পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হইতে মুক্ত হন। এই সকল কামনা করিয়া আমি পতির জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করিতেছি।”

 এইরূপে পুরোহিত কঙ্কাবতীকে সঙ্কল্প করাইলেন। তাহার পর সূর্য্যার্ঘ্য দিয়া দিকপালগণকে সাক্ষী করিলেন। সে মন্ত্রের অর্থ এই—

 “অষ্ট-লোকপাল, আদিত্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, ভূমি, জল, হৃদয়স্থিত অন্তর্য্যামী পুরুষ, যম, দিন, রাত্রি, সন্ধ্যা, ধর্ম্ম, তোমরা সকলে সাক্ষী থাক, আমি জ্বলন্ত চিন্তারোহণ করিয়া স্বামীর অনুগমন করিতেছি।”

 লোকপালদিগকে সাক্ষী মানা হইলে, কঙ্কাবতী আঁচলে খই, খণ্ডের পরিবর্ত্তে বাতাসা ও কড়ি লইয়া, সাতবার চিতাকে প্রদক্ষিণ করিতে লাগিলেন, আর সেই খই-কড়ি ছড়াইতে লাগিলেন। বালক-বালিকাগণ হুড়াহুড়ি করিয়া খই-কড়ি কুড়াইতে লাগিল। কেন না, এই খই বিছানায় রাখিলে ছারপোকা হয় না।

 উপস্থিত রমণীদিগের মধ্যে একজন সতীর নিকট হইতে তাঁহার কপালের একটু সিন্দুর চাহিয়া লইলেন। সেই রমণীর পুত্রবধু নিতান্ত শিশু, এখনও পতিভক্তি তাহার মনে উদয় হয় নাই। তাহার কপালে এই সিন্দুর পরাইয়া দিলে সে অবিলম্বে পতিপরায়ণা হইবে।

 চিতা প্রদক্ষিণ করা হইলে, পুরোহিত কঙ্কাবতীকে ঋঙ্ঘত্র পড়াইলেন। শেষে কঙ্কাবতী রক্তবতীর নিকট হইতে নক্ষত্রের মালা দুইছড়া চাহিয়া লইলেন। চিতার উপর আরোহণ করিয়া একছড়া মালা খেতুর গলায় দিলেন, একছড়া মালা আপনি পরিলেন। তাহার পর, চিতার উপর স্বামীর বামপার্শ্বে শয়ন করিলেন।

 গাছের কাঁচা ছাল দিয়া, সকলে তাঁহাকে সেই চিতার সহিত বাঁধিয়া দিলেন। তাহার পর চিতার চারিদিকে সকলে আগুন দিয়া দিলেন। আগুন দিয়া, বড় বড় কঞ্চির বোঝা, বড় বড় শরের বোঝা, বড় বড় পাটকাটির বোঝা, চারিদিক হইতে সকলে ঝুপঝাপ করিয়া চিতার উপর ফেলিতে লাগিলেন! বাদ্যকরদিগের ঢাক-ঢালের কোলাহলে সকলের কর্ণে তালি লাগিল। চিতা ধূ-ধূ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। আকাশ প্রমাণ হইয়া অগ্নিশিখা উঠিল।

 কঙ্কাবতী অঘোর নিদ্রায় অভিভূত হইলেন! অতি সুখনিদ্রা! অতি শান্তিদায়িনী নিদ্রা!!


পরিশেষ

অতি সুখনিদ্রা! অতি শান্তিদায়িনী নিদ্রা।

 বৈদ্য বলিলেন,— “এই যে নিদ্রাটি দেখিতেছেন, ইহা সুনিদ্রা। বিকারের ঘোর নহে। বিকার কাটিয়া গিয়াছে। নাড়ী পরিষ্কার হইয়াছে। এক্ষণে বাড়ীতে যেন শব্দ হয় না! নিদ্রাটি যেন ভঙ্গ হয় না!”

 বৈদ্য প্রস্থান করিলেন। অঘোর অচৈতন্য হইয়া রোগী নিদ্রা যাইতে লাগিলেন। বাড়ীতে সকলেই চুপি চুপি কথা কহিতে লাগিলেন। বাড়ীতে পিপীলিকার পদশব্দটি পর্যন্ত নাই।

 মাতা কাছে বসিয়া রহিলেন। এক একবার কেবল কন্যার নাসিকার নিকট হাত রাখিয়া দেখিতে লাগিলেন, রীতিমত নিশ্বাস-প্রশ্বাস বহিতেছে কি না?

 আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া, মা আজ বাইশ দিন কন্যার নিকট এইরূপে বসিয়া আছেন।

১২৬
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ