পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮০৮
গল্পগুচ্ছ

স্থির হয়ে গিয়েছিল, কেবল অপেক্ষা ছিল বিলেত গিয়ে সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হয়ে আসার। তার পাথেয় আর খরচ জুগিয়েছেন অধ্যাপক। লোকটার সর্দির ধাত ছিল। বধির ভগবানের কাছে আমরা দুবেলা প্রার্থনা করেছি, বিবাহের পূর্বে লোকটা যেন ন্যুমোনিয়া হয়ে মরে। কিন্তু মরে নি। পাস করেছে। করেই ইন্‌ডিয়া গবর্মেণ্টের উচ্চপদস্থ একজন মুরুব্বির মেয়েকে বিয়ে করেছে। লজ্জায় ক্ষোভে নিজের কাজ ছেড়ে দিয়ে মর্মাহত মেয়েটিকে নিয়ে অধ্যাপক কোথায় যে অন্তর্ধান করেছেন, তার খবর রেখে যান নি।’

 চিঠিখানা পড়লুম। দৃঢ় সংকল্প করলুম, এই মেয়েটিকে তার লজ্জা থেকে, অবসাদ থেকে উদ্ধার করব।


ইতিমধ্যে অচিরার সঙ্গে কোনো রকম করে একটা কথা আরম্ভ করবার জন্যে মন ছট্‌ফট্ করতে লাগল। যদি বিজ্ঞানী না হয়ে হতুম সাহিত্যরসিক, কিম্বা বাঙাল না হয়ে যদি হতুম পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক, তা হলে নিশ্চয় মুখে কথা বাধত না। কিন্তু বাঙালি মেয়েকে ভয় করি, চিনি নে ব’লে বোধ হয়। একটা ধারণা ছিল, হিন্দু নারী অজানা পরপুরুষমাত্রের কাছে একান্তই অনধিগম্য। খামকা কথা কইতে যাই যদি, তা হলে ওর রক্তে লাগবে অশুচিতা। সংস্কার জিনিসটা এমনি অন্ধ। এখানে কাজে যোগ দেবার পূর্বে কিছুদিন তো কলকাতার কাটিয়ে এসেছি— আত্মীয়বন্ধুমহলে দেখে এলাম সিনেমামঞ্চপথবর্তিনী রঙমাখানো বাঙালি মেয়ে, যারা জাতবান্ধবী, তাদের—থাক্, তাদের কথা। কিন্তু অচিরার কোনো পরিচয় না পেয়েই মনে হল ও আর-এক জাতের—এ কালের বাইরে আছে দাঁড়িয়ে নির্মল আত্মমর্যাদার, স্পর্শভীরু মেয়ে। মনে-মনে কেবলই ভাবছি প্রথম একটি কথা শুরু করব কী করে।

 এই সময়ে কাছাকাছি দুই-একটা ডাকাতি হয়ে গিয়েছিল। মনে হল এই উপলক্ষে অচিরাকে বলি, ‘রাজাকে বলে আপনার জন্যে পাহারার বন্দোবস্ত করে দিই।’ ইংরেজ মেয়ে হলে হয়তো এই গায়েপড়া আনকুল্যকে স্পর্ধা মনে করত, মাথা বাঁকিয়ে বলত ‘সে ভাবনা আমার’। কিন্তু এই বাঙালির মেয়ে যে কী ভাবে কথাটা নেবে, আমার সে অভিজ্ঞতা নেই। দীর্ঘকাল বাংলার বাইরে থেকে আমার মনের অভ্যাস অনেকখানি জড়িয়ে গেছে বিলিতি সংস্কারে।

 দিনের আলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এইবার অচিরার ঘরে ফেরবার সময়, কিম্বা ওর দাদামশার এসে ওকে বেড়াতে নিয়ে যাবেন। এমন সময়ে একজন হিন্দুস্থানী গোঁয়ার এসে অচিরার হাত থেকে হঠাৎ তার ব্যাগ আর ডায়ারিটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। আমি সেই মুহূর্তেই বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললাম, “কোনো ভয় নেই আপনার।”

 এই বলে ছুটে সেই লোকটার ঘাড়ের উপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেই সে ব্যাগ আর খাতা ফেলে দৌড় মারলে। আমি লুঠের ধন নিয়ে এসে অচিরাকে দিলাম।

 অচিরা বললে, “ভাগ্যিস আপনি—”

 আমি বললুম, “আমার কথা বলবেন না, ভাগ্যিস ও লোকটা এসেছিল।”

 “তার মানে?”