পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

মুখ হইতে অতি সহজেই গ্রহণ করিয়াছে, এ লইয়া বিরুদ্ধ লোকদের সঙ্গে সে তীক্ষভাবে তর্ক করিয়াছে; বলিয়াছে, শত্রু যখন কেল্লাকে চারি দিকে আক্রমণ করিয়াছে তখন এই কেল্লার প্রত্যেক পথ-গলি, দরজা-জানলা, প্রত্যেক ছিদ্রটি বন্ধ করিয়া প্রাণ দিয়া যদি রক্ষা করিতে থাকি তবে তাহাকে উদারতার অভাব বলে না।

 কিন্তু আজ ওই-যে আনন্দময়ীর ঘরে গোরা তাহার খাওয়া নিষেধ করিয়া দিল, ইহার আঘাত ভিতরে ভিতরে তাহাকে কেবলই বেদনা দিতে লাগিল।

 বিনয়ের বাপ ছিল না, মাকেও সে অল্পবয়সে হারাইয়াছে; খুড়া থাকেন দেশে, এবং ছেলেবেলা হইতেই পড়াশুনা লইয়া বিনয় কলিকাতার বাসায় একলা মানুষ হইয়াছে। গোরার সঙ্গে বন্ধুত্বসূত্রে বিনয় যেদিন হইতে আনন্দময়ীকে জানিয়াছে সেই দিন হইতে তাঁহাকে মা বলিয়াই জানিয়াছে। কতদিন তাঁহার ঘরে গিয়া সে কাড়াকাড়ি করিয়া উৎপাত করিয়া খাইয়াছে; আহার্যের অংশবিভাগ লইয়া আনন্দময়ী গোরার প্রতি পক্ষপাত করিয়া থাকেন, এই অপবাদ দিয়া কতদিন সে তাঁহার প্রতি কৃত্রিম ঈর্ষা প্রকাশ করিয়াছে। দুই-চারি দিন বিনয় কাছে না আসিলেই আনন্দময়ী যে কতটা উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিতেন, বিনয়কে কাছে বসাইয়া খাওয়াইবেন এই প্রত্যাশায় কতদিন তিনি তাহাদের সভাভঙ্গের জন্য উৎসুকচিত্তে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিতেন, তাহা বিনয় সমস্তই জানিত। সেই বিনয় আজ সামাজিক ঘৃণায় আনন্দময়ীর ঘরে গিয়া খাইবে না, ইহা কি আনন্দময়ী সহিতে পারেন, না বিনয় সহিবে?

 ‘ইহার পর হইতে ভালো বামুনের হাতে মা আমাকে খাওয়াইবেন, নিজের হাতে আর কখনো খাওয়াইবেন না— এ কথা মা হাসিমুখ করিয়া বলিলেন, কিন্তু এ যে মর্মান্তিক কথা। এই কথাটাই বিনয় বার বার মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে করিতে বাসায় আসিয়া পেীছিল।

 শূন্য ঘর অন্ধকার হইয়া আছে। চারি দিকে কাগজপত্র বই এলোমেলো

২৮