায় আমি আটকা পড়িয়াছি, কাজেই তোমার হইয়া যুদ্ধ করিতে পারিব না। আর যাহা চাও তাহাই দিব৷”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “আপনাকে কি করিয়া পরাজয় করিব, দয়া করিয়া তাহা বলিয়া দিন৷”

 ভীষ্ম বলিলেন, “আমাকে পরাজয় করার সাধ্য কাহারো নাই, আর এখন আমার মরিবার সময়ও উপস্থিত হয় নাই। তুমি আবার আমার নিকট আসিও৷”

উপেন্দ্র —৩৪