পাতা:কবিকঙ্কণ চণ্ডী (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Str কবিকঙ্কণ-চণ্ডী জীর্ণ শীর্ণ আবরণের মধ্যে গা ঢাকা দিয়া লজ্জা নিবারণ করিতেছে । কবিকঙ্কণ শাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন, সংস্কৃতের বিপুল শব্দসম্পদ তাহার করায়ন্ধ ছিল, কিন্তু তঁহার প্রাণে গ্ৰাম্যকথার মিষ্টত্বই কবিত্বশক্তি জাগরিত করিয়া দিয়াছিল। বঙ্গভাষার সেই সরল সোহাগমাখা মধুরাক্ষরা প্ৰকৃতি ছাড়িয়া তিনি সমাসবদ্ধ শব্দের ঝঙ্কারের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখান নাই। কিন্তু নবযুগের প্রভাবের পরিচয় তাহার পত্রে পত্রে বিদ্যমান,--যদিওপ্রাচীন বাক-শিল্পই তিনি স্বীয় কাব্যের অস্থিমজ্জার ন্যায় ব্যবহার করিয়াছেন। “ইন্দুকুন্দ জিনি ভাতি” এই সংস্কৃত পদের নমুনা দিয়া পরীক্ষণেই “দুই, বাহু লোহার সাবল” প্রভৃতি গ্ৰাম্য উপমার আশ্ৰয় লইয়াছেন। ফুল্লারার বারমাসী গ্ৰাম্য নারীর মৰ্ম্মবেদনা গ্ৰাম্যভাষায় বহিয়া আনিয়াছে। “ভেরাণ্ডার থাম”-যুক্ত—“তালপাতের ছাউনি” ঘর বৈশাখী ঝড়ে ভাঙ্গিয়া । পড়ে,- মৃৎ-ভাণ্ডের অভাবে “গৰ্ভ” পূর্ণ করিয়া “আমানি” সঞ্চিত হয় ; মাথায় মাংসের পশরা লইয়া বাজারে যাইবার সময় “দেখিতে দেখিতে চিলে করে আধসারি’ এবং দুরবস্থার চরম সীমায় পল্লীবাসিনী দরিদ্রা নারী “কত শত খায় জোক নাহি খায় ফণী” বলিয়া বিলাপ করিতে বসেন, শীতকালে “পুরাণা দোপাটা গায় দিতে টানাটানি”-এবং যখন আশ্বিন মাসে বঙ্গের নরনারী নানা নূতন রঙ্গিন বস্ত্র পরিহিত হইয়া পল্লীর পথঘাট উজ্জ্বল করিয়া চলে, তখন “অভাগী ফুল্লারী পরে হরিণের ছড়ি ।” ভাষা গ্রাম্য-কিন্তু পল্লীবাসিনীর দুরবস্থার এই মন্মস্থািদ বর্ণনা-এরূপ বুক্সব ছবি এত অল্প কথায় আর কোন কবি কি দিতে পারিয়াছেন ? কিন্তু সংস্কৃতযুগ সম্মুখে,--তাহার প্রভা তাহার কাব্যে মাঝে মাঝে প্রতিবিম্বিত হইয়াছে। পল্লীকবির পর্ণকুটিরের জীৰ্ণ বেড়ার ফঁাক দিয়া নবেদিত সংস্কৃত ভাষার সৌরকর তখন দেখা যাইতেছিল, মুকুন্দ কবি যুগ-প্রভাব রোধ করবেন। কিরূপে ? এই গ্রাম বারম্যাসীর মাঝে মাঝে “জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্ৰাণ”। প্রভূতি কথায় আমরা একটা নব জগতে প্ৰবেশলাভ করি। ষেন পর্ণকুটির ডিঙ্গাইয় কেহ এমারতের সদর দরজায় আসিয়া পড়িল, এইরূপ বোধ ভয় । তখন মনে হয়। প্ৰাচীন বাঙ্গলা ভাষা তাহার বন্ধল বাস পরিয়াও নব যুগের দুই এক খানা জহরতের দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতেছেন ।