পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
২৮১

থাকিয়া যুদ্ধ কর। আমাকে ছাড়িয়া যাইও না।”

 অর্জুন বলিলেন, “আমি বাঁচিয়া থাকিতে আপনার কোনো ভয় নাই। দেবতার সাহায্য পাইলেও কৌরবেরা আপনাকে ধরিয়া নিতে পারিবে না।”

 তারপর আবার যুদ্ধ আরম্ভ হইল, এবং প্রথম হইতেই দ্রোণের তেজে পাণ্ডবেরা নিতান্ত অস্থির হইয়া উঠিলেন। সৈন্য যে কত মরিল তাহার সীমা সংখ্যা নাই। ইহাতে যুধিষ্ঠির প্রভৃতি বীরগণ দ্রোণকে আক্রমণ করায়, যুদ্ধ ক্রমেই ঘোরতর হইয়া উঠিল।

 অভিমন্যুকে আক্রমণ করিতে গিয়া হার্দিক্য বড়ই জব্দ হইলেন। প্রথমে ধনুর্বাণ লইয়া তিনি মন্দ যুদ্ধ করেন নাই; এমনকি, তিনি অভিমন্যুর ধনুক অবাধ কাটিয়া ফেলেন। তখন অভিমন্যু খড়্গ চর্ম হাতে তাঁহার রথে উঠিয়া এক হাতে তাঁহার কেশাকর্ষণ, এক লাথিতে সারথিকে সংহার এবং খড়্গাঘাতে রথের ধবজাটি নাশ করিলেন। তারপর হার্দিকের চুল ধরিয়া তাঁহাকে ঘুরাইতে ঘুরাইতে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন।

 হার্দিক্যের পরে জয়দ্রথ আসিয়াও কম নাকাল হয় নাই। তারপর শল্য আসিতেই অভিমন্যুর হাতে তাঁহার সারথিটি মারা গেল। তাহাতে শল্য ক্রোধভরে গদাহাতে অভিমন্যুকে মারিতে আসিলে, অভিমন্যুও বজ্র হেন মহাগদা উঠাইয়া বলিলেন, “আইস৷” এমন সময় ভীম আসিয়া তাহাকে থামাইয়া শল্যের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন।

 সে অতি আশ্চর্য যুদ্ধ হইয়াছিল। গদায় গদায় ঠোকাঠুকিতে এমনি আগুনের ফিন্‌কি ছুটিয়াছিল যে, কামারের দোকানেও তেমন হয় না। শেষে দুজনের গদার বাড়িতে দুজনেই ঠিকরাইয়া পড়িলেন। ভীম তখনই আবার উঠিয়া দাঁড়াইলেন, কিন্তু শল্যের জ্ঞান না থাকায় তাহার আর উঠা হইল না।

 তারপর ভীম, কর্ণ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি প্রভৃতির ঘোর যুদ্ধ চলিল। এই সময়ে কৌরব সেনাগণ ক্ষত-বিক্ষত শরীরে পলায়ন করিতেছিল, দ্রোণ তাহাদিগকে ডাকিয়া বলিলেন, “ভয় নাই!” বলিয়াই তিনি যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ কবিতে চলিলেন। সে সময়ে শিখণ্ডী, উত্তমৌজা, নকুল, সহদেব প্রভৃতির কেহই তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইতে পারিলেন না।

 ইঁহাদিগকে পরাজয় করিয়া তিনি যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করিবামাত্র বিরাট, দ্রুপদ, কৈকেয়গণ, সাত্যকি, শিবি, ব্যাঘ্রদত্ত, সিংহসেন প্রভৃতি ছুটিয়া আসিয়া তাঁহার পথ আটকাইলেন। কিন্তু তাঁহাদের বাণে দ্রোণের কি হইবে? তিনি দেখিতে দেখিতে ব্যাঘ্রদত্ত আর সিংহসেনের মাথা কাটিয়া একেবারে যুধিষ্ঠিরের রথের কাছে গিয়া উপস্থিত হইলেন। পাণ্ডব সৈন্যেরা তখন “মহারাজকে মারিল!” বলিয়া চ্যাঁচাইতে লাগিল, আর কৌরব সৈন্যেরা “এই ধরিয়া আনিল!” বলিয়া আকাশ ফাটাইল।

 এমন সময় অর্জুন শত্রু সৈন্য কাটিতে কাটিতে আসিয়া সেখানে দেখা দিলেন। তারপর আর কি কেহ ধনুক ধরিতে পাইল? সকলে ভয়েই অস্থির, যুদ্ধ করিবে কে? অর্জুনের ভীষণ বাণবৃষ্টিতে চারিদিক আঁধার হইয়া গেল। তখন আর এতটুকুও বুঝিবার সাধ্য রহিল না যে, ‘এই পৃথিবী, ঐ আকাশ৷’

 আর তখন সন্ধ্যাও হইতেছিল। কাজেই দ্রোণ তখনি যুদ্ধ থামাইয়া দিলেন। সেদিন আর তাহার যুধিষ্ঠিরকে ধরা হইল না।

 দ্রোণের পক্ষে ইহা লজ্জার কথা বটে; আর অর্জুন থাকিতে এ লজ্জা দূর হওয়াও দুর্ঘট৷

উপেন্দ্র—৩৬