পাতা:ছিন্নমুকুল - স্বর্ণকুমারী দেবী.pdf/১২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২০
ছিন্নমুকুল

না ভর্ৎসিত হইয়াছে, কিন্তু তবুও সেজন্য কনকের তেমন মর্ম্মান্তিক দুঃখ হইত না। কনক প্রমোদকে এত দূর ভালবাসে যে, পিতা মাতা তাহাকে অনাদর করিয়া প্রমোদকে আদর করিলে তাহার সেই কষ্টের মধ্যেও একটি সুখ হইত। প্রমোদের নিকট উপেক্ষিত হইলেই কেবল তাহার দুঃখের সীমা থাকিত না। সূশীলার স্নেহে প্রমোদের ভালবাসার অভাবও সে ভুলিয়া গিয়াছিল, সুশীলার ভালবাসাই তাহাকে যেন বাঁচাইয়া রাখিয়াছিল। আজ কনক সেই স্নেহময়ী মাতাকে হারাইল, আজ সে যেন তাহার সর্ব্বস্ব হারাইল, এখন তাহার কি দশা হইবে? বালিকা কনক সেই মৃত্যুশয্যায় মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল।

 * * * * *

 তখন সন্ধ্যাকাল অতীত হইয়াছে; সুশীলা গঙ্গাতীরে চিতাশয্যায় শয়ান। মৃত্যুশয্যায় আজ তাঁহার সধবাবেশ,—পরিধানে লাল পট্টবস্ত্র, মস্তকে সিন্দূর, গলায় ফুলের মালা, হাতে লাল রুলি ও চরণ দুইখানি অলক্তকে রঞ্জিত। চতুঃপার্শ্বে, দাসদাসীগণ ক্রন্দন করিতেছে, ব্রাহ্মণ ও প্রতিবেশগণ হরিনাম কীর্ত্তন করিতেছে, স্বামী দয়ানন্দ শোকস্তব্ধ গম্ভীর মূর্ত্তিতে সম্মুখে দাঁড়াইয়া পত্নীর মৃত্যুপ্রশান্ত রমণীয় মূর্ত্তি নিরীক্ষণ করিতে করিতে মনে মনে শতাপরাধের ক্ষমা ভিক্ষা করিতেছেন।

 একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত একখানি প্রজ্জ্বলিত কাষ্ঠখণ্ড আনিয়া মন্ত্রোচ্চারণ পূর্ব্বক তাঁহার হস্তে প্রদান করিল—তিনি পূর্ব্ববৎ স্তব্ধ গম্ভীর ভাবেই তাহা গ্রহণ করিয়া মন্ত্রোচ্চারণ পূর্ব্বক মৃতপত্নীর মুখাগ্নি করিলেন। অচেতন ওষ্ঠাধরও যেন সহসা চেতনহাস্যে বিকম্পিত হইয়া উঠিল, অন্তিম শয্যা যেন ফুলশয্যার স্মৃতি মণ্ডিত হইয়া উঠিল, দয়ানন্দ পত্নীর শান্ত প্রফুল্ল মুখে পরিপূর্ণ মার্জ্জনা অনুভব করিলেন।

 মুখাগ্নির পর ঘৃত সংযোগে চিতাকাষ্ঠ যখন ধুধু করিয়া জ্বলিয়া উঠিল,